শুভ বিবাহ পর্ব-৫

0
1277

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

A sweet disorder in the dress
Kindles in clothes, a wantonness
A lawn about the shoulders’ thrown
Into a fine distraction

An erring lace, which here and there
Enthralls the crimson stomacher
A cuff neglectful, and thereby
Ribbons to flow confusedly

A winning wave, deserving note
In the tempestuous petticoat
A careless shoestring, in whose tie
I see a wild civility

More bewitch me than when art
Is too precise in every part

রবার্ট হ্যারিকের এই কবিতা আবৃত্তি করলাম একা ঘরে বসে বসে। কবিতার নাম “ডিলাইট ইন ডিজঅর্ডার”, যার অর্থ এলোমেলোতে আনন্দ। কথা হচ্ছে, এলোমেলোর মাঝে আনন্দ কি করে আসবে? আজকে স্যার সেটাই বুঝালেন। ব্যাপারটা মেয়েদের যে উল্টাপাল্টা থাকলেও কত সুন্দর লাগে, সেটাই বুঝিয়েছে। আমি বাংলায় পড়ছি,
তোমার পরিপাটি জামায় এলোমেলো ভাঁজ,
কাঁধ থেকে সরে আসা জামার অংশ
যেন সব মনোযোগ সেখানেই আটকায়!
বাতাসে উড়ে চলা তোমার ঢোলা স্কার্ট,
উড়ে বেড়ানো এলোমেলো চুলের ফিতা!
উফ!

কবিতা পড়ে একটা সন্তোষ্টির হাসি হাসলাম। কবির মাথায় কত কি ঘোরে! আসলেই একটা মেয়েকে এলোমেলো থাকলে অন্য রকম ভালো লাগে, মনে হয় যেন প্রতিটা ভাঁজ প্ল্যান করে করেছে। আমি আনমনে স্বপ্নের নায়িকার কথা ভাবতে ভাবতে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম, তখন চোখ পড়ল সামনের বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার একটা জানালায়। সন্ধ্যা হবে কিছুক্ষণের মাঝে, সম্ভবত ওদের বিল্ডিংয়ে বিদ্যুৎ নেই। আমাদের বাসাটা চারতলায় হওয়ায় তৃতীয় তলার ঐ ঘরটা উপর থেকে অনেকটা দেখা যাচ্ছে। ঐ জানালায় তাকিয়ে হুট করে আমি ‘ডিলাইট ইন ডিজঅর্ডার’ দেখতে পেলাম!

সামনের ঐ জানালায় তুতুন দাঁড়িয়ে আছে, ওর হাতে একটা মোমবাতি। আজ তার চোখে চশমা নেই, দীঘল চুল ছেড়ে রেখেছে, তার কিছু কাঁধের দুপাশে পড়ে আছে। আমি জানালা দিয়ে দেখলাম, আলতো বাতাসে ওর সামনের চুল এলোমেলো হয়ে গেছে, মোমবাতির শিখা যেন ভয়ে কেঁপে উঠেছে। তুতুন হাত দিয়ে আগুনের শিখাকে অভয় দিল যেন। সন্ধ্যা আর মোমবাতির ক্ষীণ আলো ওর এলোমেলো চুলের ফাঁকে মুখে অনিন্দ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। আমি ওর কামিজের খানিকটা সরে বেরিয়ে আসা কাঁধ আর গলদেশ দেখছি। কে বলবে এই মেয়ে সামান্য গল্পের বইয়ের জন্য কেঁদে কেটে দিন পার করে দিয়েছে? তুতুনকে এখন চেনাই যাচ্ছে না। ওকে একজন পরিণত নারীর মত লাগছে, যার যৌবনের সৌন্দর্য পরিপূর্ণতা পেয়েছে!

পেছন থেকে শায়লার ডাকে চমকে উঠি।
“ভাইয়া, জানালায় কি কর?”
আমি পর্দা টেনে দিলাম জানালায়। ভ্রু কুঁচকে পালটা প্রশ্ন করলাম,
“জানালায় কি করি মানে? জানালায় আবার কি করব? জানালায় মানুষ কি করে? কিছুই করি না! বাইরে দেখি! আকাশ দেখি, বাতাস খাই! কেন, তোর কি সমস্যা? তুই কি আমার ঘরে আসছিস আমি জানালায় কি করি সেটা দেখতে? নাকি আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য?”

শায়লা থমকে গেছে। আমি ওকে এভাবে পালটা আক্রমণ করব, সেটা হয়ত ভাবে নি। থমথমে কন্ঠে বলল,
“এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম! এজন্য এত গুলো কথা বলবা? এদিক দিয়ে ঐ বিল্ডিং ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না, এজন্য জিজ্ঞেস করা”
আমি প্রসঙ্গ চাপা দেয়ার চেষ্টা চালালাম।
“কি জন্য এসছিস, সেটা বল আগে”
“আম্মু ডাকে তোমাকে”

শায়লা কথা শেষেই ঘুরে বেরিয়ে গেল। আমি যে তুতুনকে দেখছিলাম, সেটা কি শায়লা বুঝে গেল কোনোভাবে? নাহ, ও কি করে বুঝবে? বেঁচে গেলাম বোধহয় এই যাত্রায়। মাথা ঘুরিয়ে পর্দা সরালাম। না, তুতুন সেখানে নেই, সরে গেছে। আমাদের কথা শুনে ফেলল নাকি? দুটো বিল্ডিংয়ের মাঝে তো খুব একটা ফাঁকা নেই, শব্দ যাওয়াটাও কোনো ব্যাপার না। যদি শোনে, তাহলে প্রেস্টিজ থাকবে না। এত ছোট বাচ্চার কাছে প্রেস্টিজ নষ্ট করতে চাই না।

পরদিন ভার্সিটিতে গেলাম। আজ এই সেমিস্টারের প্রথম প্রেজেন্টেশন, এজন্য বেশিরভাগ মেয়েরা শাড়ি পরে এসেছে। বাহ, আমি রসগোল্লার মত চোখ বানিয়ে এদের দেখছি। কি সুন্দরী সুন্দরী রমনী, যেন সদ্য যৌবনের বাগানে ফোটা ফুল! আহাহা! মেয়েদের অমন শাড়িতে দেখে আমার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। ব্যাপারটা আমি একা না, আমার অন্যান্য বন্ধুদের বেলায়ও ঘটেছে। আমরা আমাদের মাঝে আলোচনা চালানো শুরু করলাম কে কাকে নেবে। হাসাহাসি করতে করতে খেয়াল করলাম, কনা, স্নিগ্ধা আর নীনা এসে হাজির হয়েছে। বাকিরা শাড়ি পরলেও কনা তার সেই সচরাচর ড্রেসকোড থেকে বের হয়নি। আমি বিটকেলে হাসি দিলাম,
“কি রে! তোর স্কুল ড্রেস ছাড়া আর কি কোনো ড্রেস নাই?”
কনা আমার দিকে এমন চাহনি দিল যেন আমার মাথা মটকে দিবে। নেহাৎ স্যার তখন ঢুকে পড়েছে, তাই আমার মাথা মটকানো হলো না ওর।

ক্লাস শেষে আমি স্নিগ্ধার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে মুখে রোমিওর মত করুন স্বর ফুটিয়ে তুলে বললাম,
“ম্যারি মি ডার্লিং!”
তিন বান্ধবীর মাঝে স্নিগ্ধা একটু বোকা, তাই ওর সাথে মজা করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু স্নিগ্ধা কিছু বলার আগে কনা বলল,
“শিক্ষিত হইছিস বোধহয়? আগে বাংলায় বলতি, এখন ইংরেজি ঝারছিস, না? তোকে বলেছিলাম না৷ কুত্তাও বিয়ে করবে না? কয়দিন পর দেখিস, আমার কথাই সত্যি হবে!”

কনাকে দেখে মনে হচ্ছে, ওর অনেক রাগ হয়েছে, নাকের ডগা লাল হয়ে যাচ্ছে। ওর রাগান্বিত মুখ দেখে আমার ভেতর কৌতুক জেগে উঠল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে মুখ বাড়িয়ে বললাম,
“সেইম টু ইউ!”

কনা আমাকে নোটিশ ছাড়াই মেরে বসলে আমিও পেছনে সরে গেলাম, ফলে ওর আক্রোশে ছুড়ে মারা হাত বাতাসে আঘাত করল। আমার কান্ড দেখে অন্যান্যরা হাসছে। আমি কনার দিকে আঙুল তুললাম,
“তুই যে আমাকে মারতে চাস, মারামারি লাগলে পারবি আমার সাথে?”
“তোর মত অসভ্যের সাথে আমি কেন মারামারি করব? আচ্ছা, তোর লজ্জা লাগে না সবাইকে এমন বিয়ের প্রস্তাব দিতে?”
“বিয়ে করব, এতে লজ্জার কি আছে? বিয়ে করার পরই না লজ্জা পেতে হবে! কি বলো স্নিগ্ধা?”
কনা রেগে বোম হয়ে গেলেও স্নিগ্ধা হাসছে। ওকে দেখে বুঝা যাচ্ছে, সে লজ্জা পাচ্ছে। আমি স্নিগ্ধার দিকে একটু সরে এসে বললাম,
“তোমাকে দেখেই কিন্তু কাজী অফিসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আজকে, যেভাবে শাড়ি পরে এসছ! যাবা নাকি?”
কনা ওপাশ থেকে আবার চেঁচিয়ে উঠল,
“বন্ধ করবি এসব?”
আমি মুখ ভেংচালাম।
“কেন? নিজে বিয়ে করবি না ভালো কথা, অন্য কেউও আমাকে বিয়ে করবে না?!”
“এত ফালতু তুই!”

ওপাশ থেকে জাহিদ কনাকে হাত তুলে বলল,
“তুই শুধু শুধু ক্ষেপিস কেন? শুভ তো মজা করতেছে। ধুর, চল তো!”
আমি দাঁত বের করে হেসে স্নিগ্ধার দিকে চোখ মেরে বললাম,
“আমি সবার সাথে মজা করলেও তোমার সাথে মজা করতেছি না, সত্যি!”
সবাই হাসলেও কনাকে দেখে মনে হলো ও আমাকে জুতো ছুড়ে মারবে। আমি অবশ্য ওকে পাত্তা না দিয়ে স্নিগ্ধার হাত ধরে হাঁটছি। মেয়েটা মোটেও কনার মত না, বরং মুখ নিচু করে হাসি লুকাচ্ছে। আমি পেছন ফিরে কনাকে বললাম,
“সবাই তোর মত বজ্জাত না, বুঝলি?”
ও কিছু বলার আগেই স্নিগ্ধাকে নিয়ে সামনের দিকে চলে আসলাম।

সবাই মিলে আজকে ঘুরোঘুরি করতে করতে স্নিগ্ধাকে নিয়ে একটু আলাদা হয়ে গেলাম। এই সময় স্নিগ্ধা আমার হাত ধরে হাসিমুখে বলল,
“তুমি কনাকে খুব পছন্দ করো, তাই না? ওকে জেলাস করানোর জন্য এসব করছ, না?”
স্নিগ্ধার রিনরিনে নরম কন্ঠ আমার মগজে গীর্জার ঘন্টার মত শব্দ করে উঠল। আমি ওর কথা না বুঝতে পারায় বললাম,
“এ্যাঁ?!”
“তুমি কনাকে পছন্দ করো না? কনা কিন্তু তোমাকে পছন্দ করে!”

আমি বোকা হয়ে গেলাম, তবে সেটা ওকে বুঝতে না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে আবার ওদের কাছে চলে আসলাম। কনা আমাকে দেখে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এতদিনে আমরা জেনে গেছি, কনা বড়লোক বাবার একমাত্র কন্যা! ও যে নিয়মিত গাড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করে, তা প্রথম বর্ষের শুরুর এক মাসের মধ্যেই জেনেছি। এক সাথে খেতে বসলে বেশিরভাগ বিল কনাই দেয়, কিংবা বিলের সিংহভাগ পে করে। আমরা সেসব নিয়ে ছেলেরা বেশ পুলকিত। এমন বড়লোক বান্ধবী থাকলে কার ভালো না লাগে? কনাকে অবশ্য এসব বললে ও ক্ষেপে না, স্বাভাবিক থাকে। অথচ আমি আজকে স্নিগ্ধার সাথে মজা করায় কেমন ক্ষেপে গেল! স্নিগ্ধার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? নাকি কনার? সেসব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে আমিও ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে চলে আসলাম।

বলাই হয়নি, প্রেজেন্টেশন এর কারণে আমরাও ফর্মাল ড্রেসাপে ছিলাম। বাসায় যেতে যেতে টাই আলগা করে নিলাম। কোনো একটা অজানা কারণে ফ্ল্যাটের সামনে এসেও বেল টিপে ভেতরে যেতে ইচ্ছা হলো না, সোজা ছাদে চলে আসলাম। বিকালের আকাশে আজ নরম রোদেরা খেলছে। আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সামনে তাকালাম। কি সুন্দর আবহাওয়া আজকে! আর তারপরের আমার শান্ত মেজাজে পানি ঢেলে দিল কত গুলো পিচ্চির দলের চিৎকার। ও পাশে ফিরলাম। পাশের বাসার ছাদে সেই তুতুন পিচ্চিটা বসে আছে। আজ সে দুই বেণী করেছে, চোখে চশমা, পরনে লাল কমলা রঙের প্রিন্টের কামিজ আর কমলা রঙের সেলোয়ার আর ওড়না। আমি টাই আরও লুজ করে টেনে খুললাম। আজ তুতুন ওর চেয়ে ছোট কয়েকটা পুঁচকির সাথে কি যেন একটা খেলছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ও কেমন যেন দমে গেল। আমার কি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত? বেচারি আমার জন্য সহজ হতে পারছে না। পরক্ষনেই আমার স্বভাব জেগে উঠল। যেতে চাইলে ও ছাদ থেকে যাবে, আমি কেন যাবো? আমাদের বাসার ছাদ, আমি থাকব! বিরক্ত হয়ে চেঁচালাম,
“এই পিচ্চি! তোমাদের সারাদিন কোনো কাজ নাই? সারাক্ষণ ছাদে কি?”

আমার কন্ঠ শুনে ওরা সবাই আমার দিকে তাকালো। ওদের চোখে মুখে দ্বিধা। আমি আবার বললাম,
“এই যে দুই শিং ওয়ালী! এই বয়সে ছাদে কি করো শুনি? আজকাল তোমাদের বয়সী মেয়েরা তো আবার প্রেম করতে শিখেছে! ছাদে উঠেছ কি প্রেম করার জন্য?!”

আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুতুন কেঁদে দিবে। আশেপাশের পিচ্চিরা একবার ওর দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার আমার দিকে। আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
“এখনো ছাদে বসে আছো কেন? যাও! বাসায় যাও! স্পেশালি তুমি, দুই শিং ওয়ালী! তুমি সবার আগে ভাগো!”

তুতুন প্রায় কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে মুখে হাত চেপে পালালো। আমি ছাদের কোণে ফেলে রাখা ভাঙা টেবিলের উপর বসলাম। আহ! এখন একটু শান্তিমত এখানে বসা যাবে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here