সখি ভালোবাসা কারে কয় পর্ব-১০

0
474

#গল্প
#সখি ভালোবাসা কারে কয়?
পর্ব—-১০
কানিজ ফাতেমা

আম্মু খুশি মনে ব্যাগের চেইনটা খুলে ভেতর থেকে একটা লাল রঙের গহনার বক্স বের করে বক্সটা খুলে বড়খালামনির সামনে ধরে বলল- “বড়আপা তোমাকে বলেছিলাম না নিধির জন্য এক সেট গহনা বানিয়ে রেখেছি। কদিন ধরে তোমাকে দেখাবো দেখাবো ইচ্ছে করছিল।কিন্তু লকার থেকে নিয়ে আসার সময় করেই উঠতে পারিনি।আর নিধির বিয়েও হুট করে হয়ে গেলো। তুমিতো তোমার গায়ের গহনা খুলে আমার নিধিকে পরিয়ে দিয়েছো বিয়ের দিন। আমরা তো কিছুই দেইনি এখনো।”
তাই গতকাল নিধির বাবা গিয়ে ব্যাঙ্কের লকার থেকে গয়নাগুলো এনে আমার হাতে দিয়ে বলল- “মেয়ে যাওয়ার সময় পরিয়ে দিও।আর আবার যখন অনুষ্ঠান হবে তখন আর কিছু দিতে চাইলে গড়িয়ে দিও”।

“এই নাও বড়আপা ধরো আজ তুমিই আমার নিধিকে গহনাগুলো পরিয়ে দাও, আমি দেখি কেমন লাগে আমার মেয়েটাকে” – কথাগুলো বলতে গিয়ে -আবারও নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো আম্মু।
আম্মুর কান্না দেখে আমারও মনটা ভারি হয়ে আসছে। চোখদুটি পানিতে ভরে উঠলেও নিজেকে শক্ত করে সামলে রেখেছি।
কারো সামনে কেঁদে নিজেকে দুর্বল হতে দেবো না বলে।

বড় খালামনি খুশি মনে গহনার বাক্সটা থেকে কন্ঠহারটা নিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দিল। খেয়াল করলাম বড়খালামনিরও আম্মুর কান্না দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। বড়খালামনির সাথে একে একে কানের দুল হাতের বালা পরিয়ে দিল আম্মু। বালা দুটি হাতে পরিয়ে দিয়েই আমার হাতদুটি ধরে বলল- “আমার মেয়ে হয়ে এমন কিছু করবি না যাতে করে সকলের সামনে আমাদের লজ্জায় পড়তে হয়।আর সব সময় বড়খালামনি আর বড়খালুর অনুমতি নিয়ে সব কাজ করবি, বুঝেছিস নিধি”- বলে আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়ানো কন্ঠে বড়খালামনির দিকে তাকিয়ে বলল- বড় আপা আমার মেয়ের সৌভাগ্য তোমার বাড়ির বৌ হয়ে যাচ্ছে। তুমি আমার নিধিকে দেখে রেখো।”

কি শুরু করেছিস নাজমা, আমি কি নিধির কাছে অপরিচিত কেউ। তোর মনে নেই আমার কতদিনের শখ ছিল একটা মেয়ে হোক আমার। আল্লাহ আমাকে দুটি ছেলে দিয়েছেন । তাই তোর বড়দুলাভাই আর আমি নিধিকে নিজের মেয়ের মতই ভেবেছি সবসময়।তোর দুলাভাইয়ের সব সময়ই ইচ্ছে ছিল নিধিকে ছেলের বৌ বানিয়ে নিয়ে যাবে। এবার যখন জানলো নিধি আর শুভ দুজন দুজনকে পছন্দ করে তখন আর দেরি করতে চাইলো না বলে বিয়ে পড়িয়ে দিল।

গতরাতে তোর বড়দুলাভাই বলল কি জানিস? – “শোনো নাসরিন হুট করে ছেলে মেয়ের বিয়ে দিলাম বলে রাগ করোনা। আসলে ভয়ে ছিলাম নিধির মত লক্ষী মেয়ের বিয়ের পাত্রের অভাব হবে না। পরে যদি নির্ঝর আর ওর বাবা অমত করে তাহলে আমাদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে তাই, রিস্ক নিতে চাইনি।” খালামনি খুব খুশি মনে কথাটা বললেন।আম্মুকে আরও বললেন
“আর আমার কথা শোন নাজমা- নিধি আমাদের বুদ্ধিমতি মেয়ে, তুই এতো ভাবিস না তো সব ভালোই হবে দেখিস”- বলে আমার মাথায় হাত রাখলো বড়খালামনি।”

খালামনির কথা শেষ হওয়ার মাঝেই বাইরে থেকে নির্ঝর ভাইয়া “আম্মু আম্মু”-বলে ডাকতে ডাকতে আমার ঘরে চলে এলো।ঘরে এসেই আম্মুকে কাঁদতে দেখে মুখটা মলিন হয়ে গেলো নির্ঝর ভাইয়ার।
মন খারাপ করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলল- “আমার উপর এখনো রেগে আছিস, হুট করে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি বলে? রাগ করিস না বোন দেখবি তুই খুব সুখি হবি। হয়তো একদিন বুঝতে পারবি আমরা সবাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোর ভালোর জন্যই নিয়েছি” -বলে বাম হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছলো।
এবার নির্ঝর ভাইয়াকে চোখ মুছতে দেখে বড়খালানি কিছুটা ধমকের মত করে বলল – “কি রে নির্ঝর তোরা মা ছেলে মিলে কি শুরু করেছিস? তোরা এতো মন খারাপ করলে নিধির কেমন লাগবে বলতো? “

“না খালামনি মন খারাপ করছি না।তোমার কাছেই তো যাচ্ছে। আমার কোনো ভাবনা নেই।তবুও কেন জানি বার বার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে খালামনি”-আচ্ছা তোমরা তাড়াতাড়ি চলো বড়খালু কখন থেকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
“চল চল, নিধি চল মা”-বলে বড়খালামনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলে নির্ঝর ভাইয়া বলল “আম্মু আর কোনো ব্যাগ আছে ?”
“না বাবা।”
“আচ্ছা তুমি নিধিকে নিয়ে বাইরে এসো আমি বাইরে গিয়ে দেখি মিথিলা আর শোয়েব ভাই এসেছে কি না?”
এতক্ষণ যত কথা হচ্ছিল তার মাঝে মাথা নিচু করে একমাত্র নীরব শ্রোতা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। সবাই যার যার আত্মপক্ষ সমর্থন করে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ একবারও বুঝতে চাইছে না আমার মনে কেমন লাগছে?
সবাই আমার ভালো চাইছে কিন্তু আমার ভালোলাগা মন্দলাগার কথা কেউ জানতে চাইছে না। যাই হোক, আমি আজ চলে যাচ্ছি নিজের গন্তব্যের পথে- সেখানে আমার সকল ভালে মন্দের সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিতে চাই।”

নির্ঝর ভাইয়া আবার দ্রুত বাইরে চলে গেলে আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বোঝানোর মত করে বলল- “শোন নিধি আমি বুঝতে পারছি তোর নিজের জীবন নিয়ে, নিজের বিয়ে নিয়েও অনেক স্বপ্ন ছিল। আমরা সবাই মিলে হুট করে বিয়ে দিয়ে তোর সেই স্বপ্নগুলোকে এলোমেলো করে দিয়েছি।”
“তবে একটা কথা কি জানিস মা- বিয়ে আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়। তিনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই হবে। এই সত্যিটা একবার মেনে নিলে দেখবি সব রাগ অভিমান মন থেকে মুছে গেছে”।

চুপচাপ আম্মুর কথা শুনে কোনো কথা না বলে হাতব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাইরে বেরোতে গিয়ে বুঝলাম শাড়ি গহনা পরে বেজায় বিপদে পরে গেছি। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। তবুও না দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচিটা হাত দিয়ে ধরে আম্মুকে পেছনে ফেলে চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। সদর দরজা পেরিয়ে গাড়ির কাছে যাওয়ার সময় সদর দরজার উপরের সানসাইটে চোখ পড়লো। মনে মনে খুব চেয়েছিলাম আজ হয়তো একটা চিঠি থাকবে। না সানসাইটের উপর কোনো কাগজ জাতীয় কিছু চোখে পড়লো না বলে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পরক্ষণেই মনে হলো
আর হয়তো কোনো দিন চিঠি আসবে না। হয়তো সে জেনে ফেলেছে শুভর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে ভেবে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো।

এর মধ্যে কখন যেন শুভ এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়ালই করিনি। আমি এক মনে চিঠি রেখে যাওয়া জায়গাটার দিকেই তাকিয়ে রয়েছি।
হঠাৎ শুভর ডাকে ঘোর কাটলে আমার। শুভ বলল- “সবাই গাড়িতে উঠে বসেছে তুমি যাবে না?”
আমি শুভর দিকে অভিমান নিয়ে তাকিয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ির কাছে চলে গেলাম।
আমাকে গাড়ির কাছে শাড়ি গহনা পরে আসতে দেখে বড়চাচী খুব খুশি মনে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব স্নেহের সাথে বলল- “আমাদের নিধি কবে যে এতো বড় হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি এতোদিন।”

ওদিকে মীরাআপু মিথিলা আপু একসাথে বাসা থেকে বের হয়ে এসেই আমাকে দেখে বলল “কী সুন্দর লাগছে তেকে নিধি! আজকে তোকে সত্যি সত্যি নতুন বৌ বৌ লাগছে”- মীরা আপু কথাগুলো বলতেই পাশে থাকা বড়খালামনি বড়চাচী হাসি মুখে বলল একদম ঠিক বলেছিস মীরা।
এর মধ্যে কে কোন গাড়িতে উঠবে সে জন্য বড়খালু তার বড় ছেলে সুজয় ভাইয়া আর সাবরিনা ভাবীকে বললেন, “আমরা সবাই মাইক্রোবাসে সব জিনিসপত্র নিয়ে উঠে পড়ি আর নিধি আর শুভ মিথিলা আর শোয়েবকে সাথে নিয়ে কারে উঠে পড়ুক।”
“ঠিক আছে আব্বু”- সাবরিনা ভাবী বলল।

সুজয় ভাইয়া আর সাবরিনা ভাবী আমার আর শুভর বিয়ের পরদিনই সকালবেলা কার নিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিল। তারপর গতকাল যখন সিদ্ধান্ত হলো আমিও ঢাকা যাবো তখন বড়খালু আবার তাদের আসতে বলে দিয়েছিলেন বলে দুজনেই খুব ভোরে রওনা দিয়ে মানিকগঞ্জ চলে এসেছেন।
একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসছে দেখে বড়চাচী বলে উঠলো-“নাজমা কোথায়? মেয়ে চলে যাচ্ছে অথচ এখনো বাসার মধ্যে কি করছে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই আম্মু একটা বড় খাবারের ব্যাগ হাতে করে গাড়ির কাছে এসে নির্ঝর ভাইয়ার হাতে দিয়ে বলল গাড়িতে তুলে দিতে । তারপর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার কাছে এসে দুই হাত দিয়ে আমার মুখটা ধরে কেঁদে ফেললো। আম্মুকে কাঁদতে দেখে বড়চাচী কাছে এসে বলল নাজমা মেয়েকে খুশি মনে বিদায় দাও।

চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here