#শেষ_পর্ব_২৭
#অসমাপ্ত_প্রনয়
#মিঃনাহিদ_হাসান
ইন্সপেক্টর আইমান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন_তার চোখের কোণে পানি জমে গেছে..!
পকেট থেকে রুমাল বের করলেন,চোখ মুছে নিলেন..! নিজেকে সামলে নিয়ে, কঠোর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন..! আইনের কাছে মিথ্যা বলাও একটা অপরাধ জানো না_তুমি খু*ন করো নি, কিন্তু নিজেকে খু*নি বলার করার কারণ কী..?
কবীর দেওয়ালের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো_হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু এতো কষ্টের মাঝে হাসা যায় না..! মুখে মলিন হাঁসি নিয়ে_কবীর বলতে শুরু করলো”সেইদিন জানালায় যে ছায়া দেখেছিলাম, তিনি ছিলেন সাইফুল মাস্টার..! তিনি পুরো ঘটনাটা দেখেছেন..! একজন পাগল আমাকে বিশ্বাস করলো, আমি খু*ন করি নাই..!
কিন্তু যাকে আমি ভালোবাসি সে আমাকে বিশ্বাস করলো না,সে আমার কথা রাখলো না..! কথা দিয়েছিলো কখনো ভুল বুঝবে না, ছেড়ে যাবে না..! কিন্তু অবশেষে ভুল বুঝলো..!
গোটা দুনিয়া আমাকে খু*নি বলুক আমার গায়ে লাগবে না_কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষটির মুখে একবার খু*নি কথাটাই আমার কলিজা ছিদ্র করে দিছে,..!
ওইসব বাদ দেও আমি ভালো করে তদন্ত করে দেখছি, তুমি দোষী নও..আর সব ঘটনা শোনার পর আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি..! আশা রাখি তুমি অতি তাড়াতাড়ি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে..!
ইন্সপেক্টর আপনি বলেন আমি নির্দোষ আর যাকে ভালোবাসি তার কাছে আমি অপরাধী..! আপনি আমাকে বাঁচাতে চান_আর ভালোবাসা আমাকে মা”রতে চায়..! আমি মেনে নিয়েছি আমি দোষী, কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া আঘাত গুলো অনেক কষ্ট দেয়,,এই আঘাত মেনে নেওয়া যায় না..!
ইন্সপেক্টর সাহেব আমার ফাঁ*সি চাই, আমি বাঁচতে চাই না, আমার কঠিন শাস্তি চাই, আমি অপরাধী..!
দেখো কবীর আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, জীবনটা খেলনা নয়..! তুমি মাথা ঠান্ডা রাখো, আমি বারেক খন্দকারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি_তার ব্যাপারে আমরা কিছু জানতাম না, এখন তার সাথে দেখা করাটা জরুরি…!
———-
নদীর পাড়ে আনমনে বসে আছে নাফিসা, কাছের মানুষ গুলো আজ তার থেকে হারিয়ে গেছে..! সে একা হয়ে গেছে..! নিজের ভালোবাসা কে সে ভূল বুঝেছে,এই অনুশোচনা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে..! কোন মুখে দাঁড়াবে কবীরের সামনে সেই মুখ তার নেই..!
এই নদীর পাড় তাকে কতো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়,এই জায়গায় কতোদিন কবীরের সাথে কতো গল্প করা হয়েছে,কতো স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলো দুইজন_কিন্তু নিয়তি সবকিছু উল্টা পাল্টা করে দিছে..!
নাফিসা অসহায়ের মতো চোখের জল ফেলছে..!
পিছনে থেকে কারো পায়ের আওয়াজ শুনা গেলো, কেউ এগিয়ে আসছে এইদিকে, নাফিসা চোখের পানি মুছে নিলো..!
মায়া এসে নাফিসার পাশে বসলো,কী ভাবছো এতো..?
নাফিসা কোন উত্তর দিলো না, চুপচাপ তাকিয়ে আছে নিচের দিকে..!
মায়া বলতে শুরু করলো, আমার সেইদিন ভুল হয়েছিল_কবীরের হাতে কাঁচের টুকরো দেখে আমি ঘাবড়ে যাই, পরিস্থিতি এমন ছিলো_আমি বলতে বাধ্য হয়েছি কবীর খু*নি…!
আপু দোষ তো আমারো আছে, আমি কীভাবে ওকে ভুল বুঝতে পারলাম.. ছিঃ” নিজের উপরে অনেক রাগ হচ্ছে..!
যা হবার হয়ে গেছে এখন বাড়িতে চলো, আমার কবীরের সাথে দেখা করতে যাবো..!
আপু সত্যি যাইবা তো..?
হুম সত্যি যাবো_এখন ঘরে চল..!
নাফিসা খুশি মনে বাড়িতে চলে গেলো, কতোদিন পর আবার দেখা হবে, আবার কথা হবে…!
———-
চার দেয়ালের মাঝে বন্দী কবীর..! কেমন অস্থির লাগছে..! বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে গেছে,আর ইচ্ছে করে না স্বপ্ন দেখতে..! গত কিছুদিন থেকে লোনা পানির সমুদ্রে ভেসে আছি..! প্রতিটা মূহুর্তে দুই চোখে আষাঢ়ের বৃষ্টি..
মনকে এতো বলি ভাবিস না কারো কথা, চোখকে এতো বলি ফেলিস অযথা লোনা জল..! কেউ কথা শুনে না আমার কেউ না…!
চোখ অবাধ্যের মতো জল ঝড়ায়_মন বেহায়ার মতো তার কথা ভাবে..! আচ্ছা সেও কী ভাবে আমার কথা..
সেও কী আমার জন্য ছটফট করে…! না না ও ক্যান আমাকে মনে করবে_ও ইচ্ছা করেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আমাকে অপরাধী ঘোষণা করছে..!
হঠাৎ কবীর মাথা তুলে সামনে তাঁকালো,দেখলো নাফিসা দাঁড়িয়ে আছে..! কবীর বলতে লাগলো_হায়রে আমার কপাল সারাদিন ভাবনায় বসে থাকো, এখন হ্নিদয় পোড়াতে আবার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছো.. আজকাল আমি মনে হয় একটু ভুলভাল দেখা শুরু করছি..!
নাফিসা বললো ভুল নয়, তুমি ঠিকই দেখছো আমি এসেছি..!
আমার বিশ্বাস হইতাছে না তুমি আইছো, আমি কী জেগে আছি_নাকি স্বপ্ন দেখাছি নাকি..? কবীর নিজের শরীরের চিমটি কাটলো,উফ ব্যাথা তো লাগছে_ তাহলে নাফু তুমি সত্যি আইছো এই খু*নিকে দেখতে..!
নাফিসা কবীরের মুখ চেপে ধরলো, তুমি খু*নি নও…
আমাকে মাফ করে দাও_আমি তোমাকে ভুল বুঝছি..!
কবীর মুখ ঘুরিয়ে নিলো, একটা কথা সবসময় মনে রাখবা অনেক সময় চোখের দেখা সত্যি হয় না, আমরা যা ভাবি সেটা ঘটে না..! তুমি কেমনে পারলা আমাকে খু*নি বলতে..! যখন মনে পড়ে তুমি আমাকে খু*নি বলছো, আমাকে দোষারোপ করছো_জানো আমার খুব কষ্ট লাগে, বুকের বাম পাশে অনেক ব্যাথা করে..!
নাফিসা কান্না করতেছে, কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছে না..!
আরেহ তুমি কান্না করতাছো ক্যান_তোমার চোখের পানি কিন্তু আমি সহ্য করতে পারি না..!
কবীর এগিয়ে আসলো নাফিসার চোখের পানি মুছে দিলো..!
নাফু আমার অনেক ইচ্ছা করতাছে তোমাকে একটু বুকে জড়িয়ে এই বুকের কষ্টের আগুন গুলো নিভাতে, কিন্তু আমি তো পাখির মতো এই খাঁচায় বন্দী,আর আমার ইচ্ছা গুলোও বন্দি..!
তোমাকে দেখলে ইচ্ছে করে হাজার বছর বাঁচতে_ইচ্ছা করে রঙিন স্বপ্ন সাজাতে, আশা জাগে তোমার চোখের খাদে পড়ে থাকতে..! তোমার ওই মায়াবী চোখে জল মানায় না_ওই মায়াবতী তোমার মায়ায় জালে আমি এমন ভাবে আটকে গেছি, তুমি আমাকে না চাইলেও আমি ছাড়বো না তোমার পিছু…!
————
ইন্সপেক্টর আইমান এগিয়ে আসলেন, বললেন কবীর তোমার জামিন হয়ে গেছে.. তুমি নাফিসা ম্যাডামের সাথে যেতে পারো.. তোমার জন্য রইলো প্রাণ ভরা শুভেচ্ছা..!
আমি বারেক খন্দকারের সাথে দেখা করেছি, তিনি সবকিছু স্বীকার করছেন, তার দেওয়া ইনফরমেশন অনুযায়ী ধরা পড়েছে অনেক মাদক ব্যবসায়ী.. ধরা হয়েছে অনেক পতিতালয়ের মালিকদের..! মুক্ত করা হয়েছে অনেক অসহায় মেয়েদের…!
আমাদের ফোর্স কাজ করে যাচ্ছে_আশা করছি অতি তাড়াতাড়ি আমরা পুরো চক্রকে ধরে ফেলবো,আমাদের সমাজকে দেশকে মুক্ত করবো মাদকের করাল গ্রাস থেকে.,..!
আর সকল প্রকার অবৈধ কর্মকান্ড থেকে.. তুমি এখন যেতে পারে…!
————
বাতাস বইছে কবীর নাফিসা দাঁড়িয়ে আছে সেই চিরচেনা নদীর পাড়ে..!
এই কয়দিন কী আমাকে মনে পড়ে নাই, আমার কথা ভাবো নাই_তুমি ছটফট করো নাই আমার মতো..?
নাফিসা কবীরকে জড়িয়ে ধরলো_কান্না ভেজা কন্ঠে বললো_ আমি বোঝাতে পারবো না, তোমাকে ছাড়া আমার প্রতিটা দিন কিভাবে কাটছে, বিরহের কী নিদারুণ কষ্ট সেটা আমাকে এই কয়দিন কুড়ে কুড়ে খেয়েছে..! তুমি ছাড়া এই জীবন শুকনো মরুভূমির মতো..! অনেক ভালোবাসি তোমায়, প্রতিটা নিঃশ্বাসে তোমাকে অনুভব করি..! তুমি আমার হাত ধরে রাখবা তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত..?
নাফু আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি বলে বুঝাতে পারবো না, তোমার বিরহের আগুন এই বুকের ভেতর টা মূহুর্তে পুড়িয়ে কয়লা স্তুপ বানিয়ে দেয়..!
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি তোমাকে পাশে চাই..! জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তোমার কোলে মাথা রেখে এই দুনিয়া ছেড়ে যেতে চাই..! আমি তোমার সাথের প্রতিটা ভোরে শিশির ভেজা ঘাসে হাঁটতে চাই..!
আমি আজকেই তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে হারিয়ে যেতে চাই_যেতে চাই দূর অজানায়.. তুমি কি যাবে আমার সাথে..!
হুম যাবো,চলে যাই এই নরক পুরী থাইকা…!
আজকে রাতেই যাবো, বাড়িতে যাও সবকিছু গুছিয়ে এসো, মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে এসো…
নাফিসা বাড়িতে এসে সবকিছু গোছানো শুরু করে..মন আজকে অনেক খুশি, অবশেষে জীবনে বসন্ত আসতে চলেছে…!
—-
কবীর কে বাড়ির আঙ্গিনায় দেখে বায়জিদ এগিয়ে আসলো,বায়জিদের চোখে মুখে আনন্দের হাসি..! জরিয়ে ধরে চোখে পানি ছেড়ে দিলো..!
কবীর বললো,সব গুছিয়ে নেও, এখন সময় এসেছে যাবার..! এই গ্রাম থেকে এবার বিদায় নেবার পালা…!
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, কিছু সময়ের মধ্যে অন্ধকার পৃথিবীকে ঘিরে নিলো..! আজকে আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে..! অনেক তারার মেলা বসেছে..!
বায়জিদ দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে, চিরচেনা এই গ্রাম আজ ছেড়ে যেতে হচ্ছে,আর হবে নাকি এই ঘাটে ফেরা সেটা অজানা_নিজের দুঃখের জীবন নতুন করে সাজাতে অনেক আশা বুকে নিয়ে এসেছিলাম এই গ্রামে, এখন আবার নতুন সুখের আশায় ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই গ্রাম…!
কবীর নাফিসাকে নিয়ে আসলো, ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে..!
ভাই মাঝি কোই..?
বায়জিদ বললো, নতুন জীবন শুরু করতে যাইতাছো, নতুন জায়গায় যাইতাছো, ইচ্ছা হলো তোমাদের এই সুখের সময়ে,মাঝি হয়ে আমি তোমাদের স্বপ্নের ঠিকানায় নিয়ে যাই..! আমিও ভাগিদার হতে চাই এই আনন্দের..! আমি কী আজ তোমাদের মাঝি হতে পারি..?
নাফিসা মুচকি হেসে বললো,জ্বি ভাইয়া..! আমাদের কোন আপত্তি নাই…!
তাহলে উঠে পড়ো নৌকায়_যাইতে হইবো তো..?
কবীর নাফিসা নৌকায় উঠে পড়লো..! বায়জিদ মাঝি হয়ে নৌকা চালাতে শুরু করলো..!
নৌকা যখন মাঝ নদীতে, নাফিসা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,দেখো আকাশের তারা গুলো কেমন ঝলমল করছে, দুইটা তারা পাশাপাশি একটু বেশি আলো ছড়াচ্ছে..!
কবীর নাফিসার হাত ধরে বললো,ওই দুটো তারার মাঝে আমি নাহিদ মীমকে দেখতে পাচ্ছি..!
ওইপাড়ে মনে হয় ওরা মিলে গেছে..! কিছু ভালোবাসা এই পাড়ে পূর্ণতা পায় না..! হয়তোবা ওইপাড়ে পূর্ণতা পায় কিছু অসমাপ্ত ভালোবাসা..! বাগানের সব কলি ফুল হয়ে ফুটতে পারে না..! তেমনি মায়াময় এই পৃথিবীতে থেকেই যায় কিছু অসমাপ্ত প্রনয়…!
(সমাপ্ত)
এতো দূর যখন কষ্ট করে পড়েই ফেলছেন_গল্প সম্পর্কে আপানার ছোট একটা মতামত/ রিভিউ এর আশায় রইলাম 😊🖤