শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ৪৮

0
3398

#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব :৪৮

🌼
সারা রাত বিছানার এপাশ ওপাশ ছটফট করে শেষ রাতের দিকে অভিমানী চোখ দুটোতে ঘুম নেমেছে রোশনির।রাতের বেশি সময়ই কেটেছে নিদারুণ যন্ত্রনায়।কখনো বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে।তো কখনো রুমময় পায়চারি।জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে অন্ধকার বিলাশ করেও যন্ত্রনার সমাপ্তি ঘটেনি।তীব্র দাবানলের মতোই ভেতরটা জ্বলে উঠেছে বারবার।রঙহীন, ধোয়াহীন সেই আগুন শিখা দেখার মত কেউ নেই।অনুভব করার মত কেউ নেই।রাতকে নিকষ কালো অন্ধকারে রেখে চাঁদটাও আজ লুকিয়েছে অন্য কারো বুকে।সারা রাতের সেই তীব্র যন্ত্রনায় কাতর রোশনির চোখে ঘুম নেমেছে শেষ রাতের দিকে।চোখের কোনায় শুকিয়ে যাওয়া নোনা পানির চিহ্ন এখনো কিছুটা স্পষ্ট।অধির খুব যত্ন নিয়ে নিজের বুকে টেনে নিলো ঘুমন্ত রোশনিকে। খুব সাবধানে মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে কপালে ঠোট ছোঁয়ালো।ঘুমের মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠল রোশনি।সচেতন চোখে তাকাতেই দেখল রোশনি তার গেন্ঞ্জি খামচে ধরে আছে।ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে কিছু বলে চলেছে।অধির কান খাড়া করতেই অস্পষ্ট স্বরে ভেসে এল অগোছালো কিছু কথা,

-দি,,,আলোদি,,,,তোমাকে ওই দুষ্টু লোকগুলো ব্যাথা দিচ্ছে কেন?তুমি কি পচা কাজ করেছো?ছেড়ে দাও আমার দি কে।আমার দি ব্যাথা পাচ্ছে তো।বাবাই…? ও বাবাই..দেখো না,, দি কে ওরা ব্যাথা দিচ্ছে।ও বাবাই….?

কথাগুলো বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠল রোশনি।দুহাতে শক্ত করে অধিরের গেন্ঞ্জি খামচে ধরল।অধির ব্যস্ত হয়ে রোশনিকে জাগানোর চেষ্টা করল।গালে হাত দিয়ে কয়েকবার ডাকতেই চোখ পিটপিট করে তাকাল রোশনি।টেবিল ল্যাম্পের হালকা আলোই অধিরের মুখ কিছুটা অস্পষ্ট দেখাল রোশনির কাছে।রোশনিকে একদৃষ্টে দম মেরে তাকিয়ে থাকতে দেখে অধির রোশনির গালে হাত রেখে বলে উঠল,

-রিল্যাক্স সুইটহার্ট। আমি আছি তো তোমার কাছে।খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?আমি আ…

রোশনির নজর অধিরের অনবরত নড়তে থাকা পাতলা ঠোট জোড়ার দিকে থাকলেও কোনো কথায় তার মষ্তিষ্ক অবধি পৌছালো না।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শুধু।পরমুহূর্তেই যখন ভয়ংকর সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ল ভয়ে কেপে উঠল রোশনি।অধিরের প্রশস্ত বুকে মুখ লুকানোর চেষ্টা করতেই দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিল অধির।পিঠের দিকে শার্ট খামচে ধরে আছে রোশনি।পারলে যেন অধিরের বুকের ভেতরই ঢুকে যায়।এই মূহূর্তে এটাই যেন পৃথবী সব থেকে নিরাপদ আশ্রয়।এখানে থাকলে যেন কোনো বিপদ তাকে ছুঁতে পারবে না।অধির ছোট্ট শ্বাস টেনে রোশনির মাথার পেছনে হাত রাখল।রোশনিকে আরো কিছুটা নিজের সাথে লাগিয়ে যেন বুঝাতে চাইল,,, “আমি আছি তো।আমি থাকতে কোনো বিপদ তোমায় ছুঁতে পারবে না।আমি ছুঁতে দেবো না।”….

—–

সকাল দশটা।মাথার উপরে উতপ্ত সূর্য।টকটকে লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এল রোশনি।বসার ঘরে সবাই যেন তারই অপেক্ষা করছিল।অধির কয়েক সেকেন্ড মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরালো।রোশনি ময়নার সামনে গিয়ে দাড়াতেই ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,

-আর কয়েকটা দিন থেকে যান না ভাবি।আপনার সাথে তো সেভাবে কথায় হল না।

শেষের কথাতে মন খারাপের আভাস পেল রোশনি।মুচকি হেসে বলে উঠল,

-আবার আসবো তো ময়না রানি।একে বারে বিদায় নিচ্ছি নাকি।কিছুদিন পর আবার আসবো।তখন খুব করে আড্ডা দেবো।

ময়না উল্লাসিত কন্ঠে বলে উঠল,

-সত্যি…!!!

রোশনি হাসলো।ময়নার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,

-এখানে একটা শাড়ি আছে।দাদি বলল কয়েক দিন পরে নাকি তোমার জন্মদিন।জন্মদিন অবধি তো থাকতে পারছি না,,,তাই আজই জন্মদিনের গিফটটা দিতে হচ্ছে।পড়বে তো?

ময়না প্যাকেটা হাতে নিয়ে মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো।বিনিময়ে রোশনিও মুচকি হাসল।রোশনি মিসেস আনোয়ারা চৌধুরির সামনে দাড়াতেই উনি মন খারাপ করে বলে উঠলেন,

-আর ক’টা দিন থেকে গেলেই তো পারতি।আমি তো এখন একা হয়ে যাবো ।

ওনার কথায় অধিরের দিকে অসহায় চোখে তাকালো রোশনি।রোশনির চোখের ভাষা বুঝতে পেরে এগিয়ে এল অধির।আনোয়ারা চৌধুরির কাঁধের উপর হাত রেখে বলে উঠল,

-তোমাকে তো বললাম দাদি,,,,,আমাদের সাথে ঢাকা চলো।তুমিই তো যেতে চাচ্ছো না।এখন এভাবে মন খারাপ করে থাকলে ভাল লাগবে আমাদের?

-এবার তো অনেকদিন ঢাকায় থাকলাম।এবার কিছুদিন তোর দাদার স্মৃতি জড়িয়ে এখানে থাকতে চাই।তোরা থাকবি না যখন তখন আর আটকাবো না।তবে আমার কিছু চাই তোদের থেকে।,,,এবার ঢাকায় ফিরে যেন সুখবর পায়।বয়স তো অনেক হল।কখন দুনিয়া ছাড়ি বলা যায় না।আমারও তো শখ হয় ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে একটু খেলি।দুষ্টুমি করি।

ওনার কথায় লজ্জায় জমে গেল রোশনি।অধির রোশনির দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিল রোশনি।লজ্জায় কাঁটা হয়ে খিঁচে দাড়িয়ে রইল।অধির খুব গোপনে ছোট্ট একটা দির্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাড়াল।অধির কিছু বলার আগেই ফোঁড়ন কাটল আদি।মুখে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,

-উফফ দাদি…?এই বয়সেও তোমার খেলার মুড হয়েছে?নাতি নাতনির কি অভাব রয়েছে তোমার? আমরা আছি না।আর তোমার যদি ছোট ছোট নাতি নাতনির দরকারই পড়ে তাহলে ভাইয়াকে না বলে পাপাকে বলো।মায়ের শেষ বয়সের ইচ্ছে পূরন করার জন্যে আমি সিওর পাপা বাচ্চার লাইন লাগিয়ে দেবে।তুমি বরং তোমার ছেলেকে বলো তোমার আরো নাতি নাতনি লাগবে।

আদির কথায় সবাই হেসে উঠলেও মিসেস চৌধুরি আদির বাহুতে কিল বসালেন।চাপা শাষনের সুর তুলে বলে উঠলেন,

-চুপ কর বেয়াদব।খালি বাজে কথা।তুই তো আর বিয়ে শাদী করবি না।সারা দিন খালি মেয়েদের সাথে প্রেম করা।

-এইটা কি কইলা দাদি..?আমার কি এখনো বিয়ে করার বয়স হইছে? আর কে বলল তোমায়,,,আমি সারা দিন শুধু মেয়েদের সাথে প্রেম করি?

অধির আদির পিঠে চাপড় দিয়ে বলে উঠল,

-সেটা সবাই দেখতে পায় আদি।নতুন করে বলার কিছু নেই।এখন চুপ থাক।

অধিরের কথায় চুপ হয়ে গেল আদি।আনোয়ারা চৌধুরি রোশনিকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু আঁকলেন,

-সাবধানে থাকবি। বড় বউমার কথায় কষ্ট নিবি না।কয় দিন পরে ঠিক মেনে নেবে।এমন মিষ্টি মেয়েকে না মেনে নিয়ে পারবে নাকি?আর আমার নাতিটাকে এভাবেই বেঁধে রাখিস।দোয়া করি কেউ যেন তোদের মাঝে আসতে না পারে।

-আপনিও সাবধানে থাকবেন দাদি।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবেন।সময় মত ঔষুধ নিবেন।আমি ময়নাকে বলে দিয়েছি।খাবার আর ঔষুধে একদম ফাঁকি দেওয়া চলবে না।

রোশনির কথায় মুখ ছোট করে ফেললেন আনোয়ারা।বাচ্চাদের মত ঠোট ফুলিয়ে বললেন,

-এতো দিন অধির বলতো এখন তুই শুরু করেছিস?এমন তেতো তেতো ঔষুধ কি সব সময় খেতে ভাল লাগে?কোথায় একটু মিষ্টি টিষ্টি খেতে বলবি তা না…

-একদম মিষ্টির কথা মুখে আনবেন না।মিষ্টি খাওয়া নিষেধ।ডায়াবেটিস এখন কন্ট্রোলে আছে,,তাই বলে মিষ্টি খাওয়া চলবে না।এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন।এখনো অনেক দিন বাচতে হবে আপনাকে,,,,আমাদের জন্যে।

পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটল আয়াশ।বেঁধে যাওয়া গলায় বলে উঠল,

-বাডি ঠিক বলেছে বুড়ি বউ।তোমাকে এখনো অনেক দিন বাঁচতে হবে।তুমি তো এখন আমার বুড়ি বউ।এখনো তো আমাদের ডিভোর্স হয় নি।আমার বড় হওয়ার পর যখন সত্যি বউ হবে তখন তোমায় ডিভোর্স দিতে তো তোমায় লাগবে।ডিভোর্স এর পরে নাহয় চিন্তা করে দেখবো,, তোমাকে যেতে দেওয়া যায় কি না।

আয়াশের কথায় হেসে ফেলল সবাই।আনোয়ারার চোখ ভিজে এল।হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলেন,,,তাকে ভালবাসার জন্যে চারপাশে অনেক মানুষ আছে।এতো মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার ক্ষমতা বোধ হয় তার নেই।রোশনি, অধির,আদি আর আয়াশ ওনাদের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল।সবুজের এই মনোরম সমােরহ ছেড়ে গাড়ি ছুটল ঢাকার পথে।প্রায় আধাঘন্টা পার হওয়ার পর মিররে তাকিয়ে দেখল আয়াশ ঘুমোচ্ছে। আদির কানে হেডফোন।ফোনে ব্যস্ত সে।অধির ছোট্ট শ্বাস টেনে রোশনির দিকে তাকালো।খোলা জানালার ফাক গেলে আসা বাতাসে শাড়ির আচল উড়ছে।নিয়মহীন ভাবে উড়ছে ঘন কালো চুল।রোশনি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।বিগত আধাঘন্টা ধরে এভাবেই বসে আছে সে।অধির গাড়ি চালাতে চালাতেই বলে উঠল,

-মন খারাপ..?

রোশনি উত্তর দিলো না।ফিরেও তাকালো না।অধির আড়চোখে রোশনিকে দেখে নিয়ে আবারো বলল,

-বেশি মন খারাপ ?

রোশনি এবারও জবাব দিল না।গম্ভির চোখ জোড়া নিয়ে অধিরের দিকে তাকাতেই দেখল বাতাসে উড়া চুলগুলো অধিরের চোখে মুখে আঁচড়ে পড়ছে।রোশনি গুলোকে হাত খোপা করতে হাত তুলতেই পেটের দিকটা উন্মুক্ত হল। মেদহীন ফর্সা পেটটাতে কুচকুচে কালো তিনটা তিল।অধির দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।রোশনি দক্ষ হাতে চুলগুলোকে হাত খোপা করে আবারো আগের মত বাইরে মুখ ঘুরিয়ে বসলো।অধির সবটা পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠল,

-তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?কথা বলছো না কেন?কি হয়েছে না বললে বুঝবো কি করে? কেন রেগে আছো সুইটহার্ট…?

রোশনি এবারো জবাব দিল না।অধির হতাশ চোখে তাকালো।বলল,

-কিছু তো বলো ।

রোশনি এবার ঘুরে বসল।শান্ত অথচ রাগ নিয়ে বলল,

-কি বলতে হবে আমায়?আপনি যাওয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন? আমাকে না বলেই তো ঢাকা চলে গেছিলেন।আমি জানতে চেয়েছি একবারও কেন বলে যাননি আমায়?নিজে যখন কাউকে কিছু বলেন না তাহলে আমি কেন আপনাকে বলবো?বলবো না আমি কিছু।আর আপনিও কোনো কথা বলবেন না।

-তুমি তো তখন ঘুমিয়েছিলে বাবা।তোমায় জাগাতে ইচ্ছে করছিল না।আমি তো লিখে গিয়েছিলাম।তাও কেন এতো রাগ করছো?

-ফোন অফ ছিল কেন? কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলেন যে,,,ফোন অফ করে রেখেছিলেন?ঠিক আছে মেনে নিলাম ইমপর্টেন্ট মিটিং এ ছিলেন।মিটিং শেষ করেও তো ফোন দেওয়া যেত।যেতো না?

অধির হতাশ চোখে তাকালো,

-ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছিলো সুইটহার্ট। তারপরেও তো আমি রাতে ব্যাক করেছি তাই না?সারা দিন মিটিং করে,,ক্লান্ত শরির নিয়ে পাঁচ ঘন্টা গাড়িয়ে চালিয়ে এসেছিলাম।শুধু তোমার জন্যে।এরপরেও এতো রাগ…?এনিওয়ে,, তবুও ভাল লাগছে এটা ভেবে যে আমার বউ তাহলে আমাকে মিস করেছে।

-একদম বাজে কথা বলবেন না বলে দিলাম।আমি ভিষন রেগে আছি।আবার বাজে কথা বললে কিন্তু মাথা ফাটিয়ে দেবো।

——–

“তুমি বলেছিলে,,, তোমাকে ভুলে অন্য কাউকে ভালবাসতে।আমি শুধু মুচকি হেসেছিলাম।কি করে বুঝাতাম তোমায়,,,,?কিছু অনুভূতি একবারই আসে,,, একজনের জন্যেই।পরে চাইলেও তা অন্য কারো জন্যে জেগে ওঠে না।

জগৎ এর সব অনুভূতি যেই মানুষটার জন্য,, সে মানুষটাই আমার না।কি করে বুঝাই মনকে,,,এ কঠিন বাক্যটা?তার থেকে মনটা বরং তোমাকে ঘিরেই থাকুক।নাহয় চাইলেই তুমি হারিয়ে যেও রাজ্যহীন কোনো রাজ্যে,,,জনশূন্য কোনো প্রাচ্যে।আমি নাহয় তোমাকে খুজে পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাবো।

এটুকু লিখেই ডায়েরীটা বন্ধ করল জয়।বালিশের নিচে ডায়েরিটাকে চাপা দিয়ে সিগারেট হাতে বেলকোনিতে চলে গেল। ঠোটের ভাজে জলন্ত সিগারেট চেপে ছাড়তে লাগল একের পর এক বিষাক্ত ধোয়ার কুণ্ডলী। পরপর তিনটা সিগারেট শেষ করে আবারো ফিরে এল রুমে।বিছানায় গা এলিয়ে সিলিং এ তাকাতেই চোখ পড়ল চকচকে সাদা ফ্যানটাতে।মৃদু ওয়াজ তুলে বিরামহীন ঘুরছে।দুদিন আগেও যেখানে ধুলোর কালো আবরন ছিল আজ সেখানে ধুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।চকচকে ফ্যানটাকে দেখতেই রিয়ার কথা মনে পড়ল জয়ের।ফ্যানের পাখায় ধুলোর কালো আস্তরন দেখে সেদিন নাক ছিটকেছিল রিয়া।জয়কে কয়েকটা কড়া কথাও শুনিয়েছিল।হঠাৎই রিয়ার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল জয়ের।রিয়া বলেছিল,

“ফ্যানে এতো ময়লা কেন?লম্বা হয়ে কি কাজটা করলেন জিবনে?ফ্যানে যদি এমন ময়লা থাকে তাহলে এতো লম্বা হয়ে লাভ কি হল?তিন ফুটের লিলিপুট হয়েই না হয় থাকতেন।”

রিয়ার কথা শুনার পর নিজ হাতে ফ্যান পরিষ্কার করেছে জয়।আর যাইহোক ফ্যান অপরিষ্কারের জন্যে লম্বা হওয়া নিয়ে সে আর কোনো কথা শুনতে রাজি নয়।

——-

-তাহলে তুমিই রোশনি? অধিরের বউ?আমার বোনকে সরিয়ে তাহলে তুমিই অধিরের মন দখল করেছো?

রোশনি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে তাকালো।দেমিরের এমন প্রশ্নে কি উত্তর দেওয়া যায় সেটা ভেবেই খানিক অপ্রুস্তত হল । রোশনি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন দেমিরের বাহুতে কিল বসালো।সুরেলা গলায় বলে উঠল,

-মেয়েটাকে অযথা ভয় দেখাচ্ছো কেন? সরো সামনে থেকে।আমাকে একটু দেখতে দাও।

দেমিরকে সরিয়ে মেয়েটা এবার সামনে এলো।রোশনির দিকে তাকাতেই কপালে ভাজ পড়লো।কিছুক্ষন ওভাবেই তাকিয়ে থাকল।রোশনি তখনও মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।রোশনির মুখের আদলটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে দিয়ার।কারো সাথে যেন মিলে যাচ্ছে।কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব?সে তো….!! ।দিয়ার চোখের কোনে পানি জমলো।সবার দেখার আগেই খুব সাবধানে তা মুছে নিল।নিজেকে সামলে মুচকি হেসে বলে উঠল,

-মাশআল্লাহ…!!! অধিরের সাথে একদম পার্ফেক্ট ম্যাচ।এভাবে নিচে তাকিয়ে আছো কেন? এতো অস্বস্তি পেতে হবে না।আমি অধিরের বোন।দিয়া চৌধুরি।

রোশনি এবার চোখ তুলে তাকালো।কন্ঠটার মতোই মিষ্টি দেখতে সামনে দাড়ানো মেয়েটা।রোশনি কিছুক্ষন নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে সালাম দিল।রোশনির চোখে মুখের স্নিগ্ধতা দেখে আরো একদফা চমকালো দিয়া।পাশ থেকে দেমির একগাল হেসে বলে উঠল,

-সরি ভাবি।আমি জাস্ট মজা করছিলাম।প্লিজ নেভার মাইন্ড।অধির আমার সবথেকে ভাল বন্ধু।ওর সাথে দিদামের বিয়ে হোক বা তোমার সাথে,,,, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।আমি এটা ভেবে খুশি যে,,,অধির শেষ পর্যন্ত কাউকে ভালবেসেছে।দিদামের প্রতি ওর কোনো ফিলিংস ছিল না সেটা আমি ভাল করেই জানতাম।দিদামের জেদের বশেই অধির রাজি হয়েছিল ওকে বিয়ে করতে।আমার বোনের জন্যে একটু কষ্ট হলেও অধিরের জন্যে আমি ভিষন খুশি।

দেমিরের কথায় খানিকটা স্বস্তি পেল রোশনি।অধির এতোক্ষন চুপ করে দাড়িয়েছিল।এবার সে রোশনির পাশে দাড়িয়ে বলে উঠল,

-সুইটহার্ট এবার রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নাও।অনেকটা জার্নি করেছো।শরির খারাপ করবে নয়তো।আগে একটা শাওয়ার নিবে তার পর রেস্ট।ওকে…?

রোশনি মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।দিয়া রোশনির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।দিয়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দিয়াকে হালকা করে ধাক্কা দিল দেমির,

-এনি প্রবলেম জান?

-নো,,,,নো প্রবলেম।আমি ব্যস দেখছিলাম আর কি।আচ্ছা তোমরা কথা বলো।আমি একটু আসছি।

দিয়া ওখন থেকে চলে আসলো।রোশনির মুখটা ভাবাচ্ছে তাকে।দিয়া আনমনে হাটতে হাটতেই কারো সাথে ধাক্কা খেল।চেখ তুলে তাকাতেই দেখল ঝুমা চৌধুরি চোখ মুখ কুচকে দাড়িয়ে আছেন।

-সরি মম,,,,,আমি আসলে খেয়াল করি নি।

ঝুমা চৌধুরি বিরক্ত চোখে তাকালেন।বললেন,

-তোমায় বলেছিনা তুমি আমাকে মম বলে ডাকবে না।তুমি অধিরের বোন হতে পারো কিন্তু আমার মেয়ে নও।বুঝেছো তুমি?

দিয়া ছলছল চোখে তাকালো।এতো দিনেও ওনার মন এতটুকু পাল্টায় নি।এতো দিনেও তাকে নিজের মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারে নি।দিয়া করুন গলায় বলল,

-এভাবে কেন বলছো মম?আমি কি এতো দিনেও তোমার মেয়ে হয়ে উঠতে পারি নি?

-না পারো নি।আর কখনো পারবেও না।তোমার জন্যে আমার অধির আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।তোমাকে পেয়ে আমার ছেলে আমাকে ভুলে যাচ্ছিলো।আমার থেকে তোমাকে বেশি ভালবাসছিল।তোমাকে আমি ইউএস এমনি এমনি পাঠায় নি।তুমি আমার ছেলেকে আমার থেকে দূরে করতে চেয়েছিলে,,,তাই আমিই তোমাকে আমার ছেলে থেকে তোমাকে দূরে পাঠিয়ে দিলাম।এতো বছর পর কেন আবার ফিরে এসেছো?

দিয়ার চোখ থেকে এবার পানি গড়িয়ে পড়ল।আহত গলায় বলল,

-মম…!!

-খবরদার আমাকে মম বলে ডাকবে না।আমি শুধু আমার অধির আর রিয়ার মম।আর কারো না।আমার অধির এক সময় আমার থেকেও তোমাকে বেশি ভালবাসত।তোমাকে ওর থেকে সরিয়ে সেই ভালবাসা আমি কেড়ে নিয়েছিলাম।এখন ওই দু’টাকার মেয়ে রোশনি,,,,সে আমার ছেলেকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছে।আমার ছেলে এখন আমার থেকেও ওকে বেশি ভালবাসে।তোমার মত ওই মেয়েকেও আমি অধিরের থেকে দূরে সরিয়ে দেবো।

-প্লিজ মম।এমনটা করো না।আমার ভাইটা তাহলে মরে যাবে।অধির এখনো তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।ওর মনে তোমার জায়গা সবার উপরে।তুমি ভুল বুঝছো মম।এতো দিন পর কোনো মেয়েকে অধির পাগলের মত ভালবেসেছে মম,,,প্লিজ ওকে দূরে সরিয়ে দিও না।আমাকে নিয়ে তো তোমার প্রবলেম? ঠিক আছে।আমি না হয় আবার ইউএস চলে যাবো।তারপরেও প্লিজ রোশনির সাথে কিছু করো না। আমি হাত জোর করছি মম।প্লিজ।

ঝুমা চৌধুরি কিছু বলবেন তার আগেই সেখানে অধির এল।দিয়া অধিরের আড়ালে চোখ মুছে লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলালো।

-কি হয়েছে এখানে?

ঝুমা চৌধুরি কিছুটা ভয় নিয়ে তাকালেন।আমতা আমতা করে বলে উঠলেন,

-তেমন কিছু না।দিয়া বলছিল দুপুরে,,,,,

ঝুমা চৌধুরির কথার মাঝেই প্রশ্ন ছুঁড়ল অধির,

-দিয়া তুই কাঁদছিস?কি হয়েছে বল আমায়? মম কি বলেছো তুমি ওকে…?

শেষের কথাটা চোয়াল শক্ত করেই বলল অধির।ছেলের এমন রক্ত চক্ষু দেখে ভয়ে শিউরে উঠলেন ঝুমা। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠল দিয়া,

-অধির শান্ত হ।রেগে যাচ্ছিস কেন?মম কিছু বলে নি আমায়। আসলে ড্যাডের কথা ভেবেই চোখে পানি এসেছিল আমার।মম তো জাস্ট আমাকে শান্ত করছিল।ট্রাস্ট মি,,,মম কিছু বলে নি আমায়।

অধির সরু চোখে তাকালো।দিয়াকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে ঝুমা চৌধুরির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

-মম,,,? দিয়াকে কিছু বললে আমি কিন্তু সেটা মেনে নিবো না।রিয়ার মত দিয়াও আমার বোন।তুমি দিয়াকে মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারো নি সেটা তোমার ব্যর্থতা। আমি জানি দিয়া এখন মিথ্যে বলল তোমাকে বাঁচাতে।একটা কথা মনে রেখো মম,,,,আমি যেমন তোমাকে ভালবাসি,, তেমন দিয়াকেও ভালবাসি।দিয়া তোমাকে খারাপ কিছু বললে আমি যেমন সহ্য করবো না,,,তেমন তুমিও যদি দিয়াকে খারাপ কিছু বলো আমি সহ্য করবো না।তুমি বলো না….আমি নাকি দিয়াকে বেশি ভালবাসি? কেন ভালবাসি জানো? কারন তোমাকে ভালবাসার জন্যে তোমার ছেলে আছে,মেয়ে আছে কিন্তু এই মেয়েটার আমি ছাড়া কেউ নেই।আমি আবারো বলছি মম,,,,দয়া করে আমার বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার তুমি করবে না।আমি মেনে নেবো না।

-ভাই..!! কি সব বলছিস?মা হন উনি।আমি বললাম তো মম আমায় কিছু বলে নি।অযথা কেন রাগ…..

দিয়ার কথার মাঝেই মুখ খুললেন ঝুমা চৌধুরি।তেজ দেখিয়ে বললেন,

-থাক এখন আর আমার নামে গুনগান গাইতে হবে না।আমার সামনে ভাল সাজার আর চেষ্টা করো না।আড়ালে আড়ালে আমার ছেলেকে আমার নামে বিষিয়ে দিয়ে এখন এসব বলা হচ্ছে?নির্লজ্জ মেয়ে একটা।

ঝুমা চৌধুরি আর দাড়ালেন না।গটগট শব্দ তুলে জায়গা ত্যাগ করলেন।অধির চিল্লিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাত চেপে ধরে চুপ থাকতে বলল দিয়া।

-অধির প্লিজ কিছু বলিস না।মা হন উনি।এতোটুকু তো…

দিয়াকে শেষ করতে না দিয়েই মুখ খুলল অধির,

-মায়েরা কি সত্যিই এমন হয়? আজ আমার এই ইগো,মুডি এ্যাটিটিউড এসবের জন্যে দায়ি কে জানিস?আমার মা।হ্যা উনিই দায়ি।ছোট থেকেই টাকার পেছনে ছুটা শিখিয়েছেন উনি আমায়।বংশ,নাম,খ্যাতি,ধনি গরিব এসবকিছু উনি শিখিয়েছেন আমায়।শিখিয়েছেন ধনিরা গরিবদের সাথে মিশে না।শিখিয়েছেন বংশের অহংকার।শিখিয়েছেন কিভাবে ছিনিয়ে নিতে হয়।দাদি,তুই, সাহিল,আদি তোরা না থাকলে তো এতো দিনে আমি পুরোপুরি অমানুষ হয়ে যেতাম।আমি এই যে এখনো অবধি মানুষ আছি সেটা তোদের জন্যেই।তোরা না থাকলে বংশ আর টাকার অহংকারে এতোদিনে পশু হয়ে যেতাম আমি।আর এর জন্য কে দায়ি থাকতো জানিস? উনি।আমার মা।

——

রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা খুলে নির্দিষ্ট টেবিলটাতে বসতেই সামনে বসা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিহিতা রমনির চোখ মুখ ঝিলিক দিয়ে উঠল।ভার্সিটির সব থেকে ধনী ছেলের সাথে ডেটে এসেছে সে।সামনে বসা রমনি হাসি হাসি মুখ করে আদির দিকে তাকাতেই আদি বলে উঠল,

-আই এম সো সরি।একটু দেরি হয়ে গেল।

-ইটস ওকে বেবি।আই ডোন্ট মাইন্ড।

-ফার্স্ট ডেটেই বেবি!!!ওয়েল।বাই দা ওয়ে,,,ইউ লুকিং কিউট।

মেয়েটা দ্বিমত পোষন করে বলল,

-উঁহু,,,, নট কিউট বেবি।আই এম হট এন্ড সেক্সি।

আদি প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তে হেসে ফেলল,

-মাই মিসটেক।কি খাবে বল?

-তুমি যা খাওয়াবে।

আদি ভ্রু কুচকে তাকাল।বলল,

-সরি…।ঠিক বুঝলাম না।

-আই মিন টু সে,,,,তুমি যেটা অর্ডার করবে সেটাই খাবো।আই হেভ নো প্রবলেম।

-হাউ সুইট…!!!

আদি ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার দিল।মিটিট দশেক পরে কাঙ্খিত খাবারে ভরে গেল টেবিল।আদি আর মেয়েটা টুকটাক কথা বলতে বলতে খাবারে মনোযোগি হল।চঞ্চল কিশোরির দুরন্তপনার মতোই দেখতে দেখতে কেটে গেল সময়।টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়াতেই আদির চোখ গেল কর্নারের একটা টেবিলে।আজ বেশ কয়েকদিন পর পরিচিত মুখটা দেখল সে।আলাদা কোনো অনুভূতি হল না।আদি চলে যেতে নিয়েও থেমে গেল।পিয়ার ঠিক সামনে বসে আছে শ্যাম বর্ণের এক যুবক।যুবকের চোখে মুখে মুগ্ধতা।আদির হঠাৎ করেই যেন ছেলেটার প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।রাগ উঠছে পিয়ার উপরেও।আদিকে দাড়াতে দেখে লিজা বলে উঠল,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড বেবি? লেটস গো না……

আদি ওদের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,

-ইউ ক্যান গো লিজা।আমার কিছু কাজ আছে।

লিজা ভ্রু কুচকে তাকাল,

-আর ইউ সিওর…?

-এ্যাবসল্যুটলী

-ওকে।দেন বাই…..

-বাই…..

লিজা নামক মেয়েটা চলে যেতেই চোখ মুখ শক্ত করে দাড়ালো আদি।মুখে মাস্ক পড়ে হেটে চলল কর্নারের দিকে।পিয়া তখন মাত্রই কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো।আদি ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিয়ার হাতে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল।আদির ধাক্কায় কফির অনেক খানিই পড়ল পিয়ার শার্টে।পিয়া নিজের শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাড়াল।দাতে দাকে চেপে বলল,

-হোয়াট দা ফা*…..।

আরাফও ততোক্ষণে উঠে দাড়িয়েছে।আশে পাশে তাকিয়ে তেমন কাউকেই চোখে পড়ল না তার।আরাফ পিয়ার দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিয়ে বলল,

-এটা দিয়ে মুছে নাও।ব্যাপারটা হয়ত এক্সিডেন্টলি ঘটে গেছে।রিলাক্স।

পিয়া টিস্যু দিয়ে শার্টের উপরের দিকটা মুছতে মুছতে বলে উঠল,

-আই এম ড্যাম সিওর,,,লোকটা ইচ্ছা করে আমার হাতে ধাক্কা দিয়েছে।একবার পাই তারপর মজা বুঝাবো।

পিয়াকে রেগে যেতে দেখে ছোট্ট শ্বাস টেনে চেয়ারে বসল আরাফ।শান্ত গলায় বলল,

-তেমন সন্দেহজনক কাউকে তো চোখে পড়ছে না।বাই দা ওয়ে তুমি বরং ওয়াশরুমে গিয়ে পরিষ্কার করে নাও।আমি ওয়েট করছি।

পিয়া আর কথা বাড়ালো না।ওয়াশ রুমের দিকে হাটা দিল।ওয়াশরুমের দরজার কাছাকাছি যেতেই কেউ একজন তার হাত ধরে সজোরে টান দিল।আচমকা ঘটনায় পিয়া ঘাবড়ে গেলেও আদিকে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার।পিয়ার বুঝতে বাকি রইল না তাকে কে ধাক্কা দিয়েছে।পিয়া রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রক্ত চক্ষু নিয়ে দাতে দাত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল আদি,

-ছেলেটা কে…?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here