শেষ রাত পর্ব-১৭

0
1705

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৭
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আম্মু বলেছে মানে আপনার মনি মা।’

ধ্রুবর জবাবটা যেন মেঘহীন আকাশে শুকনো বজ্রপাতের মতো শোনালো। আকাশ থেকে পড়ার মতো বিস্মিত হলাম আমি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর মুখের দিকে। আমার চমকে যাওয়াতে মৃদু হাসলেন তিনি৷ তবে কিছু বললেন না খুব স্বাভাবিকভাবেই বসে থাকলেন। আমার মস্তিষ্ক তার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে অচল হলো। মনি মা কিভাবে জানেন! আর এতদিন কি ভেবেছেন আমাকে নিয়ে! এসব নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে পারলাম না৷ অনুশোচনা আর লজ্জাবোধে গলার স্বর আটকে গেল কণ্ঠনালীতে। অপরাধ বোধে চোখের দৃষ্টি হলো নত। ধ্রুব আমার গালে আঙুল দিয়ে গুতো দিতেই আমার হুশ ফিরলো৷ আমি ভ্রু কুচকে ওনার দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গেই উনি বাঁকা দাঁত বের করে মন কাড়া একটা হাসি দিলেন। তিনি সব সময় এভাবে বাঁকা দাঁত বের করে হাসেন না। বেশিরভাগই মৃদু হাসেন তাই এই বাঁকা দাঁত বেশি একটা দেখাও যায় না। আমি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘মনি মা কিভাবে জানেন? আপনার এত এত রহস্য ভালো লাগছে না আমার৷ দয়া করে সব কিছু খুলে বলুন তো।’

ধ্রুব আমার কথার অন্য মানে বের করলেন। দুষ্টু হাসি দিয়ে রসিকতা করে বললেন-

‘ছিঃ এসব কি বলছেন? আমাকে সব খুলে কথা বলতে বলছেন!! ছিঃ ছিঃ লজ্জা করে না আপনার!’

ধ্রুবর কথার ভাবার্থ বুঝতে আমার সেকেন্ড কয়েক সময় লাগলো। ওনার কথা বুঝতেই মনে মনে একটা কথা বললাম- ‘অসভ্য লোক’। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম মানুষটার দিকে। তিক্ত গলায় বললাম-

‘রসিকতা করছেন আমার সঙ্গে!’

‘আপনি কি আমার বিয়াইন না-কি যে আপনার রসিকতা করবো?’

ধ্রুবর পালটা জবাবে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। উনি এবার শব্দ করেই হাসলেন। পুরো গাড়ি রঞ্জিত হলো তার হাসিতে। আমি বিরক্তি নিয়ে ওনার হাসি মুখে স্থির চেয়ে থাকলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। হতাশ হয়ে ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘মজা না করে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন প্লিজ।’

ধ্রুব হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলেন। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে শীতল চাহনি দিয়ে বললেন-

‘সেদিন পার্কে আম্মু হয়তো আপনাদের কথা শুনেছিল। বাসায় এসে আমার আর সাদাফের ট্যুরের ছবি দেখিয়ে বলল সাদাফ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে। আপনাকে একা রেখে চলে গেছে। আরও নানান কথা বলে সাদাফের প্রতি ভীষণ আক্ষেপ আর রাগ প্রকাশ করেছে। আমি আম্মুর কথা বিশ্বাস করিনি। তবুও একবার সাদাফের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর নাম্বার বন্ধ থাকায় আর কথা হয়নি। পরে এসব নিয়ে আর কোনো মাথা ঘামাইনি। তবে দিন দিন আপনার প্রতি তুলতুলের পাগলামি দেখে আম্মু একদিন হঠাৎ করেই আমাদের বিয়ের কথা বললেন। আমি সেটাও গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছিলাম আপনি যেহেতু অন্য কাউকে ভালোবাসেন তাই হয়তো বিয়েতে রাজি হবেন না। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে আপনি বিয়েতে রাজি হলেন। আর সেদিনই আম্মু আমাকে বলে দিয়েছিল আমি যেন আপনার থেকে দূরে দূরে থাকি। স্বামীর অধিকার না খাটাই। আপনাকে যেন অতীত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সময় দেওয়া হয়। আপনাকে আপনার মতো করে থাকতে দেওয়া হয়। আরও অনেক অনেক হুকুম দিয়েছিল। আর সে জন্যই ওদিন রেস্টুরেন্টে ওসব শর্ত দিয়েছিলাম যেন আপনি নিজেই নিজেকে আমার থেকে দূরে রাখেন।’

ধ্রুব কথা গুলো শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম স্থির হয়ে। মনি মা সব জানেন বলেই কি আমাকে সব কিছুতে এত এত ছাড় দিয়েছেন? আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেই কথার ঝুলি খুলে বসেছে। সব সময় আমাকে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বলেছে। আমাকে মনমরা থাকতে দেখে তুলতুলকে আমার কোলে এনে দিয়েছে। আমার নিজের প্রতি অবহেলায় কড়া গলায় শাসন করেছেন। সংসার নামক কোনো দায়িত্বের যাতা কলে আমাকে পিশে যেতে দেয়নি। নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় দিয়েছে। একটা মানুষের কি আদোও এতটা ভালো হওয়া উচিত! এই স্বার্থপরের দুনিয়ায় কি আদোও এতটা ভালো মনের মানুষ হওয়া মানায়? আমি কোনো উত্তরই খুঁজে পেলাম না। আচমকাই হাতে টান অনুভব করলাম। আমি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম ধ্রুব বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।

‘বারিয়ে আসুন। একটু হাঁটাহাঁটি করি।’

আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই ধ্রুব আমার হাত ধরে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলেন। ফাঁকা ফ্লাইওভার ব্রিজ। নিচে ছোট খাটো একটা নদী। মতুন ব্রিজ তাই হয়তো গাড়ি চলাচল খুবই কম। মিনিট খানেক পর পর একটা দুটো করে গাড়ি শাই শাই শব্দে চলে যাচ্ছে। আমরা বেশ খানিকটা সময় ব্রিজের পাড় ধরে হাঁটলাম। পুরোটা সময় ছিলাম নিশ্চুপ। কথা বলার মতো কোনো কিছুই খুঁজে পেলাম না আমি। আমার নিশ্চুপতা দেখে ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে শান্ত গলায় বললেন-

‘যেদিন আপনি তুলতুলের জন্য নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম আপনি কখনও তুলতুলকে ছেড়ে যাবেন না। সাদাফ ফিরে এলেও না। আপনার প্রতি আমার আর আম্মুর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল। তাই আপনাকে কখনও আপনার অতীত নিয়ে কিছু বলিনি আর আপনার মনের উপর জোর খাটাইনি। তাই এসব নিয়ে বেশি ভাববেন না।’

আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ধ্রুবর কথা গুলো মন দিয়ে শুনলাম। গলার স্বর নামিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আমি কি এসব কিছুর যোগ্য!’

ধ্রুব তার হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। খানিকটা ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে আমার মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

‘অবশ্যই যোগ্য। আর যোগ্য বলেই তো বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছো সানসাইন। কোনো ঝামেলা না করে সব কিছু কত সুন্দর করে সামলিয়ে নিয়েছো। তুমি চাইলেই আমাদের অগোচরে সাদাফের সাথে রিলেশন রাখতে পারলে। আমাদের ছেড়ে ওর কাছে চলে যেতে পারতে। কিন্তু তুমি তা করনি। তুমি তা-ই করেছো যা তোমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে।’

কেউ আমার উপরে এতটা বিশ্বাস করে ভেবেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এখনই বোধহয় গড়িয়ে পরবে চোখের জল। কান্না করতে ইচ্ছে হলো খুব। মুখ গুজে কান্না করার জন্য ধ্রুবকেও পেলাম সামনে। কোনো দ্বিধাবোধ না করেই ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুজেই কান্না করে দিলাম। নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলাম। ধ্রুব বোধহয় সব সময়ের মতোই মৃদু হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধিরে ধিরে। আমার নিঃশ্বাস গাঢ় হতে লাগল। কান্নাজড়িত গলায় থেমে থেমে বললাম-

‘আমাকে এতটা বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আপনি অনেক ভালো।’

ধ্রুব হাসতে হাসতে বললেন-

‘ভালো না হলেই কি বার বার আমার পারসোনাল বুকটাকে সাগর বানাতে দেই না-কি!’

দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে অথচ কলিং বেল বাজাতে সাহস পাচ্ছি না। চেনা মানুষকেই আজ আবারও নতুন করে চিনলাম তাই কিছুটা ইতস্ততবোধ করছি। আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনা করে অবশেষে কলিং বেল বাজালাম। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই মনি মা দরজা খুললেন। আমাকে দেখেই বিরক্তি নিয়ে বললেন-

‘দেরি করলে কেন আজ? খাবার খেয়েছিস নাকি না খেয়েই বাদরটার সাথে ঘুরেলি? যে বেখেয়ালি একটা ছেলে জন্ম দিয়েছি মনে হয় না তোর আর তার নিজের খাবার-দাবারের প্রতি কোনো খেয়াল আছে। পুরো বাপের ফটোকপি হয়েছে।’

আমি মনি মা’র সকল কথা অগ্রাহ্য করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। মনি মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন-

‘কিরে অসুস্থ লাগছে! না-কি মন খারাপ কোনটা?’

আমি জবাব দিলাম না। চুপ করে কিছুক্ষন মনি মা’কে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। মিনিটখানেক পর ওনাকে ছেড়ে সোজা হয়ে হাসি দিয়ে বললাম-

‘কিছু না। তুমি খুব ভালো মনি মা।’

মনি মা তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-

‘তুইও দেখি ওই বাপ-ছেলের মতোই হচ্ছিস। পাম দেওয়া শিখে যাচ্ছিস। আমাকে এসব পাম দিয়ে কোনো লাভ নেই। যা হাত মুখ ধুয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।’

মনি মা চলে গেলেন রান্নাঘরে। বিরক্তি নিয়ে এটা ওটা বলেই যাচ্ছেন একের পর এক। আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। এরা মা ছেলে দুজন এতটা স্বাভাবিক থাকে কিভাবে সবসময়! সব কিছু জেনেও এমন একটা ভাব যেন তারা কিছুই জানে না। এসব কি আমাকে অস্বস্তিতে না ফেলার জন্যই করেন? আমি হাসি মুখে চলে গেলাম রুমে। আবারও যেন নতুন করে সব কিছু শুরু হলো। পুরো বাড়িটাই যেন নতুন নতুন মনে হতে লাগলো। মনের ভেতর আলাদা এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। এই বাড়ির মানুষ গুলো সাথে থাকলে আমি কখনোই ভেঙে পরবো না। এক এক জন আমার ডাল হয়ে আগলে রেখেছে আমাকে। প্রকাশ্র নয় অগোচরেই আমাকে আগলে রেখেছে প্রতিটা সময়।

চলবে…

[দুঃখিত মাইগ্রেনের ব্যথার জন্য কাল রাতে গল্প অর্ধেক লিখেই রেখে দিয়েছিলাম। পর্ব হয়তো ছোট হয়েছে। তবে রাতে আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here