শুকতারা পর্ব-২৮

0
799

#শুকতারা (পর্ব-২৮)
#হালিমা রহমান

বাইরে কেমন গুমোট আবহাওয়া।বাতাস নেই,রোদ নেই,আকাশে ছেঁড়া-খোঁড়া কালো মেঘ।কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। দুয়ারে দাঁড়ানো গ্রীষ্মের হাতছানিতে গরম পড়েছে খুব। চাপা গরম অস্বস্তি দেয় ভীষণ।ঘরের ভিতরেও শান্তি মিলে না।ক্যাটক্যাটে শব্দ তোলা যান্ত্রিক ফ্যানের বাতাসও শরীরে জ্বালা ধরায়।অসহনীয় অস্বস্তিতে শরীর-মন খিঁচিয়ে যাচ্ছে।স্বস্তি ও শান্তি–শব্দ দুটো মনে হচ্ছে হারিয়ে গেছে সূচির জীবন থেকে।বাতাসে অস্বস্তি, দৃষ্টিতে অশান্তি,মনের ভিতর ভর করেছে উত্তাল ঘূর্ণিঝড়। আহ! কোথাও একটু শান্তি নেই। পৃথিবীতে নরকের যন্ত্রণা। কমলালেবুর মতো চ্যাপ্টা দুনিয়াটা জাহান্নাম হয়ে গেল নাকি?

মনের অবস্থা যেমনই হোক,কাজ ফেলে রাখার দুঃসাহস দেখালো না সূচি।রোমেলা বানু মাগরিবের আগেই চলে আসবে।তার আগেই বিকালের কাজ সেরে ফেলতে হবে।মন খারাপের দোহাই দিয়ে গোয়ার্তুমি করার সুযোগ নেই।কাজ না শেষ করলেই শুরু হবে দৈনিকের ক্যাচাল,নতুন হাঙ্গামা।আজ আর কোনো হাঙ্গামা সহ্য করার শক্তি নেই।মেয়েটাও মানুষ।সহ্যের সীমারেখা আছে।দয়াময় প্রভু তাকে অসীম ধৈর্য্যশক্তি দেননি।নিত্যনতুন ঝামেলা দুর্বল হাড়-মাংসে আর সয় না।
ঝিমানো মন নিয়েই কাজে নামলো সূচি।ফয়সাল যাওয়ার পরে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসেছিলো ফ্লোরে।দৃষ্টি ছিল শূন্যে, বাতাসে ছিল দীর্ঘশ্বাস। চোখে পানি ছিল না।এখন আর কাঁদতে ভালো লাগে না।বিরক্ত লাগে খুব।চোখ জ্বলে। নিজের উপরেই রাগ উঠে।রাগে হাত কামড়াতে ইচ্ছা করে।তাই সে এখন আর কাঁদে না।
আসরের বেশ কিছুক্ষণ পরে বাইরে এলো।ত্যক্ত-বিরক্ত-খিঁচানো মন শরীরের চেয়ে বেশি ভারী।বিকালের ময়লা আলোকেও বিরক্ত লাগে।দুঃখ-কষ্ট-হতাশায় জড়ানো অদ্ভুত এক অবস্থা।উঠোন ঝাঁট দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঝাড়ু নিয়ে বাইরে এলো সূচি। উঠোনে হুমায়রা দাঁড়ানো।দুটো কাঁটাগাছের সাথে উঠোনের এমাথা-ওমাথা টাঙানো দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। সূচি ঘাটলো না ওকে।কথা বলার ইচ্ছা-আগ্রহ কোনোটাই নেই।থমথমে আবহাওয়ার মতোই থম ধরে রইলো।কোমড়ে আঁচল গুজে উবু হয়ে ঝাঁট দেওয়া শুরু করলো।ধুলো উড়িয়ে অন্ধকার করে ফেললো উঠোনের একাংশ।
সূচির অস্তিত্ব টের পেয়ে পিছু ফিরলো হুমায়রা।হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকলো।যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না সূচির।কিন্তু বড় ভাবির ইশারাও অমান্য করতে পারলো না।ঝাঁটা ফেলে হুমায়রার কাছে যেয়ে দাঁড়ালো।সূচি কাছে যেতেই হুমায়রা ঠেস মারা হাসি হেসে বললোঃ” ওই দেখো যৌতুক যায়।”

হুমায়রার কথা ঠিক বোঝা গেল না।তাই পুরোটা বোঝার জন্য রাস্তার দিকে চোখ পরিষ্কার করে দেখলো সূচি।রাস্তার পরিস্থিতি গরম গরম।ভাঙাচোরা রাস্তায় একটা ভ্যান চলছে কচ্ছপের গতিতে।একটু ধীরে,একটু সাবধানে।ভ্যানের উপরে একটা কাঠের আলমারি ও কাঠের টেবিল মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।পিছনে একটা নীল রঙা অটো।অটোতে তিন-চারটে বস্তা।ভ্যানের আগে-পিছে হল্লা করে চলছে দুই-তিনজন।অটোর ভিতরেও বসে আছে একজন।বস্তাগুলো আগলে বসে আছে। ঘোলাটে মস্তিষ্কে দৃশ্যটির অর্থ ধরতে পারলো না সূচি।বোকা কন্ঠে প্রশ্ন করলোঃ” কী বললে?”

” ওই যে দেখলা না ফার্নিচারগুলা,ওইগুলা টুটুল ভাইগো বাসায় যাইতাছে।অটোর ভিতরের লোকটাই টুটুল ভাই,আম্মায় আজকে যাগো বাসায় গেছে। বস্তায় মনে হয় হাড়ি-পাতিল বান্ধা।”

রাস্তার সমারোহ চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হওয়ার আগ অবধি নির্নিমেষ চেয়ে রইলো সূচি।যৌতুক শব্দটার মানে জানা আছে তার।অটোর মাঝে বসে থাকা টুটুল নামের লোকটাকে অবুঝ চতুষ্পদের চেয়েও নিম্ন মনে হচ্ছে।তার কি কোনো আত্মসম্মান নেই?

” আমার মন চাইতাছে হারামজাদারে যায়া জুতাটা দিয়া দুইটা দেই।ওর বউটা কি ভালো!আচার-ব্যবহার অনেক ভালো। তুমি দেখলে কইতা।চৌদ্দ জনের সংসারে একা খাটে।সংসারে দুইটা দেবর, তিনটা ননদ।আমগো আম্মায় কী জিনিস,তার চাইতে ডেঞ্জারাস টুটুল ভাইয়ের আম্মা।মাইয়াগুলি মহিলার নাম রাখছে।বাঘ-মহিষের লগে ভাত খায় বউটা। আমগো আম্মার তো মুখেই বিষ। আর টুটুল ভাইয়ের মায়ের হাতেও বিষ।উঠতে-বইতে ছ্যাঁচে বউটারে।কি সুন্দর আছিলো বিয়ার সময়! এখন কিছু নাই শরীরে।”

” বউয়ের বাবা-মা নাই? এমন পরিবারে মেয়ে রেখেছে কেন? আবার যৌতুকও দিচ্ছে!”

সহসা মুখটা মলিন হয়ে এলো হুমায়রার।উদাস গলায় বললো,” আছে তো।বাপ-মা সব আছে।বউরা তিন বইন। মেজটায় বিয়ের উপযুক্ত।এর লেগাও বাপ-মায়ে কিছু কয় না।টুটুল ভাইয়ের বউ যদি ঝামেলা কইরা বাপের বাড়ি থাকে,তাইলে ওই দুইটা বইনের কী হইব? বড়টার ছাড়াছাড়ির কথা শুনলে ভালো কোনো সম্বন্ধ আইব? ”

খুবই বাজে প্রশ্ন।উত্তর নেই সূচির কাছে।তাই চুপ করতে হলো।এরকম একটা ঘটনার শিকার তো সে নিজেও।ভূমি পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই শুনেছে এসব কথা।আলেয়া দাদী কিছু থেকে কিছু হলেই গাল বেঁকিয়ে বলতো,” তোর গতি ক্যামবে হইব সূচি? রূপ নাই,গুন নাই,পিঠের উপরে ভূমির কলঙ্ক।খালি থাকার মইধ্যে আছে কথার ত্যাজ। তোর কপালটা সব দিক দিয়াই ফাটা।”

বাবা-মায়ের হতাশাও দেখেছে নিজ চোখে।পাশের বাড়িতে ঘটকদের অহরহ আনাগোনা থাকলেও তাদের বাড়িতে ছিল না।ফয়সালদের আগে কোনো সম্বন্ধও আসেনি কখনো।প্রতি রাতে শোয়ার আগে নিজের ঘর থেকে আড়িপেতে বাবা-মায়ের কথা শুনতো সূচি।বাবার মুখ থেকে প্রায়ই হতাশার সুর শোনা যেত।ভাত খেতে খেতে খুব মন খারাপ করে বলতো,” আমার সূচির লেগা কোনো পাত্র আসে না সাহিদা।দুই-একটা ছেলে দেখছিলো কিন্তু মাইয়ার বড় বোইনের কথা শুনলে আর কেউ আসে না।সবার এক ভয়। যদি এইটাও ওমন করে।”

বেলাশেষের ধুলোমাখা উঠোনে দাঁড়িয়ে অনানুষ্ঠানিক বিয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেই বিয়ের দিনেও ভূমির বিষয়টা নিয়ে রফাদফা হয়ে গিয়েছিল।বড় আপার দোহাই দিয়েই তো হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন রোমেলা বানু। তাই তো আংটি বদলের দিনেই অনানুষ্ঠানিক বিয়েটা হলো।সহসা ও বাড়ির বউটার কথা মনে পড়ে কুঁকড়ে গেল সূচি।কোন অঘটনের ভয়ে বউটা মাটি কামড়ে পড়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে।ছোট দুটো বোনের গায়ে নিজের ভাগ্যের জের তুলে দিতে রাজি নয়।তাই হয়তো দিনভর অশান্তির পরেও থেকে যাচ্ছে।ও বাড়ির অপরিচিত টুটুলের বউয়ের কথা মনে করে ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সূচির। পৃথিবীতে এতো অশান্তি কেন? এখানে কি কেউ সুখে নেই?

” টুটুলের বিয়ের সময় এগুলা দেওয়ার কথা ছিল।কিন্তু কী একটা ঝামেলায় দেয় নাই তখন।আমার কী মনে হয় জানো? মনে হয় বউয়ের উপরে ওরা সেই শোধ তুলতো এতোদিন।এহন দিলো।আমগো আম্মা মনে হয় এর লেগাই গেছে আজকে।টুটুলের মায়ে বান্ধুবী তো।”

সূচি কিছুই বললো না।নিজের দুঃখের কাছে অন্যের দুঃখ ঝাপসা মনে হলো। কমলা রঙা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হলো,দুনিয়াতে আসলে একটা সূচি নেই। এখানে ঘরের আনাচে-কানাচে সূচিরা লুকিয়ে আছে।তাদের দৃষ্টিতে হতাশা,শ্বাসে দীর্ঘশ্বাসের গন্ধ,সর্বাঙ্গে বিড়ালে আঁচড়ের মতো অশান্তি।

” টুটুলের মতো অমানুষগুলিরে আসলে ঘরে ফালায়া জবাই দেওয়া উচিৎ।টুটুলের বউ অনেক ভালো মানুষ দেইখাই কিছু কয় না।বউয়ের জায়গায় আমি হইলেও খবর আছিলো হারামজাদার।”– হুমায়রার কথার উত্তাপ খট করে কানে বাজলো সূচির।বড় ভাবির চেহারাটা কঠিন।কন্ঠে স্বভাবসুলভ নম্রতা, নমনীয়তা নেই।এ কন্ঠ, এ চেহারায় কেবল অন্যের দুঃখে দুঃখীত হওয়ার ছাপ নেই। মনে হলো পুরোনো কোনো ঘায়ে আঘাত লেগেছে।বড় ভাবির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে ব্যর্থ শিকারীর মতো। ভিতরে উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ক্রোধ পুষে রেখেছে যেন। সূচির সন্দেহ হলো। কপাল কুঁচকে বললো,” তোমার আবার কী হলো ভাবি?”

” শুনবা? শুনবা তুমি? আমি কাউরে কই নাই কোনোদিন।”

কন্ঠে অসাধারণ ব্যস্ততা।বহুদিন যাবৎ ভিতরে পুষে রাখা কথাগুলো উগড়ে দেওয়ার চেষ্টা। সূচি থমকে গেল।মাথা নেড়ে বললো,” তুমি বললে আমি অবশ্যই শুনব।”

” আমার বাপের বাড়ি থেকা তিন লাখ টাকা দিছে তোমার ভাসুররে।”

” তিন লাখ! স্বেচ্ছায় উপহার হিসেবে দিলো?”

” না,দিতে হইলো। তোমার ভাইয়ের কম বেতনের ছোট চাকরি ছিল।আমি আসার পর থেকা দেখছি, বেতনের সব টাকা আম্মার হাতে দিতে হইতো। এহন যেমন ফয়সালে দেয়,তেমন তোমার ভাইও দিতো।ফয়সালের তো তাও ধরা-বাঁধা বেতন না।আম্মার অগোচরে হাতে কিছু রাখতে পারে।কিন্তু তোমার ভাইয়ের ওই সুযোগ ছিল না।মাস শেষে বেতনগুলা আইনা গইন্না আম্মার হাতে দিতে হইতো।এরপরে আম্মায় প্রতিদিন সকালে পঞ্চাশ টাকা কইরা দিতো আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়া হিসাবে।নতুন অবস্থায় তোমার ভাইয়ে আদর কইরা আমার লেগা একটা চকলেটও কোনোদিন আনতে পারে নাই সূচি।”

আচমকা রিনরিনে নারীকন্ঠটায় ভাঙন ধরলো।হুমায়রা একটু কেঁপেও উঠলো।অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সূচি। মানুষের কন্ঠেও এমন হতাশা থাকে! এতো কাতরতা মিশিয়েও কাউকে গোপন কথা বলা যায়!

” এরপর অনেক উত্থান-পতন। এই ঘরে সংসার করো,সবই বুঝো।আমি তোমার ভাইয়ের কাছে নালিশ করি।হেয় খালি আমারে সান্ত্বনা দেয় আর আমার চাইতে বেশি কান্দে।আম্মার হইয়া আমার কাছে মাফ চায়। আড়ালে-আবডালে আমার কাজ কইরা দেয়।ভোরে আমার আগে উঠে।কিন্তু আমার এইসব কান্দা-কাটি ভাল্লাগে না। অতিষ্ট হইয়া ভাবলাম আর সংসারুই করুম না।তখনই আমার মানিকের খবর জানলাম।সংসার ছাড়ার সাহস হইলো না।তোমার ভাইয়েরও মনে হয় একটু সাহস বাড়লো।আমার কাজে আরো বেশি কইরা সাহায্য-টাহায্য করে।আম্মার এইসব নজরে পড়লো।পছন্দ হয় নাই।তাই দিলো আমগোরে আলাদা কইরা। বিশ্বাস করবা না সূচি,আমার এই ঘরের প্রত্যেকটা টিন ধার কইরা কিনা।যেদিন এই ঘর থেকা বাইর হইছি,সেদিন তোমার ভাইয়ের পকেটে ছিল মাত্র একশ দশ টাকা।”

টপটপ করে পানি ঝরলো হুমায়রার চোখ থেকে।ঝাপসা দৃষ্টি সেই মেঠো রাস্তার উপর।

” ধার-দেনা কইরা ঘর তো করলো কিন্তু সংসার আর চলে না।কম বেতনের চাকরি,আমি অসুস্থ,একটা টাকা জমা নাই হাতে,শ্বাশুড়ির ঘর থেকা একটা ভাতের পাতিলও পাই নাই।একটু একটু কইরা সব কিনতে হইলো।বুঝো তাইলে, কত বড় একটা ধাক্কা গেছে উপরে দিয়া।তোমার ভাইয়ের চাকরিতেও আর কুলায় না।বেতনের টাকা দিয়া ধার দেনা দেয় একটু একটু কইরা,আর আমি ঘরে শাক-লতা রাইন্ধা খাই।আমার অপারেশনের লেগা আবার টাকাও জমাইতে হইতাছে।এতো কষ্টের মাঝেও তোমার ভাই আমার বাপের বাড়ি থেকা একটা টাকার সাহায্য নেয় নাই।হের অনেক শরম।তাছাড়া আম্মার উপরে একটা ক্ষোভও আছিলো।চিরকাল বেতনের টাকাগুলা আম্মারে দিছে।কোনোদিন অপ্রয়োজনে একটা পয়সাও নেয় নাই।শখ-আহ্লাদ করে নাই।আব্বা মরার পরে পড়ালেখা ছাইড়া সংসারের হাল ধরছে।সেই সতেরো-আঠারো বছর বয়স থেকা কামাই করে।নতুন ঘরে একটা ভাতের পাতিলও কি আমার প্রাপ্য আছিলো না?”

” আফজাল ভাই টাকা না চাইলে তোমার বাড়ি থেকে দিলো কেন? তাছাড়া, তোমার এতো কষ্টের কথা শুনেও তোমার বাবার বাড়ি থেকে কেউ সাহায্য করেনি?”

” তোমার ভান্ডে যখন দুই মুঠ চাউল থাকব,তখনই কিন্তু তুমি আরেকজনরে এক মুঠ দেওয়ার সাহস করবা।আমার বাপের ঘরে ওই এক মুঠ চাউলও ছিল না।আমারে কী দিব? বাপের বাড়ির খবর আমি জানতাম।তাই আমিই আমগো খবর ওতো বলতাম না। সাহায্য তো আসবই না, উল্টা টেনশন করব সবাই।আমগো যৌথ পরিবার।আমার জ্যাঠা আর ছোট কাকার অবস্থা ভালো।কিন্তু আব্বার অবস্থা খুব একটা ভালো না।আব্বা কিছুটা বোকা কিছিমের লোক।একহাতে রোজগার কইরা আরেক হাতে ভাঙছে। কোনোদিন জমানো শিখে নাই।চিরকাল মাইনষে হেরে ঠকাইছে। তাই আমগো ঘরে বারোমাসি সমস্যা থাকতই। এমন ঘর থেকা কোনো মানুষ সাহায্য চায় ক্যামনে? আমিও চাই নাই,তোমার ভাইও কোনোদিন বলে নাই।এরপর আমার মরা মানিক হইলো।আমি আর তোমার ভাই পাগলের মতো হইয়া গেলাম।খাইতে পারি না,শুইতে পারি না।ঘরে কিছুতেই ভাল্লাগে না।আমার অবস্থা খারাপ,তোমার ভাই কাজে যাইতে পারে না।চাকরিটা থাকলো না।এদিকে দুইবেলা পাওনাদারগো তাগাদা।কি যে একটা কষ্ট গেছে! তোমার ভাইয়ের বন্ধুরা বিদেশ যাওয়ার বুদ্ধি দিলো।তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কম।দেশে ভালো চাকরি পাইব না।কম বেতনের চাকরিতেও কুলাইব না।দেশে থাইকা ভালো কিছু করার সুযোগ নাই।তোমার ভাইয়েরও মনে ধরলো বুদ্ধি।সে বিদেশে যাইব।টাকা-পয়সার দরকার,আম্মারে জানাইল।বিদেশ যাওয়ার টাকাটা যদি আম্মায় দেয় তাইলে আমরা বাঁইচ্চা যাই।”

সূচির আগ্রহ বাড়লো।হুমায়রাকে থামার সুযোগ দিলো না।আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,” তারপর?”

” তারপর আর কী? আম্মায় টাকা দিব না। তার কাছে নাকি টাকাই নাই।অথচ তার কিছুদিন আগেই ফয়সালরে খামার নিয়া দিছে।তোমার ভাই নিজের ভাগের জমি চাইলো।হেয় জমি বিক্রি কইরা বিদেশ যাইব।চাকরি-বাকরি নাই,মাথা খারাপ তার।যেমনে হোক বিদেশে যাইতেই হইব।আম্মায় তাও দিলো না।তিনি বাঁইচ্চা থাকতে জমি-জমা ভাগ করব না। সব আগলায়া রাখব।তোমার ভাইয়ের চাকরিও নাই,বিদেশ যাওয়ার টাকার ব্যবস্থাও নাই,পাওনাদারের অভাব নাই।পুরাই দিশেহারা অবস্থা।তোমার ভাই চিন্তায় অসুস্থ হইলো। বিছানা থেকা উঠতে পারে না।চোখে যখন এমন অন্ধকার দেখি, তখন একটা কান্ড হইলো।এক সকালে আমার আব্বা আসলো বাসায়।তোমার ভাই ঘরে ছিল না।আব্বা বেশিক্ষণ বসে নাই।আমগো খোঁজ-খবর নিয়া আমার হাতে টাকার খাম ধরায়া দিলো।আমি তো অবাক।খাম খুইলা দেখি টাকা।আব্বায় বললো,তিন লাখ টাকা আছে ওইখানে।এর বেশি সে আর দিতে পারবে না।আমি তো অবাক।এই টাকা আমরা চাই না।কোনোদিন ইশারা-ইঙ্গিতেও বুঝাই নাই। আব্বা সেদিন বসে নাই আমার ঘরে।মুখ কালো কইরা চইলা গেছে।যাওয়ার আগে আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, কেন দিছে এই টাকা।আব্বায় উত্তর দিলো, আমগো প্রয়োজন তাই দিছে।তাছাড়া বিয়ের সময়ও কিছু দেয় নাই।তাই এবার বিপদেই দিলো।আব্বার কথা বুঝলাম।আমার এই টাকার দরকার নাই। তাই টাকা ফেরত দিতে চাইছি কিন্তু আব্বা নেয় নাই।চইলা গেছে।আবাব যাওয়ার পরে আম্মারে কল করলাম।এরপর আম্মা বললো আসল ঘটনা।”

” কী ঘটনা?”

” পোলার দুঃখ-কষ্ট সহ্য হয় নাই আমার শ্বাশুড়ির।তাই পোলার শ্বশুরবাড়িতে কল কইরা সব জানাইছে।তার মুখের ভাষা তো জানোই।আমার বাপের বাড়ির লোকে বিয়ার সময় বিনা পয়সায় মেয়ে দিছে,দেশচল হিসেবে শীত-গ্রীষ্ম-ঈদেও কখনো কিছু দেয় নাই।এখন জামাইয়ের কষ্টেও কিছু দিব না? আমার বাপের বাড়ির মতো এতো চোখ খাটা মানুষ দুনিয়াতে আর নাই।আব্বা-আম্মা আমার সব কষ্টের কথা জানতো না।আম্মার কথা শুইনা দিশাহারা হইয়া গেল।আব্বার হাতে সবসময়ের মতো তখনও টাকা নাই।শেষে চাষের জমি বন্ধক রাইখা আমারে টাকা দিছে।আম্মার মুখে সব শুইনা আমার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পড়লো।আমি তো এই টাকা কিছুতেই রাখুম না। তক্ষুনি ফিরায়া দিমু।আমার আম্মায় করতে দিলো না।ফোনের মইধ্যেই কসম-টসম দিয়া এক অবস্থা।এই টাকা আমি ফিরায়া দিলেও তারা আর রাখব না।প্রয়োজনে এতিম খানায় দিয়া দিব।শেষে আর কী করার? রাখলাম টাকা।তোমার ভাই প্রথমে নিতে চায় নাই।কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে যখন টাকাটা নিলো,আমার চেহারার দিকে তাকাইতে পারে নাই লজ্জায়।তোমার ভাইরে পুরা সত্যি কথা বলি নাই আমি।বললে আম্মার সাথে আবার ঝামেলা হইব।এতো ঝামেলা ভাল্লাগে না।কিন্তু ওই টাকাটা নেওয়ার পর থেকা আমি এখনো এক বেলা থাকতে পারি না আমগো বাড়িতে।কেমন লজ্জা লাগে।আব্বার চাষের জমি এমনিতেই কম ছিল।সেখান থেকাও এক খন্ড চইলা গেল আমার জন্য।আব্বা-আম্মার শুকনা চেহারার দিকে তাকাইলে আমার কেমন খারাপ লাগে।নিজেরেই খুব দোষী মনে হয়।আমারই দোষ।তখন জোর কইরা টাকাটা ফিরায়া দিলেই চলতো।মুশকিল আল্লাহ দেয়,মুশকিলের আহসানও আল্লাহই করে।ধৈর্য্য ধইরা থাকতাম।একটা না একটা ব্যবস্থা হইতোই।”

” এখন টাকাটা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নাই? ভাইয়া তো ভালোই আছে বিদেশে।”

” আমিও এই চিন্তাই করি।ভাবতাছি এবার তোমার ভাইয়া আসলে সব খুইলা বলুম।ফোনে বলা যাইব না।আস্তে-ধীরে বলুম সব।এরপর তোমার ভাই যা ভালো বুঝে তাই করব।”

একটু থামলো হুমায়রা।আঁচলের কোণে চোখ রগড়ে বললো,” তাও লজ্জা লাগে সূচি।টাকাটা এখন নাহয় ফিরায়া দিমু।কিন্তু জমিটুকু তো আর আসব না।বিপদে পইড়া আব্বা একদম সস্তায় জমি বন্ধক রাখছিলো।সময়মতো টাকা দিতে পারে নাই,তাই জমিও হাতছাড়া হইছে।এখন আমরা টাকা দিলেই কী হইব? জমি তো আর আসব না।”

মাগরিবের আযান পড়ছে চারদিকে।অলস বিকালের আকাশ থেকে পাখিদের ঘরে ফিরার পালা। সূচির কাজ কাজের জায়গায় পড়ে রইলো।হাঁস-মুরগী ঘরে তোলা হয়নি।ঝাঁটা হাতেই দাঁড়িয়ে রইলো ময়লা উঠোনে।হুমায়রা পাশে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছছে। তার কথা শেষ কিন্তু রেশ কাটেনি এখনো।কথাগুলো ঘুরে-ফিরে কানের কাছে ঘুরছে। সারা গ্রামে এই একটা বাড়িই বোধহয় সবচেয়ে অভিশপ্ত।নয়তো সেই যুগ যুগ আগ থেকেই এ বাড়িতে এতো অশান্তি কেন? এই কাজী বাড়িতে কোনো মেয়েই শুরুতে শান্তি পায় না কেন?

________________________

রোমেলা বানু এলেন সন্ধ্যার পরে।মাগরিবের প্রায় আধঘন্টা পর বাড়ি ফিরলেন।সূচি তখন কেবল রাঁধতে বসেছে। বিকাল থেকে ফয়সালেরও দেখা নেই।সেই যে পালিয়ে গেল আর এলোই না।বিকালের নাস্তাটা তাই আর তৈরি করলো না সূচি।হাঁস-মুরগী ঘরে আঁটকে রাতের রান্নার বন্দোবস্ত করছে।এমন সময় রোমেলা বানু এলেন।পান চিবিয়ে নির্যাসটুকু রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বললেন,” নাস্তা দাও বউ।”

” নুডুলস রেঁধে দেব আম্মা?”

রোমেলা বানুর কপাল কুঁচকে গেল।খিটখিটে গলায় বললেন,” এহন রানবা ক্যান? রান্দো নাই?”

” না আম্মা।আপনিও বাসায় ছিলেন না,আপনার ছেলেও আর এলো না,তাই কিছু করিনি।আমি এখনি করে দিচ্ছি।”

” হ,তোমার করনের অপেক্ষায় আমি বইসা থাকুম এখন।একটু সুযোগ পাইলেই খালি ফাঁকিবাজি।আমি আজকে মরি,কালকে এই ভিটায় কলাগাছ লাগাইতে হইব।তোমগো মতো বোধ ছাড়া মেয়ে মানুষ দিয়া সংসার চলে না।”

” বিয়ের সময় এই বোধ ছাড়া মেয়ে মানুষকেই পছন্দ ছিল আপনার।আপনাদের মা-ছেলের যা আচরণ, আমার মরণের বেশিদিন বাকি নেই আর।তখন খালি ভিটায় কলাগাছই লাগাতে হবে আপনাকে।আপনার ছেলের সাথে কোনো বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষের বাচ্চা মিলেমিশে খেতে পারবে না।”– কথাটা মনে মনেই বললো সূচি।সারাদিনের পরিশ্রম ও বিকালের মন খারাপের পর থেকে মন-মেজাজ আগুন গরম হয়ে আছে তার। শ্বাশুড়ির কথার বিপরীতে এই কথাটাই এলো মুখে। কিন্তু বলার সাহসও নেই,ইচ্ছাও নেই।কিছু বললেই এখন ফোন চলে যাবে বাবার কাছে।আরেকবার যাত্রাপালার পরে আবার শ্বাশুড়ির পা ধরে মাফ চাইতে হবে।সব মুখস্থ সূচির।দৈনিকের নাটক আর ভালো লাগে না।

অপর ব্যাক্তির মুখ তখন ছুটেছে আধুনিক ট্রেনের মতো।রান্নাঘরের পিঁড়িতে আসন পেতে বসে আপনমনে বকছেন।কথাগুলো সূচিকে উদ্দেশ্য করেই বলা।সূচি কান বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো।রেডিও বাজলেই সবসময় শুনতে হবে কেন?তবে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলো না। ভদ্রমহিলার আজকের কথাগুলো নতুন।এতোদিনের কথাগুলোর সাথে লেজ লাগানো আরেকটু কথা আছে।না চাইতেও কিছু কথা কানে গেল সূচির।

” মাইনষের বউগুলা কত ভালো,কত ভালো পরিবার তাগো।মুখ ফুইটা কিছু কওন লাগে না।সব নিজেরাই বুঝে।আর আমি আনছি দুইটা।সমাজ ছাড়া,জ্ঞান-বুদ্ধি ছাড়া।যেমন বউ, তেমন তার পরিবার।তোগো মেয়ের রূপ নাই,গুণ নাই।এমন একটা মেয়ের লেগা সোনার টুকরা একটা জামাই পাইছোছ।সুন্দর,কর্মঠ।তোগো উচিত ছিল মেয়ের জামাইরে খুশি করনের লেগা হইলেও মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে কিছু দিয়া দেওয়া।জামাইগোরে কিছু দিলেই না তাগো মন পাবি।তা না।বিনা পয়সায় মেয়েরে ঘাড়ে চাপায়া দিয়াই তারা মুক্তি পায়া গেছে। বেকুবের জাত।এরা সমাজ বুঝে না,কিছু বুঝে না।টুটুলের বউটা কত সুন্দর! তাও কতকিছু দিছে আজকে বউয়ের বাড়ি থেকা।আর আমার বেলায় উল্টা।সব মুখ ফুইটা বলা লাগে।বউরে তো শিখান লাগেই,তার লগে বউয়ের বাপ-মারেও শিখান লাগে।তারা মাইয়ারে একটা জিনিস দিব।থাকব কার? মাইয়ার নিজের।না,এ দিতেও তাগো কষ্ট।মাইয়ার বসার ঘরে একসেট সোফা নাই,রুমের খাটটা পুরান।নিজের চোখেই দেখছোছ।উপহার হিসাবে তো কিছু দিতেই পারোছ।আর আমার বউ হইছে আরেক বলদ।বলদের ঘর থেকা একটা বলদই হইছে।তুই তোর বাপের কাছ থেকা চায়া নে।মাইনষে জামাইয়ের আয় বুঝে।আর তোর তো ভাই-বইনও নাই।তুই চায়া নিলেই দোষ কী? মাইনষে আমারে এখনো জিগায়, ফয়সালের লেগা এমন একটা বউ ক্যামনে আনলাম? আরো কত সুন্দর মেয়ে ছিল গ্রামে।তারা ভাবে,বউয়ের বাপের জায়গা-জমি দেইখাই এমন বউ আনছি।আমার পোলায় বউগো বাড়ি থেকা সাহায্য পাইব।কিন্তু মাইনষে কী বুঝব? টাকা-পয়সাওয়ালা হইলেই মানুষ খরচা করতে শিখে না।খরচা করতে মন লাগে।জ্ঞান লাগে,বুকের পাটা লাগে…

অতঃপর ঘটনা বোঝা গেল।সূচিকে দিয়ে শুরু,সূচির পরিবারকে দিয়ে শেষ।বেয়াইবাড়ির কৃপনতায় অতিষ্ঠ রোমেলা বানু।চলমান ভাষনের উদ্দেশ্য, তাদের মুঠ করে রাখা হাত দুটোকে খোলা।ঘরের নির্বোধ বউয়ের মাথায় বুদ্ধি আনা।বাবার বাড়ি থেকে উপহারের নাম করে দুটো জিনিস আনলে কী এমন ক্ষতি হয়? স্বামীর আয় বাঁচলে তো তারই লাভ।শ্বাশুড়ির এমন মহৎ উদ্দেশ্য সূচির মাথায় ঢুকলো না বোধহয়। বাবার বাড়ি থেকে চাওয়ার সুবুদ্ধি তো মাথায় চাপলোই না বরং কুবুদ্ধিরা ঠেসেঠুসে জায়গা করে নিলো ঘোলাটে মস্তিষ্কে। জ্বলন্ত উনুনের হলদে-লাল আগুনে চ্যালাকাঠের মতোই শ্বাশুড়িকে গুজে দিতে ইচ্ছা হলো।চুলার রাক্ষসের মতো হা করে থাকা মুখের মধ্যে রোমেলা বানুকে চ্যাংদোলা করে ফেলে দিলে কেমন হয়? ভস্ম হয়ে যাবে একদম।মনে মনে অসম্ভব দৃশ্যটা কল্পনা করেও শান্তি পেল না।হাহ খোদা! একমাত্র যৌতুকের ভূতটা ঘাড়ে চাপাই বাকি ছিল।

” মাইনষে আমারে জিগায়,বউয়ের বাড়ি থেকা বিয়ার সময় কী দিছে? আমি কিছু কইতে পারি না।কওনের মুখ থাকে না।আমার পোলার কপাল কি আর ওতো ভালো? একটা মাইয়া,দিলে….

” আম্মা, জানেন কী হয়েছে?”— সূচির সহজ কন্ঠ।কন্ঠে কোনো উত্তাপ নেই।শ্বাশুড়ির কথাগুলো যেন শুনতেই পায়নি।

রোমেলা বানু একটু অবাক হলেন।কথার মাঝে কথা বলে না সূচি।বিরক্তও হলেন কিঞ্চিৎ। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে বাম হাত ঢুকানোর কী দরকার ছিল? কপাল কুঁচকে বললেন,” কী হইছে?”

” আমাদের বাড়ির পাশেই দর্জি বাড়ি।ও বাড়ির তমা আপুর বিয়ে হয়েছে আমার বিয়ের দু-মাস আগে।স্বামী বিদেশি,শ্বশুরবাড়ির টাকা-পয়সার অভাব নেই।কিন্তু টাকা-পয়সা থাকলেই কি হয়? শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো ছিল জানোয়ার।তমা আপুকে দিন-রাত শুধু যৌতুকের জন্য চেপেছে।আমি বৌভাতের সময় গেলাম না? তখন শুনলাম এই কাহিনী।সুন্দর,শিক্ষিত তমা আপুর হাল বেহাল করে ফেলেছে জানোয়ারগুলো। ছোটলোক তো আজীবন ছোটলোকই থাকে।এদের টাকা-পয়সা থাকলেই কি আর এরা ভদ্রলোক হয়?”

রোমেলা বানুর কান লাল হয়ে এলো।তার কথার মাঝেই সূচির এরকম কথা খুবই অপমানজনক।গায়ে লাগছে খুব।মনে হচ্ছে সূচি তমার শ্বশুরবাড়ির লোককে নয়,কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে।

সূচি থামলো না।ডালে এক চামচ লবন ফেলে দিয়ে আগ্রহ নিয়ে বললো,” তারপর কী হয়েছে জানেন, আম্মা? তমা আপু তো মনে করেন অনেক শিক্ষিত আবার অনেক চালাক।শ্বশুরবাড়ির লোক যদি হয় সাপ তো তমা আপু হলো বেজি।সে কি সহ্য করার মতো মেয়ে? একদিন দেখেছে, দুইদিন দেখেছে।তিনদিনের দিন ফট করে থানায় চলে গেছে।বাবার বাড়ির লোকদের ধার ধারেনি।বুদ্ধি করে থানায় যেয়ে ছোটলোকগুলোর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আর যৌতুকের মামলা দিয়ে দিয়েছে।দুটোই ডেঞ্জারাস মামলা।আমি এতো খুশি হয়েছি শুনে।ছোটলোকের জাত। বিয়ের দৌলতে অন্য বাড়ির একটা মেয়ে এসে তোদের সংসারে খাটছে।তোরা তাকে মেয়ের আসনে বসাবি।তা,না।দিন-রাত দাসী-বাদীর মতো খাটাচ্ছে।আবার মেয়ের বাপের বাড়ির সম্পদের দিকেও নজর! কুকুর কোথাকার।অন্যের বাড়িতে মাংস ছড়ানো-ছিটানো আছে বলেই তোদেরকে ভাগ দিতে হবে? মগের মুল্লুক পেয়েছিলো।ছোটলোকদের অবস্থা দেখেছেন আম্মা?আমি অবাক না হয়ে পারি না।এদের জন্য তমা আপুই ঠিক আছে।এখন জেলের দুয়ারে দৌড়াদৌড়ি কর।অমানুষের দল কতগুলো।”

কল্পিত তমা আপুর নাম করে সাধ মিটিয়ে ঝাড়লো সূচি।কথার শেষে ছোট্ট একটু হাসির রেখাও ফুটলো মুখে।শ্বাশুড়ি অবুঝ নয়।কথার মানে ঠিক বুঝবে। শান্তি শান্তি লাগছে এখন।সারাদিনের অশান্তিটা একটু কমেছে মনে হচ্ছে।মনটাও চাঙ্গা হয়েছে।ইচ্ছা করেই ডালে একটু বেশি করে হলুদ দিলো সূচি।আরেক চামচ লবনও ফেললো জেনে-বুঝে।ভাবখানা এই,বিদ্রোহী সূচি আজ কড়া হলুদ-লবনের ডাল খাইয়ে শত্রুদলকে মেরে ফেলবে একদম।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here