শুভ বিবাহ পর্ব-২৫

0
625

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

২৫

তুতুন আমাকে গত রাতে কল করেছিল। আমি কাজ করতে করতে কখন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছি, বলতে পারব না। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন বেকায়দায় ঘুমানোর ফলে ঘাড় আর হাত ব্যথা করছে, ঝিমঝিম অনুভূত হচ্ছে। আমি কোনোমতে নিজেকে টেনে নিয়ে বিছানায় গেলাম। তখনই খেয়াল হলো, ফোনটা আমার পিঠের নিচে পড়েছে। ফোন বের করে দেখলাম তুতুনের মিসড কল। ব্যাক করার মত অবস্থায় ছিলাম না বলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে ঘুম ভেঙে গোসলে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নেয়া আমার একটা অভ্যাস। চুল থেকে যখন টপ টপ পানি পড়ে আমার কাঁধ পিঠ ভেজায়, আমি সেটা খুব এঞ্জয় করি। মনে হয় যেন কেউ ওয়াটার মাসাজ দিচ্ছে। ভেজা চুলে আমি ঘর গোছাই, কিচেনে গিয়ে ব্রেকফাস্ট এর ব্যবস্থা করি।

আজকে কিচেনে যাওয়ার একটু পরে সায়মন এসে হাজির। ও এবার মেডিকেল কলেজে পড়ছে। একটা ভারী চশমা পরে উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ও যে নার্ড, সেটা অনেকেই বলে ওকে। দেখতে ও খারাপ নয়। গায়ের রঙ মোটামুটি ফর্সা, লম্বায় পাঁচ ফিট এগারোর একটু বেশি হবে, এই একটু, আনগুলের চিমটির মত! তবে শরীর মেদহীন টানটান নয়। ওর শরীরের স্তরে স্তরে পাতলা হলেও চর্বির লেয়ার আছে। একেবারে টানটান না হলেও খুব বেশি ঝোলাও না। ওর জীমে যাওয়ার আর নিজেকে ম্যান্টেইনের সময় নেই। সারাদিন সে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। একারণে সে ডায়েট ম্যান্টেইন করে। অতিরিক্ত মেদ হবে, এমন খাবারই সে খায় না। পড়াশোনার প্রেশারের কারণে কফি খায়, তাও আবার ব্ল্যাক উইদাউট সুগার। ওকে তেমন একটা আকর্ষণীয় মনে হয় না, এভারেজ ব্রাউন বয়। কিন্তু স্যুটেড ব্যুটেড হলে আই মিন ফর্মাল ড্রেসাপে ওকে দেখে যে মেয়দের মাথানষ্ট হবে, এটা নিশ্চিত। কারণ আমাদের পরিবারের ছেলেদের ফেসকাটিং খুব সুন্দর। একটু পরিপাটি হলেই চোখ ফেরানো দায়। ছোট চাচ্চুর একমাত্র ছেলে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বাবারা তিন ভাই। তাদের তিন ভাইয়ের বাচ্চা একজন। ফুফাতো ভাই বোন আবার আমাদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। এদিক থেকে আমরা সংখ্যালঘু।

সায়মন এসে আমার ব্রেকফাস্ট দেখে বলল,
❝আমাকে একটু বানিয়ে দিবা? খুব পেইন লাগছে। নাস্তা বানানোর সময়ও নেই❞

সায়মন গুনে গুনে আমার থেকে সাত মাসের ছোট। ওর সাথে আমার তুই তুকারির সম্পর্ক। আমি ওর দিকে কফির মগ বাড়াতে বাড়াতে বললাম,
❝এটা খা আগে। রাতে ঘুমিয়েছিস?❞
ও মাথা নেড়ে না বলল।
❝এত প্রেশার নিয়ে কি হবে? এত প্রেশার ভাল্লাগে? আর এই অখাদ্য মুখে রোচে কি করে?❞
❝ফার্স্ট অফ অল, ইউ নিড টু কিপ ইউরসেল্ফ ফিট। অলওয়েজ। নাহলে শরীর বিভিন্ন রোগের বাসা হয়ে যাবে। সেকেন্ড কথা হলো, যেটা তোমার কাছে অখাদ্য, সেটা আমার কাছে খাদ্য। তাই আমি এঞ্জয় করছি। ডোন্ট ওরি এবাউট ইট❞
❝খুবই ভালো। ব্রেকফাস্ট এ কি খাবি? এনিথিং ফ্রম ইউর সাজেশন? ❞
❝নোপ। আই উইল হ্যাভ হোয়াট ইউ উইল হ্যাভ!❞

নাস্তা তৈরি করলাম। প্যানকেক আর সাথে ফ্রুট সালাদ। আর এক গ্লাস জুস। সায়মনের খাবার ওর ঘরে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে চলে আসলাম ডাইনিং এ। দেশে থাকতে এই অভ্যাস ছিল না। এখন হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক পরিপাটি আমি, অনেক নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করি।

খাবার শেষ করে ঘর পরিপাটি করলাম, নিজের কিছু কাজ করলাম। এ সময় খেয়াল হলো, তুতুন আমাকে কল করেছিল। ফোন হাতে নিলাম। এখান থেকে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্য পাঁচ ঘন্টা। তার মানে বাংলাদেশে এখন সকাল সাড়ে ছয়টা। আজ আমার বিকালে কাজের শিফট, তাই তাড়া নেই তেমন। টেবিল পরিষ্কার করে লেপটপে বসে তুতুনকে কল দিলাম। ওপাশে বেশ সময় নিয়ে তুতুন ফোন রিসিভ করলো। ভিডিও কলে দেখতে পাচ্ছি সে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে ঘুম ঘুম চোখে মিষ্টি করে হাসলো।
❝একটু আগে নামাজ পড়ে ঘুমানোর জন্য শুলাম। আর তুমি কল দিলে এখন। রাতে কি খুব টায়ার্ড ছিলে?❞
❝হুম। পড়তে পড়তে টেবিলেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কি অবস্থা তোর? বাসার সবাই ভালো আছে?❞
❝বাসার সবাই ভালো আছে। আর আমার অবস্থা জানানোর জন্যই তোমাকে কল দিয়েছি❞
❝কি হয়েছে?❞

তুতুন বিছানায় উঠে বসে ফোনের স্ক্রিন সামনে আনলো। তারপর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
❝আমার দিনাজপুর মেডিকেলে চান্স হয়েছে, জানো?!❞

আমার ভীষণ আনন্দ হলো।
❝এতদিন পর?❞
❝ওয়েটিং এ ছিলাম। সিট খালি হলো এতদিন পর। কেউ নিশ্চয়ই এডমিশন ক্যান্সেল করেছে। এই ফাঁকে সুযোগ হয়ে গেল!❞
❝আন্টি আংকেল এত দূরে যেতে দিবে?❞
তুতুনের চেহারায় কিছুটা মলিনতার ছাপ।
❝রাজী হচ্ছে না জানো! কত চেষ্টা করছি, লাভ হচ্ছে না। আব্বু আম্মু নাকি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আর আমিও নাকি এত দূরে গিয়ে থাকতে পারব না। খারাপ কিছু হয়ে গেলে? আমাকে কে দেখে রাখবে? কে খেয়াল করবে? আমি নাকি নষ্ট হয়ে যাব! এসব বলে বলে আমাকে যেতে দিচ্ছে না। আচ্ছা আপু, এসব কি ঠিক? আমি কি তাহলে মেডিকেলে পড়তে পারব না? কত আশা ছিল! আমার কি সব আশা মাটি চাপা দিতে হবে? ভাইয়ারাও দিবে না কিছুতেই। আমি নাকি পারব না❞

আমি কয়েক সেকেন্ড একটু ভাবলাম।
❝তোর আব্বু, মানে আংকেল রিটায়ারর্ড না?❞
❝হ্যাঁ❞
❝তোর তো ছোট আর কোনো ভাই বোন নেই, তাই না?❞
❝হুম। তো?❞
❝তাহলে সবাইকে নিয়ে দিনাজপুর চলে যা! এই বাসা তো ভাড়া দেয়া আছেই। মাসে মাসে এসে টাকা কালেক্ট করবে আংকেল। ওখানে একটা বাসা ভাড়া নিলে বিন্দাস কেটে যাবে। স্বপ্ন মাটি চাপা দেয়ার তো কিছু নেই!❞
ওপাশে তুতুন লাফিয়ে উঠলো রীতিমতো।
❝আপু!! তুমি একটা জিনিয়াস! আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউউউউউ!!!!❞
তুতুন ফোনের স্ক্রিনের উপর চুমু খাচ্ছে। আমি হাসছি ওর কান্ড দেখে। ওর উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলে প্রশ্ন করলাম।
❝এত যে লাফাচ্ছিস, বললেই কি আংকেল আন্টি ঢাকা, নিজের বাড়ি ছাড়তে রাজী হবে?❞

তুতুন আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
❝তাই তো! কিন্তু চেষ্টা তো করতে পারব। আব্বু আম্মুর তো তেমন কোনো কাজ নেই। নতুন যায়গায় যেতে মানা করার কোনো কারণ থাকতে পারে?❞
❝থাকতেই পারে। এখানে তারা বাড়িওয়ালা। ওখানে হবে ভাড়াটিয়া। তার উপর নতুন শহরে কেউ কিছু চেনে না। ঢাকার মত এত ফ্যাসিলিটিও নেই। যেতে চাইবেই বা কেন?❞

তুতুনের সাথে কথা বলার সময় আমার পেছনে সায়মন এসে হাজির হলো। ও সাধারণত বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া আসে না। তুতুন ক্যামেরার ভেতর দিয়ে সায়মনকে দেখে কথা থামিয়ে দিল। আমিও সেট খেয়াল করে পেছনে ফিরলাম। দেখি, সায়মন আমার লেপটপের স্ক্রিনে চেয়ে আছে।
❝কিছু বলবি?❞
ও চুপ করে লেপটপে দেখছে। সেখানে তুতুনকে দেখা যাচ্ছ। আমার প্রশ্ন শুনে নি নাকি? আবার করলাম,
❝কি জন্য এসছিস?❞
ও জবাব দিল,
❝ভুলে গিয়েছি❞
তারপর ঘুরে আবার বেরিয়ে গেল। বুঝলাম না কি হলো। সম্ভবত ওর নিউরন গুলো কানেক্ট করতে পারছে না, তথ্য হারিয়ে ফেলেছে। তাই অমন করে চলে গেল। আমিও সামনের দিকে ফিরলাম।
❝কে ওটা আপু?❞
❝ওটা? আমার কাজিন সায়মন। বলেছিলাম না মেডিকেল কলেযে পড়ছে?❞
❝ওহ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ভাইয়া অনেক ব্রিলিয়ান্ট, তাই না?❞
আমি হেসে মাথা নাড়ালাম।

শেষ পর্যন্ত তুতুনের বাবা মা রাজী হয়েছে ওকে নিয়ে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য। ওর মায়ের নাকি ছেলে মেয়েদের মাঝে একজনকে ডাক্তার বানানোর ইচ্ছা ছিল। ছেলেরা কেউ এই লাইনে আসেনি। তাই মেয়ে যেহেতু সুযোগ পেয়েছে, এইটুকু তো করাই যায়। তুতুন এই কারণে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে উঠতে বসতে। সে জানিয়েছে, আমার জন্যে নাকি বিরাট এক গিফট রাখবে সে। দেশে আসলেই দিবে। অনেক গুলো মহান মহান টাইটেলও দিয়ে ফেলেছে! আমি হাসি। অন্যের বেলায় ঠিকই মাথা খোলে। কিন্তু নিজের বেলায় আর বুদ্ধিতে কুলোয় না। তবুও আমার বুদ্ধি যে কারো কাজে লাগছে, সেই বা কম কি?

একটা কথা অবশ্য মাথায় ঘুরছে। এখন থেকে হয়ত আর শুভর খবর দিতে পারবে না ও। তুতুনের সাথে যোগাযোগ রক্ষার আরেকটা কারণ ছিল শুভর খবরাখবর নেয়া। আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি আসলে ওর কি ধরনের খবর চাই? ওকে ভালোবাসতাম বলে ভালো দেখতে চাই? নাকি ও আমাকে হারিয়ে রিগ্রেট করছে কিনা, সেট বুঝতে চাই? নাকি প্রতিশোধ নিতে চাই? নাকি ও যেন তুতুনকেও আমার মত কলুষিত করতে না পারে, একারণে কানেক্ট থাকতে চাই?

হয়ত সব গুলোই। অথবা কোনোটাই না। হয়ত শুভকে আমি ভুলে গেছি। তারপরও তার ভালোবাসা, আমার প্রতি আকর্ষণ, যত্ন নেয়ার মুহূর্তগুলো সযতনের মনের এক কোণে রেখে দিয়েছি! কে জানে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here