#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৪
৩০)
দুপুরের পর থেকেই করিম সাহেবের শরীরটা বেশ খারাপ হতে শুরু করেছে। নিলুফার বেগম বার কয়েক স্বামীর হাতে পায়ে গরম তেল মালিশ করে বিছানা ছেড়ে উঠলেন মাগরিবের নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে। রুমাইসা বাবার শিয়রের কাছে বসে ছিলো নিলুফার বেগমকে উঠে যেতে দেখে সে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
“মা বাবাকে একবার শহরে নিয়ে গেলে হয় না?”
নিলুফার বেগম ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন রুমাইসার কথায় তিনি কিছু সময়ের জন্য থামলেন তারপর রুমাইসার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“শহরে নিয়ে যাওয়া তো আর যেই সেই কথা না। মেলা টাকার প্রয়োজন তাছাড়া থাকা খাওনের একটা ব্যাপার আছে কইলেই তো আর শহরে চইলা যাওন যায় না।”
“এর জন্য কি বাবার চিকিৎসা বন্ধ থাকবে?”
“বন্ধ থাকবো ক্যান? শেহ্ওয়ার কাল সকলরে ডাক দিয়া তো কইলো যে তোমরার বিয়ার পর সে আমাদের সবাইরে শহরে লইয়া যাইবো আর তোর বাপের চিকিৎসার সব কিছু সে নিজে দেখবো।”
রুমাইসা এবার আর কোনো কথা বলতে পারলো না। বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সব কথার এক কথা হলো তাকে এখন বিয়েটা করতেই হবে। রুমাইসা কিছু সময় বাবার ঘুমন্ত মুখের দিকে সজলনেত্রে তাকিয়ে থাকলো। এই মানুষটা ছাড়া পৃথিবীতে তাকে ভালোবাসে এমন আর কেউ নেই। একটা সময় সে ভাবতো হয় তো শেহ্ওয়ার তাকে বুঝে মন থেকে ভালোবাসে কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেক বদলে গেছে। শেহ্ওয়ারের ভালোবাসাটাও কেমন যেনো পানসে পানসে মনে হয় রুমাইসার।
বাবার কাছ থেকে উঠে রুমাইসা সোজা ঘর থেকে বেড়িয়ে কল পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো। অন্ধকারে কলপাড়টা খুব একটা ভালো দেখা যাচ্ছে না তবুও সে অন্ধকার হাতরে সামনে এগিয়ে গেলো। কলপাড়ের কাছাকাছি এসে রুমাইসা পানির ঝুপঝাপ শব্দ শুনতে পেলো। হয় তো কেউ গোসল করছে এই ভর সন্ধ্যা বেলায়। রুমাইসা এগিয়ে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে পরে আবার ফিরে ঘরের দিকে চলে এলো। হয় তো সে একটু এগিয়ে গেলে দেখতে পেতো স্নানরত দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী সন্ধের মৃদু আলোয় তাদের প্রণয়লীলা চালিয়ে যাচ্ছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বাহিরে হিমেল হাওয়া বইছে। জানালার বাহিরে শিউলি ফুল গাছের পাতা গুলো অনবরত নড়ছে। রুমাইসা কিছুসময় সে দিকে তাকিয়ে থেকে পরে পড়ার টেবিলে এসে বই খুলে বসলো। শেহ্ওয়ার আজ বাড়ি নেই কি এক কাজে শহরে গিয়েছে, নীলা জামাও তার সঙ্গে গেলেন ডাক্তার দেখাবেন বলে। পুরো বাড়িটা আজ খালি খালি বলে মনে হতে লাগলো রুমাইসার। মনোয়ারা বেগম নিজের ঘরে ইবাদত কায়েম করতে ব্যস্ত, রিমা, সমীর দুজনেই তাদের নানীর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ায় দুজনেই মায়ের কাছে বায়না ধরেছিলো। তাই সকালে রিমার মামা রহমত আলী এসে তাদের নিয়ে গেছেন। রুমাইসা কিছু সময় ধরে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে রইলো একটু পরই সে পাশের ঘর থেকে কারো উচ্চহাসির শব্দ শুনতে পেলো। রুমাইসা কিছুটা সময় কান পেতে আরো ভালোভাবে শুনার চেষ্টা করলো আর পরক্ষণে সে বুঝতে পারলো নিলুফার বেগম আর তার মামা কি যেনো কথোপকথন নিয়ে হাসি তামাশা করছে।
(৩১)
পুরো ঘর জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও এতটুকু আলো পর্যন্ত নেই। ঘুম ভেঙে স্মরণ চারপাশে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করলো কিন্তু তৎক্ষণাৎ ঘুমের রেশ কেঁটে না যাওয়ায় সে নিজের অবস্থান ঠাহর করতে পারলো না। ধীরেধীরে ঘুমের রেশ কিছুটা কেঁটে গেলে সে বুঝতে পারলো এই মুহূর্তে সে নিজের শোবার ঘরে অবস্থান করছে। অনেক দিন পর লম্বা একটা ঘুম নিয়েছে এখন নিজেকে অনেকটাই হাল্কা মনে হতে লাগলো স্মরণে।
শোয়া থেকে উঠে স্মরণ ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।
দোতালার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে নিচে তাকাতেই দেখতে পেলো মিসেস সেলিনা রহমান ডিভানে বসে আছেন আর তার একটু অদুরে বসে মোবাইলে কি একটা করছে অর্শা।
“এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
পিঠে কারো শক্ত হাতের স্পর্শ অনুভব করে পেছন ফিরে তাকালো স্মরণ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বলল,
“এমনি দাদা ভাই।”
“গ্রামে তাহলে বেশ ভালো দিন কাটালে। তা দাদুভাই কেমন লাগলো গ্রামের জীবন যাত্রা আর পরিবেশ?”
“খারাপ না। ওই সব ছাড়ো তুমি কেমন আছো বলো।”
“আমি আর কেমন থাকবো এই বয়সে দাদুভাই আল্লাহ আমায় যেমন রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ। ”
“বাবা কি বাড়িতেই আছেন?”
“আছে হয় তো দেখতে পারো গিয়ে।”
স্মারণ আরো কিছু সময় জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পরে নিচে নেমে এলো। স্মরণকে নিচে নেমে আসতে দেখে অর্শা বলল,
“কিরে ভাইয়া ঘুম ভেঙেছে তাহলে?”
স্মরণ অর্শার কথায় জবাব না দিয়ে সেলিনা রহমানের পাশে গিয়ে বসলো। সেলিনা রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তা আমার ছেলের ঘুম ভালো হয়েছে তো?”
“জ্বী মা হয়েছে।”
“সারাদিন তো কিছুই খেলে না তুমি এখন খাবার দেবো?”
“হুম দিলে ভালো হয়।”
বলে স্মরণ আবার বসা থেকে উঠে পড়লো।
নিজের ঘরে এসে স্মরণ বালিসের কাছ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো। সন্ধ্যার নিভু নিভু আলো আর কুয়াশায় ঢাকা প্রকৃতিতে দৃষ্টি মেলে প্রশস্ত একটা নিশ্বাস ছাড়লো সে। গতকাল এমনি সন্ধ্যার নিভু নিভু আলোয় অনাকাঙ্ক্ষিত রমনীটি তার কাছে ছুটে এসেছিলো। কেনো এসেছিলো সে? স্মরণের মনে নানান প্রশ্ন নাড়াছাড়া করছে। কিন্তু তার একটি উত্তরও তার অজানা।
(৩২)
আজ প্রায় বেশ কয়দিন যাবত রুমাইসা একটা বিষয় খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে যে নিলুফার বেগম আগের মতো আর তার বিয়ের ব্যাপারে আপত্তি করছেন না। এখন মনে হচ্ছে তিনিও চান এই বিয়েটা হোক। তাছাড়া নিলুফার বেগমের আচার আচরণে ও সে কিছুটা পরিবর্তন খেয়াল করেছে। তিনি এখন আর রুমাইসার সাথে এতটা খারাপ ব্যাবহার করেন না। নিজে এসে তাকে স্কুলে যাবার জন্য প্রতিদিন তাড়া দিচ্ছেন। নিলুফারের এমন আচরণে রুমাইসা যে শুধু অবাক হচ্ছে এমন নয় মনোয়ারা বেগম ও খুব অবাক হচ্ছেন।
শীতের সকালের একটুকরো মিষ্টি রোদ পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে এসে পড়েছে। রুমাইসা উঠানের একপাশে বসে বই পড়ছিলো হঠাৎ কি যেনো মনে করে সেখান থেকে উঠে এসে পুকুর ঘাটে এসে পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।
আজ তিন দিন হলো স্মরণ নিশ্চিন্দপুর ছেড়ে চলে গেছে। অথচ যাওয়ার পর থেকে তার একটা খবর পর্যন্ত রুমাইসা পায় নি। অবশ্য পাবেই বা কি করে স্মরণ তো আর তাকে খবর পাঠানোর জন্য বসে নেই। হয় তো সে নিজের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সেখানে নিশ্চিন্দপুরের পাশে অলকানন্দপুর গ্রামে বাস করা অসহায় সহজ সরল মেয়ে রুমাইসার কথা ভুলেই গেছে। আর মনে রাখবেই বা কেনো তার সাথে তো আর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই স্মরণের। ভাবতে ভাবতে রুমাইসার দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তার মন বার বার চঞ্চল হয়ে উঠছে স্মরণের কথা ভেবে। বুকের বা পাশে কেমন চিন চিন করে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। সে জানে না কেনো একজন অপরিচিত পুরুষ মানুষের জন্য তার মন বার বার বেকুল হয়ে উঠছে যার সাথে তার আলাপই হয়েছে মোটে দুই কি তিনি দিন।
“ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে বইসা আছোস ক্যান রুমাইসা?”
বলে রাত্রি এসে রুমাইসার পাশে বসে পড়লো। রুমাইসা এবার লক্ষ্য করলো সে কাঁদছে তার চোখ বেয়ে টপ টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাই সে চোখের জল লুকোতে অন্য দিকে ফিরে গেলো তারপর উড়নার একাংশে চোখের মুছে একটু হাসার চেষ্ঠা করে বলল,
“হঠাৎ তুই এলি এবাড়িতে?”
“ক্যান আমি কি আইবার পারি না?”
“না তা না,তুই তো কখনো আসিস না তাই বললাম আর কি।”
“স্কুল যাইবি না আইজ?”
রুমাইসা কিছু বলল না চুপচাপ সামনে তাকিয়ে পানিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে রইলো। রাত্রি ক্ষণকাল রুমাইসার উত্তরের অপেক্ষা করলো তারপর আবার বলল,
“আইচ্ছা ওই মহিলা হঠাৎ এমন ভালো হইয়া গেলো ক্যান? নিশ্চই কোনো বদ মতলব আছে নয় তো কি তোরে স্কুলে যাইবার অনুমিত দেন?”
“উনিও চান বিয়ে টা হোক।”
“আমার মনে হয় তোর মামা জান বেডিরে টাকা দিছে তাই তো এমন ভালা হইয়া গেছে।”
বলেই রাত্রি খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করলো।
রুমাইসা কিছুটা সময় রাত্রিকে দেখলো তারপর মনে মনে ভাবলো রাত্রির কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়। তার কথাটা একেবারেই ফেলে দেয়ার মতো না তবে হ্যাঁ তার মামা জান এই কাজ না করলেও শেহ্ওয়ার নিশ্চই করছে না হয় নিলুফার কখনো তার সাথে এতটা ভালো আচরণ করত না।
“কিরে কি ভাবছিস?”
“কিছু না। আমি আজ স্কুলে যাবো না তুই যা। আমার কিছু কাজ আছে।”
“তোর আবার কি কাজ আছে?”
“সেটা তুই বুঝবি না একজনের সাথে আমার কিছু বুঝাপড়া বাকি আছে।”
“তুই কার কথা কইতাছোস রুমাইসা।”
“নিশ্চই বুঝিতে পারছিস কার কথা বলছি।”
বলেই ঘাট থেকে উঠে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো রুমাইসা। শেহ্ওয়ারের সাথে তার অনেক কথা আছে এই মহূর্তে সেসব কথা শেষ না করলে পড়ে আরো দেরি হয়ে যাবে।
চলবে,,,।