শুভ বিবাহ পর্ব-৯

0
1083

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

পর্ব ৯

ঘুসি খেয়ে আমি পাশের দোকানের সিঁড়িতে বসে পড়লাম। বাম চোখ চেপে ধরে কোনোমতে ডান চোখ খুলে দেখলাম, দুটো ষাঁড়ের মতো ব্যাটা ছেলে মারামারি লেগেছে যার একটা ঘুসি এসে আমার চোখে পড়েছে। আশেপাশে আরও দু’একজনকে দেখলাম শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ডলে ডলে তাদের থামতে অনুরোধ জানাচ্ছ। সম্ভবত এরা মিমাংসা করতে গিয়ে মার খেয়ে আসা পার্টি। আর আমি হলাম বিনা মেঘে বজ্রপাতে অক্কা পাওয়া পার্টি। দুটোকে গালি দিতে দিতে চোখে হাত চেপে বাসার দিকে রওনা দিলাম। আমার মাথায় আর ঐ মেয়ে নেই, ঘুসি খেয়ে সব মেয়ে মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে, কেবল মায়ের কথা মনে পড়ছে।

বাসায় ঢুকে সোজা ফ্রিজ খুলে বরফ বের করলাম। চোখের উপর মায়ের ওড়না দিয়ে হালকা চেপে ধরে আয়নার সামনে গেলাম। এর মাঝেই কালশিটে পড়ে গেছে! আগামীকাল মুখ দেখাবো কি করে?! বিছানায় ধপ করে শুয়ে গুঙিয়ে উঠলাম। চোখে যতটা না ব্যথা, তার চেয়ে বেশি মাথাব্যথা চেহারা নিয়ে। সবাই কত কি প্রশ্ন করবে! নিশ্চিত কণা বলবে, আমার উচিত শিক্ষা হয়েছে। আমার শত্রুদের মনে লাড্ডু ফুটবে। কণা হয়ত এই সুযোগে আমার নামে মিথ্যা রটনাও রটিয়ে দেবে। কে জানে কি হয়!

আম্মু যখন দেখল, তখন বাসায় হাউমাউ লেগে গেছে। আমাকে পাশের বাসার দুজন আন্টিও এসে দেখে গেল। তারপর তারা সবাই মিলে আলোচনা করতে বসল, দেশটা পুরুষদের জন্যও কত অনিরাপদ হয়ে গেছে। সব দোষ শালা সরকারের! আমার চোখে ঘুসি দিল, সরকার তখন কোথায় ছিল? আমি চোখ বন্ধ করে কানে হেডফোন গুঁজে পড়ে থাকলাম। এদের রাজনৈতিক বিশ্লেষন তৃতীয় মাত্রার মত রাজনৈতিক আলোচনায় কাজে লাগতে পারে, পাড়ায় পাড়ায় মারামারি লাগাতে কাজে লাগতে পারে, গৃহযুদ্ধ লাগাতে কাজে লাগতে পারে, আমার কোনো কাজে আসবে না!

পরদিন সকালে শায়লার ঘরে উঁকি দিলাম। ও টেবিলে বসে কি যেন করছে। একটু জোরে ডাক দিতেই চমকে উঠল। আমি ওর ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলাম।
❝তোর কাছে কোনো ফেস ক্রিম বা ফেস পাউডার আছে এইটা ঢাকার জন্য?❞
❝তোমার এই কালশিটে ঢাকতে চাও?❞
❝হ্যাঁ। আছে এমন কিছু?❞
শায়লা ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবলো। তারপর আমাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলল,
❝চোখ বন্ধ করো❞

আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম। অস্বস্তি লাগছে, ও আবার শোধ নেবে না তো? বাসায় থাকলে আমি সবসময় ওর পিছে লেগে থাকি। আমার ভালো লাগে না ওর সাথে ঝগড়া না করলে। শায়লা যদি শোধ নেয়? নাহ, সে সাহস হবে না। আমি ওর বড় ভাই!

দুই মিনিট অনেক কষ্টে পার করে বললাম,
❝হলো তোর?❞
❝উম? হুম। চোখ খুলো❞

চোখ খুলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
❝বাহ! আমি ইম্প্রেসড! একদম বোঝা যাচ্ছে না! কি করলি?❞
শায়লার হাতে একটা ক্রিমের বোতল, সেটা দেখালো।
❝তোমাকে দিয়ে দিয়েছি ঠিক আছে, কিন্তু ভুলেও চোখ ডলতে যেও না। তাহলে সব লেপ্টে নষ্ট হয়ে যাবে❞
❝ঘামলে? বা মুখে পানি দিলে?❞
ও মাথা নাড়ালো।
❝কিছু করা যাবে না। কিছু করলে ঝামেলা হবে। তুমি বরফ আর ওষুধ দিচ্ছো না? দু একদিনের মাঝে ঠিক হয়ে যাবে❞

আমি সন্তুষ্ট হয়ে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। ওভার প্রোটেকশন হিসেবে একটা বেসবল ক্যাপ পরে নিলাম। বলা যায় না, যদি ক্রিম গলে যায়?

আজ বেশ আগে আগে ক্লাসে পৌঁছে গিয়েছি। বন্ধুরা ক্লাস শুরুর এক মিনিট আগে ঢুকে আমাকে দেখে একটু অবাক হয়েছে। আমি অবশ্য স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি। আজকে কণাকে দেখতে পাচ্ছি না এখনো। ক্লাস শুরুর দশ মিনিট পর কণাকে দেখলাম। ও আমাদের দুই বেঞ্চ সামনের বেঞ্চে নীনার পাশে গিয়ে বসলো।

টানা তিনটা ক্লাস করার পর দেড় ঘন্টার ব্রেক, দেড় ঘন্টা পর শেষ ক্লাস। আমি এখনো ক্যাপ লাগিয়ে রেখেছি। জানুয়ারি মাসে ঠান্ডা থাকায় তেমন একটা ঘামছি না, সমস্যাও হচ্ছে না। এর মাঝে আমাদের সাথে কণা জয়েন করল। ও একেবারে স্বাভাবিক। গতকাল আমাদের মাঝে আদৌ কিছু হয়েছে কিনা, তা বোঝা যাচ্ছে না। আমি কণাকে এক মনে দেখে যাচ্ছি। মেয়েটার মুখে আজকে অন্য রকম জৌলুশ কাজ করছে। এটা কি আমার বেহায়া চোখ আর মনের কারসাজি? নাকি আসলেই?

কণা সবার উদ্দেশ্যে বলল,
❝লাইব্রেরিতে যাবি কেউ?❞
জাহিদ জবাব দিল,
❝আগে ক্যানটিনে গিয়ে খাবো, এরপর ভাবা যাবে। আগে পেট পূজো দিব!❞
❝আমিও যাবো। এরপর লাইব্রেরিতে যাবো। আগে চল খেয়ে নিই, আমার হাতে সময় নেই❞

ক্যান্টিনে বসে সবাই স্বাভাবিক ভাবে হৈচৈ করে খাচ্ছে। আমি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কণাকে দেখছি। ওর হাসি যতটা সুন্দর, ততটা আগে কখনো লাগে নি। কণাকে আমার ভালো লাগে ঠিক, কিন্তু এরকম করে ভালো লাগছে কেন? আমার মাথার তার কিছু নড়ে চড়ে যায়নি তো?

খাওয়া শেষে কণা একাই যখন লাইব্রেরিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন আমি উঠে দাঁড়ালাম।
❝আমিও যাবো❞
ভেবেছিলাম কণা আমাকে ইগ্নোর করবে, বা নিষেধ করবে, রাগ দেখাবে। কিছুই হলো না। ও স্বভাবতই ওর সাথে যেতে বলল। এদিকে আমার বন্ধুরা যারা সেদিনের সাক্ষী ছিল, ওরা আমাকে ইশারায় গলায় পোঁচ দেয়ার ভঙ্গি করে বুঝালো, আজকে আমি নিশ্চিত মরব। ওদের পাত্তা না দিয়ে কণার পাশে হাঁটা ধরলাম। কণার স্বাভাবিক আচরণের ব্যাখ্যা আমাকে জানতেই হবে।

লাইব্রেরিতে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। কণা “ইন্ট্রোডাকশন টু লিটারেচার” এর একটা এসাইনমেন্ট নিয় বসেছে। আমিও ওর সাথে বসে আছি। ও মনোযোগ দিয়ে কি কি যেন বই থেকে টুকছে, আমি সেসব দেখছি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও বলল,
❝আমি কি করছি সেসব দেখলেই হবে? নিজের কাজ করতে হবে না?❞
❝করব তো। কিন্তু কি করব বুঝে পাচ্ছি না❞
কণা আমাকে যত্ন করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। অন্য সময় হলে সে মুখ ভেঙচে আমাকে ভাগিয়ে দিত। আজ অব্দি কোনো পড়া ও আমাকে বুঝায় নি। আজ কেন বুঝাচ্ছে এত যত্নসহকারে? আমি দুম করে ওর কপালে হাত দিলাম। তাতে কণা চমকে পেছনে সরে গেল।
❝জ্বর তো নেই! তুই ঠিক আছিস?❞
❝কেন?! আমি কি বেঠিক কাজ করলাম?❞
❝এত যত্ন নিয়ে পড়াচ্ছিস যে? আর আমার উপর তো তোর রাগ হওয়া উচিত, আমাকে মারা উচিত। সেটা না করে একদম স্বাভাবিক আছিস। কাহিনী কি? মনে মনে প্রতিশোধের মতলব আঁটছিস না তো?❞

কণা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আমার চোখে চোখ রাখলো।
❝দেখ শুভ, তোর মত ভণিতা করতে পারি না, মিথ্যাও বলতে পারি না কাউকে। এর আগে একটা রিলেশন ছিল আমার। আমাদের থেকে পাঁচ বছরের বড়। ফ্যামিলি স্টেটাস আমাদের নিচে থাকা সত্ত্বেও আমাকে সারাক্ষণ কন্ট্রোলের চেষ্টা করত। তার কথা না শুনলে আজেবাজে কি যে সব বকত! আমি খুব ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এডমিশনের সময়টায় যথেষ্ট বিরক্ত করত, জাহিদ সব জানে। আমি তবুও সব বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মন দিয়েছি। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি তিন মাস চলছে। এর মাঝে তোকে যতটুকু চিনেছি, তুই বাইরে যা, ভেতরে তা না। আমার কখনো মনে হয়েছে তুই আমাকে পছন্দ করিস, কখনো মনে হয়েছে করিস না। আমি সত্যটা জানি না। কিন্তু আমি তোকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করতে পারছি না। কি কারণে আমার মাথায় শুধু তুই ঘুরিস। ঐদিন সবার সামনে জড়িয়ে ধরার পর থেকে আমার ভেতর অনেক কিছু বদলে গেছে। আমি তোকে স্ট্রেইট বলতে চাই, আমার তোকে ভালো লাগে। কেন লাগে জানি না, লাগে। এখন তুই কি ভাবছিস, সেটা তোর ব্যাপার। আমি তোকে যত্ন করতে চাই, খেয়াল রাখতে চাই। এখন বাকিটা তোর ইচ্ছা। তুই কি ভাবছিস আমাকে জানা❞

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কণা বই নিয়ে উঠে চলে গেল। আমি ওকে অনুসরণ না করে স্থাণুর মত বসে রইলাম। আমি এমন কি করেছি যাতে কণা আমাকে পছন্দ করবে? চুপ করে ভাবছি।

কণা আর দশটা ভীতু টাইম পাস করার মত মেয়ে না। ও স্বাধীনচেতা, একরোখা, জেদী, সাহসী আর সোজাসাপ্টা মানুষ। ওর মনে যা ছিল, তা বলে দিয়েছে। আর আমি? আমার মনে ঠিক কি চলে?

চেয়ার থেকে উঠলাম। কণা আগেই বেরিয়ে গেছে। ভাবছি বন্ধুদের সাথে কথা বলব। ওদের সাথে দেখা করে জাহিদকে আলাদা করে এনে একটা সিগারেট ধরলাম, ওকেও একটা দিলাম। জাহিদ সিগারেটে টান মেরে বলল,
❝কি মামা? নিজে থেকে সিগারেট দিলা যে? কাহিনী কি?❞
আমি সহজে পকেট থেকে টাকা বের করি না। বন্ধুরাও অবশ্য এটা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে না, কেবল কিপটা ডেকে ফেলে। অন্য সময় হলে এ নিয়ে প্রতিবাদ করতাম৷ বেশি করে ধোঁয়া ছেড়ে বললাম,
❝ও তো আগে তোর বান্ধবী ছিল, তাই কথাটা তোকেই আগে বলতেছি। কণা তো আমাকে পছন্দ করে রে!❞
জাহিদ সবজান্তার মত মাথা নেড়ে বলল,
❝সেটা তোকে আগেই বলছিলাম। তুইই তো বিশ্বাস করলি না❞
❝আরে ভাই, লাইব্রেরিতে মুখের উপর বলসে!❞
❝পরে? তুই কি বললি?❞
❝আমি তো ওরে আমার সাথে এত নরম ব্যবহারে কারণ জিজ্ঞেস করতেছিলাম। পরে এসব বলে চলে গেল। আমাকে বলসে, আমি কি ভাবী, সেটা জানানোর জন্য। কি করব?❞
❝কি করবি মানে? কণার মত মেয়ে তোকে পছন্দ করছে, মানে বুঝস এইটার? ওর বাপের টাকার অভাব নাই, ওয় ও তো ট্যালেন্টের ডিব্বা! প্রেম কর। বল তুইও পছন্দ করস❞
❝আমি কি আসলেই পছন্দ করি?❞
❝এক কাজ কর। বাসায় যা, ঠান্ডা মাথায় ভাব, তারপর তোর যা মনে হয়, ওর বল। তাড়াহুড়ার কিছু নাই❞
❝কিন্তু আমি এমন কি করসি যে ও পছন্দ করব?❞
❝বিয়া বিয়া করছস, আর কি। ঐদিন সবার সামনে জড়ায় ধরছস। আর কি লাগে?❞

জাহিদ যতই বলুক মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে, আমি মাথা ঠান্ডা করতে পারলাম না। কণাকে ভালোও লাগছে, আবার কোনো প্রেমে জড়াতেও ইচ্ছা করছে না। আমি ভাবছি, ওর সাথে প্রেম করলে কোনো মেয়ের দিকে তাকানো যাবে না নিশ্চিত। তাকালেই ঘাড় মটকে দিবে। এখন কি করণীয়?!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here