শুকতারা পর্ব-৪৩ ২

0
1500

#শুকতারা ( পর্ব-৪৩, বর্ধিতাংশ)
#হালিমা রহমান

ইশতিয়াকের ঘুম বরাবর পাতলা।বেঘোরে মরার মতো সে ঘুমাতে পারে না।আশেপাশে একটু শব্দ হলেই ঘুম ছুটে যায়।এবারেও তাই হলো।বেচারা ভাত খেয়ে উঠে সবে আধঘন্টা আগে ঘুমিয়েছে।ঘুমটা দুচোখে ভালোভাবে জেকে বসার আগেই পালিয়ে গেল। বাহির থেকে আসা অস্বাভাবিক তীব্র শব্দে এক লাফে উঠে বসলো সে।প্রথমে ভাবলো বুঝি ভূমির কিছু হয়েছে।যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করছে এমন করে।কিন্তু দু-চোখের পাতা থেকে ঘুমের রেশ কেটে যাওয়ার পরে বুঝলো ভূমি না,অন্যকেউ।বাইরে থেকে ভেসে আসছে চাপা গর্জন,গোটা কয়েক মানুষের সম্মিলিত ফিসফিসানি। মনে হচ্ছে তারা নিজেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করছে।কৌতুহলী হয়ে উঠলো ইশতিয়াক।টি-শার্টটা গায়ে চাপিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়লো উঠোনে।
ভূমির ঘরের সামনে দুটো চওড়া সিঁড়ি।সিঁড়ি পেরিয়ে ছোট্ট একফালি উঠোন।সেখানে নামতে হলো না।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মুখ বাড়িয়েই দেখলো তাদেরকে।জনা চারেক মানুষ।এর মাঝে তিন জনকে চিনলো ইশতিয়াক।এক ধারে দাঁড়িয়ে ফোসফাস করছে তার শ্বশুর, মমিন শেখ।তার পাশেই দাঁড়ানো রতন পাটোয়ারী। একটু দূরে বুকে দুটো হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল,তার পিছনে দাঁড়ানো আপাদমস্তক বোরকায় জড়ানো ছোট্ট-খাট্টো নারীটি অচেনা।তাকে সে কোনোদিন দেখেনি।ঝামেলার আশঙ্কায় তড়িঘড়ি করে সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালো ইশতিয়াক।শ্বশুরের দিকে চেয়ে বিনীত গলায় বললো, ” আসসালামু আলাইকুম, আব্বা।ঘরে আসুন,বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?”

মমিন শেখ তীব্র ঘৃণায় আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।পেশিবহুল শরীরের সাথে মানানসই তার লম্বাটে মুখ। সেখানে ফুটে উঠলো অসহনীয় ক্রোধ।আলগোছে তেরছা চোখে শ্বশুরকে মেপে নিল ইশতিয়াক।রাগে তার হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে।

” জামাই,সূচি আপনাগো কাছে আছে নিশ্চয়ই। তারে কষ্ট কইরা একটু ডাইক্কা দেন। তারপর আপনেরে আমরা আর বিরক্ত করুম না।”

বন্ধুর রাগ-গোস্বা বুঝতে পেরে কথাটা বললেন রতন পাটোয়ারী। আজ এখানে একটা ঝামেলা হবে তা বেশ বুঝলো ইশতিয়াক।অস্বীকার করার ইচ্ছা জাগলো।জোর দেখিয়ে বলতে ইচ্ছা হলো, ” না,সূচি আমাদের কাছে নেই।” কিন্তু ছেলেটার মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই।মিথ্যা আসে না তার জ্বিভে।তাই পানির মতো গড়িয়ে পড়লো মুখ দিয়ে, ” হ্যাঁ, সূচি আমাদের কাছেই আছে।ঘুমাচ্ছে বোধহয়।”

” দেখছেন অবস্থা! মমিন ভাই শুনছেন নিজ কানে?একটা অমানুষ জন্ম দিছেন ভাই।আমগোরে কুত্তার মতো দৌড় করায়া ভালো জায়গায় আইসা লুকাইছে।এরপরেও আপনে কইবেন এই মাইয়ারে আমি সংসারে রাখমু?এরপরেও আপনের মাইয়ারে মাইনষের ঘরে দেওয়ার লেগা সাফাই গাইবেন?”

ক্ষেপা কুকুরের মতো চিৎকার করেলেন রোমেলা বানু। তার গলার পর্দা সপ্তমে চরে আছে আগে থেকেই।আসরের নামাজ শেষ করে এদিকেরই জনা কয়েক মানুষ এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তার কোল ঘেঁষে ঘরে ফিরছিলো হয়তো। রোমেলা বানুর তীক্ষ্ম চিৎকারে আগ্রহীর মতো টিনের ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে চোখ দিচ্ছে।সবাই এদিকের মানুষ,হয়তো ফয়সাল নয়তো ভূমিদের প্রতিবেশী।দুই বাড়ি পরের মোখলেসের বাপ বাড়িতে ঢুকে কৃত্রিম বিস্ময়ের সুরে ইশতিয়াককে বললো, ” কি গো ইশতিয়াক,কিছু হইছে? চিল্লাচিল্লি কীয়ের এতো?এইটা কাজী বাড়ির ফয়সাল না?”

মোখলেসের বাপের পিছুপিছু আরো পাঁচ-সাতজন জোয়ান-বুড়ো এসে দাঁড়ালো বাড়ির আঙিনায়।গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কাজী বাড়িকে চেনে।অল্প বয়সেই বিশাল খামারের মালিক হওয়ায় ফয়সালও তাদের অচেনা নয়।যুগে যুগে অনেক কিছু আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু কলহপ্রিয় প্রতিবেশীর অমূলক কৌতুহলকে বিনাশ করার মতো অবিনাশী অস্ত্র এখনো আসেনি।পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি ঝামেলায় এরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখে, ঝগড়া না থামিয়ে অস্বস্তি দেয়,বিদায় নেওয়ার আগে হাওয়ার অনুকূলে লম্বা-চওড়া একটা মন্তব্য করে, সবশেষে পরেরদিন সোৎসাহে আরো দশটা কানে নিজের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেয়।
কয়েক জোড়া কৌতুহলী ও রাগান্বিত চোখের সামনে অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে ইশতিয়াক।সে অন্তর্মুখী মানুষ,ঝুট-ঝামেলা থেকে একশ হাত দূরে থাকাই তার স্বভাব। আশেপাশে নজর বুলিয়ে শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে আরেকবার বিনীত ভঙ্গিতে বললো, ” আমি ওকে ডাকছি আব্বা।আপনারা ঘরে এসে বসুন। ঘরের ঝামেলা বাইরের মানুষকে শোনানোর কোনো মানে হয় না।বসে ঠান্ডা হয়ে আস্তে-ধীরে কথা বললেই চলবে।”

ঘরের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল ইশতিয়াক।মমিন শেখ অন্যদিকে চেয়ে অদ্ভুত ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করলো।সে হয়তো রাগ চাপার চেষ্টা করছে।
রোমেলা বানু ছেলের মাথায় ডান হাতের বুড়ো ও তর্জনী আঙুলটা ঠুকে দিলেন সজোরে।সবাইকে শুনিয়ে ছেলেকে তিরস্কার করে বললেন, ” আরো আহ্লাদ করো বউরে নিয়া। তারে দশটা পর্যন্ত ঘুম পাড়ায়া দোকান থেকা নাস্তা আনায়া খাওয়ায়। এইবার বাড়িতে নিয়া আরো গোলামী কইরো বউয়ের। বলদের ছাও বলদ।”

ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আগ্রহী মানুষদেরকে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বললেন গুনগুনিয়ে।স্বভাবে শান্ত-শিষ্ট দেখে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েটাকে নিয়েছিলেন ঘরে।ছেলের পাশে মানায় না বউকে, তবুও সেই বউ নিয়ে মুখ বুজে সংসার করছে তারা।কিন্তু মেয়েটা কী আর ঘরের বউ হওয়ার যোগ্য? শুরু থেকে জ্বালিয়েছে তাদেরকে। এই চারটা মাসে জ্বালাতে জ্বালাতে তাদের হাড্ডিতে দাগ বসিয়ে দিয়েছে। তবুও একে নিয়েই সংসার করে যেতো তারা।কিন্তু আজ যা করলো! শাশুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়েছে,অভিশাপ দিয়েছে এমনকি একলা ঘরে ফেলে বুড়ো শাশুড়িকে মারধরের হুমকি দিয়েছে। এই দুর্ভাগ্য কোথায় রাখবেন রোমেলা বানু? এই নাগিনী নিয়েই বা কোন বুদ্ধিতে সংসার করবেন? অকারণে হাতের উল্টো পিঠে চোখ রগড়ে মুছলেন তিনি।উপস্থিত বাইরের মানুষদেরকে উদ্দেশ্য করে কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন, ” আমার মতো পোড়াকপালি আর একটাও নাই। বউগো এতো মন যোগায়া চলতে চাই কিন্তু তারা আমারে সহ্যই করতে পারে না।জোয়ানকালে জ্বালাইছে শাশুড়ি,এখন জ্বালায় বউয়েরা।আমার জীবনডাই গেল জ্বলতে জ্বলতে।”

উপস্থিত জনতার মুখে ” আহারে,আহারে” রব উঠে।কেউ কেউ তাল মিলায়,কেউ কেউ মমিন শেখের দিকে কটাক্ষ করে পারিবারিক শিক্ষার অভাবের কথাও বলে।তবে মুখে যে যাই বলুক উপস্থিত প্রায় সকলেই সূচিকে দেখার জন্যে উদগ্রীব। আগ্রহ বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। রতন পাটোয়ারী,রোমেলা বানু মনে মনে সময় গোনেন।মমিন শেখও ক্রোধে দরজার দিকে চেয়ে আছেন অবাধ্য আসামীর প্রত্যাশায়।এতোকিছুর মাঝে শুধু একজনই নিশ্চল,বড্ড বেশি শান্ত।ঝড়ের আগের গুমোট আকাশের মতো সে নিশ্চুপ।এক মাথা ধুলো-বালি নিয়ে অভুক্ত,অস্নাত ছেলেটা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মাটির দিকে। মুখের পেশিগুলো কঠিন,নিষ্ঠুর পুরুষের মতো টানটান।রোমেলা বানু হয়তো আজ ছেলের দিকে ভালোভাবে নজর দেননি।দিলে তিনি চমকে যেতেন।এতোদিনের লেলেপুলে বড় করা ফয়সালের সাথে আজ এই ফয়সালের আকাশ-পাতাল তফাৎ।
আজ সারাদিনে সে সত্যিই ব্যস্ত ছিল।খামারের কাজ নিতান্ত কম ছিল না।সকালে সেই যে হোটেলের দুটো পরোটা খেয়ে বেরিয়েছে,ফিরেছে বেলা সোয়া চারটায়।দীর্ঘ সময়ের মাঝে শুধু এক কাপ চা ও একটি ছোট্ট কেক গেছে পেটের ভিতর।সবজির দেখাশোনা,সার প্রয়োগ,আগাছা পরিষ্কার,নতুন বীজ বপন,পুকুর থেকে মাছ ধরা, জেলেদেরকে মাছ বুঝিয়ে দেওয়ার ঝামেলা শেষ করে ফয়সাল যখন বাড়ি ঢুকলো তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় প্রাণ তার ওষ্ঠাগত। সারাদিনে মাটির কাছাকাছি থাকতে থাকতে কাদা উঠেছে হাঁটু অবধি।চুলে,সারা গায়ে ধুলোবালি চিকচিক করছে।ঘরে ঢুকে কোনোদিকে না চেয়ে লম্বা লম্বা পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে হুকুম করলো,” সূচি,তাড়াতাড়ি ভাত দাও তো।”

পেটের ক্ষুধায় কোনোমতে গা,হাত-পা ডলে ঘরে পা রাখতেই নজরে এলো রোমেলা বানুকে।ওদের খাটে বসে আছেন পা ঝুলিয়ে,মুখটা থমথমে খুব। ফয়সাল কিছু বলার আগেই গর্জে উঠে বললো, ” তোর বউয়ে কী করছে জানোছ? সে বাড়িতে নাই।আমার মনে হয় সে বাপের বাড়িতে গেছে রাগ কইরা। তুই এই ছেড়িরে নিয়া আর সংসার করবি না ফয়সাল।আজকে গেছে যাক,তুই আর ফিরাও তাকাবি না।একবারে তালাক দিবি। ঐ বান্দির বাচ্চারে যেন…

” কী বলছো আম্মা? বাবার বাড়িতে গেছে মানে! কাকে জিজ্ঞেস করে গেছে? কেন গেছে?”

তখনকার ক্রোধ কমেনি রোমেলা বানুর।ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললো, ” হুমায়রার থেকা চায়া ভর্তা আনছে ভাত খাওয়ার লেগা।তুই সাহসটা চিন্তা কর একবার।এই ঘরে খাওন নাই? খাইতে মন চাইলে তৈয়ার কইরা খাইতে পারে না? তা না কইরা ঐ ছেড়িরতে গেছে আনতে।এতোবার কইছি ওর লগে মিশতে না তাও কথা শোনে না। ঐ হুমুর লগেই ওর গলায় গলায় পিরিত।দুইটা বেজন্মার জাত।হুমু যে সূচির কান ভারী করার লেগা এতো ভাও দেয়,ভালো সাজে, তা কি আমি জানি না?আমার সংসারের সুখ সহ্য হয় নাকি ওর? আমার পোলাডা..

অগত্যা আরেকবার থামাতে হলো রোমেলা বানুকে।কিছুটা অস্থির হয়ে কাতর গলায় ফয়সাল বললো, ” সূচিকে তুমি কী বলেছো তাই বলো আম্মা।বড় ভাবির কথা বাদ দাও।”

” তোর বউরে কি আমি খালি কথাই শুনাই? আমার কোনো কাজ নাই আর? কিছুই কই নাই।খালি রাগ কইরা ভর্তাগুলি ফালায়া দিছি আর জিগাইছি হুমুর থেকা ক্যান আনছে।বাবারে বাবা! এরপরে যা কইলো আমারে! আমি ফালাইছি ক্যান,আমি বুড়াকালে ভাত পামু না,আমি বেশি করি,আজকে একা ঘরে ওয় আমারে কিছু করব,আমি যেন বাড়াবাড়ি না করি— জারুনি হাজারটা কথা কইছে আমারে।শেষে রাগ কইরা কইছি আমার বাড়ি থেকা বাইরায়া যাইতে।ওরে আমি আর ঘরে ঢুকতেও দিমু না,এই বাড়িতে সংসারও করতে দিমু না।এই কথা নিজের কানেও ঢুকায়া নে।ওই ছেড়িরে কিন্তু আমি আর এই বাড়িতে পাও রাখতে দিমু না।ওয় যদি আর একবেলাও এই ঘরে আসে তাইলে আমি মাইরা ফালামু ওরে।ওর ছায়াও মারামু না।তোর যদি বউয়ের লেগা আহ্লাদ থাকে তাইলে বউয়ের হাত ধইরা ঘর থেকা বাইরায়া যাবি।আমার তিরিসীমানায় তোরে যেন আর না দেখি।কথাটা কানে ঢুকায়া নিছ।আয় এহন ভাত খাবি। ওর রাঁন্দা এক পাতিল ভাত ফালায়া দিয়া আবার নিজে রাঁনছি।আয় ডিম ভাইজ্জা দেই,ভাত খা।”

অভুক্ত, অসুস্থ বউকে হুট করে আক্রমণ করার কথাটুকু চেপেই গেলেন তিনি।কী দরকার এসব কথা বলার? এ তো ছোট-খাটো জিনিস।না বলাটাই ভালো।ডিম ভাজার জন্যে হালকা চালে হেলেদুলে চলে গেলেন রান্নাঘরে।যেন কিছুই হয়নি।ফয়সালের প্রতিক্রিয়া তখন ভিন্ন।ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে রাগে-উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে খাটে বসে পড়লো সে।মনে পড়লো আজ সকালেই সূচি বলেছিলো,বাড়াবাড়ি হলে সে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়বে। তাই করলো নাকি? সত্যি সত্যিই চলে গেল! খাটের কোণে বসে নিজের ঝাকড়া কোঁকড়া চুলগুলো শক্ত মুঠিতে আঁকড়ে ধরলো।পারিবারিক টানাপোড়েন, অসহনীয় অন্তর্জ্বালা,মা-বউয়ের সম্মিলিত গোয়ার্তমি দু’দিক থেকে টানা-হেঁচড়া করছে তার আত্মাটাকে। ঘরের ঝামেলা যেন শেষ হতেই চায় না।এই একটা জিনিস ক্ষত-বিক্ষত করছে তাকে।বসে বসে নিজেকেই বৃথা প্রশ্ন করে সে, ” এর শেষ কোথায়?”
বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেই নিজেকে শোনায়, ” আর না,এবার আমি সবকিছু থেকে মুক্তি চাই।”

এতো বছরের জীবনে এই প্রথমবার মায়ের কথার অবাধ্য হলো ফয়সাল।গায়ে শার্ট চাপিয়ে ভাত না খেয়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই পিছু ডাকলেন রোমেলা বানু।ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, ” কই যাছ?”

” সূচিদের বাড়িতে।”

” কী!! তোর এতো সাহস! আমি মানা করছি কিন্তু ফয়সাল।”

” কী বলছো আম্মা? কেন গেল তা জানতে হবে না?এতো সাহস ও কোথায় পেল তা তো শুনতে হবে।ছেড়ে দিব বললেই তো ছেড়ে দেওয়া যায় না।”

সেকেন্ডের মাঝে কিছু একটা ভাবলেন রোমেলা বানি।হয়তো একা একা ছেলেকে ও বাড়িতে পাঠানোর সাহস হলো না।তাই বললো, ” দাঁড়া, আমিও যামু।তোর শ্বশুরের লগে কথা আছে।”

এরপরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। সূচিদের বাড়িতে সূচিকে পাওয়া গেল না।মমিন শেখ,সাহিদা বেগম ফয়সালের মুখেই শুনলেন মেয়ের অন্তর্ধানের কথা।যে মমিন শেখ বেয়াইন ও মেয়ের জামাইকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন সমাদরের খাতিরে, সে মমিন শেখই রাগে আগুন হয়ে উঠলেন মেয়ের চূড়ান্ত অবাধ্যতার কথা শুনে। তিনি অতিরিক্ত শাসনে বিশ্বাসী।ছেলে-মেয়ের বয়স যতই হোক তাদেরকে লাঠির আগায় রাখাই কর্তব্য– এই তার স্থির বিশ্বাস।ছোট মেয়ের বেলায় এই শাসনটাই কখনো কখনো বাড়াবাড়ি হয়ে দাঁড়ায়।সূচিকে খুঁজতে বের হওয়ার আগে জয়া,মনি,চম্পা,রনি,রোমেলা বানু,ফয়সাল,আলেয়া বানু– সবার সামনে স্ত্রীকে ডেকে গর্জে উঠে বললেন, ” শু*** বাচ্চারে আজকে কবর দিমু পাইলে। নিত্য মরার চেয়ে একদিনে মরা ভালো।তোর চোখে যেন একফোঁটা পানি না দেখি।”

মুখে প্রকাশ না করলেও সবাই এক প্রকার নিশ্চিত,সূচি ভূমির বাড়িতেই গেছে।এছাড়া আর যাওয়ার জায়গা নেই।যাওয়ার পথে মমিন শেখ রতন পাটোয়ারীকেও নিয়ে নিলেন।সাহিদা বেগম একলা ঘরে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন।কেঁদে কেঁদে আর্জি জানালেন দয়াময়ের দরবারে, ” আমার সূচিরে রক্ষা করো খোদা। ওর বাপের হাত থেকা রক্ষা করো।”

_______________________________

সূচিকে অভয় দিয়ে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাইরে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো ভূমিকে।বারবার বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ” কিচ্ছু হবে না।ভয় পাবি না।ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আব্বাকে ভয় পাস তো? লাঠির ভয় তোর? নিজের ভয় নিজেকেই দূর করতে হবে। তোর ভয় আমি দূর করতে পারব না।আপার কথা শোন,ভয় পাবি না।তোর পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে।এখন তুই যত দুর্বল হবি,যত ভাববি,ভয় তোকে ততোই ভয় দেখাবে। চোখের পানি মুছ,কিছু হবে না।আমরা শুধু ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে যাচ্ছি বাইরে।এর বাইরে আর কিছুই হবে না।দেখি মাথা তোল।আর কাঁদবি না,ঠিকাছে?”

ইশতিয়াকও পুনরাবৃত্তি করলো বউয়ের কথাগুলো।সূচির দিকে চেয়ে বলিষ্ঠ স্বরে বললো, ছিঃ! কেঁদো না সূচি। ওরা তোমার চোখের পানি দেখলে ভাববে তুমি ভয় পাচ্ছো।তখন সবাই আবার চাপবে তোমাকে।মনকে শক্ত করো।এরচেয়ে আরো অনেক কঠিন সমস্যার মিমাংসা হচ্ছে।তোমার বিপদও কাটবে।ভাইয়া আছি তো।আর কেঁদো না।”

বোনকে শান্ত করে রান্নাঘর ছাড়ার আগে পিছু ফিরে একবার দেখলো ভূমি।সূচির ব্যবহৃত প্লেটটা পড়ে আছে অযত্নে।বোনের জন্য শখ করে রাঁধা জিনিসগুলো ঠান্ডা হয়ে অবহেলায় পড়ে আছে। ভূমির মনটা হাহাকার করে উঠলো।আহ! মেয়েটা সবে খেতে বসেছিলো। খাওয়ার সময়টুকুও মিললো না।দেহের মাঝে লুকিয়ে থাকা মনটা বারবার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, আজ ভয়ংকর কিছু একটা হবে।

কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখের সামনে বাইরে পা রাখতেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেল সূচি।বড় আপার উঠোনে এতো মানুষ কেন? সকালে যেই সূচি রাগে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে ঘর ছেড়ে ছিল,এখন সেই সাহসী সূচিটা হারিয়ে গেছে অতলে।বাবাকে সে সত্যিই ভয় পায়।তাই তো জন্মদাতার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না।গোলগাল,ভারী শরীরের বড় আপার পিছনে লুকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সে। ভূমি যেন রক্ষা প্রাচীর, সযত্নে রক্ষা করবে ভীতু বোনকে।
সবাই দেখলো সূচিকে। রোমেলা বানুর গলাটাই শোনা গেল আগে।গলা বাড়িয়ে মুখ-চোখ খিঁচিয়ে বললেন, ” আইছো নবাবের বেটি? আর কত রঙ-তামাশা করবা? আর কত মুখে চুনকালি লাগাইবা? আজকে এতোগুলি মাইনষের সামনে তোমার বাপের মুখও পোড়াইছো,আমার মুখও পোড়াইছো।এহন আবার বইনের পিছে পিছে আইছো ভিজা বিড়াল সাইজ্জা! মুখ দেখলে মনে হইব ভাজা মাছটাও খাইতে জানো না।অথচ,তুমি যে কত বড় কালনাগিনী তা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।হুহ! কালীরে কালী কত রঙ্গ দেখাইলি।”

সূচি কোনো কথা বললো না।ভূমি নিতান্ত অবহেলায় একবার রোমেলা বানুকে আপাদমস্তক মেপে মমিন শেখের দিকে চেয়ে বললো, ” আব্বা ঘরে এসে বসো। অনেক কথা বলার আছে,বাইরের মানুষের সামনে সিনক্রিয়েট করার ইচ্ছা নেই।রতন কাকা আসুন,ফয়সাল তুইও আয়।”

রোমেলা বানুকে পাত্তা না দেওয়ায় মনে মনে অসম্মানিত বোধ করলেন তিনি।পিছন থেকে ছেলের পিঠ খামচে বললেন, ” যাবি না তুই।”

সূচিকে চোখের ইশারায় ঘরে ঢুকার ইঙ্গিত দিয়ে নিজেও ঢুকতে যাবে,এমন সময় বাবার গর্জনে থমকে গেল তার পা।মমিন শেখ চিৎকার করে সূচিকে ডেকে বললেন, ” আর এক পাও দিবি না তুই ঐ ঘরে।চল বাড়িতে চল।তোর লগে অনেক হিসাব আছে।”

ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলো সূচি।বোনের ওড়নার আঁচল খামচে বললো, ” আমি যাব না।”

” তুই যাবি না তোর ঘাড়ে যাইব।চল কইতাছি সূচি,ভালোয় ভালোয় কইতাছি এহনো।তাড়াতাড়ি চল।”

” আপাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।তোমার সাথেও যাব না,কাজী বাড়িতেও যাব না।আমি আর ওর সংসার আর করব না।ওরা মানুষ না।”

ধক করে জ্বলে উঠলো ফয়সালের চোখ দুটো।স্থির দৃষ্টি পাতা বউয়ের উপরে,বুকের উপরে হাতের ভাঁজ আরো দৃঢ় হলো। রোমেলা বানু গর্জে উঠে বললেন, ” হ তা তো কইবাই।এহন আর আমগোরে ভাল্লাগব ক্যান? জামাইরে হাতের মুঠের মইধ্যে পাইলেই তো ভাল্লাগতো।তুমি তো চাও বইনের মতো সংসার।হাত করা জামাই ছাড়া আর কেউ থাকব না।সারাদিন তারে লইয়াই নাচবা,বুড়া শাশুড়ি মরুক গা।নষ্টা বইনের কাছে আইছো সেই সকালে,

” খালাম্মা মুখ সামলে।আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীকে অসম্মান করার সাহস হয় কী করে আপনার? খবরদার আর একটা বাজে কথা যেন না শুনি।”— রোমেলা বানুর কথার মাঝে গমগম করে উঠলো ইশতিয়াকের পুরুষালি কঠিন গলা।
রেগে গেলেন রোমেলা বানু।ছেলের হাত মুঠোতে পুরে বললেন, ” ফয়সাল, চল এই বাড়িতে আর না।এই ছেড়িরে আর দরকার নাই।”

সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল ফয়সালের উপরে।কিন্তু সে নড়লো না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিমসানো মুখে চেয়ে রইলো সূচির দিকে।মজা দেখতে আসা কেউ কেউ বুদ্ধি দিলো, ” যাও গা,মায়ের কথা অমান্য করতে নাই।তোমার বউয়ে চূড়ান্ত অসিব্য।”

ফয়সাল কিন্তু এবারেও নড়লো না।কেবল দৃষ্টিটা ঘুরে গেল। মায়ের হাত ছাড়িয়ে স্থির হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো ভূমিদের একফালি উঠোনে।ছেলের এই অসংলগ্ন অবাধ্যতায় কথা জাগলো না মায়ের মুখে।রোমেলা বানু কেবল হতভম্বের মতো চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে।
ভূমি ও ইশতিয়াক আঁড়চোখে নজর দিচ্ছে ফয়সালের দিকে।সূচিও বেশ অবাক।ভেবেছিলো স্বামী শাশুড়ির কথা মেনে চলে যাবে,সে একটু শান্তিতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।কিন্তু তা তো হলো না।ডর-ভয় ভুলে পরিবর্তিত স্বামীর দিকে সেও নজর দিচ্ছে বারবার।

আচমকা এক কান্ড ঘটলো।সবার মনোযোগ যখন ফয়সালের দিকে,তখন মমিন শেখ হুট করেই বাঘের মতো লাফিয়ে গেলেন দু’পা সামনে।অমনোযোগী সূচি তার কয়েক হাতের মধ্যেই ছিল।মেয়ে-মেয়ের জামাই,বেয়াইন, বন্ধু,বাইরের লোক– সবার সামনেই সূচির চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে এলেন নিজের দিকে।কেউ কিছু বোঝার আগেই মেয়ের পিঠে দুমদাম কয়েক ঘা বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” বান্দির বাচ্চা, চল আজকে বাড়িতে।তোর হাড্ডি-মাংস এক করুম আমি।চল আমার লগে।অনেক পাও বাড়ছে না তোর? আজকে কাইট্টা কুত্তারে খাওয়ামু।”

কী থেকে কী হয়ে কেউ বুঝতেই পারলো না।যখন বুঝলো তখন অবস্থা বেগতিক।সূচির মেরুদন্ডে গোটা কয়েক শক্ত হাতের কিল পড়েছে ততোক্ষণে।মেয়েটা বেঁকে গেছে।ঘন চুলের গোড়া মমিন শেখের হাতের মুঠোয়।টান মেরে ধরে রেখেছেন তিনি।সূচি এক হাতে চুল বাঁচাচ্ছে,আরেক হাতে বাবার বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে সরানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎ আক্রমণে অবাকের রেশে শুরুতে যন্ত্রণায় একবার মাত্র চিৎকার করেছে সে।তারপরেই থেমে গেছে।মুখে কথা নেই,হাত দুটো আপন চেষ্টায় মত্ত।সে এসবে অভ্যস্ত।

” মেরে ফেললো, মেরে ফেললো আমার সূচিকে!ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।তুমি মানুষ না।”– ভারী শরীরে এখন আর আগের মতো ছুটতে পারে না ভূমি।তবুও কেঁদে কেঁদে দৌড়ে আসছিল।তার আগেই যেন উড়ে এলো ইশতিয়াক।শ্বশুরের হাত ঝাঁকিয়ে ছাড়াতে চাইলো সূচিকে। ওদিক থেকে রতন পাটোয়ারীও এলো ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কাটিয়ে।উপস্থিত জনতাও হায় হায় করে উঠলো।কেউ কেউ এগিয়ে এলো।বাকিরা পিছে দাঁড়িয়ে ” ছাড়ো, ছাড়ো ” রব তুললো।চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে গোটা কয়েক মহিলাও জড়ো হয়েছে উঠোনে।সবাই হা করে চেয়ে আছে হাতাহাতির দিকে।এতোকিছুর মাঝে কেবল ফয়সালই নিশ্চুপ,আগের মতোই মাটির দিকে চেয়ে আছে।
ওদিকে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে ততোক্ষণে।মমিন শেখ আকাশ ছোঁয়া রাগে পশু হয়ে গেছেন যেন।ইশতিয়াক,রতন পাটোয়ারী, ভূমি যত ছাড়াতে চায় তার হাতের মুঠো ততো আঁকড়ে ধরে মেয়ের চুল।পিঠের উপর আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছেন না এখন আর।তবে ফাঁকটুকু পুষিয়ে নিচ্ছেন বিস্তর গালিগালাজের মাধ্যমে। চিৎকার করে সূচিকে বকছেন। মেয়ে আজ দুটো অপরাধ করেছে।প্রথমত কাউকে কিছু না বলে বাড়ির বাইরে পা দিয়েছে,দ্বিতীয়ত সে আশ্রয় নিয়েছে ভূমির বাড়িতে।দুটোই মমিন শেখের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ।অতএব দন্ড বিধান কর্তব্য। তিন জনে যতই চেষ্টা করুক না কেন মমিন শেখকে ছাড়াতে পারছে না কিছুতেই। তার শরীরে আজ দানব ভর করেছে যেন।ওরা তিনটে মানুষ পারবে কেন?
মনে হচ্ছিলো এই টানাটানি আজ শেষই হবে না।কিন্তু সবকিছুর যেমন শেষ হয়,তেমনি এরও শেষ হলো।নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় সূচি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ঠিক তখনই এক অদ্ভুত ভয়ংকর কাজ করলো সে। চেপে রাখা ঠোঁট দুটো মেলে পিচ করে এক দলা থু থু ছুঁড়ে মারলো বাবার গায়ে।চেহারাকে উদ্দেশ্য করে মারলেও নাক-মুখে বিছিয়ে পড়লো না তা।পড়লো ডান গালের নিচের দিকে, হাফ হাতার ফতুয়ার ডান কাঁধে। মুহূর্তেই সব নিশ্চুপ হয়ে গেল।ইশতিয়াক,রতন পাটোয়ারীর হাত থেমে গেল।ভূমি অবাক চোখে চেয়ে রইল বোনের দিকে।মমিন শেখের হাত থেকে ছুটে গেল সূচির চুলের গোড়া।মুখের ময়লা মুছার অবসরটুকু মিললো না।মমিন শেখ বাতিকগ্রস্তের মতো বললো, ” তুই আমারে ছ্যাপ মারলি! তুই! আমার ঘরে জন্মায়া আমারে মারলি?”

এতোক্ষণের ধস্তাধস্তিতে শাড়ির আঁচল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো সূচির।এতোগুলো বিস্মিত চোখের সামনে সে আগে সারা গা ঢাকলো।একটা অপ্রত্যাশিত তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়লো ওর ঠোঁটের চারদিকে।অকারণে খুব জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ” হ্যাঁ, মারলাম। সজ্ঞানেই থু থু মারলাম।তোমার হাত যদি এতো চলতে পারে তো আমি এতুটুকু এগোতে পারব না? আমার একটুও আফসোস নেই।কাজটা আরো আগে করলে তোমার হাতটা আরো আগেই থামতো।”

চারদিকে কবরের নিস্তব্ধতা।ঠোঁটের কোণে হাসি,চোখের কোল বেয়ে ঝরছে জল।শেষ বেলার হলদে আলো মুখের একাংশে ছড়িয়ে পড়ে তাকে দেখাচ্ছে এক কথা কওয়া মাটির মূর্তির মতো। পিঠে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো কাঁধের উপরে এনে হাত বুলিয়ে নিলো সূচি।ছোট বাচ্চাদের মতো হাত বুলিয়ে রুক্ষ চুলগুলোকে আদর করলো কিছুক্ষণ।মেয়েটা যেন পাগল হয়ে গেছে আজ।

” কিছুদিন যাবৎ আমার জ্বর।অনেক জ্বর।রাতেরবেলা জ্বর এসে আমার সারাটা শরীর থেতলে দেয়।তবুও কাউকে কিছু বলিনি।যেই জানোয়ারটার সাথে আমি থাকি,সে শুধু জানে আমার শরীর খারাপের কথা।জ্বর এলেই একটা নাপা খাইয়ে দেয় আর প্রতিদিন সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে।কিন্তু আর নিয়ে যায় না।আমি প্রতি রাতে কষ্ট করে সকালে উঠে কামলা খাটি ওর ঘরে।ও তাতেই খুশি।তাই তো আমার শরীর খারাপের কথা ওর মনেই থাকে না।আমিও মুখ ফুটে বলি না।তিনবেলা খাইয়ে পরিয়ে যে খোঁটা দেয় তাকে কেন বলব? আমি ওর কাছে আর কিছুই বলব না। আমার শাশুড়ি এক ঘাট এগিয়ে।সে কিন্তু আমার মুখ দেখে বুঝে সব কিন্তু তাও না বোঝার ভান করে। শাসনের নামে সারাদিন করে মানসিক অত্যাচার। আমার চৌদ্দপুরুষ ধরে টান মারে যখন তখন।তার জ্বিভের বিষে আমার মন মরে গেছে আরো আগেই। যা আছে তা মন ছাড়া শরীর।রক্ত-মাংসের জোরে চলছে এখনো।বড় আপার সাথে আমাকে মিলাও তো আব্বা।কেমন দেখায়? আপাকে যেমন পরিপূর্ণ মানুষের মতো দেখায় আমাকে তেমন দেখায়? একটুও না। আমি নিজেই আয়নার দিকে তাকাই না।বিশ্রী লাগে,নিজেকে দেখলে ঘৃণা হয়।”

এতোগুলো কথা বলে দম নিলো সূচি।নিজের কথা বাবাকে শোনাচ্ছে নাকি নিজেকেই শোনাচ্ছে তা বোঝা গেল না।সবার চোখ জোড়া তার উপরে হলেও বিচলিত হলো না সে।চোখ মুছে বললো, ” ঐ বাড়িতে শুধু বড় ভাবি আমাকে ভালোবাসে।সে আমার খবর নেয়।কাল রাতে জ্বরে ঘুমাতে পারিনি।সকালের দিকে ঘুমিয়েছি।উঠেছি সাড়ে আটটায়।আমার শাশুড়ির মুখ ছুটেছে তখন। ফয়সাল নাস্তা এনে দিলো।জ্বরের মুখ, আমার ভালো লাগে না খেতে। খালি পেটে মেজাজটাও খিঁচড়ে ছিল।ওকে বলেছিলাম আম্মাকে থামাতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছিলাম কিন্তু ও বিশ্বাস করেনি।হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।ভেবেছে বাড়াবাড়ি হলেও আমি মাটি কামড়ে পড়ে থাকব।ছিঃ! আমার আত্মসম্মান এতোই কমে গেছে? কখনো না।
আমি কালকে রাতেও খাইনি,আজ সকালেও খাইনি।বড় ভাবি আদর করে একটু ভর্তা দিয়েছিল ভাত খেতে।জ্বরের মুখ, ভালো লাগবে আমার।আমার শাশুড়ি কী করলো জানো? আমার সকালের খাবারটুকুই ছুঁড়ে ফেলে দিলো।সকালে একগাদা কাপড় ধুয়ে আমি তখন ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছি।আমার শুকনো মুখ দেখেও তার দয়া হলো না। বড় ভাবি দিয়েছে এটাই আমার দোষ।ওনার সাথে বড় ভাবির বনিবনা নেই বলে আমিও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখব।কত আবদার! এই বড় ভাবির ঋণের একাংশও আমি শোধ করতে পারব না। পায়ের কাছে সকালের খাবারকে গড়াগড়ি করতে দেখে আমার পায়ের রক্ত মাথায় চরে গেল।উনি আমাকে বকেছেন আমিও মুখে মুখে কথা বলেছি।এর জন্যেও আমার আফসোস নাই।”

” কত বড় কইলজা তোমার তা এইবার চিন্তা করো।নিজে বেদ্দপি করছো আবার একদল মাইনষের সামনে স্বীকারও করতাছো! এমন নির্লজ্জ মাইয়া মানুষ আমি আর দেখি নাই।লোক না হাসায়া আর বাঁচলা না তুমি।”– এতোক্ষণে রোমেলা বানুর গলায় স্বর ফুটলো।ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন ও-ধারে।

” আমার ন্যায়-অন্যায় আমি সব বলছি।আপনার মতো নিজের দোষ ঢাকছি না।আপনি যে আমাকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছেন তা বলেছেন কাউকে? আমাকে আঘাত করার কথাটা কেউ জানে? এখন কথা বলেন না কেন? আবার ওভাবে চেয়ে আছেন যে! আমি মিথ্যা বলছি? আপনি আমাকে মারেননি?”

ভূমি ছাড়া সবার চোখ দুটো ঘুরে গেল রোমেলা বানুর উপর।ফয়সাল মায়ের দিকে চেয়ে রইলো নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। সেখান রাগ,ক্ষোভ, হতাশা– সবকিছু মেশানো। এতোগুলো দৃষ্টির মাঝে সহসা সংকুচিত হয়ে গেলেন তিনি।মাথা নেড়ে অস্ফুটে বললেন, ” মিথ্যা কথা,সব মিথ্যা কথা।তুমি আমার নামে মিথ্যা কইতাছো।আমি মারলে দাগ থাকব তোমার শরীরে।দাগ দেখাও,দাগ দেখাইলে বিশ্বাস করুম।”

সূচির আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠলো ভূমি।নাকের পাটা ফুলিয়ে বললো, ” হ্যাঁ, হ্যাঁ সব মিথ্যা।আপনারা একাই সত্যবাদী আর আমরা সবাই মিথ্যা বলছি।জুতো ছুড়ে মারলে দাগ হয় কখনো? আরেকজনের মেয়ের দিকে তো মারতে কষ্ট হয়নি।নিজের ছেলের মুখে মেরে একবার মেরে দেখুন দাগ হয় কি না।তারপরে বলতে আসবেন।আর শরীরে দাগ থাকলে আপনার মনে হয় আপনি এখনো এখানে দাঁড়াতে পারতেন? মোটেও না।আমার বাড়িতে না, আপনাদের সাথে আমাদের থানায় দেখা হতো।”

ভূমির কথায় আরেক দফা অপমানিত বোধ করলেন রোমেলা বানু।নিজের স্বরে গুনগুনিয়ে কাঁদার ভান করলেন।আশপাশের মহিলা মহল তখন একে-অন্যের গা টেপাটেপি করছে।ভীরের মধ্য থেকে কে যেন বললো, ” মাইয়ার বইনে এতো কথা কয় ক্যান? মাইয়ার জামাই আছে,বাপ আছে,দুলাভাই আছে,শাশুড়ি আছে,বিয়ার ঘটক আছে–আর কেউ তো কথা কয় না।তাইলে ঐ ছেড়ি এই বুড়া মাইনষের মুখের উপরে কথা কয় ক্যামনে? আদ্দব- কায়দা নাই?আর এমন পোয়াতি সোমত্তা মাইয়া এতো বড় পেটটা নিয়া এতো মাইনষের সামনে বাইরেই আইছে ক্যামনে?লজ্জা-শরমও দেহি নাই।”

কথাটা কানে আসতেই ভীরের দিকে আগুন চোখে চাইলো ভূমি।রাগের মাথায় ইচ্ছা করলো মহিলার গলা টিপে ধরতে। রোমেলা বানুর গুনগুনানি বেড়েছে এখন।সূচির দিকে চেয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললেন, ” তুমি যে এক উঠান মাইনষের সামনে আমারে এমনে অপমান করবা,তা আমি কল্পনাও করি নাই।আমি একটু কঠোর তা এই দিকের সবাই জানে।কঠোর না হইলে জামাই মরার পরে পোলাপাইন দুইটা নিয়া টিকতে পারতাম না।হাসতে পারি না,অন্য মহিলাগো মতো বউগো লগে মিশতে পারি না, একটু শাসন করি,বুড়া হইছি, হাজারটা রোগে মেজাজ খারাপ থাকে দেইক্ষা একটু খিটমিট করি– এগুলা কি আমার দোষ? আমি তো তোমার মায়ের মতোনই।তোমার মায়ে তোমার লগে এমন করলে সহ্য করতা না? কও তুমি, করতা না? নাকি এমন কইরাই এক উঠান মাইনষের সামনে অপমান করতা? আজকে আমি পরের মা বইল্লা শাসন করতে পারুম না, দুইটা কথা শুনাইতে পারুম না। তোমার সহ্য হয় না।তোমার নিজের মা হইলে দেখতা ঠিকই সহ্য হইতো।বাইরের মাইনষের সামনে আমার ঘরের বউ আমার নামে বিচার বসাইছে!খোদা, এই দিন দেখার আগে আমারে মরন দিতো। আচ্ছা সূচি,তুমি কোরান শরীফ ছুঁইয়া কও তো আমি কি তোমারে মারছি?কথা কাটাকাটির বেশি আর কিছু হইছে আজকে সকালে? যাও ঘর থেকা কোরান নিয়া আসো। ছুঁইয়া কও। যত কইতাছো ততো জীবনেও করি নাই আমি।করলে এই চাইর মাস একলগে সংসার করতে পারতাম না।তুমি যা মাইয়া, আমারে ঘরে ফালায়া জবাই দিতা। জীবনেও মুখ বুইজ্জা সহ্য করতা না।”

” এটা সত্যি বলেছেন।মুখ বুজে সহ্য করার মতো ওতো ভালো মানুষ আমি না।আমি শুরু থেকেই আপনাদের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছি।কিন্তু পারিনি শুধু আমার বাপের জন্য।আপনারা জানতেন আমি আব্বাকে ভয় পাই।তাই কিছু থেকে কিছু হলেই তার কাছে ফোন চলে যেতো বিনিময়ে আসতো আমার উপরে শাসন।”
মমিন শেখের দিকে ঘৃণাভরে চাইলো সূচি।ভরাট গলায় বললো, ” আব্বার মতো শত্রু আমার দ্বিতীয়টা নাই।তাকে যতোটা ঘৃণা করি ততোটা আপনাকেও করি না আম্মা। স্রেফ আব্বার ভয়ে আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।এছাড়া আর কিছু নয়।আপনাদেরকে ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে আমি নই।আপনি আমার মায়ের সাথে নিজের তুলনা দিলেন।কিন্তু আপনি কি কখনো আমার মা হতে চেয়েছেন? সত্যি করে বলুন তো। আপনি শাশুড়ি হতে চেয়েছেন, মা না।আমাকে মেয়ে ভাবতে পারলে আমিও আপনাকে মা ভাবতে পারতাম।আর কোরান শরীফ ছুঁয়ে বলতে বললেন না? তার আর দরকার নেই। কাউকে বিশ্বাস করানোর গরজ নেই আমার। সেই দিন ফুরিয়েছে।কিন্তু দোয়া করি, যেই কর্তৃত্বের জন্য আপনি আমার সাথে জোর-জবরদস্তি করতেন,যা আপনার স্বভাব,তা যেন চিরকালের মতো ঘুচে যায়।ভবিষ্যতে যেন আপনাকে আমার মতোই সবকিছু মুখ বুজে মেনে নিতে হয়।আমার কথা যেমন আপনারা কেউ শোনেন নাই, তেমনি আপনার কথাও যেন কেউ না শোনে।”

ছোট বোনের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো ভূমি।সূচির চোখ দুটো ভালো করে মুছে দিয়ে সস্নেহে বোনের চুল গুছিয়ে দিয়ে বললো, ” চল ঘরে চল।দুপুরের খাবারটাও খেতে পারিসনি এখনো।আবার জ্বর আসবে মনে হচ্ছে।ঘরে যেয়ে শুয়ে থাকবি চল। আর কাউকে ভয় পেতে হবে না,কারো কথা মাথায় রাখতে হবে না।”– বোনকে বলে নিজের বাবার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো ভূমি।লোকটা কাছেই দাঁড়ানো।চুপচাপ,থমথমে মুখ।ভূমির দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে সে চেয়ে আছে সূচির দিকে।

ভূমির কথা শুনলো না সূচি।ফয়সালের দিকে চেয়ে ভাবগ্রস্তের মতো বললো, ” বিয়ের এই কয়েকটা মাসে কিছুই তো মুখ ফুটে চাইনি।আজ একটা জিনিস চাইব।আপনাকে দিতেই হবে নয়তো আমি দাবি ছাড়ব না।আমাকে মুক্তি দিন।আপনি আমার যোগ্য না।এ কথাটা বিয়ের আগে বুঝতে পারলেই ভালো হতো।আপনিও বেঁচে যেতেন, আমিও বেঁচে যেতাম। আমাকে তালাক দিয়ে ভালো-ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট কোনো মেয়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করুন।সে হয়তো আমার মতো মনের শান্তির জন্য কাউ কাউ করবে না।আপনার দিন কেটে যাবে।আমিও আমার রাস্তায় চলব।মানুষের মতো বাঁচার চেষ্টা করব। এতোদিনে এটা বেশ ভালো বুঝেছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে চেপে দিন কাটালে কিছুতেই জীবনের রস পাওয়া যায় না। আজ আমার একটা পরিচয়,একটা কঠিন ব্যক্তিত্ব থাকলে কিছুতেই আপনি আমাকে দুঃখ দিতে পারতেন না।নিজের অপূর্ণতায় নিজেই কষ্ট পেয়েছি।আপনার বিরুদ্ধে তাই আর কোনো অভিযোগ নেই। হয়তো আপনি আমাকে ত্যাগ করুন নয়তো অপেক্ষা করুন। আমি তো আর এসব বুঝি না।আপা সুস্থ হোক।তারপর ডিভোর্স লেটারটা আমিই পাঠাব।”

একদমে কথাগুলো বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সূচি।

” আর একটা কথাও বলো না,ঘরে চলো এবার।”– ইশতিয়াকের কথাটাও যেন কানে ঢুকলো না সূচির।অদ্ভুত এক বাচালতা পেয়ে বসেছে ওকে। এতোদিন কেউ কথা শোনেনি আজ সবাইকে শুনিয়ে ছাড়বে সব।দু-হাতে চোখ-মুখ মুছে আবার বললো, ” আমি বড় আপার কাছেই থাকব।আমি ক্লান্ত এখন। আর ভালো লাগে না।আপনাদের জন্যেও আমি বিপজ্জনক। আমার মাথাটা এখন আর কাজ করে না।ভালো-মন্দ ভাবনাগুলো গুলিয়ে যায়।সারাদিনের খাটুনি শেষে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে যখন আম্মার পা টিপতাম, তখন মাঝে মাঝে ইচ্ছা করতো বালিশ চেপে তাকে খুন করি। গলাবাজি করার সময় কত দিন ইচ্ছা করেছে বটির একটা কোপ বসিয়ে দিতে! আপনি যখন আমাকে বুঝতে চাইতেন না তখন আপনাকেও খুন করতে ইচ্ছা করতো।এখন যেমন আব্বাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে, ঠিক তেমন। তোমার ভাগ্য ভালো আব্বা আজ আমার হাতের কাছে ধারালো কিছু নেই। থাকলে দেখতে,বাবা-মেয়ের অস্বাভাবিক সম্পর্কের পালাটা আজ চুকিয়ে দিতাম।”

” ইয়া মাবুদ,ছেড়ি দেহি পাগল।এই পাগল নিয়া সংসার করছে ক্যামনে এতোদিন?”– চারদিকের চাপা গুঞ্জনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মমিন শেখ।এতোক্ষণ কোনোমতে নিজেকে সামলাতে পারলেও এবার আর পারলেন না।সূচির দুঃসাহসিক কথা ও ডিভোর্সের উল্লেখ তাকে দিশেহারা করে দিলো একদম।নিজের সম্পর্কে এতোকিছু ভাবার সাহস ও কোথায় পেল? কতটুকু বয়স ওর? কে ওর মাথাটা খেয়ে দিল? তবে এবার আর সূচিকে আঘাত করার সাহস হলো না।হাতের কাছে ছিল ভূমি।সহসা ভূমির গালেই শরীরের সব জোর খাটিয়ে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলেন। ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, ” এই এক বেলায়ই মাথাটা খায়া দিছোছ ওর? এই বা* পাকনামি তুই শিখাইছোছ না? ক্যান করলি এরকম? আবার আমার মুখ পুড়াইলি ক্যান?”

সতর্ক ছিল না মেয়েটা।চড়টা পড়লো বাম গালে। নাকের উপরেই বাবার হাতটা পড়েছে।লোহার হাতটা মনে হয়ে ভেঙে দিয়েছে নাকের নরম হাড়। কনিষ্ঠ আঙুলের নখের কোণটা বিঁধেছে চোখের কোণে। অসুস্থ ভূমি সহ্য করতে পারলো না।এক চড়েই কাবু হয়ে চোখ-নাক ঢেকে বসে পড়লো মাটিতে।

” এক্ষুণি,এক্ষুণি আপনি বেরিয়ে যাবেন বাড়ি থেকে।আপনার সাথে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই।আপনি মানুষ খুন করতে পারবেন।বেরিয়ে যান বলছি।”

পাগলের মতো চিৎকার করে বউয়ের কাছে যেয়ে বসে পড়লো ইশতিয়াক।আগেই বলেছি ভূমির ব্যাপারে ও সবচেয়ে স্বার্থপর। যন্ত্রণায় কাতর ভূমির মুখটা বুকে পুরে কাতর গলায় বললো, ” খুব বেশি লেগেছে? চলো ঘরে চলো।কেন যে এই অসুস্থ শরীরে তুমি বাইরে বেরিয়ে এসেছো।আমরা কি ছিলাম না? তোমাকেই কেন ব্যস্ত হতে হবে?”

ফয়সাল কখন এসে সূচির পাশে দাঁড়িয়েছে তা কেউ বুঝতে পারেনি।ভূমির দিকেই নজর ছিল সবার। বউয়ের হাত টেনে সে বললো, ” বাড়ি চলো।”

চকিতে লাফিয়ে উঠলো সূচি।অনবরত মাথা নেড়ে বললো, ” কখনো না।”

” চলো।অনেক হয়েছে, আর না।”

” এরপরেও, এরপরেও আপনি আমাকে বাড়ি যেতে বলবেন? কী বললাম এতোক্ষণ?”

” তুমি বাড়ি যাও না ভাই। এখন কেন এসেছো? একটু আগে বউ যখন মার খেয়েছে তখন তো দেখলাম না।এখন এসেছো দরদ দেখাতে? তোমার মাকে নিয়ে বাড়ি যাও।আজ আর না,ভূমি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।ও সুস্থ হলে আরেকদিন ফয়সালা হবে।”– কপাল কুঁচকে কথাগুলো বলে থামলো।ইশতিয়াক। চূড়ান্ত পর্যায়ের বিরক্ত সে।এসব ঝামেলা-টামেলার প্রভাব ভূমিকে অসুস্থ করে তুলছে। এই ভাবনাটাই অর্ধেক পাগল করে দিলো ওকে।ইচ্ছে করছে একেকজনকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে।

” যতদিন ছাড়াছাড়ি হচ্ছে না ততোদিন সূচির দায়িত্বও আমার, ওর উপরে অধিকারও আমার।আমার অবর্তমানে আব্বার দায়িত্ব। আমার সাথে না গেলে ও আব্বার সাথে যেতে বাধ্য।আমার বউকে আমি আপনার ঘরে রাখব কোন বিশ্বাসে? কে আপনি? বোন জামাই,শত হলেও সূচির জন্যে পরপুরুষ। আপনাকে বিশ্বাস করব কেন আমি? আমি এতো ভালোমানুষ নই যে বউকে আরেক পুরুষের ঘরে ফেলে রাখব।আপনি কি কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে? যেদিন আমার কোনো অধিকার থাকবে না সেদিন আর ফিরে তাকাব না।কিন্তু যতদিন অধিকার আছে ততোদিন আমি একচুলও ছাড়ছি না।কথাটা মাথায় রাখবেন দুলাভাই।”

ভরা মজলিসে ইশতিয়াকের চরিত্রের উপরে সজ্ঞানে সন্দেহের তীর ফেলে দিলো ফয়সাল।সূচি,ইশতিয়াক দুজনেই বিস্ময়ে, ঘৃণায় নির্বাক।একটি সুন্দর ভাই-বোনের সম্পর্ককে কেউ এরকম কলুষিত করতে পারে, তা ভাবতেই পারেনি কেউ।ভূমি চেঁচিয়ে উঠলো।যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বললো, ” তুই একটা অমানুষ। ভাবলি কী করে বোনকে আবার তোর ঘরে পাঠাব? জানোয়ার একটা।ছিঃ! কত নিম্ন তোর চিন্তা-ভাবনা!”

” সূচির উপরে আব্বার চেয়ে নিশ্চয়ই তোর অধিকার বেশি না। তুই নাক গলাতে আসবি না।আমাদের সমস্যা আমরাই মিটমাট করতে জানি।তুই তোর মতো থাক।আম্মাকে নিয়েই তো তোদের সমস্যা? আচ্ছা,যা।সম্পর্ক সহজ করার জন্যে আমি তাকে কিছু দিনের জন্যে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।সব সমাধান না হওয়া অবধি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যাক্তিকে সহ্য করব না।”– ফয়সালের নিরুত্তাপ কন্ঠ।ভাবলেশহীন সহজ, স্বাভাবিক সে।যেন সব ঠিকঠাক, কোথাও কিছু হয়নি।

” ফয়সাল,ফয়সাল!! তুই কে আমারে তোর মামাবাড়ি পাঠানের? তোর এতো কইলজা হইছে! তোরে কাইট্টা….

” চুপ করো।এবার মুখে লাগাম দাও। এতো বছর অনেক বলেছো, এবার আর না।কিছুদিন মামাবাড়ি থেকে ঘুরে এসো।তারপর ফিরে আল্লাহর নাম নিয়ে দিন কাটাবে। এরপরে আর কোনো অভিযোগ করতে দেব না তোমাকে।রতন কাকা, আম্মাকে আপনার সাথে নিয়ে যান তো।বাজার থেকে একটা রিকশায় তুলে দিয়েন।আমি মামাকে ফোন করে বলে দেব।মামা নামিয়ে নেবে।”

এই ফয়সাল বড্ড অচেনা।সূচি হা করে চেয়ে ছিল।বস্তুত সবার সাথে এমন ধমকে ধমকে সে কথা বলতে পারে, এই কথাটাই অজানা ছিল সূচির।
ফয়সাল বউয়ের হাত চেপে বললো, ” চলো আর কোনো ঝামেলা না।আচ্ছা অকৃতজ্ঞ তুমি।বোনকে এতো ভালোবাসো, অথচ নিজের ঝামেলা নিয়েই অসুস্থ বোনের কাঁধে চেপেছো। লজ্জা থাকা উচিত।”

” সূচি ওর কথা শুনবি না তুই।যাবি না। বড় আপার কথা শোন।আমি বলছি, আমার কোনো সমস্যা হবে না তোকে নিয়ে।”

ভূমিকে পাত্তাই দিলো না ফয়সাল।সূচির দিকে চেয়ে গাঢ় স্বরে বললো, ” আমার সাথে না গেলে আব্বার সাথে যাও। কিন্তু এ বাড়িতে না।তুমি মুক্তি চেয়েছো না? মুক্তিই দেব।কিন্তু আজ চলো।”

চারদিকে তখন মাগরিবের আজান পড়েছে।রোমেলা বানু বজ্রাহতের মতো চলেছেন রতন পাটোয়ারীর সাথে।ভোজভাজির মতো কী যে হয়ে গেল।ছেলে আজ কথাই শুনছে না।তার কর্তৃত্ব মানলো না ফয়সাল।কিছুতেই বাড়িতে নিলো না। মজা দেখতে আসা মহিলারা গেল বাড়িতে,পুরুষেরা গেল নামাজে।সবার মুখে মুখে ঘুরছে এক কথা।একে অন্যের সাথে বলছে,” কাজী বাড়ির ছোট পোলাডা ভালোই কিন্তু একটু বেশিই বউ ভাউরা।নাইলে মারে তাড়ায়া বউরে নিয়া বাড়ি ফিরতে পারে? যেই বউ এতো অপমান করলো সেই বউরেই বাড়িতে নিছে।কি যুগ যে আইলো! মায়ের চেয়ে নাকি এহন বউ বড়! খোদা,খোদা,রক্ষা করো।”
বাতাস বাড়ছে হু হু করে।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি,সূচি ফয়সালের সাথে ফের কাজী বাড়িতেই ফিরছে। ছেলেটাকে যেন আজ ভূতে ধরেছিলো।সূচিকে ছাড়া কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না।ইশতিয়াকের দিক থেকে ছিল শিথিলতা, অনাগ্রহ।ফয়সাল সূচি ও তাকে ঘিরে যেই ইঙ্গিত দিয়েছে,তারপরে আর জোর করতে পারেনি সে। কেবল ভূমিই খুব চেঁচিয়েছে।কিছুতেই ঐ বাড়িতে ফিরতে দেবে না বোনকে।ইশতিয়াক সামলাতে পারছিলো না তাকে। তার উত্তেজনা দেখেই মূলত স্বামীর সাথে পা বাড়িয়েছে সূচি।ইচ্ছা করলে জোর করে থাকতে পারতো। কিন্তু তাতে ঝামেলা কমতো না।ফয়সাল ওকে ছাড়া আসবে না,কোনো কথা শুনবে না।এদিকে বোনের উত্তেজনাও বাড়ছে।অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর ভালো লাগছিলো না তার।নিজের দুর্ভাগ্য থেকে বোনকে মুক্তি দিতেই আবার ফিরছে সেই কাজী বাড়িতে।

অন্ধকার নেমেছে চারদিকে।মানুষের অভাবে খা খা করছে বাড়ি।বাইরের লাইটটা জ্বালানো হয়নি আজ।সূচির হাতটা শক্ত মুঠোতে পুরে বসার ঘরে নিয়ে তাকে মাটিতে ঠেলে ফেলে দিলো ফয়সাল।পাগলের মতো জ্বলন্ত চোখে বউয়ের দিকে চেয়ে বললো, ” তুই মুক্তি চেয়েছিস না? আমিও মুক্তি চাই।আয় আজ সব চুকিয়ে দেই।”

ভিতর থেকে কপাট পড়লো ঐ অভিশপ্ত ঘরে।বাইরে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস, অন্ধকারের বুকে ডুবে যাওয়া উঠোনটা অচেনা এক অঘটনের আশঙ্কায় নিশ্চুপ। সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন কাজী বাড়ি আজ এক পাতালপুরী।

চলবে…

( আজকের পর্ব পড়ে যারা লেখিকার উপরে চটে গিয়ে তাকে নিষ্ঠুর ও জ্ঞানহীন আখ্যা দেবেন,তাদেরকে বলছি, শুকতারা এক বিশাল ভাবনা।দুই খন্ডের সম্মিলিত এক উপন্যাস।সুতরাং, কাহিনী এখানেই শেষ নয়। যে কোনঠাসা সূচিকে আমি সৃষ্টি করেছি তার হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানোটা দেখালে হবে চূড়ান্ত নাটকীয়তা। আমি এখানে অবাস্তব নাটকীয়তা দেখাতে চাচ্ছি না।মানসিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া প্রথম পরিচ্ছেদের চূড়ান্ত ঝামেলা এই ঘটনাটি।আর দুটো পর্বেই শুকতারার প্রথম পরিচ্ছেদটি শেষ হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here