সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-০৮

0
463

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব-০৮

(১৬)

বসার ঘরের পর্দার আড়াল থেকে একজোড়া শুভ্র নগ্ন পা দেখা যেতে দেখলো স্মরণ। পা জোড়া যে করিম সাহেবের বড় মেয়ে রুমাইসার এ ব্যাপারে তার বিন্দু পরিমান ভুল নেই। নিলুফার বেগম কয়েক মিনিট আগেও তাকে কথা শুনিয়ে এসেছেন যাতে সে কোনোভাবে করিম সাহেবের অসুস্থতা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে এবং কোনো কিছুতে আগ বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত না নেয়। করিম সাহেবের যা হবে তার সব কিছুর সিদ্ধান্ত নিলুফার একাই নিবে এই নিয়ে যেনো কেউ কোনো দুকথা না বলে।
রুমাইসার তখন আর কিছুই বলার ছিলো না নীরবে দুফোটা চোখের জল বিসর্জন দেয়া ছাড়া। নিলুফারের এমন আচরণে বেশ অবাক হয়েছিলো স্মরণ এবং ফায়াজ। একজন মা তার মেয়ের উপর এতটা আক্রোশ জমিয়ে রাখতে পারে এটা তাদের জানা ছিলো না। স্মরণ রুমাইসাকে না দেখলেও অন্তঃকরণে রুমাইসার জন্য অজানা ব্যাথা অনুভব করলো।

রুমাইসা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে করিম সাহেবের অবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছিলো। নিলুফার বেগম স্মরণ এবং ফায়াজকে বসার ঘরে এনে করিম সাহেবের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলছিলেন। হয় তো এ কারণে রুমাইসা মায়ের অগোচরে এসে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েছে।

স্মরণ করিম সাহেবের ফাইল গুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো কিন্তু কোনো এক অজানা কারনে তার চোখ দুটো বার বার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির পায়ের উপর চলে যাচ্ছিলো। স্মরণ কিছুসময় সে দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে পরে আবার ফাইল দেখায় মনোযোগ দিলো।

করিম সাহেবকে কিছু টেস্ট করতে দিয়েছিল স্মরণ কিন্তু সেগুলোর রিফোর্ট যে খুব একটা ভালো আসে নি তা পর্দার ওপার হতেই বুঝতে পারলো রুমাইসা। স্মরণে কপালের দুটো ভাঁজই তার প্রমাণ দিচ্ছিলো। রুমাইসা আরো লক্ষ্য করলো সে দিন রাত্রিদের বাড়িতে যে লোকটি তাকে ভিড়ের মধ্যে যেতে বারণ করেছিলো সে লোকটি আর কেউ নয়
নিশ্চিন্দপুর মেডিকেল ক্যাপে আগত একজন ডাক্তার। যিনি এখন তার বাবাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন।

সারাদিন থেমে থেমে কাঁদছিলেন নিলুফার বেগম। তার কান্না দেখে যে কেউ বলবে হয় তো করিম সাহেব আর বেঁচে নেই। নিলুফারের এমন নাকিকান্না দেখে বেশ বিরক্ত হলো স্মরণ। মেয়ে মানুষের এই একটা জিনিস তার মোটেই পছন্দ না। করিম সাহেব জ্ঞান ফেরার পর তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছিলো স্মরণ। এই পনেরো মিনিট হলো তার জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিরতেই তিনি প্রথম রুমাইসার নাম নিলেন। রুমাইসা তখন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবার জ্ঞান ফিরেছে কিনা দেখতে এসেছিলো বেশ কয়েকবার কিন্তু নিলুফার বেগম তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে যেনো কিছুতেই এই ঘরের চৌকাঠ পার না হয়।

বাবার মুখে নিজের নাম শুনে হকচকিয়ে উঠলো রুমাইসা। দ্রুত ঘরে প্রবেশ করতে যাবে ঠিক সে সময় এসে নিলুফার বেগম তাকে বাঁধা দিয়ে বলেন,

“কোথায় যাচ্ছিস তুই? তোকে না বলে ছিলাম এই ঘরের চৌকাঠ মাড়াবি না।”

“বাবা ডেকেছেন নিশ্চই আমাকে খুঁজছেন একবার যাই না মা?”

“তোর বাবা তোকে ডাকে নি রিমাকে ডেকেছে। তোর সেখানে গিয়ে কাজ নেই তুই বরং রান্না ঘরে গিয়ে ডাক্তার সাহেবের জন্য কিছু খাবার তৈরী কর তিনি সেই কখন এসেছেন মানুষটাকে নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই মুখে দেন নি।”

“কিন্তু বাবা যে ডেকেছেন একটা বার দেখা করে গেলে,,,।”

“তোকে আর কতবার বলতে হবে উনি রিমাকে ডেকেছেন তোকে না।”

রুমাইসার চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো। সে এত ইঅভাগী যে বাবার এই অসুস্থতার সময় একটিবার বাবাকে চোখের দেখা টুকুও দেখতে পারছে না।

ঘর থেকে স্মরণ নিলুফার আর রুমাইসার কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলো। অনেকক্ষণ সে মৌন হয়ে বসে থাকলেও এবার আর তা পারলো না উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে নিলুফার বেগমের পেছনে দাঁড়াল।

“কি হয়েছে এখানে? পাশে রুগী সেটা নিশ্চই আপনাদের অজানা নয়?”

স্মরণের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতে রুমাইসা একটু সরে গিয়ে মাথা নিচু করে আড়ালে দাঁড়াল। কালো সেলোয়ার কামিজ মাথায় অর্ধ গোমটা টেনা মেয়েটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে স্মরণ সরাসরি নিলুফার বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“দেখুন রুগী অনেকক্ষণ যাবত উনাকে খুঁজছেন আপনার উচিৎ উনাকে যেতে দেয়া।”

স্মরণের কথা শেষ হতে রুমাইসা একবার চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। সন্ধ্যার নিভু নিভু আলোয় রুমাইসার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। স্মরণ পরিষ্কার দেখতে পেলো এই সেই চোখ দুটো যে চোখে সেদিন বিকেল বেলায় সে আগুন দেখেছিলো। কড়া ভাষায় যে তাকে অযথা কথা শুনিয়েছিল।

স্মরণের কথার উপর আর কোনো কথা বলার সাহস করলো না নিলুফার বেগম। অগত্যা রুমাইসাকে ভেতরে যাবার অনুমতি দিতে হলো। অবশ্য স্মরণ নিলুফারের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করে নি তার আগেই সে রুমাইসাকে সাথে সাহেবের ঘরে চলে গেলো।

(১৭)

রুমাইসাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে স্মরণের জন্য অপেক্ষা করছে রমিজ। রুমাইসা জানালার ফাঁকে রমিজকে দেখতে পেয়ে চুপি চুপি পেছনের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এলো। বেঁটেখাটো রমিজ একটা ভিড়ি ধরিয়ে তাতে আয়েশ করে টানছে আর বাতাসে দোয়া উড়িয়ে দিচ্ছে। চারপাশে কুয়াশার দাপট আগের চেয়ে অনেকটা বেড়েছে। শীত শীত ভাবটা প্রকৃতিতে দারুণভাবেই ঝেঁকে বসেছে। রমিজ রুমাইসাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে হাতের ভিড়িটা শেষবার টান দিয়ে দূর করে ফেলে দিলো।

“রমিজ ভাই?”
“হ বইন কও। চাচা কেমন আছে শরীলডা ভালা নি?”

“বাবা এখন একটু সুস্থ আছেন, তবে পুরোপুরিভাবে না।”

“হ,শরীলের আর কি দোষ কও। মানুষডা সারা জীবন খালি কষ্টই কইরা গেলো।”

“রমিজ ভাই আমি আপনাকে সেদিন যে চিঠিটা দিয়েছিলাম তা আপনি একজন ভালো ডাক্তারকে দিয়েছিলেন তো?”

“হ, দিছিলাম তো। মেলা ভালা ডাক্তার তিনি। চাচারেও খুব যত্ন কইরা দেখছে।”

“ওই ডাক্তারের সাথে আমায় একবার কথা বলিয়ে দিতে পারবে? খুব দরকার।”

“আপনি যার সাথে আলাপ করতে চাইছেন সে আপনার অতি নিকটেই আছে একটু ভালো করে দেখলেই বোধহয় বুঝতে পারতেন।”

পেছন থেকে কারো গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো রুমাইসা। স্মরণ তার চেয়ে দুহাত অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। ছয় ফুট লম্বা বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী স্মরণ পেন্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমাইসা কি বলবে বুঝতে না পেরে দু পা পিছিয়ে এসে নতমস্তকে দাঁড়াল। রমিজ তখন সহসা হেসে বলল,

“উনিই তো হেই ডাক্তার যারে আমি তোমার চিঠিখান পড়তে দিছিলাম।”

রুমাইসা চোখ তুলে একবার স্মরণকে দেখলো কিন্তু বেশিক্ষণ সে স্মরণের গম্ভীর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না, সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এই লোকটার দিকে সে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারে না। এক নাম না জানা শিহরণ তার বুকে উতাল পাতাল ঢেউ বইয়ে দেয়। স্মরণ কয়েক মুহূতের জন্য রুমাইসাকে অবলোকন করে দেখলো। মেয়েটাকে সে প্রথম যেদিন দেখেছিলো বুকের ভেতর কেমন চিন চিন ব্যাথা অনুভব করেছিলো। সে দিন সে মেয়েটির রাগী মুর্তি দেখলোও আজ তার মাঝে ভিন্ন কিছু দেখেছে।

স্মরণের সামনে আসার পর থেকে রুমাইসা নত জানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহসটুকুও সে পাচ্ছে না। খুব জড়তা কাজ করছিলো তার মাঝে।

রুমাইসার এমন নিশ্চুপতা দেখে স্মরণ নিজেই এবার কথা বলল,

“আপনার বাবা সম্পর্কে আপনি চিঠিতে যা লিখেছেন তা আমি পড়েছি। আর উনার চিকিৎসা ও আমি সেদিন থেকে করছি। বোধকরি এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন আপনার মনে নেই।”

রুমাইসা মাথা নেড়ে না জানালো।

“বাবা এখন কেমন আছে? উনি বাঁচবে তো নাকি মায়ের মতো তিনিও আমাকে ছেড়ে ওপারে চলে যাবেন?”
অন্যমনষ্ক হয়ে রুমাইসা কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে ফেললো।

স্মরণ তৎক্ষণাৎ রুমাইসার কথার কোনো জবাব করলো না। তবে এ ব্যাপারে সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। করিম সাহেবের সাথে স্মরণের বেশ ভালোই সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। প্রায় সময় স্মরণ নিজেই করিম সাহেবের সাথে দেখা করতে তার স্কুলে যেতেন। দুজনে একসাথে বসে বেশ কয়েকবার চাও খেয়েছে। তখন থেকেই স্মরণ রুমাইসা সম্পর্কে অনেক কথা জেনতে পেরেছে। তবে তার মনে রুমাইসাকে নিয়ে যে ধারণা ছিলো তা পুরোপুরিভাবে বদলে গেছে যখন সে প্রথম রুমাইসাকে বাবার পায়ের কাছে বসে নীরবে কাঁদতে দেখেছিলো।

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here