সংসর্গ (পর্ব ২)
ফ্যান্টাসি_গল্প
তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী
হাত দুটো উপরেই রেখে পিছনের দিকে ঘুরে তাকাল শুভ্র। চমকে উঠল সে। বলে উঠল, “কিরে তুই! তোর হাতে খড়গ কেন?”
শুভ্রের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ওর বন্ধু নারিস। এই ছোট্ট গ্রামে ওর প্রাণ প্রিয় বন্ধুই এই একজন। নারিস কথা বলতে পারে না। কিন্তু শুভ্র ওর ইশারা ইঙ্গিতের কথা সব বুঝতে পারে। ইশারাতেই কথা বলে শুভ্রও সবসময় নারিসের সাথে। নারিস এখন হাসছে। খড়গ সরিয়ে নিল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে।
শুভ্র আবারও বলতে লাগল সাথে হাত দিয়ে ইশারা যোগ হলো, “তুই এখানে খড়গ হাতে কেন? তোকে কে দিলো এটা?”
নারিস ইশারা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছে। আর সেটা উচ্চারণ করছে শুভ্র, “এটা রুমেল ভাই দিয়েছে। আমাকে সে খড়গ চালানো শেখাবে।”
কথাটা বুঝতে পেরে মাথায় রাগ চেপে বসল শুভ্রের। নারিস কোমল মনের একজন মানুষ। নারিসকে এসব শেখানোর মানে হয় না। তার উপর সে অনেক দূর্বল। কানেও শোনে না।
শুভ্র দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “রাখ তোর খড়গ চালানো শেখা! ফেল ওটা হাত থেকে।” বলেই নারিসের কাছ থেকে টান দিয়ে নিয়ে নিল খড়গটা। আবার বলল, “এসব তোর কাজ না। মনের ভুলেও এগুলো হাতে নিবি না।”
মন খারাপ হয়ে গেল নারিসের। কিছু বলল না সে। শুধু চোখে অশ্রুর আভাস। সেটা জানান দিচ্ছে মন খারাপ হয়ে গেছে তার।
শুভ্র পাশে খেলতে থাকা কয়েকজন ছেলের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে খড়গটা দিয়ে পৌঁছে দিতে বলল রুমেল ভাইয়ের কাছে।
সামনে থাকা নারিসের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ” আরে বোকা মন খারাপ করিস না। তোর খড়গ চালানো লাগবে না। শিখতেও হবে না। তুই এসব শিখে কী করবি? আমাদের এখানে তো আর যুদ্ধ হয় না। ওটা নামে মাত্র। আমাদের এই জায়গাটার বাহিরের জগৎ কেমন তাও জানি না। আদৌও কিছু আছে কিনা, তাও সন্দেহ। বরং আমার সাথে চল অরণ্যে যাই। ঘুরে ফিরে আসি মন ভালো হয়ে যাবে।”
নারিস ডান হাত উঠিয়ে জামার হাত দিয়ে চোখ মুছে নিল। তারপর মুখে হাসি ফুঁটিয়ে ইশারায় বলতে লাগল, “তুই আমাকে কিছুই করতে দিস না তেমন। আমার কিছু করে চলতে হবে। তোর মতো তো আর চাষ করে নিজেদের খাবার যোগার করতে পারি না।”
“আমি থাকতে তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি কী চাষের জমিতে যাই বেশি? যা করেন বাবা করেন। আমার এসব ভালো লাগে না।”
“তোর কী ভালো লাগে তাহলে?”
“জানিসই তো আমার গান গাইতে ইচ্ছে করে। ঘুরতে ইচ্ছে করে। অরণ্যের প্রাণীগুলোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। আর ইচ্ছে করে বাহিরের জগৎটাকে দেখার।”
“বাহিরের জগৎ বলে কিছু আছে নাকি?”
“মন্দিরে একটা কিতাব পেয়েছি। সেখানে অনেক কিছুই জানতে পেরেছি।” কয়েককদম এগিয়ে নারিসের একদম সামনে এসে আবার নিচু স্বরে বলতে লাগল শুভ্র, “দেবী কথনকুপের চরণের নিচে একটা সুড়ঙ্গপথ পেয়েছি গতকাল। সেখানে বহু ধরণের কিতাব আছে। হয়তো এগুলো খুব কাজের বা এমন কিছু আছে এতে যা আমরা জানলে সমস্যার সৃষ্টি ঘটতে পারে। এজন্য হয়তো আমাদের থেকে সম্পূর্ণ লুকায়িত রেখে চলেছেন দেবী।”
নারিস হাসল। ইশারায় বলতে লাগল, “তোর মনে হয় এরকম। তাহলে তো সব জানতে হবে। চল আজকে যাবো ওখানে যাই তাহলে?”
“হ্যাঁ যাবো। এখন না রাতে। পূজারি মন্দির থেকে তার গৃহে ফিরে যাবে তখন ঢুকব লুকিয়ে। এখন চল এখানে না থেকে অরণ্যে যাই। ওখানে গিয়ে সময় কাটিয়ে আসি।”
নারিস কিছু বলল না। দুজনে বেড়িয়ে পড়ল অরণ্যের উদ্দেশ্যে। হাঁটতে হাঁটতে অরণ্যের একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল শুভ্র। তার দেখা দেখি দাঁড়িয়ে পড়ল নারিস-ও। শুভ্র চোখ দুটো বন্ধ করে মনে মনে কিছু একটা আওড়াতে থাকল। তারপর চোখে খুলে বড়ো করে শ্বাস নিয়ে অরণ্যে ভেতর চলে গেল।
অরণ্যের ভেতরে আছে নানাবিধ বড়ো ছোটো গাছ-গাছালি। পা ফেলতে হয় ছোটো ছোটো ঘাস জাতীয় উদ্ভিদগুলোর উপর। সামনে থাকা গাছের ছড়িয়ে থাকা ডালপালা গুলো সরাতে হয়। পশুপাখির আওয়াজ সবসময় ভেসে আসতেই থাকে। মাঝে মাঝে শোনা যায় বড়ো বড়ো প্রাণীদের গর্জন। এই অরণ্যের শেষ অংশে মরুভূমি। সেটা পেরিয়ে গেলেই বিশাল বিশাল পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যে পাহাড় গুলোর ওপাশে কী আছে সেটা কেউ জানে না। কেউ কখনো পাহাড়গুলোর ওপাশে যাওয়ার সাহস করেনি।
এই গ্রামের মানুষজন সহজ-সরল। গ্রামে দেবী কথনকুপের তৈরি করা সকল নিয়ম-কানুনে চলতে হয় সকলকে। একটা কিতাবের মধ্যে দেবী স্বয়ং নিজে সব লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যে দেবীর পূজো তারা করে তার কথার খেলাপ করার সাহস কারোর নেই। তাই অরণ্য পেরিয়ে মরুভূমি পর্যন্ত কেউ গেলেও সেটা পার করে পাহাড় পর্যন্ত যাওয়ার কারো ক্ষমতা হয়নি। তাদের আত্মায় কুলোয়নি। দেবী নারাজ হলে তাদেরি বিপদ হবে। সেটা তারা চায় না। দেবী তাদের সবসময় ভরপেট থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সবসময় তাদের খেয়াল রাখছেন। সেখানে দেবীকে নারাজ করা ঘোর পাপ। এই পাপ কেউ করতে পারবে না আর চায়-ও না।
শুভ্র এই অরণ্যকে খুব ভালোবাসে। নিজের জীবনের থেকেও বেশি। সবসময় এই অরণ্য তাকে আগলে রাখছে। অরণ্যের ভেতরের পশুপাখিও তাকে খুব ভালোবাসায় মাতিয়ে রাখে। তার বিনিময়ে সে শুধু গান শোনায়। এতেই তারা খুশি। শুভ্রের গান গাছের ভেতরের ছোট্ট পোকাটাও শোনে মন দিয়ে। এজন্যই শুভ্র তার গান গাওয়াকে এতো ভালোবাসে। প্রতিদিন একবার এই অরণ্যে না এলে তার মন ভরে না। দিন কিংবা রাত, এই অরণ্যে আসতেই হয়। যেন অরণ্য তাকে ডাকতে থাকে সবসময়।
অরণ্যের গহীনে এক গুহার কাছে এসেছে তারা। গুহার উপরে উঠে বসল ও। ওর পাশে উঠে বসল বন্ধু নারিস। শুভ্র য়েকটা ইচ্ছাকৃত কাশি দিয়ে গলার স্বর ঠিক করে নিল। এরপর একটা গান গাইতে শুরু করল সে।
তার গান গাওয়ার সাথে সাথে অরণ্যের আশে-পাশে ছুটতে থাকা সকল পশুপাখি ছুটে আসতে থাকল। জমা হতে লাগল গুহার সামনে। সব পশুপাখি তাদের চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে শুভ্রের গান শুনছে। কারো মুখ থেকে একটা অতিরিক্ত শব্দ বের হচ্ছে না। এক প্রকার সম্মোহিত হয়ে আছে সব কিছুই। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বইতে লাগল। যেন গানের অনুভূতির দোলা গায়ে লাগাতেই এই বাতাস। উদ্ভিদ থেকে শুরু করে বিশাল বৃক্ষ এমন ভাবে দুলছে, যেন গানের সাথে তাল মেলাচ্ছে। এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হলো সেখানে।
কিছুক্ষণ পর গান থামিয়ে দিলো শুভ্র। গান গাওয়া শেষ হলো। সৃষ্টি হলো আরেক পরিবেশ। পশুপাখি গুলো নানাবিধ আওয়াজ করতে শুরু করল তাদের নিজ কন্ঠে। আবার কেউ হাত তালির মতো করছে। গাছগুলো সামনের দিকে সামন্য ঝুঁকছে আবার সোজা হচ্ছে। বাতাসের পরিমাণ বাড়ছে অনেকটাই৷
এসব দেখে মন ভরে উঠল শুভ্রের। তার বন্ধু নারিস এখনো চুপচাপ, নড়ছেও না।গানের রেশ কাটেনি এখনো।
শুভ্র নারিসকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল, “কীরে কই হারাই গেলি?”
নারিস নড়েচড়ে উঠল। ইশারা বলতে লাগল, “তোর গানের কন্ঠে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই সবসময়। মনে হচ্ছে এখনো গাচ্ছিস।”
“আমি যে গাই সেটা তো শুনতে পারিস না কোনো সময়ই। তাহলে মুগ্ধ হস কীভাবে?”
“আরে না বোকা! তোর কথা বা শব্দ না বুঝতেও পারি। যখন গান গাইতে থাকিস সেটা ঠিকই বুঝতে পারি সবসময়। এটা বার বার বলি। তোর বিশ্বাস হয় না।”
শুভ্র উঠতে যাবে ঠিক তখনি একটা মেয়ে কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসল তাদের কানে। চিৎকারের ফলে অরণ্য কেঁপে উঠল কয়েকবার। ভূমির কম্পনের ফলে কেঁপে উঠল শুভ্র আর নারিস সহ সেখানকার পশুপাখি, গাছগাছালি সব।
শুভ্রের মনে হলো, এই কন্ঠটা তার পরিচিত, খুব পরিচিত!
চলবে…..
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন)