#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ৪৬
🌼
দুপুরের ঝাঁঁঝালো রোদে কংক্রিটের ব্যস্ত শহর যখন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে,, তখনই কলিং বেলের বিরস আওয়াজে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে এল জয়ের।ভর দুপুরে কে আসল সেটা নিয়ে বিশেষ ভাবে ভাবনা চিন্তা করতেও বড্ড বিরক্ত লাগছে।তবে দরজার ওপাশের ব্যক্তিটির বোধ হয় ধৈর্যশক্তি অনেক বেশি প্রখর।অন্তত তার কলিং বেল চাপার উদ্যোম দেখে সেটাই মনে হচ্ছে জয়ের।মাত্রই ঠান্ডা পানিতে শাওয়ার নিয়েছে সে।তবুও কলিং বেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে মাথাটা ক্রমেই গরম হয়ে যাচ্ছে।না… দরজার ওপাশের ব্যক্তি বোধ হয় প্রতিজ্ঞা করে বসেছে যে,,,দরজা না খোলা অবধি সে কিছুতেই থামবে না।স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে এটুকু অধিকার তার নিশ্চয় আছে।জয় ছোট্ট শ্বাস টেনে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।সুনিপুণ হাতে দরজা খুলে দিতেই সামনের মানুষটা চোখ বড় বড় করে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে।জয় বিরক্ত হলো।সকাল থেকেই তার অকারনে মেজাজ খারাপ হচ্ছে।খুব সামান্য বিষয়েও রেগে যাচ্ছে।শাওয়ারের নিচে এক ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে মাথা ঠান্ডা করার পরেও এখন মনে হচ্ছে ঠান্ডা ভাবটা বেশিক্ষন হয়ত থাকবে না।সামনের আগুন্তককে এমন লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল জয়।তবে সেটাকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বিরস মুখ করে বলে উঠল,
-তুমি? আবারো এসেছো?
সামনে দাড়ানো আগুন্তক লোভাতুর দৃষ্টি সরিয়ে বিরক্ত চোখে তাকালো।প্রতিবাদের সুর তুলে বলে উঠল,
-আবার মানে কি হ্যা? আমি কি আপনার বাসায় রোজ রোজ আসি যে আপনি এভাবে বলছেন?
জয় কিছুটা বিড়বিড় করে বলে উঠল,
-না না,,,,রোজ রোজ কোথায় আসেন।সপ্তাহে তিন দিন আসাকে কি আর রোজ রোজ বলা চলে?
সামনে দাড়ানো মানুষটা ভ্রু কুচকে তাকালো।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল,
-আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?
জয় দাত এঁটে হেসে বলে উঠল,
-না না,,,, আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে আপনার নামে কিছু বলবো।আমি তো নিজেকে বলছিলাম।
-আচ্ছা? তো ভেতরে ঢুকতে দিবেন নাকি দরজা আটকে এভাবেই দাড়িয়ে থাকবেন?
জয় আবারো বিড়বিড় করে উঠল।
-আটকাতে চাইলেও কি আটকাতে পারবো?
রিয়া সন্দিহান চোখে তাকিয়ে কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই জয় বলে বসল,
-আজ কি জন্যে এসেছো?
রিয়া কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,
-আন্টির সাথে দেখা করতে এসেছি।সরুন ভেতরে যেতে দিন।
জয় চট করে বলে উঠল,
-আম্মু বাসায় নেই।
-নেই মানে? কোথায় গেছে?
-গ্রামের বাড়ি।
জয়ের কথা শুনে মনের ভেতর বাক বাকুম করে উঠল রিয়ার।অদ্ভুদ অনুভূতি ছুয়ে দিল সারা শরির।রিয়া নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল,
-ওয়াও!!তারমানে বাসায় শুধু বজ্জাতটা আর আমি।অসভস্যটাকে ইচ্ছেমত জ্বালানো যাবে।কি যে ভাল্গাচ্ছে।ইয়াহু…
রিয়াকে মিটিমিটি হাসতে দেখে শিড় দাড়া সোজা করে দাড়ালো জয়।হালকা কুচকানো ভ্রু নিয়ে প্রশ্ন করল,
-কি ভেবে হাসছো?আচ্ছা থাক বলতে হবে না।শুনার মুড নেই।যাই হোক এবার তুমি আসতে পারো।
মুহূর্তেই চোখ মুখ কুচকে তাকালো রিয়া।নাক ছিটকে বলে উঠল,
-আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন? ছিঃ….।আপনার মধ্যে তো দেখি মানবতা বলে কোনো বস্তুই নেই।একেতো দরজার সামনে অর্ধউলঙ্গ হয়ে দাড়িয়ে আছেন। তারউপর অতিথিকে ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে তাকে চলে যেতে বলছেন? আপনার মত নির্দয় মানুষ জিবনে দেখিনি।
জয় সরু চোখে তাকাল।ভেতরে লুকায়িত মানব সত্তা হঠাৎই প্রশ্ন করে বসল,,,সে কি সত্যিই নির্দয়?সচেতন মষ্তিষ্ক প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল,,,হ্যা অবশ্যই তুমি নির্দয়।কোনো নরম মনের মানুষের পক্ষে সামনে দাড়ানো পুতুলের মত পিচ্চি মেয়েটাকে তাড়িয়ে দেওয়া কিছুতেই সম্ভব না।….জয় এবার প্রতিবাদ করে উঠল।বলল,,,আমি ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছি না।শুধু চলে যেতে বলছি।তাড়িয়ে দেওয়া এবং চলে যেতে বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য।……জয়ের ভাবনার মাঝেই তাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে ভেতরে চলে এল রিয়া।ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল জয়ের।বিষয়টা বোধগম্য হতেই ভ্রু কুচকে তাকাল সে।তবে রিয়ার তাতে কিছু যায় আসছে বলে মনে হচ্ছে না।চিচিকে টেবিলের উপর রেখে কাধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ধপ করে বসে পড়লো সোফায়।সোফায় গা এলিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা আদেশের সুরে বলল,
-ফ্যানের স্পীডটা একটু বাড়িয়ে দিন তো।বড্ড গরম পড়েছে।আপনাদের এখানে এলিভেটরটাও তো নষ্ট দেখলাম।পুরো সাত তলা সিঁড়ি বেয়ে এসেছি। এই ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে কি আর আসা যায়!!পা দুটো আরো কিছুটা বড় হওয়া দরকার ছিল।
জয় অবাক হল না।আজকাল এই মেয়ের কোনো কথাতেই অবাক হয় না সে।ও বুঝে গেছে এই মেয়ে ভিন গ্রহের প্রানী।সো তারা নরমাল মানুষের থেকে আলাদা হবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।জয় দরজাটা বন্ধ করে ফানের স্পীড বাড়িয়ে দিল।আসলেই কদিন ধরে বেশ গরম পড়ছে।তীব্র দাবদাহে যেন পুড়ে যাচ্ছে শহর।জয় কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে এসে চেন্জ্ঞ করে নিলো।ফোনে কারো কল আসায় ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেল।বেশ কিছুক্ষন পর রিয়া যখন চোখ খুললো তখন সামনে জয়কে দেখতে পেল না।রিয়া দুষ্টু হেসে পা বাড়ালো জয়ের রুমের দিকে।রুমটা আগের মতোই অগোছালো।এখানে ওখানে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে জিনিস পত্র।রিয়া নাক ছিটকালো।বরাবরই সে ভিষন গুছালো মেয়ে।এই গুছানো স্বভাবটা মূলত অধিরের থেকেই শিখেছে সে।অধির যে ভিষন পরিমানে গোছালো সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।রিয়া ঘুরে ঘুরে সবটা দেখতেই সোফার দিকে নজর গেল তার।একটু আগে যে সাদা রঙের তোয়ালেটা জয়ের কাধে ঝুলানো ছিল সেটাই এখন সোফার উপর বিশ্রী ভাবে পড়ে আছে।বিছানার অবস্থাও খুব একটা শোভনীয় নয়।রিয়া কিছুক্ষন কটমট করে বিছানা গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।এরপর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্যান্ট,শার্ট আর গেন্জি গুলো তুলে সুন্দর করে ভাজ করে আলমারিতে রাখল।রুমের এক কোনায় অবস্থিত টেবিলটার দিকে নজর যেতেই মেজাজ খিচে গেল রিয়ার।টেবিলের অবস্থা দেখে বমি পাচ্ছে তার।একটা মানুষের রুম এতোটা অগোছালো কি করে থাকতে পারে?রিয়া জয়কে কিছু কঠিন গালি দিতে দিতে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বইগুলো গুছিয়ে ঠিক ঠিক জায়গায় রাখতে গিয়ে একটা কালো রঙের ডায়েরি চোখে পড়ল।ডায়েরিটা তুলে নিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতেই ভ্রু কুচকে এলো রিয়ার।ডায়েরীর উপরের লেখাটাই হঠাৎই চোখ আটকে গেল ।ডায়েরীর উপরে গুটি গুটি অক্ষরে,, ,,””মায়াবিনী”” লেখাটার উপর হাত বুলাতেই মনের ভেতর আঁতকে উঠল ।কিশোরি মনটা মুহূর্তেই ফুঁপিয়ে উঠল প্রখর এক বেদনায়।মনের ভেতর উঁতলে ওঠা সুপ্ত অনুভূতি গুলো হাহাকার করে উঠলো।রিয়া নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল,,,””তাহলে কি ওনার মনে সত্যিই অন্য কারো বসবাস? উনি কি তাকে ভিষন ভালবাসেন?যেমনটা আমি বেসে ফেলেছি ওনাকে।””””””রিয়ার ভাবনার মাঝেই হাত থেকে কেউ একজন দ্রুত গতিতে ছিনিয়ে নিল ডায়েরিটা।রিয়া চোখ তুলে তাকালো।জয়কে অপ্রস্তুত দাড়িয়ে থাকতে দেখে চট করে সামলে নিল নিজেকে।কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ভাব নিয়ে বলে উঠল,
-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?আমি কারো পার্সোনাল ডায়েরি পড়ি না।ব্যস আমি শুধু দেখছিলাম।
জয় স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।রিয়ার হাতে ডায়েরিটা দেখে ভয় পেয়ে গেছিলো সে।তার এই গুপ্ত অনুভূতির কথা সে কাউকে জানাতে চাই না।খুব যতনে নিজের ভেতরই লুকিয়ে রাখতে চাই।জয় ডায়েরিটাকে ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বলে উঠল,
-কি করছো আমার রুমে?
বাকি বইগুলো গোছাতে গোছাতেই বলে উঠল রিয়া,
-এটাকে রুম বলে নাকি!!!!!মানুষের রুম এমন অগোছালো হয় সেটা আপনার রুম না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না।রুমের এমন বিদঘুটে চেহারা দেখলে আপনাকে বন মানুষ ভেবে চিড়িয়াখানার লোক এসে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।আপনাকে যাতে চিড়িয়াখানায় যেতে না হয় সেই ব্যবস্থায় করছি।রুমটাকে মানুষের থাকার উপযোগী করার হালকা চেষ্টা চালাচ্ছি।
জয় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল রিয়ার দিকে।রিয়ার অনেক কথায়ই রোশনির কথার সাথে মিলে যায়।জয় খুব বেশি গোছালো কোনো দিনই ছিল না।তার রুমের এমন বিদঘুটে অবস্থা দেখে এভাবেই নাক ছিটকাতো রোশনি।এরপর তার গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে নিজ হাতে রুম গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত।পুরোনো কথা মনে হতেই ভেতর থেকে দির্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল জয়ের।রিয়া সোফার উপর থেকে ভেজা তোয়ালেটা তুলে নিতে নিতে বলল,
-আপনার কি মনে হয় না,,,,যেখানে যে জিনিস থাকা দরকার সেখানে সে জিনিসটাই রাখা উচিত?ভেজা টাওয়েল এর জায়গা বেলকোনিতে। সো সোফা বা অন্য কোথাও ছুঁড়ে ফেলাটা আইন বিরোধী।
——
শেষ বিকেলের আদর মেখে মুখ লুকাতে ব্যস্ত তপ্ত সূর্য।গোধূলি লগ্ন।উত্তপ্ত সূর্যের তেজ অনেকটাই মিইয়ে এসেছে।সারাদিনের ভ্যাপসা গরম ছাপিয়ে মৃদু মন্দ বাতাসের আগমন।পাখিরা নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত।রোশনির মন ভাল নেই।আজকাল অধিরের উপর ভিষন অভিমান হয় তার।কারনে অকারনে কান্না পায়।অধিরের আশেপাশে কোনো মেয়েকে দেখলে শরির জ্বালা করে ওঠে।এমন হওয়ার কারন জানা নেই রোশনির।তবে এটুকু জানে,,,, অধিরের সাথে অন্য কাউকে সে সহ্য করতে পারছে না।কিন্তু কেন?জানা নেই তার।পশ্চিমে হেলে পড়া রক্তিম সূর্যের দিকে তাকিয়ে দির্ঘশ্বাস ছাড়ল রোশনি।দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে পড়তেই মনতা শীতল অভিমানে ভার হয়ে এল।
দুপুরের খাঁখা রোদে পৃথিবী যখন পুড়তে ব্যস্ত তখনই নূপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে সামনে এল ময়না নামের মেয়েটা।অধির আর রোশনি তখন বাড়ির পেছনে শান বাঁধানো পুকুরের ধারে বসে ছিল।মাথার উপরে মস্ত বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছের জন্যে রোদের তাপ খুব একটা পড়ছে না তাদের উপর।আশেপাশে প্রচুর গাছ থাকায় গরমটাও খুব একটা অনুভব করা যাচ্ছে না।রোশনির ভাল লাগছে এভাবে বসে থাকতে।পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে দৃষ্টি রেখেও অনায়েসে অনুভব করতে পারছে একজোড়া পুরুষালী চোখ তার দিকেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।লজ্জায় শরিরে কাটা দিলেও খিঁচে বসে আছে সে।ভাল লাগছে তার।ভেতরের নারী মনটাও যেন খুব করে চাইছে সে তাকাক।গভির ভাবে তাকিয়ে একটু করে ছুঁয়ে দিক।লজ্জায় যখন নুইয়ে যাবো খুব যতনে আবদ্ধ করুক প্রশস্ত ওই বুকে।নারী সত্তার সেই স্বপ্নকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতেই ময়নার আগমন হল।চোখে মুখে কিশোরি সুলভ লজ্জা ফুটিয়ে বলে উঠল,
-এই দুপুর বেলাতে এখানে বসে আছেন কেন অধিরদা?গরমে আপনার নাক মুখ কেমন লাল হয়ে গেছে।
ময়নার কথায় ভেতরটা রাগে রিরি করে উঠল রোশনির।কিন্তু প্রকাশ করল না।অধির আড় চোখে রোশনির রাগান্বিত মুখটা একবার দেখে নিয়ে শব্দহীন হাসল।বলল,
-লজ্জা রাগা চাঁদকে উত্তপ্ত সূর্য হতে দেখছি ময়না রানি।আর উত্তপ্ত সূর্যের তেজে একটু আধটু লাল হয়ে যেতে আপত্তি নেই।
অধিরের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না ময়না।কিছুক্ষন কথাগুলোকে মাথার মধ্যে আওড়াতেই আবারো ঘেটে গেল। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ময়না,
-আপনি দিনের বেলায় চাঁদ কোথায় পেলেন অধিরদা? আর চাঁদ আবার সূর্য হয় কিভাবে?আগে তো এমনটা শুনি নি।
আড় চোখে রোশনির ফুলে ওঠা মুখটা দেখে নিয়ে আবারো শব্দহীন হেসে বলে উঠল অধির,
-এই চাঁদটা সবার নয়।এটা শুধু মাত্র আমার ব্যক্তিগত চাঁদ।নিজস্ব চাঁদ।এই চাঁদকে দেখার অধিকার কারো নেই।জানিস ময়নারানি…?এই চাঁদটা না ভিষন অদ্ভুদ। কখনো লজ্জায় নিজেকে রাঙিয়ে আমাকে এলোমেলো করে দেয়।তো কখনো তপ্ত তেজে জ্বালিয়ে দেয়।তার যতো তেজ,, যত রুক্ষতা সবকিছু আমাকে ঘিরেই।তবে আজকাল হঠাৎ হঠাৎই ভিষন রেগে যাচ্ছে চাঁদটা।নরম জ্যোৎস্না না দিয়ে তপ্ত রোদে পুড়িয়ে দিচ্ছে।চাঁদ বোধ হয় রেগে আছে আমার উপর।এজন্যই এতো তেজ।কি করে তার তেজ কমিয়ে জ্যোৎস্না আনি বলতো?
-জ্যোৎস্না কিভাবে আনবে সেটা তো বলতে পারছি তবে তোমার জন্যে পেয়ারা নিশ্চয় আনতে পারি।
অধির ভ্রু কুচকে তাকাতেই হাত তুলে পেয়ারা গাছ দেখালো ময়না।অসংখ্য পেয়ারা ঝুলছে পাতার আড়ালে।অধির কিছু বলবে তার আগেই পেয়ারা গাছের ডালে চড়ে বসল ময়না।গাছটার খুব নিচ থেকে ডাল পালা থাকায় কোনো বেগ ছাড়ায় খুব সহজে গাছে উঠা যায়।ময়না টপাটপ কয়েকটা পেয়ারা ছিঁড়ে অধিরের দিকে ছুঁড়ে মারতেই হাত মুঠো করে ক্যাচ করে নিলো।গাছটা বেশ লম্বা।রোশনি আগের জায়গাতেই বসে আছে।ওদের এসব আদিখ্যেতা দেখতে ইচ্ছে করঝছে না তার।অধির ময়নাকে নেমে আসতে বলে।ময়না গাছ থেকে নামতে গিয়ে পা পিচলে পড়ে যেতে নিলেই দ্রুত গতিতে ময়নাকে ধরে নেয় অধির।অধিরের কোলে ময়নাকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে রোশনি।দুহাতে ওড়না মুচড়াতে থাকে ক্রমাগত।অধির ময়নাকে কোল থেকে নামাতে নামাতে বলে ওঠে,
-সাবধানে নামবি না? আরেকটু হলেই তো অঘটন ঘটত।
ময়না অধিরের কথার উত্তর না দিয়ে চোখ নামিয়ে বলে,
-আমি বরং যাই অধিরদা।পেয়েরা গুলো কেটে নিই।আপনারা আসুন।
ময়না একটুও দেরি না করে লজ্জা রাঙা মুখ নিয়ে দৌড় দিল বাড়ির দিকে।ময়না চলে যেতেই অধির রোশনির দিকে ফিরে দাড়ালো।রোশনির টকটকে লাল মুখ দেখে খানিক ঘাবড়ে গেল অধির।রোদের কারনে এমন লাল দেখাচ্ছে নাকি অন্য কোনো কারন? খুজে পেল না অধির।অধির কিছু বলার আগেই তেড়ে এল রোশনি।তেজ দেখিয়ে বলল,
-আপনি যে ভিষন রকমের অসভ্য সেটা কি আপনি জানেন?
অধির ভ্রু কুচকে তাকালো।বলল,
-মানে?
-মানে বুঝেন না? খুব তো বলে বেড়ান অধির চৌধুরি মেয়েদের পিছে ঘুরে না।মেয়েরাই আমার পিছনে ঘুরে।এখনই তো নমুনা পেলাম কে কার পিছে ঘুরে।অসভ্য লোক একটা।
-আরে বাপ অসভ্যতামি কোথায় পেলে? কার সাথে অসভ্যতামি করলাম?কিছুই তো বুঝতেছি না।
-এখনো বুঝতেছেন না কি অসভ্যতামি করলেন? মেয়েদের কোলে নেওয়ার ভিষন শখ তাই না? আদির কথায় তাহলে ঠিক?এখন আমি একদম নিশ্চিত আপনার আর ময়নার মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে।আদির কথা তখন আমার বিশ্বাস হয় নাই।কিন্তু এখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেছি।আপনার নামে আমি থানায় ডিজি করবো।প্রেম করেছেন একজনের সাথে,,, এংগেজমেন্ট অন্য জনের সাথে আবার বিয়ে করেছেন অন্যজনকে? এই আপনার কয়টা লাগে হ্যা? অসভ্য লোক।
রোশনির কথায় বাকরুদ্ধ হওয়ার অবস্থা।কি বলছে মেয়েটা।অধির চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-ওয়েট ওয়েট।অাদি কি বলেছে তোমায়? আমার আর ময়নার মাঝে রিলেশন ছিল এটা বলেছে ও?
রোশনি চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,
-আদি কি বলল না বলল সেটা বড় কথা নয়।আসল কথা হল আপনি একটা অসভ্য।মেয়েদের কোলে নেওয়ার জন্যে সব সময় রেডি হয়েই থাকেন।অসভ্য লোক কোথাকার।
অধির সুন্দর করে হাসল।বলল,
-উফফ সুইটহার্ট ওটা মেয়েদের হবে না।শুধু মেয়ে হবে।আমি শুধু তোমাকে কোলে নিতে চাই।
-একদম মিথ্যে বলবেন না।তাহলে ওই মেয়েকে কেন কোলে নিলেন? বলুন।
-ওকে তো আমি ইচ্ছে করে নিই নাই বাপ।গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছিল সেসময় না ধরলে এতোক্ষনে হাত পা ভেঙে বসে থাকতো মেয়েটা।
-ভেঙে গেলে যেত।আপনি কেন ধরবেন?সত্যি করে বলুন তো,,,আপনাদের মধ্যে সত্যিই কোনো সম্পর্ক নেই তো?
-কি বলছো এই সব সুইটহার্ট? তেমন কিছুই…
অধিরের কথার মাঝেই ফোন বেজে উঠল।অধির পকেট থেকে মোবাইল বের করে সামনে ধরতেই ফোনের স্ক্রীনে দিদামের নামট জ্বলজ্বল করে উঠল।রোশনির মেজাজ খিঁচে গেল মুহূর্তেই। সুন্দর স্বামী থাকা আসলেই প্যারা।অধির ফোন রিসিভ করতে যাবে তার আগেই দ্রুত গতিতে ফোনটা ছিনিয়ে নিল রোশনি।অধিরের কিছু বলার আগেই ছুঁড়ে ফেলল ফোনটা।দুর্ভাগ্যবশত ফোনটা গিয়ে পড়ল পুকুরের টলটলে পানিতে।অধির ভ্রু কুচকে তাকালো।রোশনির মাঝে কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।মেয়েটাকে কি ভূতে টূতে ধরল? নয়ত এমন অদ্ভুদ বিহেবের মানে কি? অধির কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে যাবে তার আগেই দূর থেকে আদি চেঁচিয়ে ডেকে উঠল,
-ভাইয়া,,,,ময়না পেয়ারা কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে।ব্লেডিং হচ্ছে।তাড়াতাড়ি আসো।
কথাটা শেষ হতেই আদিকে আর পাওয়া গেল না।অধির রোশনির দিকে তাকাতেই রোশনি শক্ত গলায় বলে উঠল,
-আপনি যাবেন না।
অধির ভ্রু কুচকে তাকাল।রোশনির গমগমে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-মানে?
রোশনি আগের মতোই বলে উঠল,
-মানে আপনি যাবেন না।
অধির হতাশ চোখে তাকালো।ছোট্ট শ্বাস টেনে বলল,
-এমন অদ্ভুদ বিহেব কেন করছো সুইটহার্ট? মেয়েটার ব্লেডিং হচ্ছে।ব্লেডিং বন্ধ না হলে সমস্যা হয়ে যাবে।
-হলে হউক।আদি তো আছেই ওখানে।আপনাকে কেন যেতে হবে? কোথাও যাবেন না আপনি।
-প্লিজ সুইটহার্ট,,,, আমি বুঝতে পারছি তুমি ওকে পছন্দ করতে পারছো না।বিলিভ মি সুইটহার্ট,,, মেয়েটা ভিষন ভালো।তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা একে বারেই নয়।দেরি হওয়ার আগে প্লিজ যায়?
-ঠিক আছে যান।
অধির শব্দহীন হেসে বলে উঠল,
-আমি জানতাম তুমি বুঝবে।থ্যাংক ইউ সুইটহার্ট।
অধির পেছনে ঘুরে কয়েক পা যেতেই ঝপাং করে শব্দ হল।অধির সাথে সাথে পেছনে ফিরে তাকালো।রোশনিকে পুকুরের পানিতে হাবুডুবু খেতে দেখে কলিজা কেঁপে উঠল তার।কোনো কিছু না ভেবেই এক প্রকার দৌড়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে রোশনিকে দুহাতে আকড়ে ধরল নিজের সাথে।রোশনিকে বুকের সাথে চেপে ধরতেই অধিরের গলা জড়িয়ে ধরল রোশনি।খুকখুক করে কাশতে কাশতেই মুচকি হাসল। অধিরের বুক ধরফর করছে।অধির চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,
-এসবের মানে কি রোশনি? তুমি জানো কতোটা ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি?এমন বাচ্চাদের মত বিহেভিয়ার এর মানে কি?তুমি সাতার পারোনা তার পরেও কেন পানিতে ঝাঁপ দিয়েছো?কানের নিচে দুইটা দিলে সব বাচ্চামো পালিয়ে যাবে।সব সময় আমাকে টেনশনে না রাখলে তোমার শান্তি লাগে না। তাইনা?
অধিরের রাগ মিশ্রিত কথাগুলো শুনেও মুচকি হাসছে রোশনি।সে জানতো অধির তাকে বাঁচাবে।এতোদিনে এটুকু বিশ্বাস তো হয়েই গেছে।সেই বিশ্বাসের জোরেই তো সে লাফ দিয়েছে।অধির রোশনিকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই সবাই ভ্রু কুচকে তাকালো ওদের দিকে।ময়নার হাতে তখন ব্যান্ডেজ বাঁধছিল আদি। ময়নার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে অধিরের গলা দুহাতে জড়িয়ে বুকে মাথা রাখল রোশনি।চোখ দিয়েই যেন বুঝাতে চাইল,,,,”এই পুরুষটার কোলে ওঠা,,, তার বুকে মাথা রাখা,,, সব কিছুর অধিকার শুধু তার।এখানে অন্য কারো প্রবেশের সুযোগ নেই”””””।রোশনির খেয়াল নেই এখানে ময়না বাদেও মিসেস আনোয়ারা, আদি এবং আরো বেশ কয়েকজন উপস্থিত আছে।আনোয়ারা চোখের চশমাটা ঠিক করে অপ্রুস্তত চোখে তাকালেন।খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠলেন,
-ভিজে গেছিস একদম।যা রুমে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টে নে দুজনে।
আনোয়ারার কথা শেষ হতেই ফিচেল হেসে বলতে শুরু করল আদি,
-কি ব্যাপার বলো তো ভাইয়া..? কিছুক্ষন আগেও দুজনকে শুকনো দেখলাম।হঠাৎ এমন ভেজাভিজির কারন কি হ্যা? এই রোদের মধ্যে বৃষ্টি কোথায় পেলে?
মিসেস আনোয়ারা আদির পিঠে ছোট করে চাপড় মারতেই চুপ হয়ে গেল আদি।মুখ টিপে দুষ্টু হাসতেই কঠিন চোখ করে চোয়াল শক্ত করে তাকালো অধির।চোখ দিয়েই যেন বুঝিয়ে দিল,,,”””আমার বউ এর কাছে আমার নামে মিথ্যে বলা? তোর মিথ্যে বলার শখ বের করছি দাড়া।আজ তোর রেহাই নেই…..”””।অধিরের চোখ দেখে শুকনো ঢোক গিলে নজর সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলো আদি।
হঠাৎই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এল রোশনি। পাশে আয়াশকে দেখে বলে উঠল,
-তুই কখন এলি?
-এসেছি তো অনেক আগেই।কি ভাবছো বলোতো?
চলবে……