শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর ২ পর্ব-১২

0
1388

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১২

ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠলো দেয়ালে ঝুলানো দেয়াল ঘড়িটা। ঠিক ঠিক ৯ বার বেজে থেমে গেলো। রান্না ঘর থেকে ছনছন আওয়াজ ভেসে এলো। খানিকবাদেই আবার নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিলো ঘরটাকে। মুখোমুখি দাড়িয়ে ইভান ঈশা। ইভানের চোখে একরাশ প্রশ্নে ভরা তির্যক চাহুনি। ঈশার কথার রেশ টেনেই বলল
–সিরিয়াসলি! ঘুমানোর ভান করে আমাকে পাহারা দাও রাতে?

কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়লো ঈশার কপালে। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–এতো জোরে হেসে হেসে কথা বললে জেগে থাকার দরকার নেই তো। এমনিতেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে।

ইভান শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। ঠোট বাকিয়ে হেসে বলল
–সন্দেহ? জিজ্ঞেস করতে পারতে কার ফোন। আমি তোমাকে মিথ্যা বলিনা। আর তোমার ঘুম যাতে নষ্ট নাহয় সেজন্যই বারান্দায় গিয়েছিলাম কথা বলতে। তোমার কাছ থেকে কিছু লুকানোর মতো নাই। গট ইট?

ঈশা গম্ভীর হয়ে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–এটা সন্দেহ নয়। আমি তোমার ব্যপারে খুবই পজেসিভ। এসব বিষয় সহজ ভাবে নিতে পারি না। তুমি সেটা ভালো করেই জানো। তারপরেও বাসায় এসব না করলেই পারো।

ঈশার কথাটা বেশ অসন্তোষজনক মনে হল ইভানের কাছে। ভ্রু কুচকে বলল
–এক্সকিউজ মি? তুমি কি বলতে চাইছ? এসব বাসায় না করলেও পারি মানে কি? তোমার ধারনা আমি কি প্রেম করছি?

ইভানের কথা শুনে ঈশা যেন আকাশ থেকে পড়লো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি সেটা কখন বললাম? আমি যথেষ্ট শিক্ষিত। বাইরে চলতে গেলে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলতে হয় সেটা আমি জানি। কিন্তু তুমি এভাবে লুকিয়ে ছাপিয়ে বারান্দায় গিয়ে কথা না বললেও পারতে। আমার সামনে কথা বললে কি এমন ক্ষতি হতো? তোমার আচরন গুলোই অদ্ভুত।

ইভান সরু চোখে তাকাল। তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–ওয়াও! আমি তোমাকে দেখে রীতিমতো অবাক হচ্ছি। আমি যার সাথেই কথা বলি সেটা মেয়ে না ছেলে তুমি কিভাবে বুঝলে? কারন সেই সময় তুমি ঘুমাচ্ছিলে? আর আমি কথা বলার সময় নাম মেনশন করিনি যে তুমি কথা শুনেই বুঝে যাবে সেটা মেয়ে। তার মানে তুমি আমার ফোন চেক করো? এটা ঠিক কি ধরনের ব্যবহার?

ইভানের আচরনে ঈশা হতভম্ব হয়ে গেলো। গলার স্বর নামিয়ে বলল
–আমি চেক করিনি। আমি তো…।

–শাট আপ! একদম মিথ্যা বলবে না। এই আচরণটা তোমার নতুন না। তুমি আমাকে সব সময় সন্দেহ করো। যদি ভুলে যাও তাহলে মনে করিয়ে দেই বিয়ের সময়টার কথা।

ইভান থেমে গেলো। এমন আচরন ঈশার খারাপ লাগলো। তীব্র অভিমানে বিষিয়ে উঠলো মন। পুরো কথা না শুনেই এমন আচরন করলো? চোখ ভরে উঠলো। ইভান প্রচণ্ড রেগে বলল
–এরপর থেকে মেয়েদের নিয়ে আমাকে ব্লেম করতে হলে আগে ভালভাবে সবটা জেনে নেবে তারপর কথা বলবে। নাহলে আমার সাথে তোমার কথা বলার কোন দরকার নেই।

ইভান দ্রুত পায়ে চলে গেলো বের হয়ে। ঈশা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো নিজের রুমে। অনাহারে কেটে গেলো সকালটা। ঈশা ঘর থেকে বের হল না। তার মনে তীব্র অভিমান জমে গেছে। কেদে কেদে একদম চোখ ফুলে তুলেছে। ইভান তার পুরো কথাটা শুনলই না। ইভানের হাসির শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন ঠিকই বুঝতে পারেনি কার সাথে কথা বলছিল। আর ঘুমের মাঝে এতটা গুরুত্বও দেয়নি। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তীব্র শব্দে আবারো ইভানের ফোন বেজে ওঠে। ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবেই ঈশা ফোনটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট করে দেয়। নাম্বারটা সেভ করা ছিল না। এতটুকু বুঝতে পেরেছিল সেটা বিদেশী নাম্বার। কিন্তু কলটা কেটে যেতেই ঐ নাম্বার থেকে মেসেজ আসে। মেসেজটা দেখেই ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সেখানে লেখা ছিল

“শুভ সকাল। ঘুম থেকে উঠেই আমাকে একটা কল দেবে। আমি তোমার কলের জন্য অপেক্ষা করবো ইভান। মিস ইউ।“

নিচে ছোট্ট করে লেখা তৃনা। এই নামটা ঈশা আগে কখনো শোনেনি। হয়তো ইভানের পরিচিত কেউ। সে হিস্ট্রি চেক করতে গিয়েই দেখে ইভান মাঝে মাঝেই ঐ নাম্বারে কথা বলে। কাল রাতেও যে নাম্বারে কথা বলেছে সেটা একই। তাই ঈশা ঠিক করে ফেলে সে এই বিষয়টা নিয়ে ইভানের সাথে কথা বলবে। কিন্তু শুরু করতেই ইভান বিষয়টাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। সব সময় এমন করে। ইভান তাকে কোনভাবেই বুঝতে চায় না।

————-
জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ডের মতো উত্তাপ ছড়াচ্ছে সূর্যটা। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা ইভানের। মেজাজটা বেশ খারাপ। হাতের ঘড়িটায় ঘণ্টার কাঁটা ২ টায় আটকে আছে। মাত্র অফিস থেকে বের হয়েছে। জরুরী মিটিং ছিল। সেটা শেষ করেই ছুটি নিয়ে নিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় যাবে বলে। রাতে ঘুম হয়নি। আর এই মিটিং টার জন্য একটা সপ্তাহ বেশ পরিশ্রম করেছে সে। আজ কাজটা শেষ করে অনেক শান্তি লাগছে। এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট নেবে। একটা ফাঁকা রিক্সা দেখে সেটাতে উঠে পড়লো। এতটা টায়ার্ড যে রিক্সার ঝাকুনিতেই তার ঘুম চলে আসছে। চোখ মেলে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনরকমে বাড়ি পৌঁছে গেলো। কলিং বেল বাজাতেই ইফতি এসে হাসি মুখে দরজা খুলে দিলো। অবাক হয়ে বলল
–আরে ভাইয়া তুমি এতো তাড়াতাড়ি?

ইভানের কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না। তার মনে হচ্ছে কোনরকমে শুয়ে পড়লেই বাঁচে। তাই ইফতির কথায় বেশ বিরক্ত হল সে। ধমকে উঠে বলল
–সরে যা সামনে থেকে।

ইভানের এমন গম্ভীর ধমকে সবাই সেদিকে তাকাল। ইফতি সরে দাঁড়ালো। ইভান ভেতরে ঢুকেই চোখ পড়লো সোফায়। তার সব কাজিনরা বসে আছে। সবার চেহারা থমথমে। ইভান ক্লান্ত সরে বলল
–তোরা কখন এসেছিস?

ইরিনার স্বামী রাজিব বলল
–অনেক্ষন হল এসেছি ভাইয়া। আপনার অফিস এতো তাড়াতাড়ি শেষ হল?

ইভান ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–ছুটি নিয়ে এসেছি। তোমরা গল্প করো। আমি ভীষণ টায়ার্ড। রেস্ট নিয়ে আসছি।

কথা শেষ করে ক্লান্ত দৃষ্টি ঈশার দিকে ফেরাল। শুকনো মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ইভান এখন আর কোন কথা বলার অবস্থায় নাই। তাই নিজের ঘরে চলে গেলো। বেশ লম্বা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলো ক্লান্তি কাটাতে। কিন্তু কোন লাভ হল না। শাওয়ার নেয়ার পরেই আরও বেশী করে ক্লান্তি যেন জাপটে ধরল। বিছানায় কিছুক্ষন শুয়ে রেস্ট নিতে চাইল। কিন্তু শোয়া মাত্রই রাজ্যের ঘুম এসে ভিড় করলো চোখের পাতায়। সময় নিলো না গভীর ঘুমে ডুবে যেতে। দুপুরে খাওয়ার জন্য ইভান কে ডাকতে ঈশা ঘরে এলো। কিন্তু এসেই দেখল সে গভীর ঘুমে আছে। পাশে বসে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো ঘুমন্ত মুখের দিকে। আলতো হাত বুলিয়ে দিলেও কোন হেলদোল প্রকাশ পেলো না তার। ঈশা আর ডাকল না। উঠে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। সকালেও না খেয়ে গেছে সে। দুপুরেও খেলো না। বাইরে খেয়েছে কিনা কে জানে। কথাই তো বলল না। ঈশা বাইরে আসতেই সবাই জোর করলো খেতে। কিন্তু ঈশা কারো কথা শুনল না। ইভানের সাথে খাবে বললে তেমন কেউ আর জোর করলো না। সবাই যে যার মতো খেয়ে দুপুরে রেস্ট নিতে গেলো। ঈশাও ঘরে চলে গেলো। ইভান তখনও ঘুমেই আছে। ঈশা ঘরে এসেই মনে হল শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। সেও ইভানের পাশে আলতো করে শুয়ে পড়লো। শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠলো। অন্ধকার করে এলো দৃষ্টি।

সন্ধ্যার আগে আগে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঈশাকে গুটিসুটি হয়ে পাশে শুয়ে থাকতে দেখে তার উপরে একটু ঝুঁকে গেলো। শুকনো মুখটা চোখে পড়তেই হাহাকার করে উঠলো ভেতরটা। মেয়েটাকে আবারো কষ্ট দিয়ে ফেললো। অমন ব্যাবহার না করলেও পারতো। কাজের চাপে আসলে তারও মেজাজটা ঠিক ছিলনা। তাই খুব দ্রুত রিয়াক্ট করে ফেলেছে। খুব মন খারাপ করেছে ঈশা। এতক্ষনে একটা সরি বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে তো ভীষণ ক্লান্ত ছিল। কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল
–সরি জান।

উঠে বসে কিছুক্ষন ভাবল। কিভাবে রাগ ভাঙ্গাবে। অনেক কিছু ভেবে অবশেষে বের করলো ঈশা রাতে ঘুরতে পছন্দ করে। আর কাজিনরা সবাই বাসায় তাই আজ রাতে সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। তাহলে একটু হলেও রাগটা কমবে। ইভান ফ্রেশ হয়ে এসে হাতমুখ মুছে নিলো। ঘর থেকে বাইরে গেলো। নাজমা কে বলল এক কাপ চা দিতে। নাজমা চা দিয়ে গেলে ইভান বেশ সময় নিয়ে চা টা শেষ করলো। চা শেষ করে ঘরে এসে ঢুকতেই ঈশার উপরে চোখ পড়লো। কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। ইভান ঘুম থেকে উঠে যেভাবে দেখেছে সেভাবেই আছে। এতটা সময়ে এক চুলও নড়াচড়া করেনি। কিন্তু ঈশা যতই গভীর ঘুমে থাক সে অনবরত নড়াচড়া করে। মাঝে মাঝে ঈশাকে জড়িয়ে ধরলে তার নড়াচড়া করার কারনে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। কাছে গিয়ে বসল। সারামুখে হাত বুলিয়ে কোন হেলদোল পেলো না। ধির কণ্ঠে ডাকল
–ঈশা। ঈশা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

ঈশার বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হল না। ইভান আলতো করে গালে হাত রেখে বলল
–ঈশা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

ঈশা আগের মতই অনড়। ইভানের চিন্তাটা এবার ভয়ে পরিণত হল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে ঈশার মাথাটা তুলে বুকে চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলল
–একবার চোখটা খোলো। আমি ডাকছি তো।

চোখ মেলে তাকাল না ঈশা। এমনকি ইভানের কথাও কানে গেলো না।

চলবে………
(ব্যস্ততার মধ্যে লিখেছি পর্বটা। রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা করে চেয়ে নিচ্ছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here