শুকতারা পর্ব-২৯

0
815

#শুকতারা (পর্ব-২৯)
#হালিমা রহমান

সূচিদের বাড়ির পাশে দর্জি বাড়ি আছে ঠিকই কিন্তু সে বাড়িতে তমা নামের কোনো মেয়ে নাই।পুরো গ্রামে এই নামের কোনো মেয়ে আছে কি না সন্দেহ।থাকলেও তার সাথে সূচির কোনো পরিচয় নেই।কল্পিত একটা চরিত্রকে আশ্রয় করেই শ্বাশুড়িকে কত কথা শুনিয়ে এলো মেয়েটা! ভাবা যায়? সূচি খুব মিথ্যা বলতে পারে।আগেও বলতো,আজকেও রান্নাঘরে গড়গড় করে একচোট বলে এলো।যৌতুকের কথা বলায় ছোটলোক,কুকুর,অমানুষ– আরো কতকিছু বলে এলো! সূচি হেসেই কুটিকুটি।সন্ধ্যার কথাগুলো মনে পড়তেই ঝর্ণার জলের মতো ছলছলিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়লো খাটে।তখন ঝোঁকের বশে কাজটা করলেও এখন বুদ্ধিটা বেশ মনে ধরেছে।সবসময় কোমড়ে আঁচল বেঁধে মুখোমুখি ঝগড়ায় নামার চেয়ে পরোক্ষভাবে দু-চারটে ঘা মারা বেশি শান্তির। ও পক্ষ বুঝতে পারবে ঠিকই কিন্তু সরাসরি আঘাত না করায় সরাসরি প্রতিঘাত করতে পারবে না। রোমেলা বানু রাগে ফোঁসফোঁস করবে ঠিকই কিন্তু সূচির গায়ে বেয়াদবের তকমা লাগাতে পারবে না। বাবার কাছে নালিশও করতে পারবে না। বাহ! ঘুরিয়ে কথা শোনানোর বুদ্ধিটা তো বেশ।

আজ রান্নাটা একটু তাড়াতাড়ি শেষ হলো।সন্ধ্যার পর থেকে রোমেলা বানুও চুপচাপ।সূচির কথার শেষে কিছুক্ষণ থম মেরে বসেছিলেন রান্নাঘরে।এরপর বেশ কিছুক্ষন পর, প্রায় দশ মিনিট পরে থপথপ করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেলেন।পরোক্ষ হুমকি-ধমকি বেশ কাজে দিয়েছে বোধহয়।সেই তখন থেকেই চুপচাপ। একটুও হু-হ্যাঁ শোনা যায়নি এখনো।সূচি বেশ স্বস্তি পেলো।ভালোয় ভালোয় আজ রাতটা কেটে যাক।মায়ের সাথে একচোট হলো।এখন ছেলের পালা।ফয়সাল সেই যে বিকালে পালিয়ে গেল,এখন অবধি তার পাত্তা নেই।কোনো ফোন করেনি,বাড়িও আসেনি।সূচির রাগ-অভিমান কমলো না।তরতর করে বেড়ে অভিমানের পাহাড়টা আকাশ ছুঁয়ে গেল।পালিয়ে বেড়ানোর কী আছে? সে কি ভূত-পেত্নীর মতো ভয়ংকর কিছু? দেখলেই ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলবে?

ফয়সালের কথা মনে পড়তেই আবারো মন খারাপ হয়ে গেল৷ ছেলেটা তাকে পছন্দ করে না,একটুও করে না।বিয়ের সময়ও পছন্দ করেনি,এখনো আহামরি ভালোবাসে না। দুজনের মাঝের সম্পর্কটা সংসারের নিত্য অশান্তি ও চাওয়া-পাওয়ার হালখাতার মাঝেই সীমাবদ্ধ। কবুলের জোরেই সম্পর্কটা হয়তো এখনো আধভাঙ্গা সেতুর মতো ঝুলে আছে। ভাবতেও অবাক লাগে। সূচির প্রতিটি মোনাজাতে ফয়সাল ছিল,অথচ সে কখনোই সূচিকে চায়নি।ভালোবাসা তো বহুদূরের কথা, সে পছন্দই করেনি।বিয়ের প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা,আজ বিকালের কথা খুব মনে পড়ছে।স্মৃতিগুলো পসরা সাজিয়ে বসেছে চোখের সামনে।আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটায়।খুব মন খারাপের রাতে হুট করেই একটা রুঢ় বাস্তব সত্য বুঝলো সূচি।সংসার করতে আসলে খুব বেশি প্রেম-ভালোবাসা লাগে না।শ্রদ্ধা-সম্মান,সমর্থন,এসব স্বস্তিদায়ক অনুভূতিরও দরকার হয় না।তিন কবুলের জোর ও মৌন সম্মতিই যথেষ্ট। তবে প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মহব্বত, শ্রদ্ধা-সম্মান,সমর্থন,মূল্যায়ন –এগুলোও কাজে লাগে।এসব সুন্দর অনুভূতি একটু শান্তির জন্যে দরকার। শারীরিক ও মানসিক শান্তি দুটোর জন্যই।একটি সুন্দর সুখী সম্পর্কের জন্য দরকার।দিনশেষে যার ঝুলিতে এসব থাকে, তার মতো সুখী ব্যক্তি দুনিয়াতে আর কেউ নেই।বালিশে হেলান দিয়ে ভাবে সূচি।তবে কি সে একটুও সুখী না?এ সংসারে শ্রদ্ধা-সম্মান বাঘের চোখের মতোই দুর্লভ।সূচির বাবা-মায়ের সম্মানই যেখানে নেই,সেখানে সে তো খুব দূরের বিষয়।বেয়াই-বেয়াইনকে উদ্দেশ্য করে রোমেলা বানু সকাল-সন্ধ্যা যেই পুঁথি পাঠ করে,তা শুনলে বাবা-মা হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবে।সমর্থন-মূল্যায়ন এসবের কোনো বালাই নেই।আনাড়ি মেয়েটা এ বাড়িতে এসেই বিশাল কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লো।সেই কোন আমলের সংসারটার ভার দুটো অপরিপক্ব কাঁধে বইছে। অপটু হাতে শিখতে শিখতে আজ সূচি পাক্কা গৃহিনী।এই দু-তিন মাসের কসরতে কতটুকু মূল্যায়ন পেয়েছে সে?কারো কাছে কোনো কাজে একটু সমর্থন পেয়েছে?ঘরের কার কাছে দুবেলা দুটো ভালো কথা শুনেছে? আর প্রেম-ভালোবাসা? ওরে বাবা! সে তো ভয়ংকর বিলাসিতা। ওসবের বালাই এ ঘরে নেই।শ্বাশুড়ি তো সেই শুরু থেকেই ভালোবাসে না।ফয়সাল,সেও বোধহয় একই পথের পথিক।আজ বিকালেই তার একদফা মীমাংসা হয়ে গেছে।অনাগত সন্তানের সৌন্দর্য নিয়েও সে খুব সচেতন।অর্ধাঙ্গিনীর রূপ যেন তার অংশ না পায় তার জন্য কত চিন্তা! কি সুন্দর অবলীলায় বলে ফেললো,দিনের বেলায় রাতের অন্ধকার ভালো লাগে না।হৃদয় কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সূচির ভিতর থেকে। সে কি খুব বেশি অসুন্দর? শরীরের সাদা-কালো চামড়াটাই সব? ময়লা চামড়ার জায়গায় যদি ধবধবে সাদা চামড়া জুড়ে দিতো বিধাতা, তবেই কি ফয়সাল ভালোবাসতো? মনের ভিতর ভাবনাগুলো যতো গেড়ে বসছে,মন খারাপের পারদটা ততোই বাড়ছে। বিষন্নতার শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে এই প্রথম নিজের চেহারা নিয়ে আফসোস হলো সূচির।আল্লাহ যদি আরেকটু সৌন্দর্য দিতো! শরীর মোড়ানো সাদা চামড়া,হরিণের মতো চোখ আর মুক্ত ঝরা হাসি যদি থাকতো! খুব কি ক্ষতি হতো তবে?

দূরত্ব বাড়লে নাকি সম্পর্কের গুরুত্ব বাড়ে। নাটক-সিনেমা গুলে খাওয়া সূচির মাথায় একটা চিন্তা চাপলো।সেই ফেব্রুয়ারিতে বৌ-ভাতে যে নিজের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো তার পরে আর যাওয়া হয়নি। আসলে এই ঘরের বাইরে এই কয়েকটা মাস পা রাখাই হয়নি।এর মাঝে বাড়ির জন্য মন খারাপ হয়েছে খুব।ফয়সালকে একদিন বলেছিলো বাড়িতে যাওয়ার কথা কিন্তু উপরের আদালত ছুটি মঞ্জুর করেনি।ও বাড়ি থেকে সূচির বাবা-মাও খুব একটা পীড়াপীড়ি করেনি যাওয়ার জন্য। তাই আর যাওয়া হয়নি।ভীষণ মন খারাপের রাতে আজ বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে সূচির। এক জায়গায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে গেছে সে।একটু বায়ু পরিবর্তনের নাম করে হলেও বাড়ি থেকে ঘুরে আসা দরকার।পুরোনো টিনের ঘর,ঝকঝকে মাটির উঠোন, তেঁতুল গাছ,করমচা গাছ,ঘরের পিছনের সুপারি বাগান,দাড়িয়াবান্ধার ঘর,বৌচি খেলার ঘর, লিলির পুতুলবৌ,মনি ভাবির ঘাটভাঙা পুকুর আর শখের ভাবি মহল— সূচির শান্তি ওখানেই লুকানো।এ বাড়ির দেওয়ালগুলোও ইদানীং গলা চেপে ধরে।সূচি শ্বাস নিতে পারে না।প্রাণ বাঁচানোর জন্যে হলেও এইবার বাড়িতে যেতেই হবে।স্বামী-শ্বাশুড়ি এবাড়িতে থাকবে,সূচি মুক্ত পাখির মতো একবার নীড়ে ঘুরে আসবে। বিষয়টা সুন্দর,ভাবনাগুলো শান্তি দেয়।যেই ভাবা সেই কাজ।সূচি চট করে সাহিদা বেগমকে কল করলো।

” আসসালামু আলাইকুম, আম্মা।”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আজকে এতো তাড়াতাড়ি কল করলি? ঘরে কেউ নাই?”

” আছে।রান্নাবান্না শেষ,বসেই আছি।তাই ভাবলাম তোমার সাথে কথা বলি।তোমার কী খবর?”

” ভালো।ঐ বাড়ির কী অবস্থা? জামাই,বেয়াইন আছে ভালো?”

” হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে।আব্বা বাড়ি আছে আম্মা? কাল আমাদের বাড়ি একবার আসতে পারবে?”

” ক্যান? আবার কিছু হইছে,সূচি? তুই কিছু করছোছ?”– ও পাশ থেকে সাহিদা বেগমের উদ্বিগ্ন কন্ঠ ভেসে এলো।
সূচির ভিতরটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল মুহূর্তেই।চড়চড় করে রাগ উঠলো।তবে রাগলো না।ঠান্ডা গলায় বললো,” কিছুই হয়নি।তোমার কি মনে হয় কিছু ঘটলেই আমি কেবল ফোন দেই? আব্বা কি এই বাসায় এমনিই আসতে পারে না?সবসময় বিচার করতেই আসতে হবে?”– শেষের দিকে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো সূচির কন্ঠ।

” সবসময় ত্যাজ দেখাবি না।চাপার এতো জোর দেইখ্যাই বিচার করতে যাইতে হয়,ঘন্টায় ঘন্টায় নালিশ আসে তোর নামে।তোরে আমি খুব ভালো কইরা চিনি। তুই আমার পেট থেকা হইছোছ।”

” সেটাই বড় দুঃখ আম্মা।তোমারও,আমারও।তোমার ঘরে আরো ভদ্র,ভালো মেয়ের দরকার ছিল। আমার শ্বাশুড়ি মাঝে মাঝে একটা কথা বলে।তোমরা ঘাড় থেকে মেয়েকে নামিয়েই বেঁচে গেছো।সেই ফেব্রুয়ারির পর থেকে একবারও আমাকে দেখতে ইচ্ছা করেনি তোমাদের? একদিনও আমার শ্বাশুড়ির কাছে ফোন করে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারোনি?”– সূচির কন্ঠ ভিজে এলো।হতাশা,বিরক্তি, রাগ,ক্ষোভে মেশানো অদ্ভুত এক অবস্থা।

” বাড়িতে আসবি? এটা আগে বললেই হইতো।আমার কথায় কিছু মনে করিস না মা।তুই ফোন দিলেই আমার কলিজা টিপ্পা থাকে।”

” কালকেই আব্বাকে পাঠাবা আম্মা।এইবার আমি যাবই যাব।যেভাবেই হোক আমাকে নিয়ে যেতে বলবা।”

” আচ্ছা। কালকে তোর আব্বারে পাঠামু।কিন্তু বিয়াইন কি আসতে দিব? জামাইরে কইছোছ কিছু? ওনারা না আসতে দিলে ক্যামনে আসবি?”

” জোর করে আসব।একটু অবসর না পেলে আমি বোধহয় আর বাঁচবই না আম্মা।একটু শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাই।”

ও পাশে সাহিদা বেগম আরো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।সূচির কন্ঠটা কেমন ঠেকছে না? চিন্তায় অস্থির হয়ে বললেন,” ঐ বাড়িতে কিছু হইছে সূচি? সত্যি কইরা বল তো। আমার কসম,সব বলবি।”

বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘটে যাওয়া একটা কথাও বলতে ইচ্ছা হলো না সূচির।তাই বালিশে মাথা ফেলে বললো,” কিছু হয়নি আম্মা,সব ঠিক আছে।রাখছি আজকে।আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।তুমি কিন্তু আব্বাকে অবশ্যই পাঠাবা।”

খট করে কল কেটে দিলো সূচি। সত্যি আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।কারো কথা শুনতে আজকাল ভাল লাগে না।বিরক্ত লাগে,মাঝে মাঝে রাগও উঠে। চপলা সূচি বোধহয় দিনদিন খিটখিটে, রগচটা হয়ে যাচ্ছে।হাসতে ভালো লাগে না,কাঁদতে বিরক্ত লাগে,বৃথা রাগ করতে ভালো লাগে না,অভিমান করতেও আলসেমি হয়।দিনদিন মেয়েটা সৃষ্টিছাড়া অদ্ভুত মানুষে পরিণত হচ্ছে।কতদিন আগে অন্তু বলেছিলো,সূচি ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে? সত্যি কি তাই? শুয়ে শুয়ে মেয়েটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।শুধু ভিতর কেন? রক্ত-মাংসের শরীরটাও মরে যাক। ইহজীবনের লীলাখেলা সাঙ্গ হলেই ল্যাঠা চুকে যায়। প্রতিদিন একটু একটু অশান্তিতে ডুবে যাওয়ার চেয়ে একবারে মরা ভালো।সূচি একটু শান্তির স্বাদ পাক।

_______________________

ফয়সাল এলো বেশ রাত করে।সাড়ে এগারোটায় বাড়ি এলো।সচরাচর এতো রাত হয় না।আজকেই হলো।কাজটা ইচ্ছাকৃত।খামারে খুব বেশি কাজ ছিল না আজ। কাজ শেষে এমনিই তপুর সাথে ঘুরে বেরিয়েছে এদিক-ওদিক।তপুর বোন তনুর জন্মদিন ছিল আজ।মেয়েটা সূচির বয়সী।জন্মদিন উপলক্ষে ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছিল ওদের বাড়িতে।অষ্টাদশীকে লালচে সাদা রঙের খুব সুন্দর একটা শাড়ি উপহার দিয়েছে ফয়সাল। শাড়ির দোকানে এরকম আরেকটা শাড়ি পছন্দ হয়েছিলো।ধবধবে সাদা শাড়ির আঁচলে টকটকে লাল বুনো ফুলের কাজ।এতো সুন্দর ছিল শাড়িটা! সূচির জন্যে নেবে নেবে করেও নেওয়া হয়নি।শাড়িটা খুব সুন্দর।কিন্তু মেয়েটাকে ঠিক মানাবে না।এতো সুন্দর শাড়িটা যদি না-ই মানায় তো নেওয়ার কোনো মানে হয় না।এই চিন্তা মাথায় আসতেই আর কিনলো না ফয়সাল।বন্ধুর সুন্দরী বোনের জন্য একটা শাড়ি কিনলো কেবল।তনুর উজ্জ্বল মুখ আর রিনরিনে হাসির ঝংকার দেখতে দেখতেই সারাক্ষণ কেটে গেল।তপুর মা আর না খাইয়ে ছাড়লো না।ফয়সালও আসতে চায়নি।সূচির চোখ থেকে পালাতে চেয়েছে।তাছাড়া, শান্তি থেকে কে অশান্তির আখড়ায় আসে? আনন্দে মজে থাকতে থাকতে কখন এতো রাত হয়ে গেল তা বুঝতেই পারলো না।

সূচি রোমেলা বানুর ঘরে ছিল।সারাদিনের কাজ শেষে চুপচাপ পা টিপছিল। রাজ্যের ঘুম তাড়িয়ে শ্বাশুড়ির সেবা করতে করতে ফয়সালের জন্য অপেক্ষা করছিলো। বিকালে যতো কিছুই হয়ে যাক,এতোক্ষণ অবধি স্বামীর একটা খবরও না পেয়ে মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলো সে।সাধারণত এতো দেরি হয় না লোকটার।আটটা-নয়টার মাঝেই বাসায় থাকে।আজ কী হলো?

ক্ষীণ শব্দ হলো দরজায়।সূচি ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো।শব্দটা কানে আসতেই এক লহমায় ঘুম পালিয়ে গেল।সোজা হয়ে বসলো সে।মন-মস্তিষ্ক সচল হয়েছে।ফয়সাল এসেছে।শ্বাশুড়ির পা থেকে হাত সরিয়ে চট জলদি উঠে আসার আগেই গম্ভীর স্বরের প্রশ্ন এলো তার দিকে,

” কই যাও বউ?”

” আপনার ছেলে এসেছে আম্মা।দরজা নক করছে।”

” আজকে এতো দেরি হইলো যে?”

” জানি না আমি।আমাকে কিছু বলেনি।”

” আচ্ছা, যাও।আর ফয়সালরে ডাইল দিয়ো না।এহনো রান্ধন-বাড়ন শিখলা না।ডাইলের নাম কইরা ছাগলের পেশাব রাইন্ধা থুইছো।বিশ্রী স্বাদ।তোমার মায়ে তোমারে কিছু শিখায় নাই।যতসব অলক্ষ্মী…

বিড়বিড় করে আরো অনেককিছু বলছিলেন তিনি।সূচি কান দিলো না।দমকা বাতাসের মতো প্রায় উড়ে চলে গেল দরজার সামনে।প্রিয়তমের চিন্তায় বিকালের অভিমানের পাহাড়টা ঠাই পায়নি।গুড়িয়ে গেছে মাটিতে।চঞ্চল হাতে ছিটকিনি খুলে উদ্বিগ্ন গলায় বললো,” কী হয়েছে আপনার? এতো দেরি হলো যে?”

সূচির সহজ কন্ঠ,অলক্ষুণে বিকালের কোনো উত্তাপ নেই।তার মানে ঘরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক।ফয়সালের মনের অবস্থাও খানিক স্বাভাবিক হলো।হালকা চালে বললো,” আগে ঢুকতে দাও ভিতরে।”

স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হুকুম করলো,” জুতোগুলো তুলে রেখো, সূচি।আর একটা গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট দিয়ো তো।পেটটা কেমন করছে।”

টানা বিশ মিনিট বাথরুমে কাটানোর পর ফয়সাল যখন বাইরে এলো,সূচি তখন চিন্তিত মুখে খাটে বসে আছে। ফয়সালকে দেখেই ট্যাবলেট বাড়িয়ে দিলো।চিন্তিত কন্ঠে বললো,” গ্যাস্ট্রিক বাড়লো কী করে?”

” কি জানি। পেটটা পাথর হয়ে আছে।”

” ব্যাথা করছে?”

” না।কিন্তু একটু অস্বস্তি হচ্ছে।মনে হচ্ছে বমি হলে ভালো লাগবে।”

” ঔষধটা খেয়ে ফেলুন।তারপর একটু ভাত খান।অনেক সময় খালি পেটেও এমন অস্বস্তি হয়।”

এক গ্লাস পানির সাথে টুক করে ট্যাবলেটটা গিলে ফেললো ফয়সাল।বিছানায় গা এলিয়ে বালিশে মাথা দিয়ে বললো,” আজকে আর কিছু খাব না।দাওয়াত ছিল, সেখানেই খেয়েছি।”

” কোথায় দাওয়াত ছিল?”

” তপুর বাসায়।তনুর জন্মদিন আজকে।আন্টি না খাইয়ে ছাড়লো না।”

” তেল, চর্বি খেয়েই পেটের এই অবস্থা।আপনি আমাকে একটা ফোন করলেই পারতেন।আমি তাহলে আম্মার সাথেই খেয়ে নিতাম।অযথা আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি।”

” আমি কী করে জানব,তুমি এখনো খাওনি?”

” আপনি আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না।আপনাকে ছাড়া কবে খেয়েছি আমি?”

এক পাতিল ডাল ফেলে দিতে হলো।তখন ঝোঁকের বশে ইচ্ছা করে বেশি হলুদ-লবন দিলেও এখন আফসোস হচ্ছে।কতগুলো ডাল নষ্ট হলো! অপচয় অপছন্দ সূচির।তবে যার উদ্দেশ্যে রান্না করা,সে একটু খেয়েছে।বাটিতে ডাল নিয়ে তাতে রুটি ভিজিয়ে মুখে দিতেই, চোখ-মুখের অবস্থা বদলে গেছে রোমেলা বানুর।বাটি উল্টে ফেলে দিলেন সূচির পায়ের কাছে।চোখ পাকিয়ে বললেন,” কী রাঁনছো এগুলা? মুখে দিয়া দেখো তো খাওয়া যায় কি না?”

মুখে দিতে হবে কেন? সূচি তো জানেই এগুলো খাওয়া যাবে না।তাই রান্নাঘরের জানলা দিয়ে শুকনো মাটির উপর ফেলে দিলো ডালগুলো।ভাত খেতে ইচ্ছা করছে না।একা একা ভাত খেতে ভালোও লাগে না।তাই আজ রাতে আর খাওয়া হলো না।ভাত,তরকারী মিটসেফে রেখে দিলো সুন্দর করে।এতো কষ্ট করে রান্না করা খাবারগুলো সব কাল সকালে ফেলে দিতে হবে।শ্বাশুড়ির কড়া নির্দেশ,এ বাড়িতে আবার বাসি-টাসি খায় না কেউ।একবেলারটা অন্যবেলায় খাওয়া ঘোর অন্যায়।সূচি একা খেতে পারবে না সব। কিছু না কিছু থেকেই যাবে।রোমেলা বানু নিজেই কাল সকালে ফেলে দেবেন এসব।তারা খুব জমিদার তো,উচ্ছিষ্ট কিছু মুখে রোচে না।

লাইট নিভিয়ে বিড়ালের মতো শব্দহীন পায়ে খাটে উঠে এলো সূচি। পাশেই ফয়সাল শোয়া।ঘুমায়নি এখনো।ঘন অন্ধকারেও সে বুঝলো,সূচি এসেছে।মনে মনে দুশ্চিন্তায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো।কে জানে, এখন আবার বিকালের অসমাপ্ত কেচ্ছা শুরু করে কি না মেয়েটা।

” ঘুমিয়েছেন?”

যা ভেবেছিলো, ঠিক তাই।আবার কিছু অপ্রিয় আলোচনার সূত্রপাত হবে। কোথাও একটু শান্তি নেই।সূচির প্রশ্নের উত্তর দিলো না ফয়সাল।কপালের উপর ডান হাতটা আড়াআড়ি ফেলে ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইল।
ফয়সালের নাটকটা ঠিক বুঝলো সূচি।অন্ধকারে হাতড়ে স্বামীর হাত কপালের উপর থেকে ফেলে দিয়ে বললো, ” আমি জানি আপনি ঘুমাননি।নাটক করছেন কেন?”

” রাত-বিরেতে ভাঙা রেডিও শুনতে চাইছি না তাই।”

” আমি ভাঙা রেডিও?”

“অবশ্যই। খালি নালিশ কর আর বাজে বাজে কথা বলো।”

বিকালের চিরচেনা রাগটা ফিরে আসছে।চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠার আগেই নিজেকে শক্ত করলো সূচি। কঠিন গলায় বললো,” কাল আব্বা আসবে।”

” ভালো কথা।”

” আমাকে নিতে আসবে।”

” তাই নাকি? তুমি বাড়ি যাবে?”

” হ্যাঁ।”

সূচির দিকে কাত হয়ে ফিরলো ফয়সাল।হাতের উপর মাথা পেতে বললো,” আম্মা জানে?”

” বলেছি একটু আগে।”

” কী বললো?”

” কিছুই বলেনি।মনে হয় এবার যেতে দেবে।”

“কতদিনের জন্য যাবে?”

” জানি না।কমপক্ষে এক সপ্তাহ তো হবেই।”

” আচ্ছা যাও,ঘুরে এসো।”

” আপনি যাবেন না?”

” না,আমার সময় হবে না।”

” আমার বাবার বাড়ি সৌদিতে না।রিকশায় দশ-পনেরো মিনিটের পথ মাত্র।”

” হোক।আমার এখন সুযোগ হবে না।”

” আচ্ছা, আপনার যেমন ইচ্ছা।”

কথার শেষে চুপ করলো সূচি।মনে মনে একটু খুশিই হয়েছে। থাকুক বাড়িতে।সূচিও এটাই চায়।স্বামী-শ্বাশুড়ি ছাড়া একটি সুন্দর ছুটির সপ্তাহ।আরামের মাঝে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেবে।
কিছু একটা মনে এলো সূচির।গম্ভীর গলায় বললো,” আপনাকে কিছু বলার আছে?”

” নালিশ আর অভিযোগ ছাড়া যেকোনো কিছু বলতে পারো।”

” আমি সবসময় নালিশ করি?”

” সন্দেহ আছে?”

” হাহ! খবরদার, মাথা খারাপ করে দেবেন না। শুনুন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি।আম্মা আমাকে আজকে কী বলেছে জানেন? যৌতুকের ইঙ্গিত দিয়েছে।আমার বাবার বাড়ি থেকে উপহারের নাম করে কিছু আনতে বলেছেন।”

” যাহ,মিথ্যা কথা। আমাদের কি কম আছে? তোমাদের বাড়ি থেকে আনতে হবে কেন?”

” ওই, আমি মিথ্যা বলছি?আম্মার নামে মিথ্যা বলে আমার কী লাভ?”

” সেটা তুমিই জানো।বউ-শ্বাশুড়ির যুদ্ধ এদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।আমার ঘর বাদ যাবে কেন?আম্মাকে আমার চোখে খারাপ বানানোর জন্যেও মিথ্যা বলতেই পারো।নিজের কানে না শোনা অবধি আমি কিছু বিশ্বাস করব না।”

ভয়ংকর রেগে গেল সূচি।ফয়সালের বুকের উপর নরম হাতের থাবা মেরে বললো,” শুধু বউ শ্বাশুড়ির যুদ্ধ না,আপনার ঘরে আরো অনেক কিছুই হয়।কিন্তু আপনি তো সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী, তাই কিছু চোখে পড়ে না।আম্মাকে আপনার চোখে খারাপ বানাতে হবে না।আপনি যে কত বড় মাতৃভক্ত ছেলে তা আমার বেশ জানা আছে। মায়ের কথায় বিয়ে করেছেন,জোর করে পেত্নীর সাথে সংসার করছেন, অশান্তি ভোগ করছেন,এগুলো পুরোনো খবর।মাতৃভক্ত ছেলের আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই।কাল সকালে নিজেই জিজ্ঞেস করে নিয়েন।কিন্তু খবরদার,কালকে আব্বা আসবে।তখন যেন এসব নিয়ে একটা আলোচনা না হয়।আপনি সকাল সকাল আম্মার সাথে কথা বলবেন। আব্বার সামনে এসব নিয়ে একটা কথাও আমি সহ্য করব না।”

ফয়সালের দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়লো সূচি।রাগে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে।মাথাটা টনটন করছে ব্যাথায়।অন্যদিন হলে ফয়সালকে চুলগুলো টেনে দিতে বলতো।আজ বললো না। আহত সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে করতে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
গায়ের উপর আলগোছে হাত তুলে দিয়েছিলো ফয়সাল।আগুনে ঘি পড়েছে যেন।এক ঝটকায় প্রিয়তমের হাতটা ছুঁড়ে ফেললো দূরে।বিরক্তিতে মেশানো কন্ঠ শোনা গেল ফয়সালের।

” ঘুমাতে দেবে না?”

” ঘুমান।আমি মানা করেছি?”

” হাতটা ছুঁড়ে ফেললে কেন?”

” মন চেয়েছে তাই।কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমান আর চুপ করুন।”

” সবসময় অশান্তি,বিরক্ত লাগে একদম।এই তুমি বাড়ি যাবে কবে বলে তো? আমি একটু শান্তি পাই।”– ফয়সালের কন্ঠে ক্ষোভ।সূচি শক্ত হয়ে শুয়ে রইলো। মোটেও পাত্তা দিলো না।তবে রাগের পারদটা বাড়ছে। বিকালের কথার জের ধরে কিছু শক্ত কথা বলার ইচ্ছা হচ্ছে।অপ্রিয় স্ত্রীকে ঘুমের সময় জ্বালাতন করতে হবে কেন? প্রশ্নটা জ্বিভের আগায় এনেও গিলে ফেললো সূচি।সবসময় ঝগড়া-বচসা করতে ভালো লাগে না।আবর্জনা যতো ঘাটে ততোই গন্ধ বেরোয়। কাল তো চলেই যাবে।আজ আর কোনোকিছু ঘাটাঘাটির দরকার নেই।

কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পরে আবারো সূচির গায়ে হাত-পা তুলে দিলো ফয়সাল।কিন্তু এবারেও পাত্তা পেল না।বিদ্যুতের মতো এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিলো মেয়েটা।।রাগে-ক্ষোভে খাটের উপর ডান পা দিয়ে একটা লাথিও দিলো ফয়সাল ।দুই অক্ষরের বাজে একটা গালিও বেরিয়ে এলো মুখ থেকে।কিন্তু না,এবারেও কাজ হলো না।ঘরে যান্ত্রিক ফ্যানের ক্যাটক্যাটে শব্দ ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই যেন।সবকিছু পায়ে ঠেলে নির্জীবের মতো পড়ে রইলো সূচি।বিয়ের প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে না? সেসময়ে ফয়সাল এমন নিরাসক্ত সন্যাসীর মতো পড়ে থাকতো বিছানায়।আর সূচির চোখে থাকতো এক আকাশ আকুলতা,কাতরতা।আজকের দৃশ্যপট একই রকম।শুধু চরিত্রগুলোর অদল-বদল।ফয়সালের জায়গায় সূচি,সূচির জায়গায় ফয়সাল।সত্যি মানুষের দিন কত দ্রুত বদলায়!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here