শেষ রাত পর্ব-১৮

0
1802

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

গুমোট আকাশের নিচে কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরটা যেন আজ বেশ থমথমে। এই আলো তো এই অন্ধকার৷ কিছুক্ষন আগেই আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হলো। ঝড়ো হাওয়ার তান্ডবে এলোমেলো হলো চারপাশ। ঘন্টাখানেকের তীব্র বৃষ্টির শেষে ক্লান্ত হয়েই গতি কমিয়ে পরিবর্তিত হলো মৃদু ঠান্ডা বাতাস আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। আমি দরজা খুলে বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। পা বাড়ালাম বারান্দার ভেজা মেঝেতে। ধ্রুবর বেলি গাছ গুলোর বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখেই মন খারাপ হলো। ডাল পালা একদম নেতিয়ে গেছে। এতদিনের যত্নে বেলি গাছে যে কয়টা কলি এসেছিল তার প্রায় বেশির ভাগই ঝড়ে পরেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বেলি গাছগুলোকে ঠিক করে দিতেই কলিং বেল ভেজে উঠলো। মনি মা তুলতুলের গায়ে মালিশ করে দিচ্ছে। তাই আমি বারান্দা থেকে পা টিপে টিপে রুমে আসলাম। ওড়নায় ভেজা হাত মুছে ছুটে চললাম দরজা খুলতে। দরজা খোলা মাত্রই ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়তে দেখলাম। শার্টের কিছু কিছু জায়গা ভেজা। মুখে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোটা। আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে শার্টের হাতায় মুখ মুছলেন তিনি। ভেতরে আসতে আসতে উচ্চস্বরে বললেন-

‘আমার তুলতুল পাখি কোথায়?’

আমি দরজা লাগিয়ে ওনার পেছন পেছন এসে গাঢ় স্বরে বললাম-

‘সব সময় আমার তুলতুল পাখি, আমার মেয়ে এসব বলেন কেন?’

ধ্রুব সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন বেশ আরাম করে। আমার দিকে চেয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন-

‘আমার মেয়েকে আমার মেয়ে বলবো না তাহলে কার মেয়ে বলবো?’

আমি কন্ঠে ক্ষীণ বিরক্তি ভাব নিয়ে বললাম-

‘অদ্ভুত তো! তুলতুল কি আপনার একার মেয়ে নাকি যে সব সময় আমার আমার করতে হবে!’

‘অবশ্যই আমার মেয়ে। তাই আমার মেয়ে, আমার তুলতুল এসবই বলবো। তাতে আপনার কি?’

ধ্রুবর ত্যাড়া কথায় আমার মেজাজ খারাপ হলো। অসহ্যকর! মেয়েদের মতো কিভাবে গায়ে পরে ঝগড়া করছেন! আমি ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই মনি মা তুলতুলকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলেন। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কি নিয়ে এত তর্ক করছিস!’

মনি মা ধ্রুবর পাশে বসতেই ধ্রুব তুলতুলকে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন। তুলতুলের গালে চুমু দিয়ে আড় চোখের আমার দিকে চেয়ে বললেন-

‘বুঝলে তো মা! আমার তুলতুলকে এখন আমার বললেও কিছু মানুষের শরীর ছ্যাত করে জ্বলে ওঠে।’

‘আপনার মেয়ে আপনার মেয়ে কি? তুলতুলকে কি আপনি একা জন্ম দিয়েছেন না-কি! তুলতুল আমারও মেয়ে।’

ধ্রুবর কথায় বিরক্ত হয়েই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললাম। তৎক্ষনাৎ নিজের কথাতেই লজ্জায় চুপসে গেলাম। মনি মা বুঝলেন আমার অস্বস্তি বোধ তাই তিনি কথা পালটানোর জন্য বললেন-

‘তোরা থাম তো বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করিস না। তুলতুল নিজেই বলবে ও কার মেয়ে।’

আমি মাথা তুলে তাকালাম তাদের দিকে। ধ্রুব মিটমিট করে হাসছেন। ওনার হাসিতে আমি আবারও লজ্জা পেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিলাম। মনি মা তুলতুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হাতে তালি দিয়ে আদুরে গলায় বললেন-

‘দিদা বলো তো তুমি কার মেয়ে? মাম্মা’র নাকি পাপ্পা’র!’

তুলতুল কি বুঝলো জানি না। তবে সে খিলখিল করে হেসে ফেলল। কিন্তু কিছু বলল না। খানিকক্ষণ বাদেই তুলতুল ধ্রুবর কোল থেকে নেমে পুরো ড্রয়িং রুম ঘুরে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে মাম্মা মাম্মা বলে ডাকতে লাগল। আমি তুলতুলকে কোলে নিয়েই বিশ্বজয়ী হাসি দিলাম। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম-

‘দেখলেন তো তুলতুল কার মেয়ে? তাই এখন থেকে আমার আমার করবেন না। হয় আমাদের মেয়ে বলবেন নাহলে কিছুই বলতে পারবেন না।’

ধ্রুব তার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সোফা থেকে উঠে শার্ট ঝাড়া দিয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-

‘পুরো বাড়িটাই আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। প্রতিটা মানুষ আমার বিপক্ষে স্বরযন্ত্র করছে। সবগুলো রাজাকার। আর এই যে তুলতুল পাখি আপনি আবার আমার কাছে কিছু চেয়ে আবদার করলে তখন বোঝাবো এই বিরোধী দল কি কি করতে পারে।’

ধ্রুব তুলতুলের গালে টান দিয়েই রুম চলে গেলেন। মনি মা আর আমি সশব্দে হেসে ফেললাম ধ্রুবর কথা শুনে। তুলতুল আমাদের হাসি দেখে বেশ উৎসাহ পেল। আমার কোল থেকে নেমে চোখ বন্ধ করে খিলখিল করে হাসতে হাসতে লাগল। আধো আধো বুলিতে অস্ফুটস্বরে বলল-

‘লাজাকার.. লাজাকার…’

আমি আর মনি মা দুজনেই বিস্মিত হয়ে তুলতুলকে দেখতে লাগলাম৷ তুলতুল হাতে তালিয়ে লাফাচ্ছে আর ভীষণ আগ্রহ নিয়ে লাজাকার লাজাকার বলছে। তাল হারিয়ে সামনের দিকে উবু হয়ে পরে যাচ্ছে আবারও উঠে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে। হয়তো শব্দটা তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি বিরক্তি নিয়ে মনি মা’কে বললাম-

‘দেখেছো মনি মা তোমার ছেলে এসব কি শিখিয়ে গেল?’

মনি মা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললেন-

‘তোরা সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বি।’

আব্বু আজ সকালেই ব্যবসায়ের কাজে সিলেট গেছে। তাই মনি মা তুলতুলকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। তুলতুলকে মনি মা’র রুমে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আসতে আসতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। রুমে ডুকেই ধ্রুবকে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপতে দেখলাম। আমি সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে আপনমনে চুল আঁচড়াতে লাগলাম। চুল গুলো হাত খোপা করে বিছানার কাছে আসতেই ধ্রুব বললেন-

‘আসুন তুলতুলের আম্মু।’

ধ্রুব বিছানায় শুয়েই এক হাত বাড়িয়ে চোখের ইশারায় আমাকে তার বুকে আসতে বললেন। বাচ্চাদের যেমন করে নিজের কাছে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবেই। আমার কপাল কুচকে এলো। সরু চোখে ওনার দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম-

‘আসুন মানে? কোথায় আসবো?’

‘কোথায় আবার আমার বুকে।’

ধ্রুবর সহজ সরল জবাবে আমার চাহনি আরও তীক্ষ্ণ হলো। বললাম-

‘বুকে কেন?!

ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন গলায় বললেন-

‘আপনি তো কান্না করার জন্য আর ঘুমানোর জন্য আমার বুক শেয়ারে নিয়েছেন তাইনা! তাহলে আসুন ঘুমানোর সময় হয়েছে তো।’

‘আপনি আবারও আমার সাথে মজা করছেন?’

ধ্রুব অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘আপনার সাথে কি আমার মজা করার সম্পর্ক নাকি যে মজা করবো? আসুন আসুন বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যান। অনেক রাত হয়ে গেছে।’

আমি লাইট অফ করে বিছানার একপাশে শুয়ে তিক্ত গলায় বললাম-

‘সারাদিন অনেক সময় পাবেন আমাকে নিয়ে মজা করার জন্য। তাই রাত-বিরেতে এসব ফাজলামো না করে ঘুমান।’

‘ভালো কথা বললেই দোষ।’

ধ্রুব উদাসীন গলায় কথাটা বলে অন্য পাশ ফিরে শুলেন। আমি ওনার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ধ্রুবর বুকে আবিষ্কার করলাম। ওনার বুকে কিভাবে আসলাম! কখন আসলাম! তা আমি কিছুই জানি না। ঘুমের মধ্যে বেশি নাড়াচাড়া করার অভ্যাস কিংবা কারও গায়ে হাত পা তুলে দেওয়ার অভ্যাসও আমার নেই। তাহলে কিভাবে ওনার কাছে এলাম? তাহলে কি ধ্রুব এনেছেন? ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কে এর কোনো উত্তর পেলাম মা। আর কোনো কিছু না ভেবে খুব সাবধানে ওনার হাত ছড়িয়ে উঠে বসলাম। সরু চোখে তাকিয়ে পরোখ করতে লাগলাম ওনাকে। উনি কি ঘুমের মধ্যে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন? আমি নিম্ন স্বরে ওনাকে ডাকলাম। কিন্তু তিনি উঠলেন না। বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আমি ওনার ঘুমের ডিস্টার্ব না করে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় আসতেই বেলি গাছে ফুটন্ত বেলি ফুল দেখে আনন্দে মন ভরে গেল। বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ শুভ্র রঙের ফুল। মুগ্ধতায় আমার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। আবারও ফিরে আসলাম রুমে। ধ্রুবর হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললাম-

‘তুলতুলের আব্বু উঠুন। আপনার বেলি গাছে ফুল ফুটেছে। আসুন না দেখে যান।’

বেশ কিছুক্ষন ডাকার পর ধ্রুব দারুন বিরক্তি নিয়ে উঠে বসেন। চোখ মুখ খিঁচে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘কি শুরু করলেন সকাল সকাল? এভাবে তো তুলতুলও আমাকে ডেকে ওঠায় না।’

আমি কোনো জবাব না দিয়ে ওনার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসলাম। গাছ গুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে আনন্দিত গলায় বললাম-

‘দেখুন আমি আমার দায়িত্ব পূরণ করেছি। গাছের ঠিক মতো যত্ন নিয়েছে আর এখন দেখুন ফুলও ফুটে গেছে।’

ধ্রুব চুপচাপ কিছুক্ষন গাছের দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আড়মোড়া ভেঙে আমার দিকে শীতল চাহনি দিয়ে বললেন-

‘হুম দায়িত্ব নেওয়া শিখেছো এখন শুধু ফুলগুলো সব ভালোবাসা হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। ফুলের স্নিগ্ধতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার পালা সানসাইন।’

চলবে….

[রিচেক করা হয়নি। একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। হয়তো আজকের পর্বটা একটু অগোছালো হয়েছে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here