শেষ ইচ্ছে পর্ব-১০ শেষ পর্ব

1
2307

#শেষ_ইচ্ছে
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১০ (অন্তিম পর্ব)

২৫।
স্মরণের বাবা ছিলেন একজন নামধারী মানুষ। সমাজের নিম্নবর্গের দশজন মানুষের ক্ষতি করে, তিনি উচ্চবর্গের পাঁচজন মানুষের উপকার করতেন আর খ্যাতিও বেশ ভালোই পেয়ে যেতেন। স্মরণের দাদার পরিবারের সবাই অনেক নামি-দামি মানুষ ছিলেন। আর যার ফলে আজ স্মরণকে বাঁচানোর জন্য কেউ নেই। কারণ যারা স্মরণকে বাঁচাতে আসবে, তাদের পরিণতি হবে ভয়ংকর।
আইন বিভাগের বড় বড় পদে বসে আছে স্মরণের বাবা-চাচার বন্ধুরা। তাহলে স্মরণের কিভাবে গতি সম্ভব?

স্মরণের উপর শুধু খুনের মামলা হয় নি, ধর্ষণেরও মামলা হয়েছে। আর এতো সংবেদনশীল একটা ঘটনার পরও কি স্মরণের মুক্তি সম্ভব?
রাস্তায় রাস্তায় স্মরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। ব্যানারে ঝুলছে “লাবণ্যের হত্যার বিচার চাই।” আর ব্যবসায়ীরা বলছে, “জয়নালের খুনের বিচার হোক।” জনসাধারণ আর প্রভাবশালীদের মতের যখন মিল হয়ে যায়, সেখানে তো আর বাঁচার উপায় থাকে না। কিন্তু কেউ মূল ঘটনাটা এখনো জানতেই পারলো না। কারণ এই সত্যের একমাত্র সাক্ষী ছিল মিসেস রোজা আর স্মরণ নিজেই।

কলেজ জীবনে স্মরণের একমাত্র বন্ধু ছিল আমান। আর লাবণ্য আমানের ছোটবোন। খুব কম সময়ে আমানের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় স্মরণের। আর লাবণ্যও আমানের জায়গাটা স্মরণকে দিয়ে দেয়।
আমানের বাবা খুব কঠিন হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তিনি আমানের উপর জোর করেই নিজের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানানোর। কিন্তু আমানের সেটিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তবুও সে বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যায় নি। সে মেডিকেলে ভর্তিও হয়ে যায়। আর তৃতীয় বর্ষতেই অতিরিক্ত পড়াশুনার চাপে আমান স্ট্রোক করে ফেলে। আর এরপরই তার মৃত্যু হয়।

আমান বেঁচে থাকলে হয়তো আজ স্মরণের পরিণতি এমন হতো না। কারণ আমান তাকে প্রচন্ড বিশ্বাস করতো। যেমনটা লাবণ্য করতো। আর আমানের মৃত্যুর পর ভাই হওয়ার সকল দায়িত্ব স্মরণ নিজের কাঁধেই নেয়। যদিও অতিরিক্ত রক্ষণশীল হওয়ায় লাবণ্যের বাবা-মা একটা বাইরের ছেলেকে লাবণ্যের ভাই হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি। বরং তারা স্মরণের সাথে লাবণ্যের যোগাযোগ রাখাটাও পছন্দ করতেন না। আমানের বন্ধু হিসেবে স্মরণকে তারা পছন্দ করলেও লাবণ্যের ভাই হিসেবে করতেন না। কারণ তাদের ধারণা ছিল স্মরণ যেহেতু লাবণ্যের আপন ভাই না, তাদের সম্পর্কটা যেকোনো দিকে মোড় নেওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আর ব্যক্তিগতভাবে স্মরণের বাবাকে আমানের বাবা-মা পছন্দ করতেন না। আর তাই লাবণ্যের ধর্ষণের পর তার বাবা-মা স্মরণের বিরুদ্ধে মামলা করেন। স্মরণের একটা কথাও তারা শুনার চেষ্টা করেন নি। কারণ তারা আগে থেকেই স্মরণ সম্পর্কে খারাপ ধারণা নিয়ে বসে ছিলেন। মূলত সেদিন লাবণ্যকে ধর্ষণ করেছিল স্মরণের বাবা। আর স্মরণ বাবার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে যায়, আর হাতাহাতির একপর্যায়ে সে গুলি চালিয়ে দেয়।

২৬।

সেদিন ছিল শুক্রবার। জয়নাল সাহেব আর মিসেস রোজা বাসায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু জান আর জারিফ গিয়েছিল এক বন্ধুর বাসায়। লাবণ্য হুট করে স্মরণকে না জানিয়ে তার বাসায় চলে আসে, কারণ হঠাৎ বাবা-মা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে ঠিক করে বসে। আর সে এসেছিল স্মরণের কাছে সাহায্যের জন্য। কিন্তু কে জানতো তার এভাবে চলে আসাটাই তার জন্য অভিশাপ হবে?
লাবণ্যকে দেখে সেই মুহূর্তে জয়নালের মাথায় বদ মতলব চলে আসে। আর মিসেস রোজা লাবণ্যকে স্মরণের রুমে গিয়ে বসতে বলেন। লাবণ্যও তার কথামতো স্মরণের রুমে চলে যায়। স্মরণ সেই মুহূর্তে হীরার সাথে ছিল। তারা সেদিনই বসে তাদের বিয়ে নিয়ে পরিকল্পনা করছিল। তাদের পরিকল্পনা অনুসারে পরের শুক্রবার স্মরণের হীরার মায়ের সাথে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু কে জানতো এই শুক্রবারেই তাদের ভালোবাসার ভয়ংকর পরিণতি হবে?

জয়নাল সাহেব তার খারাপ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য স্মরণের ঘরে চলে যান। আর লাবণ্যকে ধর্ষণ করেন। স্মরণ সেই সময় বাসায় পৌঁছে গেলে মিসেস রোজা খুব ভয় পেয়ে যান। কারণ তিনি তার স্বামীর কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত ছিলেন। স্মরণ ঘরের বাইরে লাবণ্যের জুতা জোড়া দেখে আর ঘরে এসে মিসেস রোজার ভীত চেহারা দেখে সব আন্দাজ করে ফেলে। কারণ সে জানে তার বাবার চরিত্র সম্পর্কে। কিন্তু স্মরণের সেদিন ফিরে আসতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল।
নিজের ঘরে এসে লাবণ্যকে সেই অবস্থায় দেখে স্মরণের মাথায় রক্ত উঠে যায়। তার বাবার হিংস্র চেহারাটা দেখে তার মনে পড়ে যায় তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনা, রফিক মামার ফাঁসির ঘটনা, মামীর আকুতি ভরা কন্ঠস্বর, নবনীতার নিথর দেহ। স্মরণ ভুলেই গিয়েছিল তার সামনে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। সে শুধু একজন হিংস্র মানুষকে দেখেছিল। এরপর সব রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা একসাথে মিলেমিশে সেদিন স্মরণকে খুব ভয়ংকর করে তুলেছিল। জয়নালের সাথে হাতাহাতির এক পর্যায়ে মিসেস রোজা জয়নালের ব্যক্তিগত পিস্তল জয়নালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, স্মরণের উপর গুলি চালাতে। কিন্তু সেই পিস্তল জয়নালের হাতে যাওয়ার আগেই মিসেস রোজার হাত থেকে কেঁড়ে নিয়ে স্মরণ তা চালিয়ে দেয়। আর দুর্ভাগ্যক্রমে জান আর জারিফ সেই মুহূর্তে বাসায় এসে এই দৃশ্য দেখে ফেলে।

মিসেস রোজা সবাইকে জানান স্মরণই লাবণ্যকে ধর্ষণ করে৷ কিন্তু জয়নাল পিস্তল দেখিয়ে ছেলেকে বাঁধা দিতে গেলে, স্মরণ সেই পিস্তল কেঁড়ে নিয়ে জয়নালের উপর গুলি চালিয়ে দেয়।
অন্যদিকে লাবণ্যকে হাস্পাতালে নেওয়ার আগেই সে মারা যায়। কলেজ পড়ুয়া লাবণ্যকে ন্যায় দেওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে পড়ে জনসাধারণ। জয়নাল হয়ে পড়েন করুণার পাত্র আর সাহসী বাবা। সংবাদপত্রে ছাপানো হয়, ছেলের কুকর্মে বাঁধা দেওয়ায় বাবাকে হত্যা করে ছেলে।

লাবণ্যের মেডিকেল রিপোর্টে স্মরণকে ফাঁসানোর জন্য মিসেস রোজা মোটা অংকের টাকা দেন। আর সব তথ্য স্মরণের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এক সপ্তাহের রিমান্ডে স্মরণের উপর সব ধরণের অত্যাচার চালানোর পরও সে খুন করার ব্যাপারটা স্বীকার করলেও ধর্ষণের ব্যাপারটা স্বীকার করে নি। তবুও সবাইকে মিথ্যে জানানো হয় যে সে সব স্বীকার করে নিয়েছে। আর এরপর গণ আন্দোলনের মুখে স্মরণের ফাঁসির রায় হয়ে যায়।
মিসেস রোজা জানতেন স্মরণ বেঁচে গেলে তিনি ফেঁসে যাবেন। তাই তিনি স্মরণকে বাঁচানোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেন।

২৭।

ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। হীরা নদীর ঘাটে বসে একে একে সব চিঠি ভাসিয়ে দেওয়ার পর দাঁড়িয়ে যায়। ফোন বের করে কানে হেডফোন গুঁজে স্মরণের রেকর্ড করা কথাগুলো শুনতে শুনতে জেলখানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হীরা স্মরণের অপেক্ষায় বসে ছিল। দূরে দাঁড়িয়ে আছে জান ও জারিফ। স্মরণের ফাঁসি হয়ে গেছে আরো দশমিনিট আগে। তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর সেই খবর দেওয়ার জন্য একজন বেরিয়ে এলেন। আর তারপরই শহরে আনন্দ মিছিল বের হয়। কারণ দেশে একজন ধর্ষক আর খুনীর বিচার হয়েছে।

আধাঘন্টা পর স্মরণের লাশটি বের করে জান ও জারিফকে দিয়ে দেওয়া হয়। স্মরণের ইচ্ছানুযায়ী তাকে তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে।

হীরা স্মরণকে একটিবার দেখার জন্য এগিয়ে আসলো। তারপর স্মরণের ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে হীরা বলল,
“তোমার কি খুব কষ্ট হয়েছিল? আমি তোমার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইবো, যাতে তিনি তোমার কষ্ট কমিয়ে দেন। জানি না আমার প্রার্থনা কবুল হবে কিনা, তবুও চাইবো। তোমার ইচ্ছেনুযায়ী আমি সব চিঠি অশ্রু প্রবাহিণীকে দান করে দিয়েছি। কিন্তু তবুও তুমি আমার হৃদয়ে সবসময় বেঁচে থাকবে।”

স্মরণের গ্রামের বাড়ি যাওয়া হীরার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর হীরা মায়ের অনুমতি ছাড়া কখনোই সেখানে যেতে পারবে না। তাই সেখান থেকেই স্মরণকে বিদায় দিয়ে দেয় হীরা।

স্মরণের মৃত্যুর অনেক বছর কেটে গেছে। হীরা এখনো স্মরণকে ভুলতে পারে নি। তাকে মাঝে মাঝে দেখা যায় সেই নদীর ঘাটে একা একা বসে থাকতে, আর তার সঙ্গী হয় ফোনে রেকর্ড করা স্মরণের সেই কথাগুলো। হীরা উজানের মতো করে স্মরণকে কখনোই ভালোবাসে নি। তাই হয়তো উজানকে যতো তাড়াতাড়ি ভুলতে পেরেছিল, স্মরণকে ততো তাড়াতাড়ি ভালোবাসতে পেরেছে। হীরার দৃষ্টিতে এই ভালোবাসা কখনোই উন্মাদের মতো ছিল না। তাই সেই প্রেম তার মনে ভিন্নভাবে জায়গা করে ফেলেছে।

একদিন হীরা বলেছিলো স্মরণকে,
“তোমাকে আমি কখনোই পাগলের মতো ভালোবাসি নি। তাই তুমি আমার উন্মাদ রূপের সাথে পরিচিত নও। সেই রূপ দেখলে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যেতো।”

স্মরণের উত্তর ছিল,
“আমি সুস্থ হীরার মাঝে স্বস্তি পেয়েছি, সেই স্বস্তির মাঝেই ভালোবাসা অনুভব করেছি। জানো হীরা, তোমাকে ভালোবাসার পর থেকেই আমি খুব শান্তি পাচ্ছি। যা আমি আগে কখনোই পাই নি। তাহলে এতোবছর আমাদের দুজনের জীবনে কিসের অভাব ছিল?”

হীরা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে করতে বলল,
“শান্তি। আর এই শান্তিটা খুব শীঘ্রই হারিয়ে যাবে।”

স্মরণ বলল,
“আমার জ্ঞান থাকতে তোমাকে ভুলা সম্ভব না। তোমাকে ভালোবাসতে বাসতেই আমি হারিয়ে যাবো। তাই আমার জীবনে এখন শান্তি আর শান্তি। এই শান্তি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি পাবো।”

হীরা প্রশান্তির হাসি মুখে টেনে বলল,
“আমিও আমার হিয়ার মাঝে তোমায় খুব যত্নের সাথে তুলে রাখবো। এবার হবে আমাদের কাল্পনিক শান্তিময় প্রেম।”

হীরা তার কথা রেখেছে। সে স্মরণের জন্য এখন আর কাঁদে না। সে মনে করে স্মরণ তার পাশে আছে। বায়বীয় জগতে যে প্রেম অসম্ভব ছিল, সেই প্রেম কল্পনার জগতে খুব সুন্দর জায়গা করে নিয়েছে। কল্পনায় স্মরণ মাঝি হয়ে নৌকা বাইতে থাকে আর হীরা কমলা শাড়ি পরে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে স্মরণের দিকে।আর স্মরণ হীরার দিকে তাকিয়ে কন্ঠে গান ধরে,
“তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান,
যদি খুব আদরে ডাকি তোমাকে,
ভুলে যেও অভিমান.. হায়!
তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান।
চোখের পাতায়.. স্মৃতি ভেসে যায়.. আনমনে গায়.. তোমার গান।
মনের খাতায়.. রঙিন পাতায়.. শুধু লিখে যায়.. তোমার নাম।”

#সমাপ্তি

1 COMMENT

  1. সত্যি কথা বলতে বিগত তিন বছর ধরে আমি গল্প পড়ছি
    আমি জানি সব গল্পের এন্ডিং ভালো হয়না কোন কোন গল্প শেষ হয় অনেক দুঃখজনক ভাবে , এতটা খারাপ ভাবে না
    একবার যেহেতু ছেলেটার মেয়ের সাথে অন্যায় হয়েছে
    লাস্টের বার ন্যায়বিচার পেলে অনেক ভালো হতো……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here