মেয়েটার পেটে শাণিত খড়গের চোট। সেই চোটের স্থান থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। কারণ সে এখন মরুভূমির মতো একটা স্থানে আছে। চারপাশে শুধু বালি আর বালি। বাতাস বয়ে চলেছে তার নিজ রুপ পরিবর্তন করে। বাতাস তার গতি বাড়িয়েছে কিছুসময় হলো। মেয়েটা বালির উপর শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর চিৎকার করে চলেছে। এই চিৎকারের ফলে কম্পিত হচ্ছে পুরো মরুভূমির মতো স্থানটা।
হঠাৎ একটা ছেলের হাত বালির নিচ থেকে বেড়িয়ে এল, পেটে চোট পাওয়া মেয়েটার থেকে ঠিক কয়েক হাত দূরে। ছেলেটা সেই হাত দিয়ে বালি সরানোর প্রয়াস করে চলেছে। এক সময় তার মাথাটা বালির উপরে আনতে সক্ষম হলো। আশে-পাশে তাকিয়ে লক্ষ করল তার সামনে কোনো মেয়ে বালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভালো করে চোখে বুলিয়ে বুঝতে পারল হয়তো কিছু একটা হয়েছে মেয়েটার, যে কারণে– নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে ওখানে। মেয়েটাকে ওভাবে দেখে একটা মায়া জন্ম নিল ছেলেটার মনে। সে আরো লক্ষ করল, তার পুরো শরীর বালির নিচে এখনো। কোনো উপায় না দেখে ছেলেটা বালি সরাতে লাগল এক হাত দিয়েই। সমস্থ শক্তি লাগিয়ে সে একই কাজ করছে কিন্তু কিছুতেই এগোতে পারছে না যেন। কিছু সময় পর বুঝতে পারল তার মাথার পিছনে ভারী কিছুর আঘাতের অনুভূতি। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল।
চোখ খুলল সেই ছেলেটা। চোখের সামনে ঝাপসা দেখছে সব। সূর্যের কিরণ সোজাসুজি ছেলেটার চোখে এসে পড়ছে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ঠিকমতো চোখের পাতা মেলে তাকাল সে। এবার স্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। সে বালুর উপরে আছে আর তার সামনে মেয়েটা পড়ে আছে। মেয়েটার মুখ দেখা বোঝা যাচ্ছে না। সারা মুখ বালি জড়িয়ে ঢেকে গেছে। কিন্তু চারদিকে রক্তের ছড়াছড়ি। মেয়েটা হয়তো আর বেঁচে নেই বলেই ধারণা করল সে। প্রাণভোমরা বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে মেয়েটার। ছেলেটা মেয়েটার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতে গিয়েও পারল না। মনে হচ্ছে তার শরীরে শক্তি নেই৷ একটুকুও শক্তি নেই। অবশ হয়ে গেছে সারা শরীর।
অপর দিকে হঠাৎ মেয়েটার এক হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা গেল ছেলেটার দিকে। তার মানে মেয়েটা এখনো জীবিত আছে। ছেলেটা তার সমস্ত শক্তি ডান হাত সঞ্চারিত করে ব্যর্থ হলো। তবে চেষ্টা ছাড়ার ক্ষেত্রে নাছোড়বান্দা সে। কিন্তু তবুও সফল হচ্ছে না। ছেলেটার বহু চেষ্টার পর ডান হাত বাড়িয়ে দিতে সক্ষম মেয়েটার বাড়ানো হাতটার দিকে। ছেলেটা হাত বাড়াতে বাড়াতে মেয়েটার হাতের একদম কাছে ছেলেটার হাত চলে এসেছে। ছেলেটার হাত মেয়েটার হাতে স্পর্শ করা থেকে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরে মাত্র। ছেলেটা আবার শক্তি প্রয়োগ করল তার হাতে। একটু উপরে উঠিয়ে নিতে সক্ষম হলো ডান হাতটা। নিচে নামালেই মেয়েটার হাত আঁকড়ে ধরতে পারবে সে।
নিচে হাত ফেলতে যাবে এমন সময় ঘুম ভাঙল একটা ডাকে, “শুভ্র, ও শুভ্র।”
ঘুম ভাঙ্গল শুভ্রের। এতক্ষণ স্বপ্ন অবলোকন করছিল সে। ঘুম ভাঙ্গল তার মায়ের কন্ঠে। চোখ মেলে তাকাতেই শুভ্রর মা বলে উঠলেন, “ঘুম থেকে ওঠ বাপ। বেলা অনেক হয়েছে। মাঠে যেতে হবে। তোর বাপ ফসলের জমিতে গেছে। গিয়ে তোর বাপকে সাহায্য করে আমাকে উদ্ধার কর। নইলে বাড়িতে এসে চেঁচিয়ে বাড়ির সব এক করে ফেলবে তোর বাপ।”
শুভ্রর নিজের শরীরকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বসে পড়ল। তার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। সে এই স্বপ্নটা প্রায়ই অবলোকন করে। সবসময় একই পরিস্থিতি হয়। যখনি সে মেয়েটার হস্ত স্পর্শ করবে তখনি তার ঘুম ভাঙ্গবে, না হলে কেউ ভাঙ্গিয়ে দেবে।
শুভ্র নিজেকে সামলে ঘুম কাতর কন্ঠে বলল, “এরকম কোরো না তো মা। আমি মাঠে যেতে পারব না। এসব হয় না আমার দ্বারা।”
ছেলের কাছে এসে বসে পড়ে মা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “চাষ না করলে হবে? আমাদের এটা ছাড়া উপায় নাই কোনো। করতেই হবে। না করলে খাবি কী? তোর বাপের শরীরও আজকাল ভালো যাচ্ছে না। তুই না জানলে, শিখলে সংসারের হাল কীভাবে ধরবি? এখন তুই কথা না বাড়িয়ে খাবার দিচ্ছি, হাত-মুখ ধূয়ে এসে খেয়ে জমিতে যা, বাপ।”
শুভ্র হার মেনে নিল মায়ের আবেগি কথায়। বলল, “তোমার সাথে কথায় পারব না। খেতে দাও। আসছি বাহির থেকে।”
শুভ্র বিছানা থেকে নেমে বাহিরে চলে গেল। শুভ্রের মা নিজের ছেলের বাহিরে চলে যাওয়া দেখলেন কয়েকপলক। তারপর উঠে গেলেন খাবার আনতে।
★
রেডফোড গ্রাম। এই গ্রামটা আসলে কোথায় অবস্থিত কেউ জানে না। পৃথিবীতেও হতে পারে আবার হতে পারে এর বাহিরের কোনো জগতের। কেউ এই গ্রামে দূর থেকে এখনো আসেনি, না এই গ্রামের কেউ এখান থেকে বাহিরে গেছে। হতে পারে এটা পৃথিবী থেকে আলাদা একটা গ্রাম হওয়ায় কেউ আসতে পারেনি অথবা কেউ যাওয়ার সাহস করেনি। এই গ্রামে ৬৬৬ জন মানুষ বসবাস করে। অদ্ভুত তাই না! এখানে কেউ মরলেই তবে একজনের জন্ম হয়। এখানকার নিয়মও পৃথিবীর সকল নিয়ম থেকে আলাদা। এই গ্রামেই ভালোমন্দ সবই সমান৷ জীবনের জন্য সব ঠিক। গ্রামের বাড়িগুলো একটা অন্যটা থেকে খুব একটা দূরে নয়। তবে, বাড়িগুলো সব মাটির তৈরি। উপরে ছাদের জন্য বিশেষ কোনো বস্তু ব্যবহৃত হয়েছে। এই গ্রামের সবাই একে অন্যকে খুব ভালো করে চেনে। গ্রামটার চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। দেখে মনে হয়, পাহাড়গুলোই গ্রামটাকে বাঁচাচ্ছে পুরো পৃথিবীতে থেকে। গ্রামের গাছগুলোও অদ্ভুত। গাছের পাতা দুইধরণের। গাছের একদিকে সবুজ পাতা আর একদিকে লাল পাতা। গ্রামের উত্তর দিকে এক বিশাল অরণ্য। আর তিন দিকে আবাদি ফসলি জমি। সেখানে বিভিন্ন ফসল চাষ করেই জীবিকা নির্ধারণ করে মানুষগুলো। মাংস আর ফলমূলের জন্য তো অরণ্য আছেই। অরণ্যকে তারা মা মনে করে পূজো করে।
এই অদ্ভুত গ্রামের ছেলে শুভ্র। শুভ্রের ফসল ফলাতে ভালো লাগে না। ও মাঝে মাঝেই চলে যায় অরণ্যের গহীনে এক নীরব স্থানে। সেখানে বসে গান গায়। সে নিজে গান বানায় আবার সেই গান গেয়ে বেড়ায়। তার গানের কোনো মানুষ স্রোতা নেই। সেই কাউকে শোনায় না। তবে পুরো অরণ্য খুব মন দিয়ে তা শোনে। শোনে অরণ্যের সব পশুপাখিও। ভীড় জমে যায় তার সামনে পশুপাখির। এতো সুমধুর কন্ঠ শুভ্রের। না শুনে উপায় আছে। সে গান গাইতে শুরু করলে পুরো অরণ্য নিস্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে। যেন শুভ্রের গানের অপেক্ষাতেই থাকে পুরো অরণ্য।
শুভ্র খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি থেকে বের হতেই একে একে সামনে যাকে পাচ্ছে তার সাথে হাসি মুখে কুশল বিনিময় করে যাচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে মনের অবস্থাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। স্বপ্নটাকে তাকে আজ-কাল খুব বেশি তাড়া করছে। ফসলের জমির দিকে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই। বাবার রাগ সহ্য হয় না তার। ফসলের জমির পথ এখনো কিছুটা বাকি। হঠাৎ কেউ একজন পেছন থেকে কিছু একটা ঠেকালো পিঠে। শুভ্রের পিঠে খোঁচা লাগা মাত্রই সে বুঝতে পারল এটা কোনো সূক্ষ্ম সূঁচ জাতীয় বস্তু। খড়গ না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই গ্রামে তার পিঠে খড়গ ধরার মতো সাহস তো কারোর হবার কথা নয়। সে নিরুপায় হয়ে দুটো হাত উপরের দিকে তুলে ভাবতে লাগল– তাহলে কে ধরল? সে কী তার ক্ষতি করতে এসেছে? তাহলে এটা তো গ্রামের নিয়মের খেলাপ! তার ক্ষতি করার মতো সাধ্য এখনো এখানকার বলিষ্ঠ যোদ্ধাদেরও হয়নি। তাহলে কে সে?
সূচনা পর্ব
সংসর্গ
ফ্যান্টাসি_গল্প
তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী
(বি:দ্র: বহুদিন পর গল্প লেখায় ফিরলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হলো অবশ্যই জানাবেন।)