#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria
পর্ব ৬
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। পাশের বাসার ভাইয়াটা মনে হয় আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। সেদিন ছাদে গেলাম, আমাকে নাম নিয়ে বাজে কথা বলল। আমার নাম নাকি তেঁতুল ফুল হওয়া উচিত। কেন? আমি দেখতে তেঁতুল ফুলের মত? আমি কি তেঁতুল গাছে ঝুলে থাকব এখন? আমার নাম শুনে সবাই বলে “কি কিউট!” আর উনি? কি খারাপ একটা মানুষ। আমার সেদিনও অনেক কান্না পেয়েছে। তারপর যখন লাফ দিয়ে ছাদে আসলো, তখন মনে হলো একটা গুন্ডা। একটা গুন্ডা না হলে।এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে এভাবে লাফিয়ে আসে? আমাকে বোধহয় ধরতে এসছিল উনি। আমার কি ভয়টাই না লেগেছিল! আমি ভয়ে দৌড়ে ছাদ থেকে চলে এসেছি। তখন খেয়ালই করিনি যে আমার প্রিয় বইটা ফেলে এসেছি। কিছুক্ষণ পর ছাদে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি বইটা নেই। সারারাত কি কান্না এসেছে আমার! পরীক্ষার আগে ফুপি দিয়েছিল বইটা। আমি কোনোদিন বই জমাই না! কিন্তু পরীক্ষা ছিল বলে প্রতিদিন নিজেকে বুঝ দিতাম, কদিন পরেই পরীক্ষা শেষে পড়তে পারব। যতবার বইটা চোখে পড়ত, ততবার চোখে দুহাত চেপে ধরতাম। নিজেকে বুঝাতাম, নতুন কোনো বই নেই তোর, কোনো বই নেই! অথচ সেই বই যদি হারিয়ে যায়, তাহলে কান্না পাবে না?
সারারাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে সকালে আম্মুর কাছে ধরা পড়ে গেলাম। কান্না করছিলাম, এই কথা জানার পর আম্মু ইচ্ছামতো বকলো আমাকে। আমি তখন আরও বেশি করে কাঁদলাম। মনে হচ্ছিল বইয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাবো! বিকালের দিকে ঐ বাসার আন্টি এসে দিয়ে গেল বইটা। বইটা নাকি ঐ আন্টি যিনি আম্মুর বান্ধবী হোন, উনার ছেলে দিয়েছিল। জানতে পারলাম ভাইয়াটার নাম, শুভ। উনার নাম শুভ কে রেখেছে? উনার নাম শুভ না রেখে অশুভ রাখলে ভালো হতো!
উনার নাম যে অশুভ হওয়া উচিত ছিল, সেটা আজকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। আজকে উনি আমাকে দুই শিংওয়ালী ডেকেছে! আবার বকা দিয়ে আমাদের সবাইকে আমাদের ছাদ থেকেই ভাগিয়ে দিয়েছে!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেগে দুই বেণী টেনে খুলে ফেললাম। আম্মু জোর করে আমাকে সবসময় দুই বেণী করে দেয়। আমার দুই বেণী একদম ভালো লাগে না, তবুও করে দেয়। স্কুলে সবসময় দুই ঝুটি আর দুই বেণী করতে করতে এখন আর ভালো লাগে না। অথচ এই দুঃখ কে বুঝাবে? আজকে এই দুই বেণীর আমাকে দুই শিংওয়ালী ডাক শুনতে হলো! কি খারাপ একটা মানুষ! আমি চুল কেটে টাক্কু বেল হয়ে যাবো, তবুও আর কোনোদিন দুই বেণী করব না!
আম্মু কিছুক্ষণ পর এসে দেখল আমি চুল পেছনে কাকড়া ব্যান্ড দিয়ে খোপার মত করে আটকে রেখেছি। আমাকে খোপা করতে দেখলে আম্মুর যেন কি হয়, সে ছুটে এসে বকতে থাকে। এবারও ব্যতিক্রম হলো না, আম্মু আমার দিকে ছুটে আসলো। আমি দুই হাতে আমার খোপা চেপে ধরলাম। আমি কোমরে হাত রেখে বলছে,
“তুই খোপা করছিস কেন? তোকে না কতবার মানা করেছি এভাবে চুল বাঁধবি না?”
আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,
“এভাবে চুল বাঁধলে কি হয়?!”
“ঝগড়াটে মহিলাদের মত লাগে! বয়স্ক লাগে! ঐ, তোর সেই বয়স হইছে?”
“আম্মু! আমার বান্ধবীরাও তো বাঁধে!”
“কোন বান্ধবী বাঁধে? ঐসব খারাপ খারাপ মেয়ের সাথে চলবি না!”
“আম্মু! এভাবে চুল বাঁধলে কেউ খারাপ হয়?!”
“তোকে মানা করার পরও তর্ক করতেছিস কেন?”
আম্মু আমার খোপা খুলে বেণী করতে বসলেন। আমি জোর করে বললাম,
“দুই বেণী করব না! এক বেণী করব!”
আম্মু তারপর লেকচার দিতে থাকলেন খোপা করলে কত বাজে দেখা যায় সেটা নিয়ে। বেণী ছাড়া কি আর কিছু করা যায় না? আম্মুর কাছে বড় চুলের ছেলেরা খারাপ, ছোট চুলের মেয়েরা খারাপ, খোপা করা মেয়েরা খারাপ, জিন্স পরা মেয়েরা খারাপ, তর্ক করা মেয়েরা খারাপ, সিগারেট খাওয়া ছেলেরা খারাপ! কিন্তু সেদিন ঐ অশুভ ভাইয়ার খুব প্রশংসা করছিল।
হঠাৎ খেয়াল হলো। ঐ ভাইয়াটা না সিগারেট খায়? তাহলে ঐ ভাইয়াকে কেন ভালো বলবে? খারাপ ছেলেদের প্রশংসা তো আম্মু করে না! উনি এমন কি করে যে আম্মু এত এত প্রশংসা শুনায় আমাকে? নাকি আম্মু জানেনা যে সে সিগারেট খায়?
আমার খুব রাগ হলো। আমিও এক মাস পর এসএসসি পরীক্ষা দিব, গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাবো। আম্মু তখন আমারও প্রশংসা করবে। আম্মু এখন আমার চুল জোরে জোরে টেনে টেনে বেণী করে দিচ্ছে। আম্মু কি বুঝে না আমার চুল টানলে আমি ব্যথা পাই? আমার আবার কান্না পাচ্ছে তাই ঠোঁট উলটে শেষ পর্যন্ত কেঁদেই ফেললাম। আম্মু আমার কান্না শুনে বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কান্নার মত কি হলো আবার?!”
“শুভ ভাইয়া আমাকে দুই শিং ওয়ালী ডেকেছে আজকে ছাদে সবার সামনে!”
“কোন শুভ?”
আম্মু বোধহয় চিনতে পারছে না।
“পাশের বাসার শুভ”
“কোন পাশের?”
“ঐ যে তোমার বান্ধবীর ছেলে, সেদিন যে আমার বই দিল!”
“ওহ আচ্ছা! ও নিশ্চয়ই মজা করেছে?”
আমার চোখ বেয়ে সত্যি সত্যি পানি পড়ছে।
“না, মজা করেনি। আমাদের সবাইকে বকে ছাদ থেকে ভাগিয়েও দিয়েছে! খুব খারাপ উনি!”
আম্মু স্বাভাবিকভাবে বললেন,
“ওরকম কিছু না। বড়রা একটু বকা দিলে কিচ্ছু হয় না”
আমি শব্দ করে কেঁদে বললাম,
“আমাকে বলেছে, আমি নাকি প্রেম করতে ছাদে উঠেছি! আমি কি প্রেম করতে ছাদে যাই? আমি কি খারাপ মেয়ে?”
আম্মু কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন,
“নিশ্চয়ই তুই কিছু একটা করেছিস! আজকে থেকে ছাদে যাবি না তুই!”
এইবার ইচ্ছা করল আকশ বাতাস কাঁপিয়ে কান্না করতে! আমার আম্মুর চোখে পৃথিবীর সবাই খুব ভালো, আর সবচেয়ে খারাপ! আমি কি বলেছি আমি প্রেম করি? জীবনেও কোনো ছেলের সাথে কথা বললাম না, এমনকি আম্মুই এখনো আমাকে স্কুলে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। আমার বান্ধবী তামান্নার ভাই আমাকে পছন্দ করে বলে চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠি পেয়ে আম্মু তামান্না আর ওর আম্মুর সাথে ঝগড়া করে ওদের বাসায় যাওয়া আজীবনের জন্য বন্ধ করে দিল! অথচ ঐ ভাইয়ার সাথে আমি জীবনেও কথা বলিনি, তবুও! রাস্তায় কোনো ছেলে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে আম্মু সেখানেই ঝগড়া শুরু করে দেয়! আমি গলির মাথার দোকানেও একা যেতে পারি না। আর এখন বলে কিনা ছাদে যাওয়াও বন্ধ?
বালিশ নিয়ে বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মত কান্না শুরু করলাম। আমার সব শেষ! শুধু ছাদেই একা যেতে দিত, এখন থেকে সেটাও পারব না। সব ঐ অশুভ ভাইয়ার দোষ! আমি কি কিছু করেছি? তবুও আম্মু আমার সাথে কেন এমন করে? আম্মুর কাছে তার মেয়ে বাদে পৃথিবীর সবার ছেলে মেয়ে ভালো। সারাক্ষণ আমাকে বেঁধে রাখে আম্মু। যদি পারত, তাহলে নিশ্চিত মুরগীর মত একটা খাঁচিতে আটকে রাখত আমাকে! মানুষ বলে ইট কাঠের এই খাঁচায় আটকে রেখেছে।
বুক ফেটে কান্না আসছে। আল্লাহ গো! আমার কি হবে গো!
চলবে…