– তোমার মৃত্যুর পর যখন সবাই আমাকে বলেছিল, ‘আল্লাহ যা করেন কল্যাণের জন্য করেন’, তখন আমার খুব রাগ হতো। তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে বলতাম, কারো মৃত্যু কীভাবে ভালোর জন্য হয়ে থাকে? মাঝে মাঝে তাদেরকে চিৎকার করে চলে যেতে বলতাম। তুমি রাগ করো না, এখন আমিও তাদের মতোই ভাবি। তোমার মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর।
রুদ্র যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে অভিমান করে বলতো, ‘রিশতা, তুমি এমন করে বলতে পারলে?’ কিন্তু সময়ের সমাপ্তিতে রুদ্র আজ সমাধি নামক মাটির স্তূপের নীচে প্রাণহীন অবস্থায় আছে। রিশতা নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে সেদিকে। সে জানে, রুদ্র এখন জেগে আছে। হয়তো তার দুআ ও সদকা আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন, রুদ্র তাই এখন পরম শান্তির স্থানে। আর নয়তো সে হাবিয়ার অনলে…
– আফা, এই জায়গা ভালা না। আফনে একলা একলা আইছেন?
এখানকার শ্রমিকের কথায় ধ্যান ভাঙলো রিশতার। এই লোকটা আজ নতুন এসেছে হয়তো। তা নাহলে আক্কাস চাচা তাকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেন, ‘আর কয়দিন অ্যামনে আইবেন আম্মা?’
রিশতার উত্তর থাকে, ‘যতদিন তাকে স্মৃতিতে ধরে রাখা যায়, ততদিন।’
মাথা নিচু করে পেছন ঘুরলো রিশতা। লোকটার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে হেঁটে হেঁটে আজিমপুর কবরস্থান থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রতি শুক্রবার রুদ্রর কাছে আসে রিশতা। তার আশ্রয়, তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আজ মাটির রূপ নিয়েছে। মানুষ মানেই ধূলিসাৎ। মাটি হতে তার সৃষ্টি, মাটিতেই তার দেহ থেকে আত্মার নিষ্কৃতি। অথচ মানুষ তার ভেতরের সৃজনশীলতা নিয়ে কতই না অহংকার করে! রিশতা এমন মানুষকে দেখে অবাক হয় না। তার অবাক হওয়ার আর কিছু বাকি নেই। প্রতি মুহূর্তে সে দ্বীন সম্পর্কে যা আবিষ্কার করে, তাতে তার বিস্ময়ের স্নায়ু অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
দোয়েল চত্বরের সামনে কতগুলো গাছের দোকান রয়েছে। রিশতা সেই পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাতে থাকা গোলাপগুচ্ছ এক পথশিশুর হাতে দিয়ে দিলো। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলে সে তার কোমল গালে হাত রেখে বললো, ‘আল্লাহ তোমার সহায় হন। এই বয়সেই ফুল বিক্রির ভার নিতে হয়েছে।’
এবারও রিশতা ফুলগুলো ছোট শিশুকে দিয়ে দিলো। তার এমন কাজে তার দ্বিতীয় সত্তা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘সবসময় ফুলগুলো মানুষকে দিয়ে দিস। একবারও কি রুদ্রকে দেয়া যায় না?’
– না যায় না।
– কেন?
– কারণ আত্মার শান্তি কামনায় ফুল দেয়া নাজায়েজ।
– ধুর ছাতা! কিনিস কেন তাহলে?
– কোমল মুখের হাসি দেখতে ভালো লাগে।
এই কথা শুনে তার দ্বিতীয় সত্তা চুপ হয়ে যায়। তখন তার মনে শান্তি অনুভূত হয়। নফস নামের দ্বিতীয় সত্তাটি ইদানিং খুব বেশি বিরক্ত করছে। এই প্রভাবটা সে আগে কখনোই টের পায়নি। বিশেষ করে রুদ্রর সাথে তার বিয়ের আগের সম্পর্কের সময় সে নফসকে আত্মার বন্ধু ভেবেছিল। এখন এই নফসই তার চির শত্রু!
রিকশায় চড়ে বাসায় পৌঁছে গেল রিশতা। এসময় জুম্মার সালাত আদায় করতে মানুষের সমবেত হওয়া দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মুসলিমদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তাকে অভিভূত করে। বাসায় পৌঁছেই আজমেরী বেগম দরজা খুলে বললেন, ‘দেরি হলো যে আজ?’
রিশতা ভেতরে ঢুকে বললো, ‘একটা বাচ্চার সাথে গল্প করছিলাম।’
আজমেরী ডাইনিং টেবিলে পায়েসের বাটি রেখে বললেন, ‘সকালে এক কাপ চা খেয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলে। এখন এই পায়েসটা খেয়ে তারপর গোসলে যাবে।’
– গোসল করে, সালাত পড়ে এসে খাই?
– উহু, খেয়ে তারপর বাকি কাজ করবে।
আজমেরী বেগমের কাছে হার মেনে নিয়ে পায়েস খেতে শুরু করলো রিশতা। আজমেরী বললেন, ‘চার তলার ভাড়াটিয়া এসেছিল।’
– দুজনই?
– আনিকা একাই এসেছিল। এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এসে বললো এ বাসায় ওরা আর থাকবে না। বাসা সামনের মাস থেকে ছেড়ে দিচ্ছে।
– বাসা ছেড়ে দিচ্ছে বলে মিষ্টি?
– না রে মা। আনিকা অন্তঃসত্ত্বা। মেয়েটা মায়ের কাছে থাকবে, আর জামাই থাকবে গাজীপুর। মেয়ের শখ হয়েছে মায়ের যত্নে থাকবে। এখানে থেকে কিইবা করবে। শশুর শাশুড়ি নেই, কোনো পিছুটান নেই।
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল রিশতার। তা খেয়াল করে দ্রুত বলে উঠলেন আজমেরী, ‘আহা রিশতা! আমি কি তোমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছি মা? তুমি রুদ্রর স্ত্রী যতটা তার চেয়েও আমাদের মেয়ে বেশি।’
এ নিয়ে কথা বাড়ালো না রিশতা। তার চুপচাপ স্বভাবের সাথে আজমেরী পরিচিত আছেন। কিন্তু এখন মেয়েটা আরো বেশি চুপ করে থাকে।
_____
– আসসালামু আলাইকুম আনি আপু।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম আরশ। কিরে? উমরায় গিয়ে মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন?
আরশ ভ্রু কুঁচকে আছে। পরিবার নিয়ে উমরায় এসেছে ছয়দিন হলো। কাল বাংলাদেশে ফিরে যাবে। আর তাই, কেঁদে ভাসিয়ে ফেলছেন আরশের মা নাজিফা। রাসূলের জন্মস্থান ও আল্লাহর ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই তার বুক ফেটে কান্না আসছে। আরশ নিজের খারাপ লাগা আল্লাহর কাছে ব্যক্ত করবে ভেবেছিল। এখন মাকে সামলাতে গিয়ে সেটা হলো না। ক্বাবার সামনে একটু দূরে গিয়ে ভিডিও কল করেছে বোনকে।
– আনি আপু, তুমি মাকে বোঝাও যে আল্লাহ চাইলে আমরা সবাই একসাথে আবার আসবো এখানে।
– কেন? কী হয়েছে?
– দেখো কী হয়েছে।
মায়ের দিকে ভিডিও ঘুরালে আনিকা দেখতে পেলো এক জোড়া অশ্রুভেজা চোখ। আরশ মায়ের কাছে ফোন দিয়ে বললো, ‘কথা বলো আম্মু।’
আনিকা অভিমানী কণ্ঠে বললো, ‘আম্মু, তুমি মন খারাপ করো না। দেশে ফিরে আমাকে দেখতে আসবে না? আমার যত্ন নিতে হবে না? আমাকে কি একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না?’
আনিকা ভেবেছিল আবেগ দিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলে মায়ের কান্না থামবে। কিন্তু নাজিফার উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে গেল সে।
– তোকে আর কত দেখবো? আল্লাহর ঘরে কি রোজ রোজ আসি? আর এমনভাবে বলছিস যেন আল্লাহর চেয়েও তোকে বেশি ভালোবাসতে হবে! নাউযুবিল্লাহ! তুই তোর খেয়াল রাখ। হায় আল্লাহ! আমি যদি সারাজীবন এখানে থাকতে পারতাম!
শেষ কথাটি আরশকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। বারবার তার মা যখন এমনভাবে এখানেই থেকে যাওয়ার কথা বলছে, তখন তার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন আরো দ্রুততর হয়ে যাচ্ছে এই ভেবে, আল্লাহ যদি তাঁর বান্দাকে ভালোবেসে নিয়ে যান! তাহলে তো এখানেই মায়ের দাফন কাজ… আর ভাবতে পারলো না সে। ফোনটা নিয়ে বোনকে বললো, ‘দেখেছো?’
আনিকা প্রশান্তি নিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ দেখলাম তো। আম্মুর কথা শুনে আমার খুব শান্তি লাগলো জানিস। এমন মহিয়সী মা পেয়েছি আমরা যিনি আল্লাহ ও রাসূলকে কত্ত ভালোবাসেন!’
বোনের কথা শুনে রাগের মাত্রা আরো এক ধাপ বেড়ে গেল তার। আনিকা ভাইকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো, ‘তুই এমনিই শান্ত, আজ আবার মুখ গম্ভীর করে রেখেছিস। আম্মুর কষ্ট দেখে কি তোর একটুও কষ্ট হচ্ছে না? এই, তোর কি খারাপ লাগছে না ক্বাবা ছেড়ে আসতে?’
– আমার খারাপ লাগার সময় আছে? রাখছি।
আরশ ফোন কেটে দিলো। আনিকা বুঝতে পারলো না, খারাপ লাগা কিংবা ভালো লাগার সাথে সময়ের কি সম্পর্ক! সময় কি ভালো-মন্দের জন্য বসে থাকে?
থাকে না। সময় কখনোই কাউকে পরোয়া করে চলে না। তার নির্দেশ, তার বৈশিষ্ট্যই এমন। জগতের একমাত্র মালিকের আদেশ ছাড়া সময় আর কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আল খলিক যখন চাইবেন সময়কে থামিয়ে দিতে, তখনই তার স্রোত স্তব্ধ হয়ে থাকবে। যেমনটা ঘটেছিল মিরাজের রাতে। কত অল্প সময়ের মাঝে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিয়েছিলেন আল্লাহর সাক্ষাতে! সময় যে আপেক্ষিক, তা প্রমানে এই ঘটনাই কি যথেষ্ট নয়?
মায়ের দিকে তাকিয়ে আরশ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর ক্বাবা ঘরের দিকে তাকালে তার মন ভালো হয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে হলো, ‘আমাকেও রেখে দাও না আল্লাহ! আমার যে তোমার ঘর ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।’
নিমিষেই মায়ের প্রতি যেই রাগটা ছিল তার, তা জলে মিশে গেল। ফোন মায়ের হাতে দিয়ে কাবার কাছে এগিয়ে গেল সে। কাবার একদম নিকটে সবসময় ভিড় লেগে থাকে। একজন মানুষ একবার হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতে পারলে আর ছাড়তে চায় না। কিছু মানুষকে জোর করে টেনে আনা যায় না। মানুষের ঢেউয়ে আপনাআপনি সরে যেতে হয় তখন।
ভিড় এড়িয়ে চলা তরুণ ছেলেটা এবার সেই ভিড়ের মাঝে ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। শেষবার হাজরে আসওয়াদ ছোঁয়ার সৌভাগ্য হলো তার। এতদিন দুনিয়াবী কোনো দুআ করেনি সে, কিছুই চায়নি। শুধু আখিরাত নিয়ে ভেবেছে। নিজের দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে সৎ ভাবে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু আজ, এই সময়ে এসে তার মস্তিষ্কে একটাই কথা বিচরণ করছে। চোখ বন্ধ করে সে প্রশান্ত মনে বললো, ‘আমি আমাকে সঙ্গী করে চাই! আমাকে সঙ্গী করে চাই!’
হাত ছুটে গেল কালো পাথরের দেয়াল থেকে। পাশ থেকে মানুষের ধাক্কা আসছে। পেছনে আসতে আসতে বাইতুল্লাহ থেকে দূরে সরে গেল সে। অপলক তাকিয়ে থেকে ছলছল চোখে বললো, ‘আমার আমিকে চাই হে আল্লাহ! যেন মৃত্যুর পর তোমার নূরের দেখা পাই।’
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেলে পাশ ফিরে তাকালো আরশ। আমান মুচকি হেসে বলছে, ‘মন খারাপ ভাই?’
গাল ভেজা আরশের। ভাইয়ের সামনে কান্নারত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জা হলো তার। দ্রুত চোখ মুছে সেও মুচকি হাসলো, ‘একটু।’
– চল এবার। এর আগেও তোকে বলেছিলাম আবার আসবো ইন শা আল্লাহ, যখন এখানে হজে এসেছিলাম। এখনো বলছি, আবার আসবো ইন শা আল্লাহ। তখন তোর বউ নিয়ে আসবি, আনিকাকে নিয়ে আসবো। একসাথে আবার আল্লাহর ঘরে আসবো।
বলতে বলতে আমান অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই স্থানটাই এমন। মানুষের ধ্যান জ্ঞান সব জুড়ে অন্তর থেকে শুধু ‘আল্লাহ’ । আর কোনো কথা নয়। কোনো অনুভূতির প্রকাশ নয়। শুধু সুখের কান্না।
_____
আনিকা কথা শেষে রান্নাঘরে গেল। জমে থাকা থালা-বাসন পরিষ্কার করে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বাজতে থাকা ল্যান্ডফোন ধরলো। দারোয়ান বলছে, ‘ফোর-এ ইউনিট?’
– জি চাচা, বলুন।
– আপনাদের কারেন্ট আর অল্প সময় আছে। টাকা ভরতে হবে।
– আচ্ছা আমি একটু পর ফোন করে জানাচ্ছি।
এসব কাজ আনিকার নয়। জামিল বাসায় নেই। জামিলকে ফোনে সবটা বললে সে বাড়িওয়ালির সাহায্য নিতে বললো। টাকা আর কার্ড নিয়ে আনিকা আবার তিন তলায় গেল।
তিন তলা পুরোটা জুড়ে রুদ্রর পরিবার থাকে। আনিকা শুধু জানে, বাড়িওয়ালা হিশাম আঙ্কেল প্যারালাইজড রোগী। উনার সেবায় থাকেন স্ত্রী আজমেরী বেগম আর মর্জিনা খালা। ছোট ছেলের বউ রিশতা স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় দুই মাস কারো সাথে যোগাযোগ রাখেনি। মানুষ তাকে দেখতে এলে চিৎকার করে তাড়িয়ে দিতো। এরপর হঠাৎ মেয়েটা বদলে গেল। আধুনিকতা ছেড়ে পুরোদমে আস্তিকের মতো চলতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে লিফট দিয়ে নামার সময় দেখা হয় তাদের। সালাম ও মুচকি হাসি ছাড়া আর কোনো কথা বিনিময় হয় না।
আজমেরী বেগমের বড় পুত্র মেঘ বিয়ে করে বউ নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে ওখানেই স্থায়ী হয়েছে। ছোট পুত্রের চালচলন ছিল পাশ্চাত্য রীতির। আজমেরীর কাছে এগুলো কোনো বিষয় নয়। তবে তিনি বেশ স্বামীভক্ত মানুষ। তাই এমন রোগীকে নিয়েই আজ পাঁচটা বছর তিনি চলছেন সঙ্গীহীন। রিশতাকে খুব ভালোবাসেন।
রিশতা মেয়েটাকে অদ্ভুত মনে হয় আনিকার। অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটি রুদ্রর মতো মাতাল কাকের সাথে কেন সম্পর্কে গিয়েছিল ভেবে পায় না সে। তবে সে শুনেছে, মেয়েটার মা বাবা নেই। চাচার বাড়িতে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তরুণ সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকেছে। এখন বিধবার মতো শশুরবাড়িতে পরে আছে। শৃঙ্খল মুক্ত জীবন এখন একটা নিয়মের মাঝে এনেছে মেয়েটা।
মানুষ একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতখানি বদলে যেতে পারে তা রিশতাকে দেখে শিখেছে আনিকা। রিশতার কথা ভাবতে ভাবতে সে দরজায় নক করলো। দরজা খুললো রিশতা।
– আসসালামু আলাইকুম আপু, আপনি নেমে এলেন কেন? প্রয়োজনে আমাকে বলতেন, আমি উপরে যেতাম।
মেয়েটার আন্তরিকতা মুগ্ধ করে আনিকাকে। সে হেসে বললো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমার কথা শুনেছো মনে হচ্ছে।’
– জি আপু, আপনার আনা মিষ্টিও খেয়েছি। আসুন, ভেতরে আসুন।
নিজের প্রয়োজনের কথা বলে অল্প সময়ে কাজ সেরে নিলো আনিকা। সবটা রিশতা করেছে। এসব কাজ তাকেই করতে হয়। রিশতার সুশ্রী মুখে মায়াবী ছায়া দেখে আনিকার আরশের কথা মনে পড়লো। তার ভাইয়ের কি এমন একটা মেয়ের সান্নিধ্যে আসতে ইচ্ছে হয় না? কেন যে কুমার হয়ে জীবন কাটাচ্ছে সে! পরক্ষণেই মনে পড়লো, তার ছোট ভাইটা নিজের অনিশ্চিত জীবনে কাউকে আনতে চায় না। পুলিশের বিভাগে দ্বীন মেনে চলা মানুষগুলোর জীবন অনেকটাই শঙ্কায় কাটে।
আরশকে বাবা মা এই বিভাগে চাকরি করতে কত মানা করেছেন! তবু সে ছাড়েনি বরং সততা বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে রেখেছে। তার এক কথা, ‘সমাজে সব বিভাগে অন্তত দুজন করে দ্বীনদার মানুষ থাকা প্রয়োজন। এই বিভাগে যতদিন টিকে থাকতে পারবো ততদিন কাজ করে যাবো। খুব বেশি সমস্যা হলে কাজ ছেড়ে দিব।’
তখন নাজিফার প্রশ্ন থাকে, ‘কাজ ছেড়ে কি করবি? বাপের ব্যবসায় ঢুকতে দিব না তোকে বলে দিচ্ছি। নিজে কাজ করে খাবি।’
নাজিফা কথাটা দুষ্টুমি করে বলেন। কিন্তু আরশের নির্বিকার উত্তর থাকে, ‘নিজেই কাজ করে খাবো। দরকার হলে মক্কার ঝাড়ুদার হবো।’
রিশতার কৌতূহলী মুখ দেখে হেসে ফেললো আনিকা। মুচকি হেসে বললো, ‘দুঃখিত, আমি আমার ভাইয়ের কথা ভাবছিলাম। তোমার কথা শুনতে পাইনি।’
– বলছিলাম যে, আপনার কয় মাস হলো?
– কাল জানতে পেরেছি আড়াই মাস চলছে আলহামদুলিল্লাহ।
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা চলে যাবেন ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। কতদিন এখানে ছিলেন!
– হ্যাঁ, বিয়ের পর থেকে এখানেই ছিলাম। ছয়টা বছর ধরে কত স্মৃতি। কিন্তু এখানে আমি থাকব না। তোমার ভাইয়া একা এত বড় বাসায় সাত মাস ধরে থেকে কি করবে? এজন্যই ছেড়ে দিলাম।
– আল্লাহ আপনাদের সাথে থাকুন, এই দুআ করি।
রিশতার নজরকাড়া চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আনিকা বলে উঠলো, ‘তুমি কি এভাবেই জীবন কাটাবে? ইদ্দতের সময় তো কবেই পার হয়ে গিয়েছে।’
_____
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব : ১
তাবিনা মাহনূর
[আমি থ্রিলার লিখতে খুব ভয় পাই। থ্রিলারে চারিদিক নজর রেখে প্লট সাজাতে হয়। তাই এই ধারাবাহিক গল্পটিকে কাঁচা হাতের আধা থ্রিলার বলতে পারেন। এটি সামাজিক জীবন, দুজন মানব-মানবীর হালাল দাম্পত্য, আজিমপুর কবরস্থান কেন্দ্রিক রাজনৈ-তিক জটিলতা এবং তাওয়াক্কুলের গল্প।
এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। চরিত্র ও ঘটনা পুরোটাই কল্পনার আদলে তৈরি। তাই কোনো ব্যক্তির জীবনাদর্শের সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।]