শেষটাও_সুন্দর_হয় পর্ব ৭

#শেষটাও_সুন্দর_হয়

#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-০৭

উত্তর-দক্ষিন বরাবর প্রশস্ত বেলকুনির দোলনায় আমি আর নিদ্র ভাই বসে আছি। গতকালের মতোই আজকেও আকাশের মস্ত বড় গোল চাঁদ উঠেছে। চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে চাঁদের মোহনীয় শুভ্র আলোয়। চারিদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা। নিসুতি নিস্তব্ধ রাত। আজ ঘন্টা পাঁচেক আগে আমি অদ্রি ইসলাম থেকে মিসেস অদ্রি আরশান হয়ে গেছি।

আজ বিকেল বেলায় হঠাৎ নিদ্র ভাই ফোন করে আমাকে আর অহনাকে কাজি অফিসের সামনে আসতে বলল। আমি আর অহনা যথা সময়ে পৌঁছেও গেলাম কাজি অফিসের সামনে। সেখানে গিয়ে দেখি নিদ্র ভাইয়ের পাশে নিরা আপুও দাঁড়িয়ে আছে। নিরা আপুকে নিদ্র ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই আমার মনটা কেমন যেন কু ডাকতে লাগল। মনের গহিনে উঁকি দিল হরেক রকমের আসঙ্কা আর ভয়। তবে কি নিজের ভাই আমার কাছে আজীবন অলিক মায়া হয়েই থাকবেন। কথাটা মনে হতেই আমার দু-চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠল। নিদ্রভাই বোধহয় আমার মনের কথাটা কোনভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তাই তো মুচকি হেসে আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে সবাইকে নিয়ে কাজি অফিসের ভিতরে ঢুকলেন। তারপর কাজির সামনের চেয়ারে আমাকে বসিয়ে কাজিকে উদ্দেশ্যে করে বলে ওঠলেন,

—” কাজি সাহেব পাত্রী এসে গেছে, এবার আপনি বিয়ে পড়াতে পারেন।”

নিদ্র ভাইয়ের কথায় আমি যেন আকাশ থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়লাম। একি বললেন নিদ্রভাই। গতকাল আমার কথাগুলো নিদ্র ভাই হয়তো খুব সিরিয়াস ভাবে নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু এমন করে তো নিদ্রভাইকে বিয়ে করতে পারবো না আমি। বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন আছে আমার। সেই স্বপ্নগুলোকে কিভাবে নষ্ট হতে দেই আমি। তাই নিদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠলাম,

–” আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না নিদ্র ভাই?”

আমার কথাটা হয়তো প্রথমে বুঝতে পারেন নি তাই তো মিনিট দুই আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন । তারপর গম্ভির স্বরে বললেন,

–“কেন?”

আমি নিদ্র ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে বললাম,

–” এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করবো না আমি।আর তাছাড়া বাবা-মা যদি জানতে পারে যে আমি ওনাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করেছি তাহলে আমাকে মেরেই ফেলবে তারা। আর আপনি জানেন না বড়দের মত না নিয়ে এইভাবে বিয়ে করাটা অন্যায়।”

আমার কথা শুনে নিদ্র ভাই আবারো মিনিট দুই আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

–” আপনাকে এত কিছু ভাবতে হবে না । আপনি শুধু রেজিস্ট্রি কাগজে সই আর মুখে কবুল বলবেন , বাকিটা আমি সামলে নিবো।”

–” কিন্তু……..

আমাকে কথা বলতে না দিয়ে নিদ্র ভাই আমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন,

–” তোকে কথা বলতে বারন করেছি আমি। এখন শুধু কবুল বলবি ঠিক আছে। আঙ্কেলকে আমি সামলিয়ে নিবো। তুই তো গতরাতে বললি তোর মনে শঙ্কা বেঁধেছে , তাই সেই শঙ্কা আজ দূর করতে এসেছি আমি। ”

–” নিদ্র ভাই আপনি বুঝতে পারছেন না কেন?”

–” আর একটা কথা বলবি তো কানের গোড়ায় ঠাটিয়ে চড় মারবো। হেঁয়ালি করছিস আমার সাথে হুম? তোর কথা ভেবে কত কষ্ট করে আমি সব কিছু ব্যবস্থা করলাম আর তুই কি না বলছিস তুই বিয়ে করতে পারবি না। এই সত্যি করে একটা কথা বল তো?”

–” আমি তো সব সময় আপনাকে সত্যি কথায় বলি নিদ্র ভাই। কবে আবার মিথ্যা কথা বললাম শুনি?”

–” ফালতু বকবক না করে সাইন কর । আর যদি আজ তুই সাইন না করিস তবে আমি নিরাকে বিয়ে করে নিবো । এখন বল কি করবি? আমাকে বিয়ে করবি নাকি আমি নিরাকে বিয়ে করবো? সব কিছু তোর হাতে। ভেবে দেখ কি করবি।”

নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমার চোখ ততক্ষণে কপালে ওঠেছে। আমি অবাক হয়ে বলে ওঠলাম,

–” আপনি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলেন নিদ্র ভাই?”

–” আমি তোর ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই নিষ্ঠুর, আজ নতুন না । কি সিদ্ধান্ত নিলি বল?”

–” সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো অবস্থায় রেখেছেন আমাকে। বদ লোক একটা। ছোট বেলা থেকে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে আসছে। ঠিক আছে ঠিক আছে আমি রাজি। কি করতে হবে এখন বলুন।”

–” বেশি কিছু নয় । সবাইকে একটু নেচে দেখাতে হবে , পারবি নাচতে?”

–” আপনি আবারো আমার পিছনে লেগেছেন? এই আপনার খেয়ে দেয়ে কি আর কোন কাজ নেই নাকি।”

এতক্ষণ কাজি সাহেব আমাদের ঝগড়া নিরবে দেখছিলেন। হয়তো এই প্রথম বর বউ কাজি অফিসে এসে কাজির সামনে ঝগড়া করছে। কিন্তু এবার একটু কেঁশে বলে উঠলেন,

–” ইয়ে মানে আপনাদের ঝগড়া করা হয়েছে কি? বুঝতেই পারছেন আরো লোক আসবে। আপনাদের বিয়ে সেরে আবার তাদের নিয়ে বসতে হবে।”

কাজি সাহেবের কথায় নিদ্র ভাই সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

–” আমার কোন সমস্যা নেই। আমি তো বিয়ে করবো বলেই এসেছি। এখন কেউ বিয়ে করতে না চাইলে পাত্রী বদলাতে হবে। তবুও আজ বিয়ে করেই বাড়ি ফিরবো।”

–” কাজি সাহেব আমিও রাজি । আপনি বিয়ে পড়ান আর শুনুন এই বদ লোকটার কোন কথাতেই কান দিবেন না বুঝলেন।”

–” আচ্ছা । তো বাবাজিরা ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তো? না মানে আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আপনারা রাগে ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।”

কাজির কথা শুনে নিদ্র ভাই এবার রেগে বললেন,

–” আপনি কাজি , আপনার কাজ বিয়ে পড়ানো। সেই কাজ রেখে অন্য ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন কেন? বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”

নিদ্র ভাইয়ের ধমকে কাজি সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,

–” ইয়ে মানে না না। এমনিতেই জিঙ্গেস করছিলাম আর কি। ঠিক আছে এখন তবে বিয়ে পড়ানো শুরু করা যাক। ”

অতঃপর অনেক বাক-বিতন্ডকিতের পর আমার আর নিদ্র ভাইয়ের বিয়ে সম্পন্ন হলো। নিদ্র ভাইয়ের সাক্ষী হিসেবে ছিল ওনার তিনজন রুম মেট আর আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে ছিল অহনা, নিরা আর সৌরভ। সৌরভ অহনার বন্ধু। একই সাথে পড়াশোনা করে ওরা। বিয়ে পড়ানো সম্পন্ন হলে আমরা সবাই কাজি অফিসের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি অহনাকে বলে উঠলাম,

–” কি রে গাধির মতো এখানে দাঁড়িয়ে পড়লি যে চল বাসায় যাই। ”

অহনা আমার কথা শুনে হেসে বলে ওঠল,

–” কি যে বলিস আজ বাসায় গেলে তোদের ফুলশয্যা হবে কিভাবে শুনি?”

–” কি যে বলিস? বলি তোরও কি নিদ্র ভাইয়ের মতো মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?”

–” মাথা আমার না তোর খারাপ হয়ে গেছে বুঝলি?”

অহনার কথায় আমি ধমকে বলে উঠলাম,

–” এই তুই আমার পক্ষে নাকি নিদ্র ভাইয়ের পক্ষে?”

–” আমি এখন আমার দুলাভাই এর পক্ষে বুঝলি।”

অহনার কথা শুনে নিদ্র ভাই বলে উঠলেন,

–” যাক তোমার ঘটে তাহলে বুদ্ধি আছে দেখছি। আমি তো ভেবেছিলাম এই গাধির সাথে থাকতে থাকতে তুমিও গাধিই হয়ে গেছো।”

নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমি রেগে বলে ওঠলাম,

–” এই এই কি বললেন আপনি ? আমি গাধি? আমি যদি গাধি হই তবে আপনি কি শুনি?”

–” আমি মানুষ। তবে এ জীবনে আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল বুঝলে। আমি মানুষ হয়ে তোমার মতো একটা গাধিকে বিয়ে করতে হলো।”

আমি নিদ্র ভাইয়ের কথার জবাবে কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই অহনা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–” আহ্ থামবি তোরা। সেই কখন থেকে ঝগড়া করেই যাচ্ছিস। এবার অন্তত থাম। ভাইয়া আজকের রাতটা আমরা সৌরভদের বাংলোতে থাকবো। ঐখানে সব ব্যবস্থা করাই আছে। কোন অসুবিধা হবে না।”

অহনার কথা শেষ হতেই নিদ্র ভাই বলে উঠলেন,

–” কিন্তু তোমাদের বাড়িতে কি বলবে?”

–” আমি বাড়িতে বলেছি অদ্রিকে নিয়ে আজ আমি আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে থাকবো । আপনি কোন চিন্তা করবেন না এ নিয়ে। আপনারা বরং সৌরভের সাথে ওদের বাংলোতে চলে যান আর আমি নিরা আপুর সাথে ওনাদের বাড়ি যাবো।”

আমি কিছু বলার আগেই অহনা নিরা আপুর হাত ধরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে রিকশায় ওঠে চলে গেল সামনের দিকে। অহনা আর নিরা আপু যেতেই নিদ্র ভাইয়ের বন্ধুরা নিদ্র ভাইয়ের কানে কানে কি সব বলে হাসতে হাসতে চলে গেল ওনাদের বাসার উদ্দেশ্যে। আমরাও সৌরভের গাড়ি করে রওনা দিলাম বাংলোর উদ্দেশ্য।

আমি তখনো বিকালের ঘটনা আচ্ছন্ন হয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ একজোড়া পুরুষালী হাতের ছোঁয়া পেতেই ধ্যান ভেঙ্গে গেল আমার । পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম নিদ্র ভাই আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম আজ নিদ্র ভাইকে চশমা ছাড়া দেখলাম। চশমা ছাড়া নিদ্র ভাইকে খুব একটা খারাপ লাগছে না। আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিদ্র ভাইয়ের দিকে। তারপর আনমনেই বলে ওঠলাম,

–” ছেলেদের এত সুন্দর হতে নেই নিদ্র ভাই।”

আমার কথা শুনে নিদ্র ভাই মুচকি হেসে বললেন,

–” সুন্দর হলে কি হয় এলোকেশী?”

–” ছেলেরা সুন্দর হলে মেয়েরা তাদের সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। যেমন এখন আমি আপনার সৌন্দর্যে হারিয়ে গেছি। মনে হচ্ছে কোন এক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছি আমি।”

–” তাহলে তো ভালোই। ফ্রিতে ফ্রিতে বউকে নিজের নেশায় আসক্ত করতে পারবো।”

–” এতোটা আসক্ত করতে নেই নিদ্র ভাই। বেশি আসক্ত হয়ে গেলে যে নিজের কোন অস্তিত্ব থাকে না।”

–” তাই বুঝি? আমাতে বিলীন হলে ক্ষতি কি এলোকেশী?”

–” ক্ষতি নেই তবে ………

আমাকে আর কথা বলতে না দিয়ে নিদ্র ভাই আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলে ওঠলেন,

–” হুস। আজ কোন কথা নয়। আজ শুধু হারিয়ে যাবার সময়। আজ আমি তোমাতে আর তুমি আমাতে বিলীন হবে।”

কথাগুলো বলেই আমাকে কোলে তুলে ঘরের দিকে চলে গেলেন। আকাশের গোল চাঁদ ততক্ষণে পুব আকাশে ঢলে পড়েছে। নাম না জানা ফুলের মিষ্টি গন্ধ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে চারিপাশ। রাতের সাথে সাথে আমারাও পাড়ি জমালাম এক সুখের রাজ্যে।

চলবে

(বিঃদ্রঃ- অনেকে শ্রাবন সন্ধ্যা সিজন ০২ চাচ্ছেন। আপনারা চাইলে শেষটাও সুন্দর হয় গল্পের পাশাপাশি শ্রাবন সন্ধ্যা সিজন ০২ দিতে পারি। আপনাদের মতামত দিবেন।
আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং ❤️❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here