শুভ বিবাহ পর্ব-৪

0
1379

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

পর্ব ৪

সকালে ঘুম ভেঙেই দেখি প্রচন্ড মাথাব্যথা। রাতে যখন ঘুমিয়েছিলাম, তখন তো তেমন একটা মাথাব্যথা ছিল না। অথচ ঘুম ভাঙলে কেন মাথা ব্যথা করবে? শুয়ে শুয়ে নিজের মাথা নিজেই টিপলাম কিছুক্ষণ। এরপর উঠে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আয়নার দিকে তাকালাম। চুল গুলো কাঁধের কাছাকাছি চলে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই আমার বড় চুল বিরক্ত লাগে। অন্যান্য মেয়েরা যেমন চুল বড় করে বেণী করে রাখে, আমার তেমনটা করতে বিরক্ত বোধ হয়। এ কারণে চুল আমার লম্বায় ঘাড় ছাড়াতে পারেনি সহজে। আমি মাথাব্যথা নিয়েই নাশতার টেবিলে গেলাম। আমাদের ঘরের কাজের সহকারী এসে টেবিলে আমার নাস্তা দিয়ে গেল- ডিম পোচ আর পরোটা। আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম।
“মা কোথায়?”
“ম্যাডাম তো সকাল সকাল বের হয়ে গেলেন, বললেন মিটিং আছে”
“ওহ। এক মগ চা দিও তো, মাথাব্যথা করতেছে”

আমার মা তার অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা আছে। বাবা সিংগাপুর, থাইল্যান্ডের দিক সামলায়, মা এই দেশেরটা। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই আমরা বাইরে ট্যুর দেই। একা নাস্তা করছি বলে ভাববেন আমি বাবা মায়ের অনাদরে ঘরে একা একা থেকে বড় হয়েছি! বাবা মা ব্যবসার ফাঁকে আমাকে যথেষ্ট সময় দেন। তাছাড়া আমার চাচা, তিন মামা এই এলাকাতেই থাকে। একা ভালো না লাগলে সেখানে চলে যাই। চাচার বাড়িতে কম যাই কারণ আপু ভাইয়া সবাই ব্যস্ত থাকে। বেশিরভাগ সময় মামা বাড়ি চলে যাই কারণ তারা তিনজন এক বিল্ডিংয়ে থাকে। সেখানে সারাদিন হৈচৈ লেগে থাকে। ভালো না লাগলে সেখান থেকে একটু আনন্দ করে আসি। তবে আজকে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। ভার্সিটিতে আজ প্রথম ক্লাস, তবুও যাবো কিনা ভাবছি। মাথাব্যথায় মনে হচ্ছে না সেখানে যেতে পারব। অগত্যা বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমার এই মাথাব্যথার নাম মাইগ্রেন। মাথাব্যথায় কয়েকবার নাক মুখ দিয়ে রক্তও এসে পড়েছিল। আমি অবশ্য সেসবে বিচলিত হইনি। মেয় হিসেবে আমি খুব শক্ত। অবশ্যই আর সব মেয়েদের মত আমার ভেতর অজস্র আবেগ খেলা করে, রাগ হয়, কান্না পায়, হাসি আসে। হরমোনের লাফালাফি জনিত কারণে আমিও মুড সুইং এ ভুগি। তবে আমি কান্না আর ভয় কারো সামনে সহজে প্রকাশ করিনা। রাগ, হাসি, বিরক্তি- এসব অনুভূতির ক্ষেত্রে রাখঢাক থাকলেও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পায়, এমন অনুভূতির প্রতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে।

নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসি আসি করেও আসছে না। এই সময় জাহিদের নাম্বার ভেসে উঠল আমার ফোনে। ওর ফোন কেটে টেক্সট দিলাম-
“প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যথা। আজ আসব না। নোট রাখিস”

জাহিদকে টেক্সট পাঠিয়ে চোখের সামনে একটা ইডিয়টের চেহারা ভেসে উঠল। আমি কোনোদিন ভাবি নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম একটা ইডিয়টও চান্স পাবে পড়ার জন্য। মাত্র তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিস, এর মাঝেই কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দিবি কোন সাহসে?! এটাকে কি তোর মেট্রিমোনিয়াল এসোসিয়েশন মনে হয়? এখানে কি মানুষ বিয়ে করতে আসে? যত্তসব রাবিশ!

‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভির কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে আমির খান ছাড়া আর পুরো ভার্সিটির সবাইকেই ইডিয়টই মনে হয়েছে! আসলে এসব নামকরা ভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির জন্য ‘ইডিয়ট আইডেন্টিফায়িং’ একটা সিস্টেম থাকা উচিত, যার মাধ্যমে এধরণের কুলাঙ্গারদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেয়া হবে না। এদের কারণে দুদিন পর পর একেকটা স্ক্যান্ডাল বের হয়। মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো দেখে পটে যায়, আর এরা অসভ্যতা করে সেই সুযোগ নেয়। বিরক্ত হয়ে আমি মাথার নিচের বালিশটা মুখের উপর চেপে ধরলাম। একটা ক্লাসলেস ইডিয়টকে নিয়ে আমি কেন ভাবছি? এই কণার কি এতই খারাপ দিন চলে এলো?

এক সপ্তাহ ছুটি পেয়েছি। এক সপ্তাহ পর আজ আবার ক্লাস শুরু হয়েছে। এই দেশে থাকলে দুদিন পর পর বিরোধীদলীয় নেতাদের অত্যাচারে স্বাভাবিক জীবন অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আমার অবশ্য খুব একটা খারাপ লাগে না। আমাদের লাইফস্টাইল যেমন প্রেশার কুকারের মত হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে এমনতর বিরতি আমরা ডিজার্ভ করি!

আলমারি খুলে বাসন্তী রঙের থ্রিপিস বের করলাম। চুল ছোট রাখায় সবসময় একটা কটি পরি যে কোনো ড্রেসের সাথে। আজ একটা রাজস্থানী কটি পরলাম উপরে। এটা আমার স্টাইল। অনেকে অবশ্য আমাকে এধরণের ড্রেসাপের জন্য একটু অন্য চোখে দেখে, আমার সেসবে আসে যায় না। ড্রেসাপ রিপ্রেজেন্টশ ইউর পার্সোনালিটি। আমার পার্সোনালিটির সাথে এরকম কাপড়ই যায়।

ভার্সিটিতে গাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম, তবে ডিপার্ট্মেন্টের সামনে গাড়ি দিয়ে নামলাম না। ক্যাম্পাসের ভেতরে না নিয়ে গেইটেই নেমে সেখান থেকে হেঁটে ভেতরে আসলাম। আমি চাই না আমার সহপাঠীরা আমার বাবার টাকা সম্পর্কে এখনই জানুক। এসব ভাবতে ভাবতে ক্লাসে গিয়ে বসলাম। একটু পরেই জাহিদের সাথে ওর বন্ধুদের ঢুকতে দেখলাম। সেই ইডিয়টটাও আছে! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল, আজকের দিনটা নিশ্চিত খারাপ যাবে। আমি ব্যাগ থেকে খাতা বের করে কিছু একটা লেখার ভাণ করলাম। পুরো ক্লাসে মনোযোগ ছিল, পরের ক্লাসও এই রুমে থাকায় আমাদের বিশেষ ঝামেলা করতে হয়নি। এরপর একটা ব্রেক। ব্রেকের পর আরও তিনটা ক্লাস আছে। আমি বেরিয়ে আসলাম তখনই জাহিদ আমাকে ডেকে ওর বন্ধুদের সাথে পরিচয় করানোর সময়ই বিপত্তি ঘটল। রেগে বলে আসলাম, তোকে কোনো কুত্তাও বিয়ে করবে না!

রাগে গজগজ করতে করতে ক্যান্টিনে চলে আসলাম। সেখানে বসে এক টাকার চা নিয়ে ভবনের পেছনের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। প্রথম দিনেই একটা ঝামেলা পাকানো কি ঠিক হলো? চায়ে চুমুক দিয়ে মাথা কিছুটা ঠান্ডা হলো। শুভ যদি ঝামেলা করে? আমি বাকি সময়টা কি করে কাটাবো?

কিছুক্ষণের জাহিদের আগমন, কোনো কথা না বলে আমার পাশে বসলো।
“এত রেগে আছিস কেন? শামীম আবার ঝামেলা করছে নাকি?”
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
“শামীমকে যে আমি লাথি মেরে লাইফ থেকে বের করে দিছি, সেটা বলি নাই তোকে?”
“কিহ?! তোদের ব্রেকাপ হয়ে গেছে?”
“অবশ্যই! এরকম স্টুপিডের সাথে রিলেশন কেন রাখতে যাবো?”
জাহিদ কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে বলল,
“তাহলে ক্ষেপে আছিস কেন?”
“কারণ তোর ফ্রেন্ড একটা অসহ্য চরিত্র। একে দেখলেই কেমন যেন গা জ্বলে, ইচ্ছে করে লাঠি দিয়ে পিটাই”
“ধুর, কিছু ছেলে এমন হয়। তবে শুভ এতটাও খারাপ না”
“এতটাও ভালো না! ওর সমস্যা কি আসলে বল তো?”
“ও মেয়েদের দেখলে মজা করে। আর কিছু না। শুধু শুধু ওর উপর রাগ দেখাইস না। তাহলে ও আরও লাই পাবে। ওকে ভালো না লাগলে ইগ্নোর কর”
“বুঝলাম”

ঐদিন আর ওদের সাথে কথা বললাম না। দুটো নতুন মেয়ের সাথে পরিচয় হলো- স্নিগ্ধা আর নীনা। এরপর থেকে জাহিদদের চাইতে স্নিগ্ধা আর নীনার সাথেই বেশি থাকি আমি। আশ্চর্যজনকভাবে শুভ আমাকে দেখলে শয়তানী মাখা হাসি দিত, কিন্তু আর কিছু বলত না। আমিও ওকে দেখেও না দেখার ভাণ করতাম। একদিন আনমনে হাকিম চত্বরে বসে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলাম, তখন নীনা প্রশ্ন করল,
“কি ভাবছিস এমন করে?”
“আচ্ছা, তোকে একটা ছেলে পছন্দ না করলে কি কখনো প্রথম দেখাতেই বিয়ের কথা বলবে?”
স্নিগ্ধা মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি আটকে বলল,
“আজকালকার ছেলেরা তো দশ বছর প্রেম করেও বিয়ে করতে রাজী হয় না, আর প্রথম দেখাতে বিয়ের কথা কে বলবে?”
আমি বললাম,
“তার মানে এটা প্র‍্যাঙ্ক ছিল?”
নীনা মাথা নাড়লো।
“হয়ত প্রথম দেখাতে বিয়ের কথা মনে এসেছে, এজন্য… ”
“আমাকে দেখলে কি ম্যারেজ ম্যাটারিয়াল মনে হয়?”
“তোকে আবার কে এ কথা বলল?”

আমি সামনের দিকে তাকালাম।
“বলেছ কেউ একজন। কিন্তু সে কি আসলেই ফান করল, নাকি সিরিয়াস, এখনো বুঝতেছি না”
স্নিগ্ধা আমার হাতে হাত রাখলো।
“পাত্তা দিস না তো। এখন কি বিয়ের বয়স নাকি? অনার্স, মাস্টার্স শেষ করার পর বিয়ে নিয়ে ভাববি। এখন এসব মাথায় যায়গা দিস না তো!”

স্নিগ্ধা আর নীনা আমাকে বোঝালেও আমার মাথায় শুভ ঘুরতে থাকে। প্রথম প্রথম ওকে শিম্পাঞ্জির মত লাগলেও একদিন ওকে ভালোভাবে খেয়াল করলাম। ওর উচ্চতা ভালোই আছে, ফিগারও খারাপ না, মোটাও না, আবার শুকনোও না। ফর্সা না, তবে চেহারার কাটিং ভালো, বিশেষ করে ওর জ লাইন! আমার আবার ছেলেদের জ লাইনের প্রতি একটা দূর্বলতা আছে। শুভও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমিও তাকাই। ধীরে ধীরে আমি স্নিগ্ধা আর নীনাকে নিয়ে ওদের সাথে মিশতে শুরু করলাম। ভার্সিটিতে পা রাখলেই আমরা হাকিম চত্বর, পাব্লিক লাইব্রেরী, মল চত্বর, টিএসসি, কার্জনহল, মহসিন হল, সব যায়গা চষে বেড়াতে শুরু করলাম। ভাবতেও অবাক লাগে, শুভকে এখন আর আগের মত অসহ্য লাগে না আমার৷ কি আশ্চর্য!

চলবে…

(আব্বু অসুস্থ থাকায় একটা বড় গ্যাপ পড়েছে। এখন থেকে আবার নিয়মিত গল্প দিব ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here