শেষ থেকে শুরু পর্ব-২৮

0
1991

#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে : লাবণ্য ইয়াসমিন
#বোনাস_পর্ব

জ্ঞান ফিরে হৈমন্তী নিজেকে একটা বন্ধ রুমে আবিস্কার করলো। রুমে মিডিয়াম তাপমাত্রাই এসি চলছে,শীত শীত করছে। দরজা জানালা সব বন্ধ। হৈমন্তীর শরীর বেশ দুর্বল,ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। গায়ে অফিসের পোশাক। হিজাব ছিল মাথায় সেটাও ঠিকঠাক আছে। হৈমন্তী মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। কোথায় আছে ঠিক বুঝতে পারছে না।ও কয়েকবার ঢোক গিলে উঠে বসলো। আসবাবপত্র দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো রুমটা। রুমের মালিক বেশ সৌখিন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হৈমন্তী ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সবটা মনে হতে ওর কয়েক সেকেন্ড লাগলো। সেই সঙ্গে ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। হৈমন্তী দৌড়ে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করলো কিন্তু কিছুতেই দরজা খুঁললো না। হৈমন্তী জানালা খোলার চেষ্টা করলো সেটাও বন্ধ। রুমের মধ্যে ওর আওয়াজ প্রতিধ্বনি করে ফিরে আসছে। হৈমন্তী চিৎকার চেচামেচি করতে করতে দরজা ধরে ফ্লোরে বসে পড়লো। মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ছে। কিভাবে এখানে থেকে বের হবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ খুঁট করে আওয়াজ করে দরজা খুঁলে গেলো। হৈমন্তী অবাক চোখে দরজার দিকে তাঁকিয়ে আছে।একটা মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলত। হৈমন্তীর সারামুখে ভয় ছাপিয়ে বিরক্তি আর ঘৃণা এসে ভর করলো। কারণ লোকটা ওর প্রাক্তন স্বামী ফরহাদ। এই লোকটাকে ও প্রচণ্ড ঘৃণা করে। হৈমন্তীর ইচ্ছা করলো লোকটাকে খুন করতে। চরিত্রহীন লম্পট। হৈমন্তী দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন মুখে বলল,

> ফাজলামি করছেন আমার সঙ্গে? থাপ্পড়িয়ে গাল ভেঙে দিব বেয়াদব। আমাকে যেতে দিন।

ফরহাদের ওষ্ঠে বাঁকা হাসি। কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির আনন্দ। হৈমন্তী জিঞ্জাসু চোখে এখনো তাঁকিয়ে আছে। ফরহাদ হাসিটাকে আরও চাওড়া করে বলল,

> আজ থেকে তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে থাকবে। বউকে ছাড়া আর কতকাল একা থাকবো বলো?

হৈমন্তীর গা জ্বলে উঠলো ফরহাদের এমন খাপছাড়া কথা শুনে। ডিভোর্স হওয়ার পরে বউ বলতে লজ্জা লাগছে না। হৈমন্তী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

> তুই সত্যিই অমানুষ। লতার প্রেম উবে গেছে? তোর দেওয়া প্রতিটা আঘাত আমার মনে গেঁথে আছে। যদি কখনও মারাও যায় তবুও মনে থাকবে। তোকে ঘৃণা ছাড়া কিছুই করা যায় না।

ফরহাদ মন খারাপ করে বলল,

> ভুলে যাও না কেনো সেসব খারাপ অতীত? আমি ভূল করেছিলাম ক্ষমা চেয়েছি। তোমার উচিৎ আমাকে ক্ষমা করে সংসার করা। তাছাড়া তোমার আম্মাও চেয়েছে তুমি আমার সঙ্গে থাকো।

> কুত্তা, তুই এখুনি আমাকে দিয়ে আসবি নয়তো খুন করবো তোকে। কিসের ক্ষমা? আমি বিবাহিত, মেয়ে আছে স্বামী আছে। আমার সংসার ফেলে তোর সঙ্গে থাকবো কেনো?

> এটা একদম ঠিক না হৈমন্তী। আমি জানি ওই মেয়েটা তোমার মেয়ে না। মিথ্যা বলোনা। যদিও তোমার মেয়ে বা স্বামী থাকতো তবুও আমার কোনো সমস্যা নেই। উপর থেকে ঠিক করা তুমি শুধু আমার।

ফরহাদের কথাবার্তা শুনে হৈমন্তীর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। হাতের কাছে ফুলদানি ছিল উঁচু করে ওর গায়ে ছুড়তে গেলো কিন্তু পারলো না। ফরহাদ ছুটে এসে ওকে ধরে ফেলল। হৈমন্তীর সঙ্গে ফুলদানি নিয়ে বেশ ধস্তাধস্তি হলো। শেষমেশ ফরহাদ সফল হলো। হৈমন্তী ক্লান্ত হয়ে বসে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল। ফরহাদ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ওর ওর সামনে বসে বলল,

> আগের হৈমন্তী কিন্তু এমন ছিল না। আগে কতো লক্ষ্মী হয়ে আমার হুকুম শুনতে। আশেপাশে ঘুরঘুর করতে খুব মিস করি তোমাকে। প্লিজ আগের মতো হয়ে যাও না। খুব ভালোবাসা দিবো বিশ্বাস করো।

হৈমন্তীর গা গুলিয়ে উঠলো ফরহাদের কথা শুনে। ইবলিশ শয়তানকে হার মানিয়ে দিবে এই লোকটা। হৈমন্তী নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে ধাক্কা দিয়ে ফরহাদ কে দরজার ওপাশে ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলল। ওপাশ থেকে বাধা দিলো কিন্তু হৈমন্তীর সঙ্গে পারলো না। ফরহাদ বুঝে উঠার আগেই হৈমন্তী দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি আটকে দিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,

> আমি জানি তুই আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিবি না। যতদিন কেউ আমাকে উদ্ধার করতে না আসবে আমি এই রুমেই থাকবো। সহ‍্য করতে না পারলে সুইসাইড করবো তবুও তোর কাছে নিজেকে তুলে দিবো না। তোর থেকে মৃত্যু ভালো।

হৈমন্তী কথাগুলো বলে মেঝেতেই বসে কাঁদতে লাগলো। কাছে ফোনটা ছিল কিন্তু সেটা কোথায় আছে বুঝতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে হৈমন্তীর চোখ বন্ধ হয়ে আসলে। মেঝেতেই ঢলে পড়লো আর অজ্ঞান হয়ে গেলো।
দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ফরহাদ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ধাক্কা দিচ্ছে। হৈমন্তী যে এমন একটা কাজ করবে ওর বুঝতেই পারেনি। মেয়েটার সাহস দেখে ও হতবাক। কিন্তু পাখি কতদিন দানা পানি ছাড়া ঘর বন্দি থাকবে। এক সময় না এক সময় বাইরে আসতেই হবে। তখন কোথায় যাবে? কথাটা ভেবে ও নিচে নেমে আসলো। বাড়িতে শায়লা বানু ছিলেন কিন্তু এখন নেই। তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে এসেছে। আর দেখতে যাওয়া হয়নি। ফরহাদ মায়ের ব‍্যাপারে একদম উদাসীন। যেই মা সন্তানের খুশীর জন্য কতটা বেপরোয়া ছিল সেই মাকে আজ অনাদর অবহেলায় পড়ে থাকতে হচ্ছে। বিধির লিখন আর পাপের শাস্তি খন্ডন করার সাধ‍্য আছে কার?
_____________________
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে তবুও হৈমন্তী বাড়িতে ফিরে আসেনি। জান্নাত মায়ের জন্য কান্নাকাটি করছে। খাওয়া দাওয়া করছে না। হৈমন্তীর ফোন থেকে আরাফাতের ফোনে একটা টেক্সট এসেছে। হৈমন্তী অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে কবে নাগাদ ফিরবে বলা যাচ্ছে না। জান্নাতকে দেখে রাখতে। নেটওয়ার্কের সমস্যা ফোন বন্ধ থাকবে। আরাফাতের কেমন খটকা লাগছে। অরিন আবিরের সঙ্গে কথা বলছিল হঠাৎ জান্নাতের কান্নাকাটি শুনে জিঞ্জাসা করলো,

> ও কাঁদছে কেনো?

> হৈমী বাড়িতে নেই ভাইয়া। অফিসের কাজে বাইরে গেছে কবে ফিরবে জানিনা। টেক্সট করেছে কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। মেয়েটা মাকে চাইছে। খুব কেঁদেছে।

> আমি আসছি তুই ওকে গেটের কাছে নিয়ে আসেক।

> কাঁদবে তো।

> কাঁদবে না তুই এখুনি বাইরে আই।

> আচ্ছা।

আবির ফোন কেটে চোখ বন্ধ করলো। হৈমন্তী মেয়েকে ফেলে অফিসে কাজে গিয়েছে কিন্তু কিভাবে সম্ভব? মেহুলের নম্বরে বাধ্য হয়ে ফোন দিলো। মেহুল ফোন রিসিভ করে ঢোক গিলে বলল,

> কেমন আছো আবির?
আবির ভনিতা রেখে সোজাসুজি জিঞ্জাসা করলো,

> তোমাদের অফিস থেকে কাজের জন্য বাইরে গেছে কতজন? কোথায় গেছে?

মেহুল অবাক হয়ে বলল,

> কিসের কাজে আবির? আমাদের এখান থেকে বাইরে কেনো কাজে যাবে? অফিসের শাখা আছে। কোনো দরকার থাকলে ওরাই করে দিয়ে থাকে আমাদের যাওয়া লাগে না। কেনো বলোতো?

> হৈমী এসেছিল অফিসে?

> হুম এসেছিল আবারও চলেও গেছে। বলল জান্নাত কান্নাকাটি করছে তাই তাড়াতাড়ি ফিরে গেছে। কেনো বলতো?

> কিছু না।

> শুনো…

আবির শুনলো না খট করে ফোন রেখে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লো। সেক্রেটারি জাবেদকে ফোন দিয়ে হৈমন্তীর নাম্বার দিয়ে বলে দিলো খোঁজ করতে। মেয়েটা এমনি গায়েব হয়নি। গায়েব করা হয়েছে। নিজের বুদ্ধির তারিফ করতে ইচ্ছে করছে। বেকুবের মতো ভয় পেয়ে ওরে দূরে থাকতে বলে বিপদে পড়তে হলো। মেয়েটা ভালো আছে কি আল্লাহ্ ভালো জানে। আবির আগে জান্নাতকে নিয়ে আসলো। মেয়েটা ওকে দেখলে বেশ শান্ত হয়ে থাকে। আবির বুঝতে পারছে না কথাগুলো আরাফাতকে বলা উচিৎ কিনা। পুলিশের সাহায্য নিলো। কিন্তু বারো ঘন্টা না হলে কিছুতেই কেস নিতে চাইলো না। এক সেকেন্ড টাইম যাচ্ছে না আবার বারো ঘন্টা। বিপদের মধ্যে আরেক ঝামেলা। আরশী ঘনঘন ফোন করছে বাড়িতে ফেরার জন্য। ওর মা বাবা এসেছে কিসের কথাবার্তা বলবে। আবির সাফ জানিয়ে দিলো ফিরবে না। ফোনটা চালু রাখতে হবে।
☆☆
মন খারাপ করে বসে আছে আমেনা বেগম। শরীর ঠিক লাগছে না। বড়মেয়ের বলা কথাগুলো উনাকে আঘাত করেছে। মেয়েকে সুখে রাখতে গিয়ে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা মরার মতো বেঁচে আছে। কি করে দিবেন এই পাপের মাশুল? দুটো মেয়ের জীবন উনি নিজ হাতে নষ্ট করেছেন। কথাগুলো ভেবে উনার পেসার হাই হয়ে যাচ্ছে। প্রচুর ঘামছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ফ‍্যানের বাতাস গায়ে লাগছে না। ছোট মেয়ের জীবনটা উনি তছনছ করেছেন। শুধু ভেবেছেন বড় মেয়ে ভালো আছে ছোট মেয়েকেও বোনের মতো ভালো থাকতে হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বড় মেয়েটাই ভালো নেই। যাকে উনি আগে অহংকার ভাবতেন তাকে এখন বিষাক্ত লাগছে। মা হয়ে কিভাবে সন্তানের এমন সর্বনাশ করেছেন নিজের উপরে নিজের ঘৃণা হচ্ছে। বড় মেয়েটা না আসলে তো উনি বুঝতেই পারতেন না উনার সিদ্ধান্তগুলো কতটা খারাপ ছিল। মেয়ে দুটো দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের দেওয়া কষ্ট সহ‍্য করে বেঁচে আছে। আর উনি চোখে পর্দা টাঙিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমেনা বেগমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চারদিক ঘুরছে। শরীর থরথর করে কেঁপে উনি ধপাস করে পড়ে গেলেন। চয়নিকা শাশুড়ির কাছেই আসছিল হঠাৎ শব্দ শুনে দৌড়ে এসে দেখলো আমেনা বেগম উল্টে পড়ে আছে। ও চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডেকে নিলো। রাজীব তাড়াতাড়ি মাকে নিয়ে হাসপাতাল ছুটলো। বয়স হয়েছে হার্ট এটাক হলে রক্ষা নেই।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here