#শেষ_ইচ্ছে
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৩
০৯।
স্মরণ হীরাকে দেখেই এক ভুবন ভোলানো হাসি দিলো। কিন্তু হীরার ঠোঁটের ফাঁকে হাসি নেই। সে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্মরণের দিকে। তার চোখ জোড়া অশ্রুতে টলমল করে উঠলো।
সূর্যের কড়া রোদ স্মরণের মুখে উপর এসে পড়ছে। আর স্মরণ সিঁড়ির ধাপগুলো পার করে ধীর পায়ে হীরার কাছে এসে দাঁড়ালো। হীরা এখনো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্মরণের দিকে। এক বিন্দু জল হয়তো এখনই গড়িয়ে পড়বে। স্মরণ সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই তা নিজ হাতে মুছে দিয়ে বলল,
“কতোবার বলেছি, আমি কারো কান্না সহ্য করতে পারি না। আর তুমি শেষমেশ আমাকে কাঁদিয়ে মারছো?”
হীরা মলিন হেসে মাথা নেড়ে বললো,
“আর কাঁদবো না। সরি।”
তারপর সে সিঁড়ির মাথায় আরো দুইটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“এরা কি তোমায় একা ছাড়বে না?”
স্মরণ হেসে বলল,
“তোমার সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছি, সেটাই ঢের। এদের চলে যেতে বললে, আমাকে সহ নিয়ে চলে যাবে। তখন আজকের দিনটা আর আমাদের হাতে থাকবে না।”
হীরা মাথা নিচু করে বলল,
“তাহলে তো আমি তোমাকে ভালোভাবে দেখতেও পারবো না। তুমি তো জানোই আমি কারো সামনে ভালোবাসা দেখাতে পারি না। আর আমাকে তো আজই অনেক ভালোবাসতে হবে।”
স্মরণ মলিন হাসলো। হীরার কথা শুনে তার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হীরার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সে পায়ে আলতা লাগিয়েছে৷ তা দেখেই স্মরণ হীরার পায়ের কাছে বসে পড়লো। হীরা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“কি করছো? সালাম করছো না তো?”
স্মরণ মাথা তুলে হীরার দিকে তাকিয়ে সেই ভুবন ভোলানো হাসি দিলো। এবারও হীরা তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“এই ছেলেটার হাসি একদিন তোকে মেরেই ফেলবে, হীরা।”
পরক্ষনেই মনে পড়লো, কি ভাবছে সে? আজ তো স্মরণের সাথে তার শেষ দেখা। আর এরপর তো এই হাসিতে তাকে মরতে হবে না।
হীরার চোখ জোড়া আবার অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। স্মরণ তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে হীরার পায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“আলতা রাঙা পা আমার খুব প্রিয়। কিন্তু তোমাকে কখনোই বলা হয় নি।”
হীরা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“হুম।”
স্মরণ হীরার পা জোড়া থেকে চোখ সরিয়ে নদীর স্থির জলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজ আমি চলে যেতে চাই না, হীরা। তুমি চোখ ভেজালে আমি সত্যিই চলে যাবো। তুমি জানো, আমার এসব সহ্য হয় না। প্লিজ শুধু শুধু আমাকে কষ্ট দিও না।”
হীরা চোখ মুছে স্মরণের মুখোমুখি দুই হাঁটু গেড়ে বসে বললো,
“আমি আজ তোমাকে খুব ভালোবাসতে চাই।”
স্মরণ বলল,
“আমি তোমার ভবিষ্যৎ নই। তাই এতো ভালোবেসো না যা কাটিয়ে উঠতে তোমার নিজেরই কষ্ট হবে।”
“হবে না। একদম কষ্ট হবে না।”
হীরা হুট করেই স্মরণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরায় স্মরণ তাল সামলাতে না পেরে হীরাকে নিয়েই নিচে পড়ে গেলো। স্মরণের পিঠ সিঁড়ির মেঝেতে গিয়ে ঠেকেছে। সে এক হাত দিয়ে হীরাকে ধরে রেখেছে আর অন্য হাত দিয়ে সিঁড়ির মেঝেতে ভর দিয়ে শরীরটা আলগা করে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু হীরা এবং নিজের শরীরের ভার তার এক হাতে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
তাই সে হীরাকে বলল,
“কি করছো হীরা? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
“আমাকে পাগল হতে দেখেছো? আমি তো এখনো কোনো পাগলামিই করলাম না।”
“হীরা, উঠো বলছি।”
হীরা বলল,
“সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুইটার যদি চক্ষুলজ্জা থাকে, তাহলে আমাদের দেখে সরে পড়বে।”
স্মরণ উপরে তাকিয়ে দেখলো, লোক দুইটা সরে পড়েছে। এবার হীরাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“একমাত্র তোমারই চক্ষুলজ্জা কমে গেছে।”
হীরা উঠে সিঁড়ির ঘাটে বসলো, আর স্মরণকেও তার পাশে বসালো। নিরবতা ভেঙে স্মরণ বলল,
“চিঠি পেয়েছো?”
হীরা বলল,
“হুম। প্রথমে আপা পড়েছিল। আমি তো খেয়ালই করি নি।”
“তাহলে কি এখনো পড়ো নি?”
“পড়েছি তো।”
“তাহলে উত্তরটা দাও।”
“চিঠি লিখে বলি?”
“আমার ঠিকানায় আর কোনো চিঠি আসবে না।”
হীরা স্মরণের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলল,
“প্রিয় স্মরণ,
হলুদ, টিয়ে আর কমলা এই তিনটে রং প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত লাগলেও, এখন আর লাগে না। প্রিয় না হোক, অপ্রিয়ও তো নয়। আর আমার পরিচিত একমাত্র আমিই সেই ব্যক্তি, যার এই তিনটে রঙ-ই পছন্দের।”
স্মরণ হীরার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভ্রু কুঁচকালো। হীরা চোখ বন্ধ রেখেই তৎক্ষনাৎ বলল,
“জানি, জানি, এখন প্রশ্ন করবে, প্রিয় নয়, আবার পছন্দ কিভাবে হলো?”
হীরার কথাটি শুনে স্মরণ এবার শব্দহীন হাসি দিলো। আর মনে মনে ভাবলো,
“তুমি কিভাবে চোখ বন্ধ রেখেই আমার মনের প্রশ্নগুলো জেনে নিলে, হীরা? তোমার মতো করে কেউ আমাকে কেন বুঝলো না?”
এদিকে হীরা বলতে লাগলো,
“প্রিয় বলতে যেটা খুব মায়ায় জড়ানো, যা ছেড়ে দেওয়া যায় না, সেটাকেই বোঝায়। আর পছন্দ অর্থ রুচিশীল বা মানানসই কিছু, যা দেখতে খারাপ লাগে না। মূলত সব প্রিয় জিনিসই পছন্দের, তবে সব পছন্দের জিনিস প্রিয় নয়। যেমন তুমি আমার প্রিয় একজন। কারণ তোমার মায়া ছাড়া অসম্ভব প্রায়। কিন্তু রবার্ট প্যাটিসন আমার পছন্দের, যাকে দেখতে ভালো লাগে, কারণ সে দেখতে সুদর্শন। তবে আমি তার মায়ায় এখনো জড়াই নি।”
হীরার উদাহরণ শুনে স্মরণ হেসে বলল,
“চিঠির প্রেরককে বলছি, এবার না হয় ইতি টানা হোক এই চিঠির।”
হীরা চোখ খুলে স্মরণের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আরেকটু বললে তুমি ছাই হয়ে যাবে নাকি?”
স্মরণ চোখ ছোট করে বলল,
“তুমি প্যাটিসনের কয়টা মুভি দেখেছো?”
হীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হিসেব করি নি।”
“তাহলে তোমার পছন্দটাও দেখি জোর পাচ্ছে না।”
হীরা স্মরণের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“থাক, আমার প্রিয় মানুষটির উপর আমার অনেক জোর আছে। এই জোরে আমি এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।”
স্মরণ কথাটি শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে শক্ত করে হীরার হাতটি ধরলো। আর দুজনই হারিয়ে গেলো অতীতের পাতায়।
১০।
হুট করে কিছু কড়া অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া মানুষগুলো ধীরে ধীরে অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে। এই অনুভূতিহীন মানুষগুলোর ধারণা তাদের জীবনের সাথে ভালোবাসার কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু হঠাৎ যদি এই ভালোবাসা বসন্তের হাওয়ায় ভেসে আসে? তখন এই অনুভূতিহীন মানুষ দুটির ভালোবাসার ধরণ ভিন্ন হবেই, এটাই স্বাভাবিক।
তেমনি এক বসন্তের শুরুতে স্মরণ খুঁজে পেয়েছিল তার মায়াবতীকে। সেই মায়াবতীর চুলের ফাঁকে ফাঁকে গেঁথেছিল ফুলের সমাহার। রোদের মিষ্টি আভার সংস্পর্শে যা দেখলে শিউলি ফুলের বাগান মনে হবে। ঠোঁটের কোণে ছিল মলিন হাসি, যেই হাসিতে প্রাণ না থাকলেও ভারী দাম ছিল। এই হাসি দেখলে মনে হবে এক বিরহিণী অভিনয় করছে নিজেকে হাস্যজ্বল প্রমাণের জন্য। হাতে বেলী ফুলের বাঁধানো মালা আর হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ি গায়ে জড়ানো মেয়েটির আঁচলের মায়া স্মরণের মন প্রথম দিনই কেঁড়ে নিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটির পরিচয় নেওয়ার সুযোগটা আর হলো না। তবে ভাগ্যে হয়তো এটাই লেখা ছিলো যে স্মরণ তার মায়াবতীকে আবার খুঁজে পাবে। যার ফলে সে মায়াবতীর দ্বিতীয় দেখাটা পেয়েছিলো পহেলা বৈশাখের এক মেলায়। আর সেদিন প্রথম স্মরণ আর তার মায়াবতীর চোখাচোখি হয়েছিলো। তবে মায়াবতী এতো এতো মানুষের ভীড়ে যেন সেদিন স্মরণকে দেখেও দেখলো না।
তবে এবার সে তার মায়াবতীকে যেতে দিলো না। পুরো মেলায় তার পিছু পিছু হেঁটেছিলো। আর সেই পিছু নেওয়া থেকেই একদিন হুট করে তার মায়াবতীর নজরে চলে এলো।
হীরার হাসির শব্দে স্মরণ অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসির পেছনের ইতিহাসে কি আমি আছি?”
হীরা স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। তুমি নয়তো আর কে হবে? আমি তো তোমাকে ভেবে ভেবেই হাসি। মাঝে মাঝে অতীতের স্মৃতিগুলো মনে পড়লেই খুব হাসি আসে। লোকে হয়তো পাগল বলবে, নয়তো আমি টেম্পুর মতোই হাসতাম। তোমার মনে আছে স্মরণ, যেদিন প্রথম আমায় প্রাণ খুলে হাসতে দেখেছিলো সেদিন আমাকে কি বলেছিলে?”
“হুম, বলেছিলাম তোমার হাসির শব্দ শুনলে মনে হবে একটা টেম্পু চলতে শুরু করেছে।”
হীরা এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো। স্মরণ হীরার হাসির শব্দ শুনে নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলো না। তারপর সে হাসি থামিয়ে হীরার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এক মিনিটের বেশি সময় ধরে হীরা হাসছে। আর এই হাসির ঝংকার নদীর ঘাটে এক নতুন সৌন্দর্য যোগ করেছে।
স্মরণ গুরুজনদের মুখ থেকে শুনেছে, মেয়েরা শব্দ করে হাসলে সুন্দর দেখায় না। অথচ সে হীরাকে দেখেই বুঝেছে, এই হাসির চেয়ে সুন্দর হাসি হয় না। এটা তো প্রাণবন্ত হাসি। এই হাসি বুকের আক্ষেপ, যন্ত্রণা সব বের করে দেয়, যেভানে এখন হীরা তার জমানো যন্ত্রণাগুলো বের করছে। তাহলে গুরুজনদের এমন কথা বলার কারণটা কি?
স্মরণ মনে মনে ভাবলো,
“হয়তো তারা মেয়েদের পুরুষদের নজর থেকে বাঁচানোর জন্য ওমন করে বলেছে। বেশি হাসলে তো প্রেমিক পুরুষের ঢল নামবে!”
হীরা হাসি থামিয়ে হাঁপাতে লাগলো। তারপর কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমাকে একবার হাসালেই হয়। আমি আর থামাতে পারি না নিজেকে। দেখো, পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে আমার আরো অনেক কথায় মনে পড়ে যাচ্ছিলো। ওই যে, প্রথমদিন……..”
কথাটি বলতে বলতেই হীরা আবার হেসে উঠলো। স্মরণ ভাবলো, হয়তো তার প্রথমদিনের কথাটি মনে পড়ে গিয়েছে। এবার স্মরণ হীরার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে ভুল বলেছি। তোমার হাসির উপমা দেওয়ার মতো শব্দই আমার জানা নেই। তবে একটা কথা কি জানো, তুমি অনেক সুন্দর করে হাসতে জানো। তোমার এই প্রাণবন্ত হাসির প্রেমে পড়ে যাবে কোনো এক বীরপুরুষ।”
স্মরণের কথাগুলো শুনেই হীরার হাসিমাখা মুখটা মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল। আর শেষ কথাটি শুনে তার মুখে কালো মেঘেরা ভীড় জমালো।
হীরার অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া মুখটির দিকে তাকিয়ে স্মরণ বলল,
“তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি। তোমার বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে যেদিন তোমাকে প্রথম হাসতে দেখেছিলাম, আমি সেদিনও জানতাম না, তুমি কেন কম হাসতে। আর সেদিন তোমার হাসি দেখে মনে হয়েছিলো, ভালোই হয়েছে তুমি কম হাসো। নয়তো, আমার কপালে কি এই মায়াবতী জুটতো, বলো? কবেই সেই হাসিতেই অহরহ দেবদাবের জন্ম হয়ে যেতো। আর সেই দেবদাসের ভীড়ে কি আমাকে তোমার চোখে পড়তো?”
হীরা বলল,
“তোমাকে তো আমার সেদিনই চোখে পড়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিলে। আর ভালোবেসে ফেলেছিলাম তো সেই গানের মোহে হারিয়ে।”
হীরা স্মরণের কাঁধে মাথা রেখে অতীতের সাগরে ডুব দিলো।
১১।
হীরা একদিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে রাস্তার মোড়ে স্মরণকে দেখতে পেলো। স্মরণ সেই মুহূর্তে এক দৃষ্টিতে হীরার দিকে তাকিয়ে ছিল। আর মাঝে মাঝে তার সামনে কিছু এসে পড়লে, সে পা উঁচু করে বা ঘাড় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হীরাকে ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করতো।
হীরা স্মরণকে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল,
“এটা তো মেলার সেই ছেলেটি। আজ তার চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করবো আমি। অনেক দিন ধরে দেখছি, এই ব্যাটা আমাকে ফলো করছে। হীরার হাতের মার তো খাও নি বাছাধন। একবার কষে একটা চড় লাগালে বুঝবে। হীরা আসলেই হীরা, যার তার হাতের মোয়া নয়।”
স্মরণ হীরাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ঘাবড়ে গেলো। হীরার ছুটে আসার গতি দেখে মনে হবে, কোনো এক কালবৈশাখী ঝড় বিনা নিমন্ত্রণে ছুটে আসছে। স্মরণ মনে মনে বলল,
“মায়াবতী আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে না তো?”
আরো কিছু ভাবার আগেই হীরা কোমরে হাত দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“এই যে মিস্টার লম্বু, অনেকদিন ধরেই দেখছি আমার পেছনে ঘুরঘুর করছেন। সমস্যাটা কি?”
স্মরণ হীরার মুখ থেকে লম্বু সম্বোধন শুনে কথা বলার খেই হারিয়ে ফেললো। হীরা এবার চেঁচিয়ে বলল,
“কি ব্যাপার চুপ কেন?”
স্মরণ কিছু একটা ভেবে বলল,
“আপনি কি পড়াশুনা শেষ করে শিক্ষিকা হবেন?”
হীরা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি কি টিউশন মিডিয়ার লোক?”
স্মরণ হেসে বলল,
“জি না, আমি আপনার শাসনের সুর দেখে বিস্মিত হয়ে প্রশ্নটি করেছিলাম।”
স্মরণের হাসি দেখে হীরা অন্য জগতে হারিয়ে গেলো। একটা ছেলের হাসি কি এতো সুন্দর হতে পারে? কি মায়াবী ছেলেটার মুখখানা!
হীরাকে ভাবনার জগত থেকে বের করে আনলো স্মরণ। হীরার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“কি হলো? আমার প্রশ্নের কি কোনো উত্তর নেই?”
হীরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে স্মরণের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার প্রশ্নটি মনে করার চেষ্টা করলো। স্মরণকে দেখেই যে সে হারিয়ে গেছে, তার আর প্রশ্নের কথা মনেই নেই।
স্মরণ হীরার বিচলিত মুখ দেখে বলল,
“চিন্তা করবেন না। আমি আপনার শিক্ষার্থী হবো না। তবে আপনি ভালো শিক্ষিকা হবেন।”
হীরা স্মরণের কথায় কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলো,
“আপনার নামটা জানতে পারি?”
স্মরণ আবার সেই ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলল,
“মোঃ আরেয়ান কবির স্মরণ। বর্তমানে ইকোনমিকসে অনার্স করছি। আমার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো, আমি তোমার ভার্সিটির সিনিয়র। তুমি হয়তো নতুন ভর্তি হয়েছো। আর আমি তৃতীয় বর্ষের।”
হীরা এবার চোখ বড় বড় করে স্মরণের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“হায়! হায়! আমি তো ভেবেছি মিস্টার লম্বু আমার পিছু নিয়ে আমার ক্যাম্পাসে চলে এসেছিল। এখন তো দেখছি আমি নিজের কথার জালে নিজেই আটকা পড়লাম।”
স্মরণ হীরাকে বলল,
“আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাকি।”
হীরা কপাল ভাঁজ করে বলল,
“কি প্রশ্ন?”
“আমি এখানে কি করছি? আসলে আমি তোমার পিছু নেই নি। বরং প্রকৃতি আমাদের বারবার দেখা করানোর চেষ্টা করছে। সে আমাদের পিছু নিয়েছে। এইটা কি কোনো ইঙ্গিত হতে পারে?”
হীরা আবার কোমরে হাত রেখে উঁচু গলায় বলল,
“এই যে মিস্টার সিনিয়র, এসব ফিল্মি ডায়লগ আমার মোটেও পছন্দ না।”
স্মরণ হেসে বলল,
“সত্যিই? তাহলে তো আমার নিজেকে পরিবর্তন করতে হচ্ছে না। শুনেছি মেয়েরা এমন ফিল্মি ডায়লগ দাতার উপরই পটে যায়। তাহলে তুমি হয়তো ভিন্ন কেউ।”
হীরা হেসে বলল,
“আপনি আমাকে পটাতে চাইছেন?”
“পটিয়ে কি লাভ হবে? আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। তোমার শাসনের সুর যদি একটু নরম হতো, তাহলে আমরা ভার্সিটিতেও কথাবার্তা বলতে পারতাম। ক্যাম্পাসের বাইরে না হয়, জুনিয়র একটু শাসন করলো। কিন্তু ভেতরে তো আমারই চলবে।”
হীরা মাথা নেড়ে বুঝালো সে স্মরণের কথা ধরতে পেরেছে। সেদিনের কথোপকথন এতোটুকুই ছিলো। এরপর মাঝে মাঝেই তাদের ক্যাম্পাসে দেখা হয়ে যেতো। ক্লাস শিডিউল ভিন্ন থাকায়, তাদের কথাবার্তা ওতো বেশি হতো না। মোটামুটি ছয়মাস তাদের চোখের ইশারায় কথা হয়েছে।
আর এই ছয়মাস স্মরণ নীরবে তার মায়াবতীকে ভালোবেসে গেছে। অন্যদিকে হীরা তো স্মরণের মায়ায় পড়ে গেছে৷ সে মন থেকে চাইতো, স্মরণ তাকে এসে প্রেমের প্রস্তাব দিক। সে তার অতীত ভুলে আরেকটাবার স্মরণের হাত ধরে বাঁচতে চাইবে। আরেকটাবার জীবনকে সুযোগ দেবে। এখন হয়তো শুধু স্মরণের ভালোবাসি বলার অপেক্ষা।
চলবে-