শুভ বিবাহ পর্ব-৩

0
1911

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

ওরিয়েন্টেশন এর পর প্রথম দিনের ক্লাসে বন্ধু রাশেদ ছাড়া আর সব নতুন মুখ। বেশ কয়েকটা ছেলের সাথে খাতির হলো, মেয়েদের সাথে কথা বলার সুযোগ হলো না। মেয়েগুলো কেমন যেন, ক্লাসে আসার সাথে সাথে বের হয়ে যাওয়ার ধান্দা। কয়েকজন কেবল পরিচিত বলে নিজস্ব বলয়ে আটকে থাকলো। আমি সেই ছোট চুলের জিন্সের জ্যাকেট পরিহিতাকে খুঁজে পেলাম না। সম্ভবত সে আমাদের ডিপার্ট্মেন্টের না। আমি বন্ধুদের দিকে মনোযোগ দিলাম, হৈ হৈ রৈ রৈ করে ঢাবির প্রথম দিন সেলিব্রেশনে নামলাম।

হরতালের ঝামেলার কারণে এতপরের এক সপ্তাহের ক্লাস সাসপেন্ড হলো। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না। আমি ঘরে বসে শুয়ে সময় পার করছি। এদিকে আমার মায়ের আমাকে নিয়ে গর্বিত মনোভাব কিছুটা কমেছে, আগের মত ফোনে সবার সাথে কথায় কথায় আমার প্রশংসা করেন না। আমি বিরক্ত হয়ে আজ ছাদে গেলাম। বন্ধু বান্ধব কেউ ফ্রি নেই। ছাদে গিয়ে দেখি সেইদিনের কানি মেয়েটা চশমা পরে বই নিয়ে ছাদে একটা টুলের উপর বসে আছে। আজকে তার কুতকুত খেলার সঙ্গীরা তার সাথে নেই। আমি এপাশ থেকে বললাম,
“এই মেয়ে, একা একা ছাদে কি কর?”

মেয়েটা ছাদে বসে চশমার ভেতর দিয়ে গোল গোল চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে যে সে আমার ভাষা বোঝে না। আমি আবার জোরে জোরে বললাম,
“এই মেয়ে তুমি বাংলা পারো না? আমার কথা বুঝো না?”
মেয়েটা এখনো ফ্যালফ্যাল করে আমাকে দেখছে। বেশ বিরক্ত হয়ে আবার বললাম,
“নাম কি?”
“তুতুন”
এতক্ষণে সাহেবজাদীর মুখে বুলি ফুটলো।
“তুতুন আবার কি ধরনের নাম?”
“দাদু ডাকতো”
“তোমার দাদুকে বলবা এই আজব নাম তোমার সাথে যায় না। তোমার নাম হওয়া উচিত তেঁতুল ফুল। তুমি দেখতে তেঁতুল ফুলের মত”
মেয়েটা কি বুঝলো কে জানে, এখনো আগের মতঈ চেয়ে থাকলো। আমি কিছু একটা বলতে যাবো, তখন সে মুখ খুললো,
“আমার দাদু মরে গেছে”
“তো তাহলে তোমাকে এই নামে এখন কে ডাকে?”
“সবাই”
“তাহলে শুধু দাদুর নাম বললে কেন?”
মেয়েটা জবাব দিল না। আমাদের ছাদ থেকে ওদের ছাদে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না, অল্প দূরত্ব। আমি ছাদের সীমানার দেয়ালে দাঁড়িয়ে এক লাফে ঐ ছাদে চলে গেলাম। মেয়েটা আমার কান্ড দেখে বই ফেলে দুই কানে দুই হাত চেপে চিৎকার দিল। আমি কোমরে হাত রেখে ওর সামনে দাঁড়ালাম। সে চোখ খুলে আমাকে দেখে সেখান থেকে পালিয়ে গেল! আমার অবাক লাগলো। এত ভীতু কেন এই মেয়ে?

আমি আবার নিজের ছাদে চলে আসলাম। আসার আগে ওর বইটা নিয়ে আসলাম। মেয়েটা নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে, একটা কিশোর উপন্যাস পড়ছে। আমি জীবনেও এসব ছাইপাঁশ ধরিনি। তারপরও বইটা উলটে পালটে দেখলাম। বইয়ের উপরে লেখা ‘প্রিয় তুতুনকে বড় ফুপি’। জীবনেও এমন নাম শুনিনি। মানুষ আজকাল আদর করে বিড়াল কুকুরের এমন নাম রাখে, তাই বলে মেয়ের নাম হবে তুতুন? আমি হেসে ছাদ থেকে চলে এলাম।

নির্বিঘ্নে আরও কয়েকটা দিন কেটে গেলে আমাদের ক্লাস আবার শুরু হলো। মাঝে সরকার বিরোধী দলের হরতাল গরম পানি আর টিয়ারশেল মেরে উড়িয়ে দিয়েছে, তারপর উড়াধুরা কিছু ছেলেদের গ্রেফতার করে হাজতে ভরেছে। আশা করা যায় সামনে কিছুদিন শান্তিতে থাকা যাবে। ভার্সিটিতে যেফিন যাবো, সেদিন নাস্তার টেবিলে থাকতেই এক ভদ্রমহিলা বসায় প্রবেশ করলেন। আমি পরোটায় ভাজি ভরে মুখে পুরে নিলাম। আম্মু তার কাছে কথা শুনতে গেল। উনাকে দেখে আম্মু এমনভাবে কথা বলছেন যেন দুজন দুজনকে চেনে। আমি খাওয়া শেষ করেছি, আর উনি চলে গেলেন। আম্মুর কাছে এসে তার ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলাম,
“কে উনি আম্মু?”
“পাশের বাসায় থাকে। আমার স্কুল বান্ধবী! অথচ আমি জানতামই না ওরা এখানে। কি অবাক ব্যাপার না?”
“হ্যাঁ আম্মু, পৃথিবী তো গোল, তার উপর বাংলাদেশ একটা ছোট্ট দেশ! তা উনি কি বললেন?”
“বেশ অনেক কথাই। তিন ছেলে মেয়ে ওর, বড় দুই ছেলে দেশের বাইরে থাকে, আমার আগে বিয়ে হয়েছে তো”
“ওহ আচ্ছা। হঠাৎ তোমার কাছে আসলো কিভাবে?”
“আমাকে দুদিন আগে বিল্ডিংয়ে ঢুকতে দেখেছে”
“ওহ”
“বলছি ওর মেয়ে নাকি ছাদে গতকাল বই ফেলে গেছে, খুঁজে না পেয়ে এখন কান্না করছে। খুব বইপড়ুয়া মেয়েটা। এজন্য তাড়াতাড়ি চলে গেল”
আমি বিটকেলে একটা হাসি দিলাম।
“উনি তাহলে তুতুনের মা!”
“তুতুন? চিনস ওকে? নাম জানোস কেমনে?”

আমি আমার বিটকেলে হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে আমার ঘরে গিয়ে বইটা আনলাম। মায়ের হাতে বই তুলে দিয়ে বললাম,
“তুতুনকে বই দিয়ে দিও। কান্না থামাবে!”

আম্মু কিছু বলার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম। ভার্সিটির বাসে আরাম করে সেখানে পৌঁছালাম। আজ সেই ছোট চুলের মেয়েটাকে খুঁজে পেলাম, তবে আজ সে জিন্স পরেনি। আমি আমার বন্ধুদের সাথে বসলাম। পর পর দুইটা মাথা নষ্ট ক্লাস করার পর বাইরে বের হয়ে জানলাম, মেয়েটা জাহিদের পরিচিত, ওর স্কুলের আসলে। ক্লাসের বাইরে ও আমাকে দেখে মুখখানা পেঁচার মত বানিয়ে ফেলল। আমি ওকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছি।

জাহিদ পরিচয় করিয়ে দিল।
“শুভ, এ হচ্ছে কণা। কণা, ও হচ্ছে…”
“বিয়ে পাগলা! এইটা হচ্ছে তোদের গ্রুপের বিয়ে পাগলা যে কিনা প্রথম দেখায় একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়!”
কণা চাপা আক্রোশে ফেটে উঠল, আর আমি পেটে হাত চেপে হো হো করে হাসছি! আমি হাসছি বলে কণা ওর দু চোখ দিয়ে আমার উপর বোমা ছুড়ছে। আমি হাসি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে করতে বললাম,
“আমাকে কিন্তু বললা না সেদিন বিয়ে করবা কিনা। আমার আন্সার কই?”
কণা আঙুল তুলে বলল,
“তোরে আমি কেন, রাস্তার কোনো কুকুরও বিয়ে করবে না, মাইন্ড ইট!”

আমি সহ আমার বন্ধুরা সবাই কণার হনহনে প্রস্থানে হেসে উঠলাম। জাহিদ আমার পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
“ভাই, আগুন নিয়ে খেলা শুরু করছিস, সাবধানে থাকিস!”
“ও আগুন হলে আমি পানি হবো। পানি জানে, আগুন কিভাবে নিভায়!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here