সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-১৫

0
348

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৫

(৩৩)

কিছুক্ষণ আগে পিয়ন এসে স্মরণের চেম্বারে একটা চিঠির খাম রেখে গেছে। স্মরণ অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে সোজা নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলো। পর পর তিনটা ও.টি শেষ করে নিজের চেম্বারে এসে চেয়ার দখল করে বসতে বসতে চোখ পড়লো টেবিলের এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা একটা খামের উপর। স্মরণ হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিতেই দেখতে পেলো নিশ্চিন্দপুর থেকে রমিজ নামের একজন তার নামে চিঠিটা পাঠিয়েছে। স্মরণ কিছু সময় চিঠির খামের দিকে দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে বসে রইলো অজান্তে তার মনের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। নিশ্চিন্দপুর থেকে বিদায় নেয়ার পর পুরো একটা মাস কেঁটে গেছে আর এই একমাসে সে একটিবারের জন্যও রুমাইসাকে মন থেকে সরাতে পারে নি। চলে আসার দিন রুমাইসা কেনো এইভাবে তার কাছে ছুটে এসেছিলো? কেনই বা তাকে এতটা ভরসা করে ভর সন্ধ্যে বেলায় কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়া একজন অপরিচিত যুবকের কাছে এসে অনুরোধ করছিলো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও খুঁজে পায় নি সে।

চিটির ভাঁজ খুলে তাতে চোখ বুলিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে স্মরণ আজ থেকে দুমাস আগের কথা ভাবতে লাগলো। রমিজের হাতে করে একটুকরো চিঠি পাঠিয়েছিলো রুমাইসা যার আগাগোড়া জুড়ে শুধু বাবার অসুস্থতার কথাই বর্ণনা করে গিয়েছিলো মেয়েটা। সেদিন চিঠির ভাঁজ খুলতেই স্মরণ শিউলি ফুলের কড়া গন্ধ পেয়েছিলো। আশ্চর্য রকমের মাধকতা ছড়িয়েছিলো সে গন্ধে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে কেমন অনুভূতি শুন্য একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিলো স্মরণের। অজানা কারণেই চিটির আড়ালে থাকা মেয়েটি প্রতি তার মনে কৌতুহল জাগ্রত হয়। রুমাইসার কথা ভাবতে ভাবতে স্মরণের বুক ছিঁড়ে প্রশস্ত নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। হয় তো সেদিন রুমাইসার আকুতি মিশ্রিত অনুরোধ সে ফেলতে পারতো না যদি না শেহ্ওয়ার রুমাইসার আগেই সেখানে না এসে পৌঁছাতো। কিন্তু কি আর করা ভাগ্যে লিখন কেই বা বদলাতে পারে তবে হ্যাঁ কিছুটা চেষ্টা সে করেছিলো তবে সেটা আড়ালে থেকে। হয় তো মেয়েটা জানতে পারবে না তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ স্মরণের হাত ধরেই হয়েছিলো।

টেবিলের একপাশে রমিজের লিখা চিঠিটা অনাদরে পড়ে আছে। স্মরণ এক মগ কফি হাতে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। সামনে যত দূর চোখ পড়ে শুধু ইট পাথরে গড়া বিশাল বিশাল দালান। যার আগাগোড়া জুড়ে শুধুই চাকচিক্যের ছড়াছড়ি কোথাও এতটুকু সজীবতার ছোঁয়া নেই।
স্মরণ গোধূলির মুক্ত অম্বরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

“কি ভাবছো এতো স্মরণ?”
পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠস্বর কানে এলেও ফিরে তাকালো না স্মরণ আগের ভঙ্গিমায় নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো সে।

“হোয়াট হ্যাপেন্ড? তুমি আমার কথার উত্তর কেনো করছো না? তুমি কি আমায় ইগ্নোর করছো?”

“মিস মোনালিসা আপনি হয় তো ভুলে যাচ্ছেন আমি আপনার সমবয়সী নয়। আর এটাও ভুলে যাচ্ছেন যে আপনার সাথে আমার ইগ্নোর করা কিংবা না করার মতো কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। বাই দ্যা ওয়ে আপনি আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করবেন।”
মোনালিসার দিকে না তাকিয়ে কথাগুলো বলল স্মরণ।

“সরি স্যার।”

“ইট’স ওকে। পরের বার যেনো এমন ভুল না হয়। এখন বলুন কি কাজে এসেছেন?”

“স্যার দশ নাম্বার কেবিনের একজন রুগীর এডমিট হয়েছেন। হার্টের প্রব্লেম আপনি কি একবার ভিজিট করে আসবেন?”

“ডা.ফায়াজ উনাকে দেখছেন। আপনার আর কিছু বলার আছে?”

“স্যার আসলে আমি চাইছিলাম আপনি যদি ফ্রি থেকেন তো,,,।”

“আপনি এখন আসতে পারেন মিস মোনালিসা। আমি একটুপর বের হবো।”

স্মরণের এমন কঠিনতা দেখে মনে মনে হতাশ হলো মোনালিসা। সে কোনো ভাবেই স্মরণকে তার মনের কথা বুঝাতে পারছে না, এমনকি যতবার সে সেটা বুঝাতে চাইছে ততবারই স্মরণ তাকে অপমান করছে। বার বার স্মরণের কাছে অবহেলিত হওয়ায় নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হতে লাগলো তার।

“কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছেন?”

স্মরণের গম্ভীর গলা কানে পৌঁছাতে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো মোনালিসা। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্মরণ নামক যুবকটির উপর দৃষ্টি পড়তেই যেনো সে মনে মনে আরেক দপা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেলো। এই যুবকটিকে সে বিষন ভাবে ভালোবাসে তবুও যে কেনো সে তাকে তার ভালোবাসার কথাটি বুঝাতে পারে না।

মোনালিসা এক দৃষ্টিতে স্মরণের দিকে তাকিয়ে আছে। স্মরণ এবার প্রচন্ড বিরক্তিতে ভ্রুযুগল কুচকে নিলো তারপর কন্ঠে কাঠিন্যতা ধারণ করে বলল,

“মিস মোনালিসা আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারেন নি?”

“ইয়েয়েস স-স্যার।”

” তবে এবার জান। দরজা ওই দিকে।”

বলেই স্মরণ এসে চেয়ার দখল করে বসলো। মোনালিসা চলে গেলে ফায়াজ এসে চেম্বারে ডুকলো।

” মেয়েটাকে তুই অকারণেই একটু বেশি বকিস।”

“অকারণে আমি কাউকে কিছু বলি না ফায়াজ সেটা নিশ্চই তোর অজানা নয়।”

“মেয়েটার সাথে তো একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারিস।”

ফায়াজের কথায় এবার ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকালো স্মরণ।

“না মানে মেয়েটা যে তোকে ভালোবাসে সেটা তো তুই বুঝতে পারিস।”

” তুই কি এগুলো বলতে এসেছিস এখানে?”

“আচ্ছা তুই এমন কেনো বলতো? তুই কি কাউকে বুঝতে পারিস না?”

“কাকে বুঝার কথা বলছিস? ”

“ওই যে গ্রামে যে মেয়েটা তোর,,,।”

স্মরণ মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখায় ব্যস্ত ছিলো ফায়াজের কথায় সে কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো।

“কি হলো?”

“রমিজ চিঠি পাঠিয়েছে নিশ্চিন্দপুর থেকে।”

“কি বললো সে?”

স্মরণ মুখে কিছু না বলে ফায়াজের দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দিলো। ফায়াজ কিছুটা অবাক হয়ে সেটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। রমিজ চিঠিতে খুব একটা বেশি কিছু লিখে নি শুধু এতটুকুই লিখেছে আগামী মাসের তেরো তারিখ রুমাইসার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়েটা বিয়ে করতে চাইছে না কিন্তু বাবার কথা ফেলতে না পেরে বিয়েতে সে মত দিয়েছে। করিম সাহেবের শরীরটা আগের থেকে ভেঙে পড়েছে। স্মরণ যাবার আগে যদিও বলে গেছে আবার ফিরে এসে তাকে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে কিন্তু সেটা আর সে করে নি। আত্নসম্মানের দিকে চেয়ে করিম সাহেবও স্মরণকে কিছু বলতে পারেন নি, তবে বেশ কয়েকবার চিঠি লিখবেন ভেবেও পুরোবর্তীতে তা আর লিখা হয় নি। অবশ্যই শেহ্ওয়ার কয়েকজন ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে করিম সাহেবকে কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় নি। এখন তিনি চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে।

চিঠি পড়ে বেশ কিছু সময় চুপ করে বসে রইলো ফায়াজ। স্মরণের মাঝে সে এখন পর্যন্ত এতটুকু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে না অথচ সে রুমাইসার জন্য এখানে বসেও অনেক কিছু করে গেছে যেটার একমাত্র সাক্ষী ফায়াজ নিজে। একটা মানুষ কখন একটা মেয়ের জন্য এতটুকু করতে পারে সেটা সে জানে না তবে শুধু মানবতা থেকে যে স্মরণ রুমাইসার জন্য এতটুকু করছে তা একেবারেই নয়।

(৩৪)

বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে আছে রুমাইসা। চোখের কার্ণিশ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ফোঁটা টপ টপ করে ঝড়ে পড়ছে। তার এলোমেলো জীবনটা যেনো আরো এলোমেলো অগোছালো হয়ে পড়ছে। কোথাও কেউ নেই যে তার সমস্যা গুলো বুঝবে এই বিপদ থেকে কেউ তাকে রক্ষা করবে। সামনে তার মেট্রিক পরিক্ষা এর আগেই তাকে শেহ্ওয়ারকে বিয়ে করতে হচ্ছে। সে জানে না শেহ্ওয়ার হঠাৎ করেই কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিলো। তবে একটা ব্যাপারে সে খুব খুশি যে তাকে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে পরিক্ষা দিতে হবে না। শেহ্ওয়ার চেয়েছিলো যে রুমাইসাকে যেনো তাদের সাথে শহরে চলে যায় এমনকি পরীক্ষাও যেনো শহরেই দিতে পারে তার সব ব্যাবস্থাও সে করে ফেলেছিলো কিন্তু কি যেনো এক কারণে সেটা হয়ে উঠে নি, তাই সে পরীক্ষার আগেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সেদিক রুমাইসা স্কুলে যাবার পর প্রধান শিক্ষক তাকে অফিস কক্ষে ডেকে পাঠান। আর তখনি রুমাইসা জানতে পারে তাকে এখান থেকে শহরের স্কুলে ট্রান্সফার করা হবে না সে এখান থেকেই পরিক্ষা দিতে পারবে। শেহওয়ার যদিও বোর্ড থেকে সবরকম ব্যবস্থা করে ফেলেছিলো কিন্তু কেউ একজন চেষ্টা করে সেটা বাতিল করেছে।

“আপা আম্মা তোমারে ডাকে।”
রিমা ডাক দিতেই রুমাইসা চোখের জল মুচে নিলো। শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে সে রিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“হ্যাঁ রে রিমা তুই কি বলতে পারিস আমার ট্রান্সফার হওয়ার ব্যাপারটা কি ভাবে আটকে গেলো?”

“না তো আপা আমি তো জানি।”

“বাবা জানেন এই ব্যাপারে?”

“উহু।”

তবে কে এমন আছে যে অজান্তেই তার এত বড় উপকার করলো ভাবতে ভাবতে রুনাইসা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলে রিমা পেছন থেকে ডেকে বলল,

“আপা,,!”

“হু?”

“একখান কথা কই তুমি রাগ করবা না তো?”

“উহু বল কি কথা।”

“শেহওয়ার ভাইরে তুমি বিয়া কইরো না।”

রিমা ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললো। রুমাইসা চলে যেয়ে নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো ভ্রু কুচকে রিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুই হঠাৎ এই কথা বলছিস কেনো রিমা?”

“আমার মনে হইলো তাই কইলাম। উনার চাইতে স্মরণ ভাই অনেক ভালা তুমি তারে বিয়া কইরা নাও। আচ্ছা তুমি কি স্মরণ ভাইরে পছন্দ করো?”

স্মরণের কথা মনে পড়তেই রুমাইসার বুকের ভেতর ধুমড়ে মুচড়ে উঠলো। সে জানে না স্মরণকে সে পছন্দ করে কিনা তবে বাবার পর যদি চোখ বুজে সে কাউকে ভরসা করে সে হলো স্মরণ। যে মানুষটাকে সে খুব ভালো করে জানে না, চেনে না, যার সাথে তার অল্পকিছু সময়ের আলাপ তবুও কেনো সে তাকে চোখ বুঝে বিশ্বাস করতে পারে? ভরসা করতে পারে? অনেক ভেবেছে রুমাইসা কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যার্থ হয়েছে। এই অদ্ভুত প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তরই সে পায় নি।

চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here