শুকতারা পর্ব-২৭

0
896

#শুকতারা (পর্ব-২৭)
#হালিমা রহমান

দুপুরে খাবার শেষের কাজগুলো শেষ করতে করতে বেশ বেলা হয়ে গেল আজ। রান্না শেষ করে ঘরের বাথরুমগুলো ধুয়েছে সূচি।তাছাড়া ঘরের মাসিক কিছু ধোয়া- মোছা ছিল।কালচে-সাদা রঙা দেওয়ালে মাকড়সারা জাল বুনেছে।জানালায় ময়লা জমেছে।ঘরের চাদর,জানালার হালকা নীল রঙা পর্দাগুলোতে জমেছে ময়লা।তাছাড়া, ফ্যানগুলো তো আছেই।সব রুমে সাদা রঙা ফ্যান। একটু ময়লা হলেই এগুলোকে বিশ্রী দেখায়।না ঝেড়ে-মুছে শান্তি পাওয়া যায় না।কিন্তু আজকেই এতো কাজ করার ইচ্ছা ছিল না।রোমেলা বানুর পীড়াপীড়িতে করতে হলো।মাসের শুরুর সপ্তাহেই ঝাড়া-মোছার কাজটা শেষ করতে হবে।এ একেবারে বাঁধাধরা নিয়ম।কিন্তু রজঃস্বলা অবস্থায় কোনো কাজ করতেই ভালো লাগে না সূচির।তলপেটের শিরশিরানি পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। হাত-পা ভেঙে আসে।একটু কাজ করলেই হাঁপিয়ে যায়।মাঝে মাঝে হাত চালিয়ে খেতেও ভালো লাগে না।মনে হয় ভাতের লোকমা মুখে তুলে দেওয়াও মস্ত একটা পরিশ্রমের কাজ।ভেবেছিলো একটু সুস্থ হলেই একে একে সব করবে।কিন্তু তার উপায় কোথায়? ওই মানুষটার কানে কোনো কথা ঢুকে না।তার কথা যেন গাছ থেকে পড়া ফল।পড়েছে তো পড়েছেই।এ আর উঠবে না।করতেই হবে।শ্বাশুড়ির বকা-ঝকাও সহ্য হয় না সূচির।চামড়া শক্ত করে শুনে থাকতে পারলেও চলতো।কিন্তু ওটাই পারে না সে। শরীরের চামড়াগুলো এখনো গন্ডারের মতো মোটা হয়নি বোধহয়। তাই তো সহ্য হয় না।
একগাদা কাজের শেষে গোসল,খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা।খাবারের শেষে আবার হাড়ি-পাতিল ধোয়া-মোছা।এ আরেক বিড়ম্বনা। ঝামেলার অন্ত নেই।কোনো কাজ পরের জন্য ফেলে রাখার জো নেই। চোখে পড়লেই শুরু হয়ে যাবে ঝামেলা।নিরবিচ্ছিন্ন পুঁথি পাঠ। ” হাড়-গোড় জ্বালিয়ে খেলো একদম”– আপনমনেই বিরবির করে হাঁড়িগুলো রান্নাঘরের তাকে আছড়ে ফেললো। প্রতিদিনের মতো সাবধানে,নিঃশব্দে রাখলো না।রাখার সময় বিরক্তিকর একটা শব্দ হলো।কানে বাজে শব্দটা।

” হ, ভাইঙ্গা ফালাও সব।জাত অলক্ষ্মী।”ও-ঘর থেকে রোমেলা বানুর কঠিন কন্ঠ ভেসে এলো।

সূচি চোখ-মুখ কুঁচকে অসারের মতো দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।ভেবেছিলো শ্বাশুড়ি ঘুমিয়ে গেছে।সুতরাং এটুকু শব্দ কানে যাবে না।নির্জীব অ্যালুমিনিয়ামের উপর একটু জোর খাটালে কী ক্ষতি?
কিন্তু কে জানতো তিনি জেগে আছেন? তার কাছে সবকিছুই ক্ষমার অযোগ্য। হাহ! এঘরে একটু বিরক্ত প্রকাশ করারও উপায় নেই।
এক আকাশ বিরক্তি দমন করে রান্নাঘরের বাইরের দরজাটা আঁটকে দিলো সূচি।এটা খোলা থাকলে বাহির থেকে কুকুর -বিড়াল এসে খাবারে মুখ দেয়।দরজা আঁটকে, মিটসেফের ভিতর খাবারগুলো হেফাজত করে নিজের রুমে পা বাড়ালো।কত বেলা বাকি? একটু ঘুমানো যাবে?

আসরের আযানের খুব বেশি সময় বাকি নেই। বড়জোর আধঘন্টা।সেই ফজরের আগ থেকে এ অবধি একটানা খাটুনি।এতো পরিশ্রমের পর বিছানায় পিঠ দিয়ে উঠতে উঠতেই আধঘন্টা কেটে যাবে। শুয়ে লাভ নেই।তবুও একটু স্বস্তি পেলো মেয়েটা। এই আকালে আধঘন্টাই অনেক সময়।চোখের পাতা দুটো বন্ধ করার সুযোগ তো মিলবে।এই তো অনেক।
ভেজা চুলে গামছা প্যাঁচানো ছিল।রুমের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে একটানে গামছাটা খুলে ফেললো সূচি।খাটেই ফয়সাল শোয়া।ঘুমাচ্ছে বোধহয়।কপালের উপর ডানহাতটা ফেলে রাখা।
কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলোকে রুক্ষভাবে ঝাড়লো।ব্যস্ত হাতে মুছতে মুছতে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো।হুমায়রা বারান্দায় বসে কাঁথা সেলাই করছে একমনে।কাঁচা হলুদের মাঝে কালো খয়েরী সুতোর নকশীকাঁথা।এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।চুল ঝাড়া শেষে জানালার সাথে গামছাটা মেলে দিলো সূচি।ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর কন্ঠ।

” বউ,ঘুমাইছো?”

বিরক্তিতে তেতো হয়ে উঠলো সূচির মুখ।এই সম্বোধন চেনা।এর আগেও শুনেছে।নিশ্চয়ই এখন হাত-পা টিপে দিতে বলবে।বসে বসে কাজ করার শক্তি-সামর্থ্য বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই এখন।তাই ইচ্ছা করেই চুপ মেরে রইলো।সেকেন্ড পাঁচেক অপেক্ষা করার পর আবারো ডাক এলো।দরজার কড়া নাড়লেন রোমেলা বানু।আগেরবারের চেয়ে গলা চড়িয়ে ডাকলেনঃ” কি গো বউ, মরছো?”

চট করে চোখ মেললো ফয়সাল।জেগেই ছিল তারমানে।বউয়ের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বললোঃ” আম্মা ডাকছে।”

” এই তো যাচ্ছি।”

বিরস মুখে দরজা খুললো সূচি। যা ভেবেছিল তা না।ওপাশে রোমেলা বানু দাঁড়িয়ে আছেন বোরকায় শরীর জড়িয়ে।নেকাবের বাইরে শুধু গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখদুটো দেখা যায়।সূচিকে দেখে বললেনঃ” কতক্ষণ ধইরা ডাকতাছি?”

” একটু চোখটা লেগে এসেছিলো আম্মা।আপনি কোথাও যাচ্ছেন?”

” হ।টুটুলের আম্মায় যাইতে কইছে একটু।আসতে দেরি হইব আমার। তুমি আসো দরজাটা লাগায়া দেও।”

শ্বাশুড়ির সাথে হেঁটে দরজা অবধি এলো সূচি।আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলোঃ” মাগরিবের পর হবে আসতে?”

” না।মাগরিবের আগেই আসুম।ঘুমায়ো না তুমি।বউ মানুষগো যখন-তখন ঘুমাইতে হয় না।তোমার তো বদঅভ্যাস।সময় পাইলেই ঘুমাও।আসরের আজান দিব।পরে দেখা যাইব মরার মতো ঘুমায়া থাকবা।হাঁস-মুরগীগুলা কষ্ট করব বাইরে বাইরে।”

বসার ঘর পেরিয়ে উঠোনে পা রেখে আরেকবার সতর্ক করে দিলেন রোমেলা বানু।আঙুল উঁচিয়ে বললেনঃ” খবরদার, কোনো কাজ যেন বাকি না থাকে।”

” থাকবে না।”

রোমেলা বানু বেরিয়ে যাওয়ার পর মুখ খুললো হুমায়রা।নিজের ঘরের বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে সূচিকে প্রশ্ন করলোঃ” কই যায়?”

” টুটুল ভাইদের বাড়িতে।”

টুটুলরা প্রতিবেশী।চিনলো হুমায়রা।

” বউ মানুষদের যখন-তখন ঘুমাতে নেই।শ্বাশুড়ি আম্মা লেকচার দিয়ে গেল।আমি নাকি যখন-তখন ঘুমাই!”— মলিন হাসলো সূচি।বড় ভাবির কাছে অভিযোগ করল যেন।

” কী আর করবা? কপালে আছে এগুলা।”

” সেটাই।”

” চিন্তা কইরো না।আল্লাহ দিন ফিরাইব।আমার দাদি কইতো মানুষ বারো বছর সুখ পায়,বারো বছর দুঃখ পায়।তোমার মনে হয় দুঃখের বারো বছর চলতাছে।এইগুলা কাটলেই সুখের বছর আইব।”

” বারো বছর! তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ভাবো কী হবে? বারো বছরে বারোটা হাড়ও খুঁজে পাবে না তোমরা।”

দরজা আঁটকে, বসার ঘরের লাইট জ্বেলে নিজেদের রুমে এল সূচি।বিছানার দিকে চোখ পড়তেই মনটা ভালো হয়ে গেল।রোমেলা বানু বাড়ি নেই।তারমানে অনেক্ষন নির্বিঘ্নে ঘুমানো যাবে।ফয়সাল উঠে গেছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে।কিছুক্ষণের মাঝেই বেরিয়ে যাবে হয়তো।ফাঁকা ঘরে আজ অনেক্ষণ ঘুমাবে সূচি।অনেক রাতের অর্ধেক অর্ধেক ঘুম পুষিয়ে নেবে।নরম বিছানায় কোলবালিশ জড়িয়ে শান্তির ঘুম।আহ! সূচি কতদিন ঘুমায় না।ফয়সাল কখন বেরিয়ে যাবে? আর কত দেরি? তর সয় না।শারীরিক-মানসিক শান্তির কাছে ভালোবাসার মূল্য যে এতো কম,তা মাত্র বুঝলো মেয়েটা।একটু অবাকও হলো।কারো প্রস্থানেও এতো সুখ মেশানো থাকে?

ফয়সালের বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সূচি। নয়তো দেখা যাবে বিছানায় পিঠ ঠেকানোর সাথে সাথেই আবার ডাক পড়বে।যাওয়ার আগে ফয়সাল হুকুম দেবেঃ” সূচি দরজাটা আঁটকে দাও।”

সূচির আকাশ-পাতাল ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো ফয়সাল।অদ্ভুত এক কাজ করলো।ভাবনায় ডুবে থাকা সূচির ডান হাতে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। কাঁধে ধরে আয়নার দিকে ফিরিয়ে দিলো বউকে।আয়নায় দুটো প্রতিবিম্ব।সামনে সূচি,পিছনে ফয়সাল।বেশ বিরক্ত হলো সূচি।আহ্লাদ করার সময় নেই এখন।শরীর-মন শান্তি খুঁজছে। আয়নার দিকে চেয়েই কপাল কুঁচকে বললোঃ” আপনি খামারে কখন যাবেন?”

” সময় হলেই যাব।”

” তাড়াতাড়ি যান তো।প্রতিদিন তো আরো আগে যান।”

” আজ যাব না।এতো তাড়া দিচ্ছ কেন?”

” আমি ঘুমাব।তাহলে থাকুন আপনি।ঘুমাতে দিন।”

গায়ের উপরে জড়িয়ে থাকা হাতদুটো ছাড়াতে চাইলো সূচি।হলো না।বলিষ্ঠ হাত দুটো আরো শক্ত হলো মেদহীন কোমড়ের দু-পাশে।
নাকের ভিতর দিয়ে ভুরভুর করে ঢুকছে সূচির চুলের ঘ্রাণ।চুলের নয় অবশ্য।সুঘ্রাণটা শ্যাম্পুর।ঘ্রাণটা মিষ্টি।নাকের ভিতর সুড়সুড়ি দেয়।

” চুলে শ্যাম্পু করেছো?”

” হ্যাঁ।”

” শ্যাম্পুর গন্ধটা এতো সুন্দর! একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে।”

” পানিতে মিশিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলুন।”

” মাঝে মাঝে সেটাই মন চায়।জানো, একটু আগে আমি খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম।”

ওদের মাঝে সচরাচর এমন খোশগল্প হয় না।দিনের বেলা একজন বাইরে থাকে,আরেকজন ঘরের কাজে ব্যস্ত।বাকিসময়েও চাওয়া-পাওয়ার হালখাতায় মত্ত থাকে দুজনে।দু-দন্ড গাল-গল্প করার সুযোগ হয় না।আজ বহুদিন পরে অবসরের গল্পটুকু ভালো লাগলো সূচির।ক্লান্ত শরীরের ভর ছেড়ে দিল প্রিয়তমের গায়ের উপর।হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলোঃ” কী দেখলেন?”

” দেখলাম, আমার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে।এই এইটুকু,একদম ছোট।গায়ের রঙ একদম লাল-ফর্সা। টুকটুকে সুন্দর।ইরানি বাচ্চাদের মতো।ইশ কি সুন্দর ছিল! তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।”

” তাই?”

” হুম।এতো স্পষ্ট স্বপ্ন আমি আর কোনোদিন দেখিনি। মনে হচ্ছিলো জীবন্ত পুতুল একটা।আমার চোখে এখনো ভাসছে।”

আয়নার ভিতরেই ফয়সালের প্রতিবিম্বের দিকে চোরা চোখে দেখলো সূচি।স্বামীর চোখদুটো চকচক করছে।মনে হচ্ছে ওখনো স্বপ্নের রেশ কাটেনি।বাচ্চাটাকে কল্পনায় দেখছে সে।মনে মনে প্রমাদ গুনলো সূচি।পরবর্তী কথাটা কী হতে পারে তা বেশ আন্দাজ করতে পারছে।

” সূচি ”

” হুম ”

” আমাদের যদি একটা মেয়ে থাকতো!”

ঠিক এই ভয়টাই করছিল সূচি।শুকনো গলায় বললোঃ” আপনার বয়স কত?”

” সাড়ে চব্বিশ।”

” আমার আঠারোর শেষদিক।সামনের মাসে ঊনিশ হবে।আঠারো পর্যন্ত সবাই শিশু।আমি মাত্র শিশু থেকে বড় মানুষ হব, প্রথম পর্যায়।আমাকে আপনি এখনো শিশুই ধরতে পারেন।একটা বাচ্চার কোলে আরেকটা বাচ্চাকে কেমন লাগে দেখতে?”

” ইশ! আসছে আমাদের ঘরের বাচ্চাটা।বিয়ের পর আর কেউ শিশু থাকে না।সবাই বড় মানুষ।”

” হ্যাঁ, এক লাইন বেশিই বোঝেন আপনি।দেখি সরুন এখান থেকে।”

ফয়সাল সরলো না।ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।সূচির কাঁধে বিছানো আধভেজা চুলে মুখ পেতে বললোঃ” কল্পনা করো।একটা ছোট্ট বাচ্চা তোমার একপাশে শোয়া,আরেকপাশে আমি।ছোট ছোট হাত-পা দিয়ে খেলছে,কাঁদছে,হাসছে।একটু বড় হলে বসবে।আরেকটু বড় হলে হাঁটবে।আমাকে বাবা,তোমাকে…

কতকিছু বলে চলছে ফয়সাল।কিছুই কানে ঢুকছে না সূচির।ফয়সালের চোখে লাল-নীল স্বপ্নের ঝুমঝুমি।তার রঙিন স্বপ্নগুলো ছুঁতে পারে না সূচিকে।সেও কল্পনা করছে।বড় আপার মতো তার শরীর ভারী হবে ,রুটির মতো ফুলে উঠা পেট হবে।নয়-দশ মাস যাবৎ হাত-পা-কোমড়ে নিত্যদিনের ব্যাথা। নিজে নড়তেই কষ্ট।এসব পিঠে বেঁধেই এখনকার কাজগুলো সব করতে হবে।ফজরের আগ থেকে শুরু হবে কর্মযজ্ঞ। তিনবেলায় রান্নাঘরে বসে থাকতে হবে ঘন্টার পর ঘন্টা। তিনজনের কাপড় ধোয়া,জমির দিনমজুরদের জন্য ভাত রাঁধা,এমাথা-ওমাথা উঠোনটাকে সকাল-সন্ধ্যা ঝাঁট দেওয়া,সন্ধ্যার আগে পশ্চিমের পুকুরের পিচ্ছিল ঘাট থেকে হাঁস ধরে আনা,মুরগীর পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে ঘরে তোলা,রাতের সব কাজ শেষ করার পর আবার চেপে বসে শ্বাশুড়ির পা টিপে দেওয়া,রাতে মাত্র তিন-চার ঘন্টার ঘুম।এতো কিছুর পরে দিনভর অপমান,গঞ্জনা-লাঞ্ছনা, বকাবকি,গালিগালাজ তো আঁচলে বাঁধা।কল্পনা করতে করতেই আঁতকে উঠলো সূচি।অসুস্থ হলেই কি এখনকার নিয়মগুলো বদলে যাবে? দিনগুলো সুন্দর হয়ে যাবে? একটু অবসর মিলবে? নিত্যদিনের রুটিনের কাছে মাতৃত্বের স্বাদ ফিকে হয়ে এলো। ফয়সালের বলা সুন্দর কল্পনাগুলো ছুঁতে পারলো না ওকে। নিজের সাদা-কালো,বেরঙিন দিনগুলোর কাছে অনাগত নিষ্পাপ ছানাটাকে নেহাৎ উপদ্রব মনে হলো। মনে হলো এতো অসহযোগিতার মাঝে বাচ্চাটা না আসুক।দুটো মেরুদন্ডহীনের ঘরে সে এতো শীঘ্রই পা না রাখুক।সহসা ভাবনায় ছেদ পড়লো সূচির।নিজেই অবাক হল।নিজের অশান্তির ভয়ে নিজের অংশটাই যেন না আসে সেই কামনা করছে।কি আশ্চর্য! মেয়েটা কি দিনদিন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে?

” সূচি,তুমি শুনছো?”

” হুম,এই তো শুনছি।”

” যখন তুমি সত্যি সত্যিই অসুস্থ হবে,তখন কিন্তু এরকম অগোছালো থাকবে না।”

” অগোছালো কীরকম?”

বউয়ের চুলগুলোকে আলগোছে ছুঁয়ে দিলো ফয়সাল। মুখে বললোঃ” এই যে,চুল আঁচড়ানোর খবর নাই।জট হয়ে আছে একদম।আয়নার দিকে তাকাও।চোখের নিচে এক আঙুল কালি।দিনদিন পাটকাঠির মতো হচ্ছো।আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়।কখন যেন বাতাসে উড়ে যাও।”

” কাজে ব্যস্ত থাকলে এরকম হয়ই।”

” বেশি বেশি খাবা। আর যখন সময় পাবা তখন সুন্দর মানুষদের দিকে তাকায় থাকবা।”

সূচি একটু অবাক হলো।কপাল কুঁচকে বললোঃ”সুন্দর বলতে?কার দিকে চেয়ে থাকব? আর কেন চেয়ে থাকব?”

” আম্মা বলে,এই অবস্থায় সুন্দর মানুষ দেখলে বাবুও সুন্দর হয়।আমার দিকে তাকাবা,আম্মার দিকে তাকাবা,ভাবির দিকে তাকাবা।”

” আয়নায় নিজের দিকে তাকাব না? বাচ্চাটা যদি আমার মতো হয়?”

” না,আমার বাচ্চাটা আমার মতো সুন্দর হবে।টুকটুকে লাল-ফর্সা।যে দেখবে সেই চেয়ে থাকবে।”

ফয়সাল বলেছে হালকাভাবে কিন্তু কথাটা বাজেভাবে গায়ে লাগলো খুব। এই প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে ফয়সাল দেখিয়ে দিলো তার বউ অসুন্দর। মানুষের মনের কথা মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।বিয়ের আগ থেকেই তো এই একটা জিনিস নিয়েই তার সমস্যা ছিল,বিয়েতে অনীহা ছিল। কিন্তু বিয়ের পরে এই কয়েকমাসে কখনো মুখ ফুটে বলেনি।সূচিকে অবহেলা করেছে ঠিকই কিন্তু অবহেলার পিছনে কারনটা কখনো খুলে বলেনি।আজ অসাবধানে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সূচি আহত হলো খুব কিন্তু মুখে কিছুই বললো না।সে এসবে অভ্যস্ত। যেই কথাটা সবসময় সবার মুখ থেকে শোনা হয়, সেটা তার মুখ থেকে শুনতে কী সমস্যা?

বাইরে থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসছে।চারদিকে ধ্বনিত হচ্ছে আল্লাহর মহান মহিমা।সূচির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।আজকেও ঘুমানো হল না।আযানের পরে ঘুমানো যাবে না।সময় শেষ।অবসর শেষের ঘন্টা বেজে গেছে। সূচি ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে রইলো।ঝাঁঝিয়ে উঠে বললোঃ”আপনার আহ্লাদ শেষ হয়েছে? আমার ঘুমের সময়টুকু খেয়ে দিলেন।”

” এতো ঘুম কীসের? এখন একটু সাজগোছ করো।একটু পাউডার-টাউডারও মাখতে পারো।চেহারাটা উজ্জ্বল দেখায় একটু।”

” উজ্জ্বলের কী দরকার?”

” দিনের বেলায় রাতের অন্ধকার কার ভালো লাগে?”

রসিকতা,বিদ্রুপ নাকি অভিযোগ?ধরতে পারলো না সূচি। আঁড়চোখে আয়নার দিকে চাইলো।সে উজ্জ্বল ফর্সা না। গায়ের রঙ একটু ময়লার দিকেই।তাই বলে এভাবে বলবে? গায়ের রঙ সাদা-কালো যাই হোক,তা নিয়ে এতো কথা বলার কী আছে?চাবুকের মতো সপাং করে গায়ে লাগলো কথাটা।মুখ বাঁকিয়ে বললোঃ” ঠিকই বলেছেন।রাতের অন্ধকার কেবল রাতের বেলায়ই সয়।কারণ তখন তো আর কোনো অপশন নেই।ঘরের মাঝে কেবল আমিই আছি।কিন্তু দিনের বেলা বাইরে বেরোতে পারেন।কত সুন্দরীদের দেখেন রাস্তা-ঘাটে।তাই তো দিনেরবেলা ফিরেও দেখেন না আমার দিকে।আপনার আসলে খুব সুন্দর একটা বউয়ের দরকার ছিল।ধবধবে সাদা,মডেলদের মতো দেখতে।”

বাম হাতে জোরে সূচির নাক টিপে দিলো ফয়সাল।কপাল কুঁচকে বললোঃ” ভালো কথা আসে না মুখে?আমাকে সন্দেহ করো?”

” না।এতোদিন করতাম না,এখনো করি না।কিন্তু হুট করেই একটা কথা মনে আসলো।বিয়ের পর প্রথম প্রথম আপনি আমাকে একদম দেখতেই পারতেন না। প্রথম রাতের কথা মনে আছে? আমি ভুলিনি।তখন আপনার আচরণে একটু খটকা লেগেছিলো।মনে হচ্ছিলো কোথাও একটা সমস্যা আছে।কিন্তু এতোদিন ধরতে পারিনি।মনে হচ্ছে আপনার তখনকার সমস্যাটা আমি এখন ধরতে পারলাম।”

ফয়সাল কিছুই বললো না।ফাঁকা ঢোক গিলে চেয়ে রইলো কেবল। জ্বিভে কামড় পড়ার জোগাড়।কথায় কথায় এতোকিছু বলে ফেলবে তা বুঝতে পারেনি।মনে চেপে রাখা কথাগুলোই আজ অবসরে মুখ দিয়ে বন্যার পানির মতো বেরিয়ে এলো। ভালো হলো না জিনিসটা।মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে বিয়ে করলেও সংসারটা তো চলছে।এমনিতেই ওদের ঠ্যালা-ধাক্কার সংসার।এখন অযথা অশান্তি হবে।সূচি হয়তো সন্দেহ করবে।আবার কিছু অপ্রিয় কান্ড।ভালো লাগে এসব।

” আপনি বোধহয় আম্মার কথায় বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করেছিলেন,তাই না? একটা সুন্দরী বউয়ের শখ ছিল আপনার। আম্মার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি।তাই আমার সাথে শুরুতে ওমন করতেন।তাই না?”

সূচির কঠিন কন্ঠ, তার সাথে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।সত্য উদঘাটনের পাল্লায় ফয়সালের অন্তর অবধি হাতড়ে দেখছে যেন। এই দৃষ্টি অচেনা তার।শীতল দুটো চোখের সামনে সংকোচে একটুখানি হয়ে গেল ফয়সাল।বিষয়টাকে ধামা চাপা দেওয়ার জন্য বউয়ের শরীর থেকে হাত সরিয়ে বললোঃ” বাজে কথা বাদ দাও তো।দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।কত কাজ খামারে! দেখি সরো তো,যেতে দাও।”

তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল ফয়সাল।তার প্রতিক্রিয়া এবং ব্যস্ততা এতোই কৃত্রিম ছিল যে সূচির চোখে পড়তে সময় লাগলো না।দিনের আলোর মতো সব পরিষ্কার।শরীর-মন ভেঙে পড়লো একদম।পা দুটো টেনে খাট অবধি হেঁটে যাওয়ার শক্তি রইলো না আর। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছে।অশান্তির মাঝেও সব তো চলছিলো।এই সত্যটুকু প্রকাশ না পেলে কী হতো? ছেঁড়া ছেঁড়া সুতোগুলো জোড়া লাগার কী দরকার ছিল? সহসা হাঁটু ভেঙে এল সূচির।হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো ফ্লোরে।মনের অবস্থা বেগতিক।শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো উপরের দিকে।তার ভিতর জুড়ে অভিযোগ। আর কতকিছু সইতে হবে? অবহেলা,অপমান,অসহযোগিতা,লাঞ্ছনা,গঞ্জনা
গালিগালাজ, বকা-ঝকা,অসমর্থন– আর? আর কী বাকি আছে কপালে?
কুয়াশার ভেদ করে সুক্ষ্ম সূর্যকিরণ যেমন জায়গা করে নেয়,তেমনি সূচির মনেও খুব সুক্ষ্ম একটি প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।ফয়সালও অপছন্দ করে ওকে।তবে দুজনের মাঝে যে সম্পর্ক আছে সেটাকে কী বলা যায়? এর মাঝে আদোও কি কোনো সম্মান,শ্রদ্ধা,ভালোবাসা আছে? ফয়সালের কাছে কি ও কেবল একদলা মাংসপিন্ড? বিয়ের বয়স খুব বেশিদিন হয়নি বলেই হয়তো কদর আছে।কিছুদিন গেলেই ডাল-ভাতের মতো সাধারণ হয়ে যাবে। ফয়সাল তখন চেয়েও দেখবে না।আচমকা পৃথিবী কাঁপানো এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।নিজের মাঝেই জমা-খরচা শুরু করলো।এ সংসারে ও আসলে কী পেয়েছে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here