শেষ রাত পর্ব-৯

0
1868

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘এই যে ভাবি! কেমন আছেন ভাবি?’

পেছন ফিরে আমি মানুষটার দিকে দৃষ্টি স্থির করলাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলাম বাউন্ডুলেপনার এই সদস্যকে। মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন রাফিন ভাই। সাদাফের খুব কাছের ফ্রেন্ড উনি। আমাকে দেখলেই ভাবি ভাবি বলে জান বের করে দেওয়ার উপক্রম হয় তার। ভাবি ডাকতে ডাকতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে তবুও যেন তার মন ভরে না। রাফিন ভাই দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তরল ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘জানেন ভাবি! দু’দিন ধরে ভার্সিটিতে এসে কতবার খুঁজে গেছি আপনাকে! অবশেষে আজ আপনাকে পেয়েই গেলাম।’

আমি ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কড়া বললাম-

‘শুনুন রাফিন ভাই। বার বার আমাকে ভাবি ডাকবেন না। আমি আপনার ভাবি না। মনে থাকে যেন এই কথা।’

রাফিন ভাই আবারও হাসলেন। সহজ গলায় বললেন-

‘আচ্ছা ভাবি মনে থাকবে।’

আমার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে। কিন্তু এতে তার কোনো হেলদোল হলো না। তিনি আগের মতোই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘আপনি এখানে কি করছেন? আপনার তো এখন দেশের বাহিরে বাকি সবার সাথে থাকার কথা।’

রাফিন ভাই মুখ কালো করে বিষন্ন গলায় বললেন-

‘তিন দিন আগেই এসেছি। ওদের সাথে ট্যুর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি ভাবি। সবগুলা শা’লায় এত হাঁটাহাঁটি করতে পারে জানা ছিল না। আমি ওদের সাথে আর একদিন থাকলেই হয়তো মরা লাশ হয়ে ফিরতাম দেশে।’

‘ওহহ আচ্ছা! তা আমাকে খুঁজছিলেন কেন? কোনো দরকার ছিল নাকি এমনি!’

রাফিন ভাই আমার দিকে একটা ধূসর রঙের খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ভাবি, এই যে এটা। সাদাফ এই খাম আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছে। লাভ লেটার লিখেছে হয়তো আপনাকে।’

কথাটা বলেই রাফিন ভাই দুষ্টু হাসি দিলেন। আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম ওনার হাতের খামটার দিকে। এটা কি আদোও লাভ লেটার মনে হচ্ছে? এমন ধুসর কালো খামে কি ভালোবাসার কথা থাকে না-কি বিষন্নতার কথা, মন খারাপের কথা থাকা উচিত!

‘অনু তুই এখানে কি করছিস? জলদি চল ক্লাস শুরু হয়ে গেছে তো।’

আচমকাই সানি আমার কাছে এসে খুব তাড়া দিয়ে কথা গুলো বলে। আমি কিছু বলবো তার আগেই আবারও অস্থির হয়ে বলল-

‘তাড়াতাড়ি চল না ভাই। তোকে নিতে এসে এখন দেখছি আমাকেও বকা খেতে হবে টিচারের কাছে।’

আমি চুপ করে রইলাম৷ একবার সানির দিকে আরেকবার রাফিন ভাইয়ের দিকে তাকালাম। রাফিন ভাই আমার হাত ধূসর রঙের খামটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ভাবি আপনি এখন ক্লাসে যান। আমিও বাসায় চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন ভাবি। আল্লাহ হাফেজ।’

রাফিন ভাই চলে যেতেই সানি আমাকে টেনে ক্লাসের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমি রোবটের মতো সানির সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছি। হাতে এখনো রাফিন ভাইয়ের দেওয়া সেই খাম। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে। অনুভূতিহীন ভাবেই পুরোটা সময় ক্লাসে বসে রইলাম। সানি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে তবে আমার মস্তিষ্ক সেসব কিছুই বুঝতে পারছে না। স্পষ্ট শুনতে পারছি না কারও কোনো কথা। ক্লাস শেষ হতেই ভরদুপুরে ভার্সিটির পাশের আম বাগানে এসে বসলাম। সানিও আমার পিছু পিছু লেগে আছে। একটা সময় দারুণ বিরক্তি নিয়ে বলল-

‘এভাবে চুপ করে আসছিস কেন আসার পর থেকে? আর রাফিন ভাই এখানে কেন এসছিল? কিরে তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? কিছু বল।’

সানি হাল্কা করে আমার গায়ে ধাক্কা দিলো। আমি নেড়েচেড়ে বসলাম। চোখ তুলে শান্ত চাহনিতে তাকালাম সানির দিকে। ওর চোখেমুখে বিরক্তির সুক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠেছে। কপালে সুতীক্ষ্ম ভাঁজও পরেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘সানি আমি একা থাকতে চাচ্ছি। তুই প্লিজ বাসায় চলে যা।’

‘কিন্তু দোস্ত…’

সানির কথার মাঝেই আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে গাঢ় কন্ঠে বললাম-

‘প্লিজ সানি…’

সানি মুখ অন্ধকার করে ফেলল। আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো। মলিন মুখে বলল-

‘আচ্ছা সাবধানে থাকিস। ধ্রুব ভাইকে ফোন করে বলিস তুই এখানে। নাহলে উনি তোকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে যাবেন।’

আমি চোখের ইশারায় সম্মতি জানাতেই সানি চলে গেল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ব্যাগ থেকে ধূসর রঙের খামটা বের করে দেখলাম উপরে খুব সুন্দর করে লেখা ‘অনুপাখি’। লেখাটা দেখেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। ঝাপসা হয়ে এলো আমার দৃষ্টি। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুললাম। ধূসর রঙের চিঠি আর তার সাথে একটা লালচে-হলুদ রঙের ম্যাপল পাতা। আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখলাম পাতাটা। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। চিঠির ভাঁজ খুলতেই সাদা রঙের জেল পেন দিয়ে লেখা হাজারো শব্দ চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। প্রথম দেখাতেই বুঝলাম এগুলো সাদাফের হ্যান্ড রাইটিং। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠি পড়ার সাহস জুগানোর চেষ্টা করলাম।

অনুপাখি,

প্রথম চিঠি লিখলাম তোমাকে আর প্রথমেই ভুল করে ফেললাম, এটাই তো ভাবছো তাই না! তবে জেনে নাও আমি ভুল করি নি। ইচ্ছে করেই তোমার নামের আগে প্রিয় সম্মোধন করিনি। প্রিয় শব্দটা তোমার জন্য না। তুমি তো আমার কাছে প্রিয় থেকেও বেশি কিছু। ছোট্ট একটা শব্দ ‘প্রিয়’। এই শব্দ দিয়ে তোমার গুরুত্বটা ঠিক প্রকাশ করা যাবে না তাই লিখিনি।

কেমন আছো তুমি অনুপাখি? খুব রেগে আছো আমার উপর তাই না! খুব কি অভিমান জমেছে তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকের উপর? ভীষণ ভীষণ ভীষণ অভিমান! না-কি ক্ষুদ্র অভিমান! নিশ্চয়ই সারাক্ষণ মন খারাপ করে বসে থাকো। রাতের বেলা কান্নাকাটি করে মাথা ব্যথা তুলে ঝিম ধরে শুয়ে থাকো। ঠিক বলেছি না আমি! আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হয়৷ তবে আমি খুব স্বার্থপর অনুপাখি। তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকটা খুব বেশিই স্বার্থপর। আমি চাই তুমি আমার উপর রাগ করো। অভিমান করো। আমার জন্য নিজের চোখেরজল বিসর্জন দাও। কেন জানো তো! কারণ মানুষ তো তার উপরেই রাগ,অভিমান করে যাকে সে ভালোবাসে। একটা মানুষ তার জন্যই চোখেরজল ফেলে যাকে সে হারানোর ভয় পায়। যে মানুষটা’কে সে তীব্র ভাবে ভালোবাসে। তোমার রাগ, তোমার অভিমান, তোমার চোখের জল এসব কি প্রমাণ করছে না তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসো? এতে কি প্রমাণ পাচ্ছে না ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক কতটা ভালোবাসাময় হবে?

যাইহোক, খুব শীগ্রই এসে তোমার সামনে হাজির হবো। তোমার রাগ ভাঙাবো। তোমার মনে জমে থাকা অভিমান একটু একটু করে ভালোবাসায় পরিনত করবো। আর কি করা যায় বলো তো! ওহ হ্যাঁ মনে পরেছে। তোমাকে বিয়ে করে খুব খুব খুব শীগ্রই নিজের করে নিবো। আর অপেক্ষা করাবো না তোমাকে অনুপাখি।

ইতি,
তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিক।

পুনশ্চঃ ১.গাছের নিচে বসে চিঠি লিখছিলাম। চিঠির সাথে তোমাকে কি গিফট দেওয়া যায় তা-ই ভাবছিলাম। ঠিক তখনই গাছ থেকে এই পাতাটা ঝরে চিঠির উপর পরলো। তখনই আমি বুঝে ফেললাম পাতাটা তোমার ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল হয়ে পরেছে। ঠিক যেমনটা আমার চোখ ব্যাকুল হয়েছে তোমাকে দেখার জন্য। একটু ভালোবাসা দিয়ে ছুঁয়ে দিও পাতাটাকে। আমি না-হয় ভেবে নিবো তুমি আমাকে স্পর্শ করেছো।

পুনশ্চঃ ২.ভালোবাসি কথাটা কি বলতে হবে? তুমি কি অনুভব করতে পারছো না আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি? আমি জানি তুমি বুঝতে পারছো। অনুভব করতে পারছো তাই না অনুপাখি! আর হ্যাঁ ধূসর রঙের চিঠি পেয়ে মন খারাপ করো না। ভালোবাসা সব সময় রঙিন কাগজেই প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। আমার ভালোবাসার রঙ না হয় ধূসর রঙের-ই হলো। খুব কি ক্ষতি হবে!

চোখ চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম আমি। ভীষণ জ্বালা করছে চোখদুটো। চোখের কার্নিশ বেয়ে অবিরত নোনাজল গড়িয়ে পরছে। অসহনীয় কিছু যন্ত্রণা চোখের পানি হয়ে ঝরে যেতে চাইছে। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। উত্তপ্ত মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো। এই ছোট্ট একটা কাগজ দুমড়েমুচড়ে দিলো আমাকে। এত সুন্দর রঙিন ম্যাপল পাতাটা খুবই বিষাক্ত মনে হলো। যে বিষের একটু ছোঁয়াতেই মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু হলো আমার মন আর আমার ভালোবাসারও। ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল আমার হৃদয়। খুব কি দরকার ছিল এই চিঠি দেওয়ার! খুব কি প্রয়োজন ছিল এই সময় এসে আমাকে আরও দূর্বল করার। আমার ভাঙা হৃদয়ে আরও আঘাত করার?

হঠাৎই আমার ডান কাধে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার কান্নাভেজা ঝাপসা চোখ দুটো দিয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে আমার ডান পাশে। তার ঠোঁটজোড়ায় সহজ সরল হাসি। তার নির্লিপ্ত দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেললাম। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। আবারও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। ধ্রুব আমার পাশে বসলেন। নিঃশব্দে আমার ওড়না নিয়ে মাথায় বড় করে একটা ঘোমটা দিয়ে দিলেন। কিন্তু কেন? আমার কান্না লুকাতে চাইলেন! নাকি আমাকে কান্নার করার সুযোগ করে দিলেন? আমার জানা নেই এর উত্তর।
বেশ খানিকটা সময় পাড় হলো নিরবতায় আর শব্দহীন কান্নায়। নিরবতা ভেঙে প্রথমে ধ্রুবই কথা বললেন। দারুণ শান্ত শীতল গলায় বললেন-

‘তুলতুল কান্না করলেও ওকে আপনার মতোই কিউট লাগে।’

ধ্রুব হাসলে খুব সুন্দর করে। আমি তাকালাম তার হাসির দিকে। কি সুন্দর স্নিগ্ধ সেই হাসি। এই হাসিতে বিষন্নতার কোনো ছোঁয়া নেই। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। ডান হাত আমার দিয়ে বাড়িয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘চলুন এবার যাওয়া যাক।’

আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলাম। ধ্রুব অপেক্ষা করলেন না। উনি নিজে থেকেই আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন।

চলবে…

[রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো লাগে রেসপন্স করবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here