শেহজাদী পর্ব-২৩

0
677

#শেহজাদী
Part–23
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আকাশে ঘন কালো মেঘ ভেলার ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। থেকে থেকে অলস ভঙ্গিতে মেঘগুলো দূর আকাশে হারিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে উদাসীনতার হাতছানি। মৃদ্যু মসৃণ বাতাসের জন্য শীত শীত লাগছে। বৃষ্টি থামার পর পর পরিবেশে যেই মাটি-মাটি গন্ধ পাওয়া যায় সেই রকম গন্ধ মিরার নাকে এসে লাগলো। এই গন্ধটা শুনলেই তার বমি বমি পায়।

শাড়ির অবাধ্য আঁচলটা বড্ড জ্বালাতন করছে তাকে। বেয়াদব চুলগুলো এলোমেলো হয়ে দিক-নির্দেশনা ভুলে উড়াউড়ি করছে৷ মিরার মন চাচ্ছে, সামনে কাঁচি পেলে খ্যাঁচ করে চুলের গাছি কেটে দিবে। শাড়িটা জর্জেটের হওয়ায় পানি পেয়ে কেমন চুপসে গিয়ে শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। এইজন্যও বিরক্তির শেষ নেই মিরার। তার উপর শীতল বাতাসে তার ঠাণ্ডা করছে। এই বুঝি জ্বর চলে আসে। থেকে থেকে ঈষৎ কাঁপছেও সে। ইমান হাঁটা থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মিরা তবুও থামলো না। সে ইমানকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে ধরলে, কেউ তার বাহু ধরে হ্যাচকা টান মেরে পেছেনের দিকে দু কদম পিছিয়ে আনলো৷

মিরা চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে, চোর! চোর!

ইমান থমথমে খেয়ে বলে, চোর? চোর কোথায়? কোথায় চোর? আর কি চুরি করলো? হু?

মিরা এক চোখ খুলে ইমানকে দেখে নিল। এবার সে বুঝলো তাকে টান মেরে পেছনে জনাবই এনেছেন, কোন চোর নয়। এবারে সে দুই চোখ টান টান করে খুলতেই ইমান আবারো বলে, চোর কি চুরি করলো? আর চোরকে আমি কেন দেখলাম না?

মিরা ফিসফিস করে বলে, চোর আমার মন চুরি করেছে।

— কি বললে? আরেকটু জোরে বল?

তখনই অনেক জোরে বজ্রপাত হলো। মিরা কেঁপে উঠল। আর ঠোঁট গোল করে চিৎকার দিলো।

ইমান বলে উঠে, ভয় পেলে নাকি?

— না। আমি তেলাপোকা ছাড়া আর কিছুই ভয় পাই না।

ইমান একদণ্ড চুপ থেকে বলে, তাহলে চেচালে কেন?

মিরা মাথা চুলকে বলে, ভয়েস ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে দেখলাম। সত্যি বলছি আমি কোনকিছুতেই ভয় পাই না।

–ভুতকেও না?

মিরা মাথা নাঁচিয়ে বলে উঠে, না। একদমই ভয় পাইনা।

ইমান ভ্রু নাঁচিয়ে বলে, তাই? আগে না ভুত ভয় পাইতে? ভুতের মুভি দেখলে ভয়ে বাথরুমে যেতে পারতে না। তোমার জন্য আমাদের মুভি নাইট স্পয়েল হতো।

মিরা মুখ গোমড়া করে বলে, আগে ছোট ছিলাম।

— এখন বড় হয়ে গেছো?

— হ্যাঁ।

কথা শেষ করেই মিরা আবারো হাঁটা ধরলে ইমান তড়িঘড়ি করে তাকে আটকে দিয়ে বলে, যাও কই?

মিরা উত্তর দিলো, কেন হোটেলে ফিরে যাচ্ছি।

ইমান অপরাধী সুরে বলে, আমার মনে হচ্ছে উই আর অন রং রুট!

মিরা হতভম্ব হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে, কিহ! এ কোন বিপদে পড়লাম। এখন কি করব? আল্লাহ!

ইমান কাচুমাচু করে বলে, তোমার কথা শোনা উচিত ছিল।

মিরা অসহায় চোখে বলে, এখন কি করব?

— জানি না।

— কাউকে ফোন দিন না!

— আমি সঙ্গে ফোন আনিনি। তোমার ফোন কই?

— আমার ফোনের চার্জ ছিল না জন্য হোটেল রুমে চার্জে লাগিয়েছিলাম।

ইমান বললো, কি মহা বিপদে পড়লাম!

মিরা আর ইমান চুপচাপ ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। কারো মুখে কথা নেই। মিরাই শুধু বার কয়েক চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে আর একটু একটু লজ্জাও পেতে লাগে৷

প্রায় দশ-বারো মিনিট পর ইমান নিরবতা ভেঙে হালকা উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠে, শুনতে পেয়েছো কিছু?

মিরা কান সজাগ করে বলে, নাতো। কি শুনব?

— মনোযোগ দিয়ে শুনো।

কথাটা বলার সময় ইমানের হাত দুটো বুক বরাবর চলে গিয়ে ডান হাত, বাম হাতের উপর রেখে দিল।

মিরা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলেও কিছুই শুনতে পেল না তাই হতাশ হয়ে গেল।

ইমান বলে, দূরে কোথাও লতা মাংয়েশকারের পুরনো গান ভেসে আসছে।

মিরা আড়ি পেতে শোনাত চেষ্টা করেও কিছুই শুনতে পেল না।

ইমানের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হলো। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, তার মানে আশেপাশে জনমানব আছে। সম্ভবত কোন চায়ের দোকান থেকে রেডিওতে করে গান বাজছে। চল সামনে এগিয়ে ওদের কাছ থেকে সাহায্য নিই।

–চলুন৷ কিন্তু,,,,

— আবার কি?

— ওরা যদি ছেলেধরা হয়? আমাকে আর আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাচার করে দিলে কি হবে?

মিরা ছেলেমানুষী চিন্তায় ইমান বিচলিত হলোনা। সে সামনে আগাল। মিরার মন সায় দিচ্ছে না। কি দরকার আগ বাড়িয়ে বিপদের কাছে যাওয়ার? সত্যি সত্যি যদি তাদেরকে দশ লাখ টাকায় বাইরের দেশে বেচে দেয়?

ইমান সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। একা থাকতে তার ভীষণ ভয় করছে বিধায় ফের হাঁটা ধরলো। মিরা জানে ইমান তার সঙ্গে থাকলে তার উপর বিপদ আসবে না। এটা ভরসাটা তার উপর আছে তার!

সত্যি সত্যি পাঁচ মিনিটের পর একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। সেখানে দোকানদার সহ তিনজন বসে আছেন। বৃষ্টি জন্য বসে আছে সম্ভবত।

ইমান আর মিরা দোকানের সামনে যেতেই একটা অবাক-কর বিষয় ঘটলো। রেডিওতে ইমানের ছয় বছর আগের অডিও রেকর্ডিং শুরু হলো। ইমান হচকচিয়ে উঠে। ছয় বছর ধরে আর রেডিও সো কন্টিনিউ করেনা সে। এ যুগে কেউ আর শুনেও না রেডিও! আজ হঠাৎ এতোদিন পর নিজের ভয়েস শুনে ভেতরে ভেতরে চরম চমকে উঠে সে। মিরাও অবাক হলো।

ইমান দোকানদারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভাই, এখান থেকে মেইনরোড কত দূর?

দোকানদার বিরস মুখে বলে, মেলা দূর।

ইমান বলে, দুই কাপ চা দেন তো।

এরপর চেয়ারে বসে থাকা এক লোকের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাই? আশেপাশে কোন গ্রাম আছে?

— এখান থেকেই তো গ্রাম শুরু।

— ও। হাইওয়ে যেতে কতোক্ষণ লাগবে?

— ঘন্টা খানেক। আজকে আর ওইদিকে যাইয়েন না। আবহাওয়া ভালো না।

এরপর উঁকিঝুঁকি মেরে বলে, মাইয়া মানুষ নিয়ে ওতোদূর যাওয়ার দরকার কি?রাত অনেক হইছে৷

ইমান হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পাশে থাকা একজন বলে উঠে, এই ভাই! আপনার গলার আওয়াজ তো একদম রেডিওর ওই ছেলেটার মতো শুনতে।

ইমান মৃদ্যু হাসলো। মিরা পেছন থেকে সামনে এসে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলে, আরে উনিই তো আরজে ইমান! আপনারা ওনাকে চেনেন না? ওনাকে তো সব্বাই চেনে।

দোকানদারের এবার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সে বলে, আপনি সত্যি আরজে ইমান?

— জি।

— আমি আপনার অনেক বড় ভক্ত ভাই!

ইমান হালকা হেসে বলে, ধন্যবাদ ভাইয়া।

— দাঁড়ায় আছেন কেন? ভাবীকে নিয়ে বসেন।

ইমান অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। ভাবী কে? তার তো বিয়েই হয়নি? নিশ্চয়ই মিরাকে তার স্ত্রী ভাবছে। এতো রাতে বৌ ছাড়া ভদ্রঘরের ছেলেরা বের হয় না!

সে বসে পড়লো ধপ করে। তাকে অনুসরণ করে মিরাও বসে পড়ে৷

লোকটা নিজ গরজে চা আর বিস্কুট দিয়ে বলে, ভাইয়ের কি কোন অসুবিধা হইছে?

ইমান চা হাতে নিয়ে বলে, আসলে এদিকে ঘুরতে এসেছিলাম। এরপর ভুলবশত আমরা রাস্তা দাঁড়িয়ে ফেলেছি। হোটেলে ফিরে যাওয়ায় রাস্তা খুজে পাচ্ছি না।

— খুব বড় বিপদে পড়েছেন দেখছি৷

ইমান কিছু বললো না। তার চোখ গেল পাশে বসা রমণীর দিকে। মেয়েটা বুঝি চা আর বিস্কুট বেশ উপভোগ করছে। ঠোঁট টিপে হাসছে আর আয়েশ করে চা খাচ্ছে। মিরাকে দেখতে মোহনীয় লাগছে৷ তার চেহারায় বিন্দুমাত্র চিন্তার রেশ নেই।

দোকানদার বলে, ভাই আমার নাম রাব্বী। পাশের গ্রামেই বাসা। আপনি চাইলে আমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রামে যেতে পারেন৷ আজকের রাতটা পার করে কালকে সকালে হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা দেন। আজকে রাতে বের না হওয়াই ভালো না। হাইওয়ের রাস্তায় রাত বারোটার পর ছিনতাই, ডাকাতি হয়। তার উপর আজকে বৃষ্টি।

ইমান ভারী চিন্তায় পড়ে গেলো। অপরিচিত কারো বাসায় যাওয়া কতখানি উচিত কাজ?
আর না গিয়েও বা উপায় কি? কি মুশকিল! সে একা হলে ব্যাপার ছিল না। সঙ্গে এক অতিমাত্রায় সুন্দরী মেয়ে আছে। তাকে নিয়েই সব চিন্তা।

সুন্দরী মেয়ে নিয়ে বের হওয়া ভারী ঝামেলার কাজ তো!

ইমান মিরার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, এই! কি করব? ওদের সঙ্গে গ্রামে যাব নাকি ফিরে যাব হাইওয়ের দিকে?

ইমানকে রাগিয়ে দিয়ে মিরা বলে উঠে, আমাকে আরো দুটো বিস্কুট দিতে বলুন না! বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে৷

ইমানের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল মিরাকে একটা ধমক দিতে কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে নিজের ইচ্ছা দমিয়ে বলে, ভাই? আপনাদের সমস্যা হবে আমরা গেলে? আমাদের সঙ্গে থাকলে?

— কি যে বলেন না! আমার মাও আপনার গ্রেট ভক্ত। আপনি গেলে মুরগি জবাই করে রান্না বসাবে৷

মিরা চায়ের কাপ রেখে বলে, আপনাদের মুরগি আছে?

— হ্যাঁ ভাবী।

মিরার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হলো। তার ছোট ছোট মুরগির বাচ্চা খুব পছন্দ।

রাত এগারপ্টা নাগাদ রাব্বির সঙ্গে ইমান মিরা তার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা হলো। মিরাকে।চিন্তিত দেখা না গেলেও ইমানকে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।

চলবে।

[ আসসালামু আলাইকুম। অনেকেই জানেন যে আমি অসুস্থ। কালকে একটু সুস্থ বোধ করছিলাম বিধায় গল্প দিয়েছিলাম কিন্তু আজকে আবারো অসুস্থ বোধ হচ্ছে তাও গল্প দিলাম। কালকে দিব কি দিবা সেটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে!ভালোবাসা অবিরাম। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here