সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-০৯

0
364

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#পর্ব_৯
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান

(১৮)

প্রকৃতিতে শীত শীত ভাব। উত্তরী সমীরণ বইছে চারপাশে। কনকনে ঠান্ডায় খালি পায়ে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে পথে নেমে এলো রুমাইসা। সামনে যতদূর দেখা যায় শুধু ঘন কুয়াশার আচ্ছাদন। কোথাও জনমানবের চিহ্নটুকু নেই। রুমাইসা বারকয়েক ইতিউতি করে চারপাশটা দেখল তারপর গায়ে চাদরটা ভালো করে পেছিয়ে দ্রুত পায়ে শ্মশানঘাটের দিকে এগুতে থাকল। ভোরের স্নিগ্ধতা আর শীতের রেশ সব মিলিয়ে প্রকৃতি আজ আলাদা সাজে সেজেছে। রাস্তার দুইপাশ শিশিরস্নাত দূর্বাঘাস গুলো রুমাইসার শুভ্র পা দুটি ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। শিশির জল পায়ে ছুঁতেই রুমাইসার শরীর ঠান্ডায় কেঁপে উঠে। ইতিমধ্যে তার দুই হাত বরপের মতো শীতল হয়ে উঠেছে,নাকের ডগা সহ গালের দুপাশ ঠান্ডায় গোলাপ রাঙা হয়ে উঠেছে।

রাত্রিদের বাড়ির কাছাকাছি এসে হাঁটা থামালো রুমাইসা। বাড়িতে ডুকার আগে সে নিজেকে আরেকটু পরিপাটি করে নিলো। মাথায় আধ ঘোমটা টেনে গুটিগুটি পায়ে বাড়ির ভেতরে ডুকে মাঝ উঠোনে এসে দাঁড়াল সে।
থাকার ঘরের বারান্দায় বসে বই পড়ছিলো রাত্রি। এত ভোর বেলায় বাড়ির উঠোনে কাউকে এসে দাঁড়াতে দেখে পড়া থামিয়ে সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে দেখলো সে। কিন্তু প্রচণ্ড কুয়াশার কারনে উঠোনের কোনো কিছুই দেখতে পেলো না রাত্রি তাই কে এসেছে তা বুঝার জন্য একটু সরে এসে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়াল। মাঝ উঠোনে এমন কনকনে শীতের সকালে রুমাইসাকে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হলো সে। রাত্রিকে বারান্দায় দেখে রুমাইসা আরো একটু এগিয়ে সামনে এলো। রাত্রি ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠোনে নেমে এসেই রুমাইসার দুই হাত ধরে ফেলে বলল,

“এত সকাল তুই এইখানে ক্যান রুমাইসা? বাড়িতে আবার কিছু হইছে নাকি? চাচার কিছু হয় নি তো? তোরে এমন দেখা যায় ক্যান?”

রাত্রি এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামলো। রুমাইসা রাত্রি হাতের উপর এক হাত রেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো তারপর নির্বিকার গলায় বলল,

“সব ঠিক আছে। বাবাও এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো তবে পুরোপুরি নয়। ডাক্তার বলল শহরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।”

“শহরে নিবি চাচারে? কিন্তু কেমনে নিবি তোদের তো কোনো আত্নীয় স্বজন নেই সেখানে।”

রুমাইসা এবার ঠোঁট দুটো মৃদু প্রসারিত করলো তারপর বলল,

“একটা না একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। আল্লাহর উপর ভরসা করেই তো আছি। উনি নিশ্চই ভালো কিছু করবেন।”

“কিন্তু তোর এমন অবস্থা ক্যান? সারা রাত ঘুমাস নাই নাকি? আর এই ঠান্ডার মধ্যেই খালি পায়ে ঘর থেইকা বাহির হইয়া গেলি?”

“ও সবে আমার এখন আর কিছু হয় না। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে চল ঘরে গিয়ে বলি।”

“হ্যাঁ, আয়।”

রাত্রির সামনে মাথা নত করে বসে আছে রুমাইসা। একটু পর পর নাক টানছে সে। চোখের কার্নিশে জল টলমল করছে। রাত্রি কিছু সময় রুমাইসার দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“এখন কি করবি তাহলে? পরীক্ষার তো বেশি দিন নেই। স্কুলে ও যেতে পারিস না আর এখন তোর সৎ মা তোর বই ছিড়ে ফেলেছে, এভাবে কি কারো পক্ষে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? ”

“আমি কি করতে পারি বল? বাবার শরীরের এই অবস্থা তাকে আমি কি করে এসব বলবো। তাছাড়া মা চান না আমি বাবার সাথে কথা বলি কিংবা বাবার আসে পাশে থাকি।”

“আচ্ছা হেড ম্যাডামকে বলে যদি তোর জন্য এক সেট বইয়ের ব্যাবস্থা করা যায় তাহলে কেমন হয়?”

রাত্রির কথা শুনে রুমাইসার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। মনে হলো যেনো সে রাত্রির কথায় একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছে কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো সেদিন বাবা কাউকে ফোনে বলতে শুনেছে স্কুলে এখন নতুন পুরাতন কোনো বই নেই,তাই সে চাইলেও এখন আর কিছু করতে পারবে না। হেডম্যাডামকে বলেও আর কিছু করা যাবে না। রুমাইসার দুগাল বেয়ে অনবরত পানি পড়তে লাগলো। রাত্রি তাকে শান্তনা দিতে চেয়েও পারলো না।

রাত্রি আর রুমাইসার কথার মাঝখানে আলেয়া বেগম এসে রাত্রির ঘরে ডুকলেন। এতসকালে রুমাইসাকে এখানে দেখে তিনি কিছুটা ভড়কে গেলেন। রুমাইসাকে তিনি বরাবরই নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। ছোট বেলা থেকেই রুমাইসা এবং রাত্রি একসাথে বড় হয়েছে। রুমাইসার মা মারা যাবার পর থেকে আলিয়া বেগম যেনো আরো বেশিই মেয়েটাকে মায়া করতে শুরু করেছেন। মা মরা মেয়েটা ঘরে সৎ মায়ের কত অত্যাচার সহ্য করে দিন পার করে ভেবেই আলেয়া বেগম একদপা কেঁদে ভাসান।

আলেয়া বেগমকে ঘরে ডুকতে দেখে রুমাইসা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে কিছুটা হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না, আলেয়া বেগম ঠিক ধরতে পেরে গেছেন সে কাঁদছিল। তাছাড়া এত সকাল তাকে এখানে দেখে তিনি নিজেও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন যে কি হয়েছে। তাই কোনো ভণিতা না করে সরাসরি রুমাইসার সামনে এসে আদুরে গলায় বললেন,

” আরে আমার মেয়েটা এত সকাল কি কইরা এই বাড়িত পা রাখলো। আজ সূর্যটা কোন দিকে জানি উঠলো।”

আলেয়া বেগমের কথায় রুমাইসা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করলো।

“জানো মা ওই মহিলা রুমাইসার বই ছিড়া ফেলছে। খুব মারছেও দেখো।”
বলে রাত্রি রুমাইসার হাত টেনে এনে আলেয়া বেগমের সামনে ধরলো। আলেয়া বেগম লক্ষ্য করলো রুমাইসার ডান হাতের কব্জির ঠিক একটু উপরে রক্ত জমাট বেঁধে নীল হয়ে আছে।

“হায়, আল্লাহ এরা কি মানুষ! একটা মাইয়ারে এইভাবে মারতে পারে কেউ?”

রুমাইসা নিশ্চুপ বসে আছে। আলিয়া বেগম এবার কিছু না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে মিনিট দুইএক এর মাঝে ফিরে এলেন। হাতে করে নিয়ে এলেন নানান পদের শীতকালীন পিঠা। রুমাইসার সামনে পিঠার থালা রেখে তিনি সেখান থেকে একটা পিঠা তুলে রুমাইসার মুখে তুলে দিয়ে বললেন,

“হ, মা আইজ কাল মানষের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নাই। সতীন মেয়ে বইলা কি তারে এমন কইরা মারন লাগবো। ওই বেডি নিশ্চই তোমারে না খাওয়াই রাখছে। আহা, আইজ যদি রুমানা বাইছা থাকতো তাইলে কি এত কষ্টে থাহন লাগতো তোমারে।”

(১৯)

রাত্রিদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে খেতের আইল ধরে হাঁটা ধরলো রুমাইসা। অনেক টা বেলা হয়ে এসেছে যদিও এখনো সূর্যের দেখা মেলেনি পুবের আকাশে। কুয়াশা যেনো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। শীতে রুমাইসার ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। পাতলা চাদরে আর শীত আটকে রাখা যাচ্ছে না। যত দ্রুত সম্ভব তাকে বাড়ি পৌঁছাতে হবে নয় তো আবারো এক গাল কথা শুনতে হবে।

খেতের আইল ছেড়ে রাস্তায় উঠতেই রুমাইসার চোখ পড়ল শ্মশানঘাটের একটু কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটার নিচে। কেউ একজন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহেলিকার ঘন চাদর বেঁধ করে রুমাইসা বুঝতে পারছিলো না ব্যাক্তিটি ঠিক কে হতে পারে। কিন্তু একটু এগিয়ে কাছাকাছি আসতেই সে বুঝতে পারলো ব্যাক্তিটা আর কেউ নয় স্মরণ। স্মরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমাইসা চলার গতি কমিয়ে দিলো। পা যেনো আর সামনে এগুতে চাইছে না। ভয়ে ভয়ে সে মৃদু পায়ে স্মরণের সামনে গিয়ে নতজানু হয়ে দাঁড়াল।

স্মরণ বাহুতে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিলো। রুমাইসা সামনে এসে দাঁড়াতেই সে প্রশস্ত নিশ্বাস ছেড়ে একবার রুমাইসার পা থেকে মাথা অবধি দেখল তারপর বলল,

“ভোর বেলায় খালি পায়ে হাঁটা স্বাস্থ্যকর হলেও প্রচণ্ড শীতে তা একেবারেই নয়, পরের বার বের হতে জুতো নিয়ে বের হবেন।”

রুমাইসা এবার নিজের পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। সত্যিই সে জুতা নিয়ে বের হতে ভুলে গিয়েছিলো। রাত্রিও বেশ কয়েকবার বলেছিলো কিন্তু সে গায়ে মাখে নি কিন্তু স্মরণের মুখে কথাটা শুনে নিজের ভেতর কেমন করে উঠলো। স্মরণ যে এত কিছু ছেড়ে তার খোলা পায়ের দিকেই নজর দিবে সেটা সে ভাবে নি।

রুমাইসাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে স্মরণ আবারো আগ বাড়িয়ে নিজেই কথা বলল,

“করিম চাচা বাড়ি আছেন?”

“আছেন হয় তো।”

স্মরণ বেশ কিছুটা সময় নীরব থেকে পরে আবার বলল,

“হাতে খুব লেগেছে আপনার, রক্ত জমাট বেঁধেছে দেখছি প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট নিলেই পারতেন।”

রুমাইসা এবার নিজের হাতের দিকে তাকালো।” ইশ! এই লোকটার দেখছি সব দিকেই নজর।” মনে মনে বলল রুমাইসা তবে বাহিরে সেটা প্রকাশ করলো না।

“বাই দ্যা ওয়ে, যে কারণে এখানে আসা আমার। আপনাকে কিছু দেয়ার ছিলো, ভেবেছিলাম রমিজের হাতে পাঠাবো পরে ভাবলাম নিজেই দিয়ে আসি।”

স্মরণের কথায় কিছুটা অবাক হলো রুমাইসা। এই ব্যাক্তিটার সাথে তার খুব একটা বেশি আলাপ হয় নি। যতটুকু হয়েছে সব বাবাকে নিয়েই। কিন্তু এই টুকু আলাপে লোকটা তাকে কি দিতে এসেছে এটা ভেবে পেলো না সে।

স্মরণ লক্ষ্য করলো রুমাইসা আনমনে কিছু একটা ভাবছে। মৃদু বাতাসে সামনের কয়েক টা চুল এসে বার বার মুখের কিনারায় পড়ছে। রুমাইসা একটু পর পর সেগুলো কানের কাছে গুঁজে দিচ্ছে কিন্তু অবাধ্য চুল তার এই বাঁধা যেনো মানতেই চাইছে না। উড়ে এসে তার কপালের একপাশ ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। স্মরণ কয়েক মুহূর্তের জন্য এই দৃশ্য চোখে ধারন করলো। মাঝে মাঝে এই মেয়েটাকে তার বড্ড ভালো লাগে। আলাদা একটা স্নিগ্ধাতা যেনো সব সময় তাকে ঘিরে রাখে। ভোরের শীতল হাওয়ার মতো রুমাইসার স্থির দৃষ্টি যেনো তাকে মুহূর্তে ঘায়েল করে।

রুমাইসার গালের দুপাশ সহ নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। লজ্জায় নাকি ভয় ঠিক কি কারনে মেয়েটা তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সেটা স্মরণের অজানা। তবে মেয়েটার কাছাকাছি আসলে তার বুকের ভেতরটা কেমন যেনো করে উঠে। এইতো কয়েক দিন আগের কথা যেদিন অন্ধকারে মোমের আলোয় একজোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ সে দেখতে পেয়েছিলো। কে জানতো সেদিন রাতের আধারে দেখা চোখ জোড়া করিম সাহেবের মেয়ে রুমাইসার হবে। যার টানা হাতের লিখা চিঠির ভাঁজে সে প্রথম শিউলি ফুলের মাদকতাময় সুবাস পেয়েছিলো।

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here