শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ৩৬

0
4127

#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ৩৬

🌼
সারাদিনের ভ্যাপসা গরম অনেকটাই মিইয়ে এসেছে।মৃদু মন্দ বাতাসে মেহেদীর গন্ধ মিশে আলাদা এক সুবাস তৈরি হয়েছে। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারার আবির্ভাব। সেই আকাশের দিকে চেয়েই দির্ঘশ্বাস ফেললো রোশনি।তার মন খারাপ।ভিষন রকমের মন খারাপ। সময়ের সাথে সাথে সেই মন খারাপটা বিরক্তিতে রুপ নিচ্ছে।সব কিছুই অসহ্য আর বিরক্ত লাগছে ।মেহেদির মত এতো প্রিয় একটা বিষয়ও আজ ভিষন বিদঘুটে মনে হচ্ছে।সময়ের সাথে সাথে বিরক্তি ভাবটা তরতর করে বাড়ছে।সেই সাথে বাড়ছে অধিরের প্রতি বেহিসেব অভিমান।নালার নোংরা পানিতে ইচ্ছে মত চুবাতে ইচ্ছে করছে বজ্জাতটাকে।কিন্তু সেটা করার জন্যে হলেও তো বান্দাকে চাই।তাকে তো হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে না সকাল থেকে।রোশনি বেশ বুঝতে পারছে অধির তার উপর রেগে আছে।তাই তো সকাল থেকে জেনে বুঝে তাকে ইগনোর করে চলেছে ।রোশনি ঠোট ফুলিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে অধিরকে খুজলো।বজ্জাতটা ওর থেকে খানিক দূরে দাড়িয়ে দুটো লোকের সাথে কথা বলছে।রোশনির ইচ্ছে করছে অধিরের চুলগুলো টেনে টুনে ছিড়ে ফেলতে। রাতে না হয় সে একটু ওভার রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিল তাই বলে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে? রোশনি ঠোট উলটে নিজের মনেই অধিরকে নিয়ে অভিমানের ঝুড়ি ভরতে লাগলো।মেহেদি রাঙা হাত দুটোতে নজর দিতেই বাম হাতের আঙুলে অধিরের দেওয়া আংটিটা চোখে পড়লো।কিছুক্ষন আংটিটাকে ভালো ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সামনে তাকাতেই চোখ গেল অধিরের দিকে।রোশনির মন হলো অধির এতোক্ষন এদিকেই তাকিয়ে ছিলো।তাকেই দেখছিল গভির ভাবে।পরোক্ষনেই মনে হল তার মনে হওয়াটা একেবারেই ভুল।কারন অধির সামনে দাড়ানো দুটো লোকের সাথে সমানে কথা বলে যাচ্ছে।রোশনির রাগের পরিমান বাড়লো।তার সাথে একটা বার কথা বলছে না অথচ এদের সাথে কি সুন্দর হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে চলেছে।ব্যাটা হনুমান একটা।রোশনি চোখ মুখ কুচকে পিয়ার দিকে হাটা দিলো।রোশনি পিয়ার সামনে মুখ ফুলিয়ে দাড়াতেই ভ্রু কুচকে তাকালো পিয়া।রোশনিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু কুচকে বললো,

-কি হয়েছে? এমন মুখ ফুলিয়ে আছিস কেন?

রোশনির ফুলানো ঠোটটা আরো একটু ফুলে উঠলো।অধিরের দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়ে বললো,

-কিছু না এমনিই।

-কিছু না মানে? মুখ ফুলিয়ে বলছিস কিছু না? কি হয়েছে বল।

রোশনি বিরক্ত চোখে তাকালো।বলল,

-বলছি তো কিছু হয় নি।বার বার কেন একই প্রশ্ন করছিস?এখন কি আমি মুখ ফুলিয়েও থাকতে পারবো না?

-আরেহ এতে এতো রিয়্যাক্ট করার কি…..

পিয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়েই হনহনিয়ে চলে এলো রোশনি।রোশনির মেজাজ খারাপ হচ্ছে।তাকে নিয়েই যে কেনো সবার এতো প্রবলেম সেটাই বুঝে ওঠে না সে।রোশনির যাওয়ার দিকে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেও মাথায় ঢুকলো না রোশনির হঠাৎ এমন রেগে যাওয়ার কারন কি।পিয়া বার কয়েক মনে করার চেষ্টা চালালো, সে কি রোশনিকে রেগে যাওয়ার মত কিছু বলেছে।মনে পড়ল না।তার মানে সে বলে নি।তাহলে মেয়েটার রাগের কারন কি? পিয়া ভাবনায় ডুব দিয়ে সামনের দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে একটা পিছিয়ে গেল।বুকে হাত রেখে ক্রুর চোখে তাকালো।

-প্রবলেম কি তোমার? এমন হুটহাট সামনে চলে আসো কেন? একটু হলেই তো হার্ট এ্যাটাক করে বসতাম।

আদি সরু চোখে তাকালো।মুখে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,

-তুমিও যে ভয় পেতে পারো এটা জেনে খুশি হলাম।আমি তো মনে করতাম চুড়েলের মত চেহারা নিয়ে তুমিই অন্যদের ভয় দেখিয়ে বেড়াও।তা ভেটকি মাছের মত ভেটকি মেরে দাড়িয়ে ছিলে কেন?

পিয়ার চোয়াল শক্ত হলো।ছেলেটা যে এক নাম্বারের ফাজিল সেটা প্রথম সাক্ষাতেই বুঝে গেছে সে।পিয়া চোখ মুখে রাগ ফুটানোর চেষ্টা করে বলল,

-আমি যেভাবেই দাড়িয়ে থাকি না কেন তাতে তোমার তো প্রবলেম হওয়ার কথা নয়।তাহলে এতো চুলকাচ্ছে কেন তোমার?তোমাকে বলেছিলাম তুমি আমার সামনে আসবে না। তারপরও পেছনে পেছনে ঘুর ঘুর করছো কেন?

-তোমার পেছনে কোথায় ঘুরছি? আমি তো ব্যস তোমাকে ভেটকিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলাম।নয়তো আমারও কোনো শখ নেই তোমার মত চুড়েলের মুখ দেখার।উপর থেকে আবার ঝগড়ুটে।

-আর একটা বাজে কথা বললে আমি কিন্তু তোমায় ওই পুলের পানিতে ফেলে চুবাবো।আমার সামনে থেকে ফুটো।

আদি ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে দাড়াল।বলল,

-আমার পায়ে আমি দাড়িয়ে আছি তোমার এতো সমস্যা হচ্ছে কেন? আর সমস্যা হলে তুমি নিজে এখান থেকে ফুটো।আমি তো বাবা এখানেই থাকবো।

পিয়া জানে এই ছেলের ঘাড় ত্যারা।ভাইটা তো অধির চৌধুরিরই তাই না? ত্যারা হওয়াটাই স্বাভাবিক।পিয়া ক্রুর চোখে তাকিয়ে প্রস্থান করলো।পিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই হাসলো আদি।মেয়েটাকে জ্বালাতে তার বেশ লাগে।

দুহাত ভর্তি মেহেদি নিয়ে বসে আছে নাতাশা।পাশেই থমথমে মুখে বসে আছে দিদাম।কিছুটা দূরে দাড়িয়ে সাহিল কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।নাতাশা সেদিকে একবার তাকিয়ে দিদামের হাতের দিকে তাকালো।বলল,

-আজ সবাই মেহেদি পড়েছে শুধু তুইই পড়লি না।একটা দিন পড়লে কি এমন হতো শুনি?

দিদাম তাকালো।নাতাশার মেহেদি ভরা হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে নাক ছিটকালো।বললো,

-এই মেহেদি জিনিসটা আমার কাছে ভিষন বিদঘুটে লাগে ইয়ার।অযথাই হাত দুটোকে নোংরা করা।কেমন ক্ষ্যাত লাগে দেখতে।খালি হাতেই বেশি স্মার্টনেস। আর সব চেয়ে বড় কথা এমন সঙের মত হাত ভর্তি মেহেদি নিয়ে বসে থাকাটা দেখতেও আমার ইরিটেট লাগে।

নাতাশা কিছু বলবে তার আগেই সাহিল এসে বসলো তার পাশে।দিদাম নাতাশার দিকে তাকিয়ে বলল,

-তোরা কথা বল আমি একটু ওদিক থেকে আসছি।

দিদাম উঠে এসে নিরিবিলি জায়গায় দাড়ালো।কাউকে ফোন লাগিয়ে চাপা রাগ নিয়ে বলে উঠল,

-ইইডিয়েট।এতো দেরি কেন হচ্ছে আসতে? কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহেন্দি অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে।অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে মেয়েটাকে শেষ করতে হবে। তাড়াতাড়ি এসে কাজটা কমপ্লিট করো।আর খেয়াল রাখবে কেউ যেন তোমায় দেখতে না পায়।নয়ত কি অবস্থা করবো বুঝতেই পারছো?

দিদাম ফোন কেটে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো কিছুটা দুরে রোশনি দাড়িয়ে আছে। দিদাম শয়তানি হাসলো।নিজের মনেই বিরবির করে উঠলো।

-আমার অধিরকে কেড়ে নেওয়ার শাস্তি এবার তুমি পাবে মিস রোশনি।দিদামকে তুমি চেনো না। তুমি আমার সাথে খেলতে এসেছো।এবার দেখো এর পরিনতি কি হয়।যা করার করে নাও এরপর হয়ত আর টাইম পাবে না।আজই যে তোমার জিবনের শেষ দিন হতে চলেছে।

রোশনিকে একা একা দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো আদি।আদিকে দেখে হাসার চেষ্টা করলো রোশনি।আদি কিছুক্ষন চুপ থেকে প্রশ্ন করলো,

-ভাবি তোমার কি কোনো কারনে মন খারাপ?

রোশনি যথা সম্ভব হাসার চেষ্টা করে বলল,

-কই না তো।আমি তো ঠিকই আছি।অযথা মন খারাপ হবে কেন।

-তাহলে নিশ্চয় রেগে আছো? আমি অনেকক্ষণ থেকে খেয়াল করছি তুমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে কিছু বলছো।ভাইয়ার উপর রেগে আছো তাই না?

-না না তেমন কোনো ব্যাপার না।আমি রেগে নেই।ব্যস এমনিই নিজের মনে বিরবির করছি।

অধির আড় চোখে রোশনিকে দেখছে।সকাল থেকে ইচ্ছে করেই সে রোশনিকে ইগনোর করছে।মেয়েটাকে বুঝতে হবে তারও অভিমান হয়।তারও খারাপ লাগে।কথা বলাটা বন্ধ করতে পারলেও চোখের দৃষ্টিটাকে কিছুকেই আটকানো যাচ্ছে না।ঘুরে ফিরে সেই রোশনির দিকে গিয়েই থামছে।রোশনিকে বুঝতে না দিয়ে সে তাকেই পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিটা সময়।অধিরের খারাপ লাগছে কথা বলতে না পেরে।তবুও সে নিজে থেকে আজ কথা বলবে না।সে দেখতে চাই রোশনি তার মান ভাঙাতে আসে কি না।অধির নিজের মনেই দির্ঘশ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরালো।সাথে সাথেই চোখ মুখ কুচকে গেলো তার।গাছের আড়াল থেকে হাতে বন্ধুক তাক করে রাখা একটা হাত দেখা যাচ্ছে।যেটা রোশনির দিকেই তাক করা।অধিরের বুক কেপে উঠলো।চিৎকার করে রোশনিকে ডাকতে গিয়েও কথা আটতে আসতে লাগলো। অধির রোশনির দিকে দৌড়ে আসতে আসতেই জোরে চিৎকার করে রোশনিকে সরতে বললো।কিন্তু রোশনি সরলো না।অধিরের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো।অধির দৌড়ে এসে রোশনিকে নিয়েই মাটিতে পড়লো।সবার দৃষ্টি তখন ওদের দিকে।রোশনি ভয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছে।অধির ক্লান্ত চোখে রোশনির ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকালো।অধিরের এক হাত রোশনির মাথার নিচে। যাতে পড়ে গিয়ে রোশনির মাথায় অাঘাত না লাগে।অধির রোশনিকে টেনে তুলে দাড় করিয়ে চিৎকার করে শাহিনকে ডাকলো।অধিরের ডান হাতের বাহু থেকে রক্ত পড়ছে।অধির এক হাতে চেপে ধরে রেখেছে।এতোক্ষনে সবার নজর গেলো অধিরের হাতে দিকে।সাথে সাথেই ছুটে এলো সাহিল আদি সহ সবাই।সবার চোখে মুখেই ভয়ের ছাপ।কেউই বুঝতে পারছে না হঠাৎ রক্ত কোথা থেকে এলো।রোশনি আগের মতোই শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে।অজানা ভয়ে তার বুক কাপছে।আদি আর সাহিল ছুটে এসে অধিরের দুপাশে দাড়িয়ে অধিরের হাতের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল,

-অধির তোর হাতে রক্ত কিভাবে এলো?

অধির জবাব দিলো না।চিৎকার করে আরো একবার শাহিনকে ডেকে উঠলো।শাহিন এসে দাড়াতেই চোয়াল শক্ত করে বললো অধির,

-ওদিকটাই কেউ আছে।বাড়ি থেকে যেন বের হতে না পারে।ইমিডিয়েট ওকে ধরো।কিছুতেই যেন পালাতে না পারে।

-ইয়েস স্যার।

_____________________

বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে অধির।ডান হাত আর বাম হাতের বাহুতে ব্যান্ডেজ করা।রুমে উপস্থিত সবার চোখে মুখে এখনো ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।অধিরের ডানহাতটা মুঠোই নিয়ে সমানে কেদে চলেছেন মিসেস ঝুমা চৌধুরি ।

-মম আর কত কাঁদবে? প্লিজ এবার চুপ হয়ে যাও।আমি ঠিক আছি।

ঝুমা চৌধুরির কান্নার গতি আরো খানিকটা বাড়লো।চাপা রাগ দেখিয়ে বললো,

-ঠিক আছি মানে কি? তুই বুঝতে পারছিস আর একটু হলে কি হতো? কি দরকার ছিলো এমন করার? যদি কিছু হয়ে যেত তখন আমার কি হতো ভেবে দেখেছিস?

অধির আড় চোখে রোশনির দিকে তাকালো।রোশনি দরজার এক কোনায় গুটিশুটি মেরে মুখ নিচু করে দাড়িয়ে আছে।

-ওই মেয়েটার কিছু হয়ে গেলেও যে তোমার ছেলে বাঁচত না মম।কি করতাম বলো?

অধিরের কথায় টলমলে চোখ তুলে তাকালো রোশনি।বুক ফেটে কান্না আসছে তার।ঝুমা চৌধুরি চোখ মুখ শক্ত করে রোশনির দিকে একপলক তাকিয়ে অধিরের দিকে তাকালো।চাপা রাগ দেখিয়ে বললো,

-দুদিনের পরিচয়ের ওই মেয়ের জন্যে তুই তোর জিবন রিস্কে ফেলবি? ওই মেয়েটাই তোর কাছে সব? আমি তোর কিছুই না? আমার কথাটা একবার ভাবলি না?তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচতাম চিন্তা করেছিস?

কথাগুলো বলতে বলতেই কেদে উঠলেন উনি।অধির মাকে কিছুটা শান্ত করে নাতাশাকে ইশারা করতেই নাতাশা ওনাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।অধির এবার সাহিলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

-দাদি কেমন আছে?

-ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। ঘুমোচ্ছে এখন।ডক্টর বলেছেন চিন্তার কিছু নেই।টেনশনে প্রেসার ফল করেছে।রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষন নিরব থেকে আবারো মুখ খুললো সাহিল।

-কিন্তু গুলিটা করলো কে?শুট করার আওয়াজও তো পেলাম না।আর সবচেয়ে বড় কথা রোশনিকে কে মারতে চাই?

মুহূর্তেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো অধিরের।চোয়াল শক্ত করে বললো,

-রিভলবারে মে বি সাইলেন্সার লাগানো ছিলো।তবে সে যেই হোক জিন্দা বাচবে না।ও জানে না ও কি করতে চেয়েছিল।অধির চৌধুরির কলিজার দিকে হাত বাড়িয়েছে।এর শাস্তি কি হতে পারে সেটা এবার বুঝবে ও।লোকটাকে পাওয়া গেছে?

-এখনো অবধি পাওয়া যায় নি।তবে চিন্তা করিস না।খুব তাড়াতাড়ি খুজে বের করব ওকে।

-আদি কোথায়? ওকে দেখছিনা।

-আমিও তো অনেকক্ষণ ধরে দেখছি না।

___________

দেয়ালে হেলান দিয়ে হাটুতে মুখ গুজে মাঝে মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠছে আদি। পিয়া এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো।হঠাৎ কারো ফুঁপানোর আওয়াজ শুনে থমকে দাড়ালো।ভ্রু কুচকে আশে পাশে তাকাতেই দেখলো আবছা অন্ধকারে হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে কেউ।পিয়ার চিনতে দেরি হলো না মানুষটাকে।গুটি গুটি পায়ে আদির পাশে গিয়ে বসতেই মুখ তুলে তাকালো আদি।পিয়াকে দেখেই ঝাপিয়ে পড়লো তার উপর।দুহাতে পিয়াকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত করে কাদতে শুরু করলো।কয়েক সেকেন্ড থম মেরে বসে থেকে দির্ঘশ্বাস ফেললো পিয়া।আদির পিঠে হাত রেখে বলে উঠলো,

-এভাবে কাদছো কেন? কিছু হবে না ওনার।দু এক দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে দেখো।

আদি কাদতে কাদতেই বললো,

-সত্যিই ঠিক হয়ে যাবে তো?

-হ্যা বাবা ঠিক হয়ে যাবে।এবার কান্না থামাও।

-জানো আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম? ভাইয়ার কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যেতাম।তুমি জানো ছোট থেকে ভাইয়া আমাকে কতবার বাঁচিয়েছে? আমার যেকোনো দোষ ভাইয়া নিজের কাধে নিয়ে নেয়।একবার তো….

আদি পিয়াকে ছেড়ে পা ভাজ করে বসে নিজের মত করেই বকবক করতে লাগলো।পিয়া নিজের মনেই হাসলো।ছেলেটা আসলেই বাচ্চা।কেমন বাচ্চাদের মত নাক টেনে টেনে কান্না করছে আর কথা বলছে।পিয়া এবার খুব মনোযোগ দিয়ে আদির কথা গুলো শুনতে লাগলো।

সাহিল রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রোশনির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে চোখ বুজলো অধির।রোশনি গুটি গুটি পায়ে অধিরের পাশে বসে তাকিয়ে রইলো অধিরের ক্লান্ত মুখের দিকে।অধির আগের মতোই চোখ বুজে বালিশে হেলান দিয়ে আছে।রোশনি বুঝতে পারছে অধির এখনো তার উপর রেগে আছে।তাই তো একটা বার তার দিকে তাকিয়েও দেখছে না।রোশনি ফুপিয়ে কেদে উঠতেই চট করে চোখ খুলে তাকালো অধির।রোশনিকে কাদতে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলো ভেতরটা।বুকের ভেতর কোথাও একটা ব্যথা অনুভূত হলো।তবুও নিজেকে শক্ত রেখে বলে উঠলো,

-কাঁদছো কেন?এখনো বেঁচে আছি মরে যাই নি।সো তোমার মুক্তি পাওয়ারও চান্স নেই।কান্না বন্ধ করো।

অধিরের কথা শেষ হতেই করুন চোখে তাকালো রোশনি।চোখ থেকে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ছে অনবরত।রোশনি চোখ নামিয়ে আবারো কাঁদতে লাগলো।অধির দির্ঘশ্বাস ফেলে রোশনিকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিতেই দুহাতে আকড়ে ধরলো রোশনি।অধিরের বুকে মুখ গুজে ভেঙে পড়লো কান্নায়।অধির আটকালো না।দুহাতে শক্ত করে বুকের সাথে ধরে রাখলো শুধু। বেশ কিছুক্ষন পরেও যখন রোশনির কান্না বন্ধ হলো না তখন ধমকে উঠলো অধির।

-এই মেয়ে সমস্যা কি? আর কত কাঁদবে?কিছু বলছি না দেখে থামার নামই নিচ্ছো না?আর একবার কাঁদলে ঠাটিয়ে একটা দিবো কানের নিচে।একদম কাদবে না।

অধিরের ধমকানি খুব একটা কাজে লাগলো বলে মনে হলো না।রোশনির কান্না থামলো না।অধির দির্ঘশ্বাস ফেলে রোশনির মাথায় হাত রাখলো।আদুরে গলায় বললো,

-প্লিজ সুইটহার্ট কান্না থামাও।আমার কষ্ট হচ্ছে।আমি ঠিক আছি তো বাবা। এটুকুতেই এতো কান্নার মানে হয়? শান্ত হও।

রোশনির কান্নার গতি এবার কিছুটা কমলো।তবুও মাঝে মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠছে।অধিরের বুকে মাথা রেখেই ধরে আসা গলায় বলে উঠলো রোশনি,

-আপনার কাছে এটুকু মনে হচ্ছে? গুলিটা হাত ঘেষে বেরিয়ে গেছে।যদি এর থেকেও ভয়াবহ কিছু হত তখন? কি দরকার ছিলো এতোটা রিস্ক নেওয়ার?আপনি জানেন আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম।যদি আপনার কিছু হয়ে যেত?

-কি আর হত? মরে যেতাম।তুমি মুক্তি পেয়ে যেতে এই খারাপ মানুষটার থেকে।ভালোই তো হতো।কিন্তু তোমার কপাল খারাপ তাই এবারের মত বেঁচে গেলাম।

অধিরের কথা শেষ হতেই বুকে দুচারটে কিল ঘুষি পড়লো।অধির হাসলো।রোশনিকে আরো একটু শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিতেই অধিরের বুকে মুখ ঘষলো রোশনি।অধিরের এখন ভাল লাগছে।হাহাকার করা বুকটা এখন অনকটাই শীতল লাগছে।

-আপনি আজ সারা দিন আমাকে ইগনোর করেছেন।আমার সাথে একটা কথাও বলেন নি।রাতের জন্যে আপনি আমার উপর এখনো রেগে আছেন তাই না?

-তোমার উপর কখনোই রেগে থাকতে পারি না সুইটহার্ট। তবে তোমারও বোঝা উচিত আমারও কষ্ট হয়।আমারও অভিমান হয়। আমার ভালবাসাটা মিথ্যে নয় সুইটহার্ট। আমি আবারো বলছি প্লিজ আমাকে ভালবাসতে না পারো অন্তত আমার ভালবাসাকে অপমান করো না।বিশ্বাস করো আমার ভিষন কষ্ট হয়।

-সরি

-কেন?

-রাতে আপনাকে কতো গুলো বাজে কথা বললাম সে জন্য।

-জিবনে কখনো এমন কোনো কাজ করো না সুইটহার্ট যাতে সেই কাজের জন্যে তোমাকে সরি বলতে হয়।সরি শব্দটাতে আমার ভিষন রকমের এলার্জি।সহ্য হয় না খুব একটা।

রোশনি আর কিছু বললো না।চুপ করে অধিরের বুকের সাথে মিশে রইলো।অধিরও আবেশে চোখ বুজলো।হঠাৎ কারো গলা খাঁকারিতে চোখ মেলে তাকালো দুজনে।দরজায় জয়কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ছিটকে সরে এলো রোশনি।

-আমি আপনার জন্যে খাবার নিয়ে আসছি।

রোশনি আর দাড়ালো না।রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজায় দাড়িয়েই বলে উঠলো জয়,

-ভেতরে আসবো?

-ইয়া অফকোর্স।

জয় ভেতরে আসতেই জয়কে বসতে বললো অধির।কিছুক্ষন দুজনেই চুপ থেকে নিরবতা ভেঙে মুখ খুললো জয়,

-এখন কেমন ফিল করছেন স্যার?

– মোটামুটি ভাল ।

এর পর আর কি বলা যায় ভেবে পেলো না জয়।অধিরও নিজে থেকে কথা বাড়ালো না।কিছুক্ষন নিশ্চুপ দুজনে বসে থেকে জয় বললো,

-আমি তাহলে আসি স্যার।

জয় উঠে চলে আসতে নিয়েও থেমে গেলো।অধিরের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,

-একটা কথা রাখবেন স্যার?

-হ্যা বলো।

-রোশনির চোখ থেকে কখনো পানি ঝরতে দিবেন না প্লিজ।আমি চাই ও সুখে থাকুক।

অধির বিষ্মিত চোখে তাকালো।আজ প্রথম বার জয়ের প্রতি তার মায়া লাগছে।ছেলেটাকে সে বড্ড বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।জয় আর দাড়ালো না।রুম থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো।জয় চলে যেতেই দির্ঘশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা এলিয়ে দিলো অধির।সে জানে সে যা করেছে ভুল করেছে।কিন্তু তারই বা কি করার ছিল? রোশনিকে কি করে ছেড়ে দিত? মেয়েটা যে তার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছিলো। এতো সহজে কি অভ্যাস ছাড়া যায়?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here