শুভ বিবাহ পর্ব-৮

0
1221

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

পর্ব ৮

আজকে মেজাজ চরম রকম গরম। সকাল সকাল শায়লার সাথে ঝগড়া লেগে গেল, তারপর আব্বুর ঝাড়ি। বাসা থেকে বের হয়ে দেখলাম একটুর জন্য ভার্সিটির বাস মিস হয়ে গেল। পরের বাসের জন্য বসে থাকলে ক্লাসে দেরী হবে। মেজাজ গরম করে অন্য বাসে উঠে বসলাম। ক্লাসে শান্তি মত সময় কাটলেও ক্লাস শেষে কণার সাথে ধাক্কা খেয়ে কণা পড়ে গেল। বুঝলাম না, আমি এত বড় একটা মানুষ, আমাকে কি ও দেখবে না? তবুও ওকে তুলতে গিয়ে ওর সাথে ঝগড়া লেগে গেল। আমিই সরি বললাম, তবুও যা মুখে আসলো তাই বলল। এজন্য আমি ধরে হাতে চিমটি দিয়ে দৌড় দিয়েছি! আমার সাথে অকারণে ঝগড়া করবি কেন? চিমটি খেয়ে ওর হাত লাল হয়ে গেছে। ভালো হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে।

হাকিম চত্বরে বসে যখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন কোত্থেকে যেন এক বালতি পানি আমার মাথায় পড়ল! আমি হাঁ করে কয়েক সেকেন্ড থমকে থেকে পেছনে ফিরে দেখলাম কণা দাঁতে দাঁত পিষে আমার দিকে চেয়ে আছে। ওর হাতে একটা বালতি, আর সেটা হলো পাশের ফুচকাওয়ালা মামার ময়লা পানির বালতি। রাগে মন চাচ্ছিল কণার ঐ ছোট ছোট চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে ছিল। কারো চোখে ভয়, কারো চোখে আমার পরবর্তী কার্যক্রম দেখার কৌতুহল, কারো চোখে ভয়। তবে কণার চেহারায় স্পষ্টত প্রতিশোধের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে যার খানিকটা নিভে এসেছে আমাকে ময়লা পানিতে ভিজিয়ে।

আমার যেন কি হয়ে গেল। এতগুলো মানুষের মাঝে আমি কণাকে জড়িয়ে ধরলাম! আশেপাশের সবাই চমকে উঠল, চমকে উঠলাম আমি নিজেও! এটা কি করলাম? পরমুহূর্তে ওকে ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরলাম যেন আমার গায়ের ময়লা পানি ওর গায়েও লেগে যায়। মাত্র দুই তিন সেকেন্ড, এর মাঝে আমার ভেতরের মিচকা শয়তান জেগে উঠল। আমি কণাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে বললাম,
❝এখন আর আমি একা ময়লা পানিতে ভিজিনি, তুমিও ভিজেছ! কি? আরেক বালতি পানি আনি?❞
কণা বিস্ফোরিত চোখে আমাকেই দেখে আশেপাশের সবাইকে দেখলো। সবাই আমাদেরকে দেখছে। কণা আমার কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালালো। আমার বন্ধুরা সব হাঁ করে আছে। ওরা জিজ্ঞেস করল,
❝এটা কি করলি তুই?❞
❝আমার সাথে এমন করল কেন? এখন জ্বলে পুড়ে মরুক। সবার সামনে আমাকে ময়লা পানিতে ভিজিয়েছে, আমিও দিলাম সবার সামনে ইজ্জতের ফালুদা করে, যাহ শালা!❞

জানি না কণা কি করবে, তবে নিকট ভবিষ্যত ভালো না। যেহেতু এই ময়লা নিয়ে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, তাই আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম। আমি জানি না এরপর কি হবে, কণা কি করবে; শুধু মনে হচ্ছে, একটা উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া গেছে। মেয়ে হয়ে ছেলেদের সাথে লাগতে আসবি কেন? কণাকে কোনো এক অজানা কারণে তুই বলতে পারি না যদিও ও সবসময় আমাকে তুই করে বলে। আজকের পর ফ্রেন্ডসার্কেলে একটা বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে নিশ্চিত। আমাকে কণা কি বলে ডাকবে, তার জন্য আমি অপেক্ষা করতে চাই।

বাসায় এসে গোসলে ঢুকলাম। গোসল শেষে খাবার খেতে বসলাম, তক্ষুনি আম্মু এসে বলতে শুরু করল,
❝তুই পাশের বাসার তুতুনকে কি বলছিস?❞
আমি ডালের সাথে মাছ মাখতে মাখতে বললাম,
❝কোন তুতুন?❞
❝সেদিন যে বই দিলি ওর। ওকে কি বলছিস?❞
আম্মুর মুখের দিকে তাকালাম।
❝তোমাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে তুমি জানো সব। তুমিই বলো কি বলেছি?❞
❝আশেপাশের বাসার মেয়েদেরকে আজেবাজে কথা বলবি কেন? বকাবকি করবি কেন? আমি যেন এসব আর না শুনি!❞

আমার গুণমুগ্ধ মা অনেক দিন মুখ কুঁচকে বকে গেল। এখন আমার প্লেটের ভাতগুলোকে চাল মনে হচ্ছে। তুতুনকে দেখলে তো হাবাগোবা মেয়ে মনে হয়। অথচ সে কিনা আমার মা পর্যন্ত অভিযোগ পৌঁছে দেয়? সাহস তো কম না! আজই ধরতে হবে।

খাওয়া শেষে দেখলাম, আসামী ছাদে হাজির। ইচ্ছে মত বকলাম। মেয়ে তো কেঁদেকেটে একাকার! কি রে ভাই, ওর চোখে কি ওয়াসার লাইন লাগানো? কথায় কথায় এত কাঁদে কেন? এজন্য ঐ ছাদে গিয়ে হাত ধরে উঠিয়ে বসালাম। ঐদিকের কয়েকটা ছেলের নজর পড়েছে ওর উপর। ছেলেগুলো ভালো না, তাই সাবধান করলাম। যেরকম মেয়ে, দেখলে মনে হয় না এসব বোঝে। এত উজবুক হয় কি করে ওরা? কোন পন্ডিত যেন বলেছিল, মেয়েরা নাকি পেছন থেকে কোনো ছেলে বাজেভাবে তাকালেও বুঝতে পারে, কেউ প্রেমে পড়লেও বোঝে। ঐ পন্ডিত নিশ্চিত তুতুনের মত কার্টুন গুলোকে মিস করে গেছে। নাহলে এমন কথা জীবনেও বলত না!

তুতুনকে বকা দিয়ে বেশিক্ষণ ছাদে থাকতে পারলাম না, চলে আসলাম। ছাদ থেকে স্ট্রেইট আমার ঘরে। দরজা বন্ধ করে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। তুতুনকে কাঁদলে সুন্দর লাগে। কেবল সুন্দর না, ভয়াবহ সুন্দর, মাথা নষ্ট করা সুন্দর! এত কাছ থেকে ওকে কাঁদতে দেখে আমার মাথায় বাজ পড়েছে। আকাশে কি আজ মেঘ ছিল? তাও বাজ পড়ল কি করে? এটা কিসের বাজ? আশ্চর্য! আজীবন দেখে গেলাম কাঁদলে মানুষকে দেখলে বোকার মত লাগে, মায়া লাগে, কষ্ট হয়। অথচ তুতুনকে কাঁদতে দেখে আমার সম্পূর্ণ বিপরীত অনুভূতি হয়েছে। ইচ্ছে করছিল ওকে থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে আরও কাঁদাই। গাল লাল করে ও যখন কাঁদবে, তখন নিশ্চয়ই আরও সুন্দরী লাগবে ওকে! বড় বড় গোল চোখে যখন আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদবে, তখন নিশ্চয়ই আমার কাছে আরও ভালো লাগবে!

কয়েক সেকেন্ড বাদে নিজেকে পাগল মনে হলো। আজ ভার্সিটিতে একজনকে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে জড়িয়ে ধরেছি, আরেকজনকে ইচ্ছামতো কাঁদানোর পরিকল্পনা করছি! এ কী অধঃপতন হলো আমার? নাকি আমি আসলে এমনই?

মেজাজ খারাপ লাগছে। দরজা আটকে সিগারেট ধরালাম। এই প্রথম আমার ঘরে দিনের বেলা সিগারেট টানছি। আম্মু জানলে বাসায় আগুন লাগাবে। তবুও ধরলাম। একটা, দুইটা, তিনটা। পুরো ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে। কিন্তু এটা কি ঠিক হলো? জানালা পুরোটা খুলে দিলাম। বাতাসের সাথে যদি কিছুটা বেরোয়! এবার পড়লাম আরও বিপত্তিতে। জানালা দিয়ে তুতুনকে দেখা যাচ্ছে। আজ ওর ঘরের আলো জ্বালানো। তুতুন কান্না থামিয়ে দিয়েছে। ওর চোখে চশমা লাগানো। চশমা পরে সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কিছু একটা মুখস্ত করছে। আমি মনোযোগ দিয়ে ওকে দেখছি। এই মেয়েকে নিয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছি আমি? আমার পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতার কাছে ও রীতিমতো পিচ্চি। কত হবে উচ্চতা? পাঁচ ফিট? নাকি আরও দু এক ইঞ্চি বাড়বে? কে জানে, তবুও তো পিচ্চিই লাগবে। উফ, কি যে ভাবছি, এই মেয়ে তো পিচ্চিই! এত পিচ্চি মেয়েকে নিয়ে কেন ভাবছি? আপাতত একটাই কারণ- একটা মেয়েকে কাঁদলে এত সুন্দর লাগে তা আগে জানতাম না আমি যা আজ খুব কাছ থেকে হুট করে আবিষ্কার করেছি। আচ্ছা, হাসলে ওকে কেমন লাগে? আজ একটু হেসেছিল। আমি কি সেটা খেয়াল করেছি?

এই সময় স্নিগ্ধার কল আসলো। ফোন কানে ঠেকালাম। স্নিগ্ধা হড়বড় করে বলল,
❝শুভ, একটা হেল্প লাগবে?❞
❝হেল্প? কি হেল্প চাই সুন্দরী❞
সুন্দরী বলায় স্নিগ্ধা বোধহয় খুশি হলো। স্নিগ্ধা আসলেও বেশ সুন্দরী। নিজের স্তুতি শুনলে লজ্জা পায়, আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়। আচ্ছা, ও কি জানে যে ছেলেরা কোনো মেয়ে সুন্দরী না হলেও স্বার্থের জন্য এমন বলে থাকে? আর ওর মত ব্রেইনলেস সুন্দরীদের গাধীও ডাকে? স্নিগ্ধা তো আমার মনে খবর জানে না, তাই সে খুশিতে জ
ডগমগ হয়ে পড়ালেখা সংক্রান্ত একটা সাহায্য চাইলো। কাজের কথা শেষ হওয়ার পর আমি এদিক ওদিকে কথা বললাম কিছুক্ষণ। তারপর প্রশ্ন করলাম,
❝স্নিগ্ধায়ায়া?❞
ওপাশ থেকে আগ্রহী উত্তর,
❝বলো?❞
❝সেদিন যে বললে আমি কণাকে পছন্দ করি কিনা, কেন বললে? কণা কি আমাকে পছন্দ করে- এ জাতীয় কিছু বলেছে?❞
ওপাশ থেকে কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর স্নিগ্ধা হেসে বলল,
❝কি যে বলো না বলো! ওরকম কিছু কেন হতে যাবে? আমি কি এমন কিছু বলেছি নাকি? এমন হলে তুমি জানবেই, তাই না?❞
আমিও উড়িয়ে দিলাম। তারপর অন্যান্য কথা বলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বুঝতে চাইলাম, কণা আজকের ঘটনা নিয়ে কিছু বলেছে কিনা। স্নিগ্ধা তেমন কিছুই বললো না। ও আর নীনা, কেউ আজ সেখানে ছিল না যখন কণা আমার মাথায় ময়লা বালতির পানি ঢেলে দেয়। এর সাক্ষী কেবল আমার তিন বন্ধু। মেয়েদের মাঝে তো ঘটনা আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়ার কথা। স্নিগ্ধা কি জেনেও বলেনি? নাকি আসলেই জানে না?

আমার আর ওদের নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করল না, ফোন কেটে দিলাম। ফোনের লাইন কেটে জানালা দিয়ে তাকালাম, তুতুনকে দেখা যাচ্ছে না। না দেখা যাক, আমি সরে আসলাম সেখান থেকে। দেখলে যদি আবার চড় মেরে গাল লাল করে কাঁদানোর লোভ হয়? আসলেই পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।

দুই দিন পার হলো নির্বিঘ্নে। না তুতুনের সাথে ছাদে দেখা হলো, না কণা ফোন দিল। দুই দিন ছুটি ছিল, তাই কণার সাথে দেখা হওয়ার প্রশ্নই আসেনি। আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি। রাস্তায় আজ দুটো মেয়েকে দেখে শিস বাজিয়েছি, একজনকে অযথা চোখ মেরেছি, কয়েকজনকে ড্যাবড্যাব করে দেখেছি। এর মাঝে শেষজন আমাকে বলে বসলো,
❝কি ভাইয়া? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? মেয়ে দেখেননি কোনোদিন?❞
আমি স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিয়েছি,
❝আল্লাহ চোখ দিয়েছে, তাই দেখছি। চোখ না দিলে দেখতাম না। এখন তো আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করতে হয় চোখ কেন দিল!❞
মেয়েটা রেগে বেগুন হয়ে চলে গেল। বেগুন বললাম কারণ শ্যামলা মেয়েরা রেগে লাল টমেটো হয় না, গায়ের রঙের কারণে বেগুন হয়ে যায়। একটা ব্যাপার কিছুতেই ধরতে পারি না। মেয়েদের দেখলে ওদের এত সমস্যা হয় কেন? দেখার জিনিস দেখব না কেন? তাহলে দেখায়ই বা কেন? না দেখারে চাইলে বোরকা পরবে, ঢাকবে। খোলা রেখে দেখতে মানা করে কেন?

ভাবতে একটা ড্রেসের দোকানের সামনে গেলাম। ভেতরে থ্রিপিস পরা এক সুন্দরী ড্রেস দেখছে। আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। ও যেদিকে যেদিকে ড্রেস দেখছে, আমিও কাছাকাছি দেখছি। এক সময় মেয়েটা একটা গর্জিয়াস ড্রেস দেখতে শুরু করল। আমি একটু কাছে গিয়ে বললাম,
❝এই ড্রেসে আপনাকে মানাবে খুব। আমাকে বিয়ে করলে এই ড্রেস কিনে দেব। বিয়ে করবেন?❞
মেয়েটা আমাকে বিরক্তি নিয়ে দেখে দোকান থেকে বেরিয়ে আসলো। আমিও পেছন পেছন বেরিয়ে আসলাম। আজ তোমায় ছাড়ছি না। দোকান থেকে বের হতে গিয়ে ভীড়ের কারণে ওর থেকে একটু দূরে সরে গেছি৷ দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছে আসার সাথে সাথে চোখে একটা ঘুসি খেয়ে চিৎপটাং হয়ে পেছনে হেলে পড়লাম। বাম চোখ দুই হাতে চেপে চিৎকার করে উঠলাম,
❝ও মা গো!❞

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here