সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-১৭

0
334

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৭

(৩৭)

আজ রুমাইসার গায়ে হলুদ। পুরো বাড়ি জুড়ে কত আলোর রোশনাই। আত্নীয় স্বজনদের কোলাহল, হইহুল্লোড়ে মেতে উঠেছে সারা বাড়ি।একটু পর রুমাইসার হলুদের আয়োজন শুরু হবে, তাই রুমাইসার দুই ফুফাতো বোন এসেছে তাকে সাজাতে। সবুজ পাড় হলুদ জামদানী শাড়ি তার সাতগে গা ভর্তি কাঁচা ফুলের গয়না অপূর্ব দেখতে লাগছে তাকে। রিমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুমাইসাকে সাজাতে দেখছে। মেয়েটার মুখে হাসি নেই, চোখ মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে। রিমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে মণিকা বলল,

“কিরে রিমা ওইখানে খাড়ায়া আছোস ক্যান, এইখানে আয়?”

রিমা কোনো উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপে ঘরে এসে রুমাইসার পেছনে দাঁড়াল। আয়নায় বোনের প্রতিবিম্বের দিকে তাকি প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো সে। এমন একটা দিনে হয় তো বোন হিসেবে তারই বেশি খুশি হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সে কেনো খুশি হতে পারছে না?

আয়নায় রিমার মলিন মুখ দেখে স্মিত হাসলো রুমাইসা। চোখের ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে কিন্তু রিমা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না মৌন হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো নিজের আপাকে। পৃথিবীতে বাবা আর সমীরের পর যদি কাউকে সে বেশি ভালোবেসে থাকে তবে সেটা রুমাইসাকেই। ছোটবেলা থেকেই তার রুমাইসার প্রতি একটা আলাদা টান ছিলো। মায়ের অত্যাচার আর অশ্রাব্য গালি সহ্য করে রুমাইসা যখন বাড়ির সকল কাজ শেষ করে পুকুর ঘাটে গিয়ে নিভৃতে চোখের জল ফেলতো, তখন মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি বোনের কাছে গিয়ে ক্রোড় ঘেঁষে বসতো রিমা। ছোট ছোট দুই হাত দিয়ে বোনের চোখের জল মুছে দিতো। ছোট্ট রিমা চেষ্টা করতো কি করে আপাকে খুশি করা যায়, কি করলে তার আপা আবার হাসবে, আদর করে তার গালে চুমু খাবে।

“এই রিমা তুই এত কি ভাবতাছোস? যা তাড়াতাড়ি রেডি হইয়া নে একটু পরই তো হলুদ শুরু হইবো।”

“আপার লগে আমার কথা আছে।”

“এহন আপার লগে আবার কিসে কথা কইবি রিমা। তার আগে দেখতো কেমন দেখতে লাগে আপারে?”

“কইলাম তো আমার আপার লগে কথা আছে।” কিছুটা উচ্চবাক্যে কথাটা বললো রিমা।

অনামিকা, মণিকা দুজনেই অবাক হয়ে রিমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর তারা দুজনে দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শেষে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

অনামিকা, মণিকা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে রুমাইসা রিমার সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। রিমা তখন নতমস্তকে মাটিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। রুমাইসা ক্ষণকাল রিমার দিকে তাকিয়ে থেকে পরে বলল,

“কি কথা বলবি বল ওরা চলে গেছে।”

এবার রিমা মুখ তুলে সরাসরি রুমাইসার মুখের দিকে তাকালো। তারপর কণ্ঠে কিছুটা কাঠিন্যতা এনে বলল,

“তুমি কি সত্যিই বিয়েটা করবা আপা?”

“এই কথার জন্য এত রাগ?”

“আমি মজা করতেছি না আপা, তোমারে যেইডা জিগাই তার উত্তর দাও।”

“আমার উত্তরে আর কি হবে রিমা। বাবা যা চান আমি তাই করতে রাজী।”

“কিন্তু আপা তুমি ক্যান আব্বারে সব কথা কইলা না? শেহওয়ার ভাইরে বিয়া করলে তুমি কোনো দিন সুখী হইবা না, তোমার সব স্বপ্ন শেষ হইয়া যাইবো।”

“স্বপ্নই যার মরিচিকা তা কি আর ধরা যায় বল? কত জন কত স্বপ্নই তো রোজ দেখে কিন্তু তার আর কয়টাই পূর্ণ হয়।”

“তাই বলে তুমি ওই লোকটারে বিয়া করবা যেই লোকটা,,,।”

“প্রতিশ্রুতি সবাই দিতে পারে রিমা কিন্তু তা রক্ষা করতে জানে কয় জন। ধরে নে আমার সাথেও তাই হয়েছে। স্বপ্ন দেখার আগেই যার ঘুম ভেঙে যায় সে কি করে আশা করে পুরো স্বপ্ন দেখার?”
বলতে বলতে রুমাইসার বুক ছিঁড়ে একটা প্রশস্ত নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। রিমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে রুমাইসাকে। মেয়েটার চোখ ভিজে উঠেছে, ভেতরটাও নিশ্চই ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। রিমা অনুভব করতে পারলো রুমাইসার কষ্ট কিন্তু তারই বা কি করার আছে। সে আর কতটুকুই বা করতে পারে।

“আপা একটা কথা কমু?”

“হু।”

“তুমি জানো স্মরণ ভাই গতকাল রাইতে নিশ্চিন্দপুর আইসে।”

“হু।”

“কিন্তু তিনি একবারো আমাদের বাড়িতে আইলো না ক্যান? আব্বার লগে তো তার ভালা সম্পর্ক তাও ক্যান আইলো না।”

“এসব কথা এখন কেনো বলছিস, অনেক দেরি হয়ে গেছে দেখ, তাড়াতাড়ি গিয়ে তৈরি হয়ে নে যা।”
বলে রুমাইসা আয়নায় দিকে ফিরে নিজেকে দেখতে লাগলো। রিমা আরো কিছুটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবলো তারপর রুমাইসার কাছে এসে বলল,

“আপা উনি তো তোমারে কতবারই সাহায্য করছে, এইবার যদি করতো তাহলে নিশ্চই বিয়া টা আটকানো যাইতো।”

রিমার মুখের কথা কর্ণপাত হতেই রুমাইসার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথাটা এবার তীব্রভাবে যন্ত্রণা দিতে শুরু করলো। স্মরণ নাম টা অজান্তেই তার মনে অনেকখানি স্থান দখল করে নিয়েছে।

কারণে অকারণে বিনাপ্রতিশ্রুতিতে স্মরণ আড়ালে থেকে রুমাইসার অনেক উপকার করেছে আর তার সবটাই রুমাইসার অজানা। তাই তো স্মরণে কড়া ব্যাক্তিত্বের কাছে ঘেঁষার সাহস কখনো হয় নি রুমাইসার।

(৩৮)

পুকুরঘাটে নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছে স্মরণ। তার একটু অদূরে দাঁড়িয়ে সিগেরেটে আগুন ধরালো রমিজ।

“ডাক্তার সাহাব হঠাৎ কি মনে কইরা ক্যান নিশ্চিন্দপুর আইলেন ওইডা তো কইলেন না?”

“সেটা আপনার না জানলেও চলবে মি রমিজ সাহেব।”

“আরে, ডাক্তার সাহাব রাগ করেন ক্যান? আমি কিন্তু কথাডা ওই ভাবে কই নাই।”

“চেয়ারম্যান সাহাব কইলো উনার কি এক দরকারে আপনারে এখানে ডাইকা আনছেন।”

“সব যখন জানেন তবে এত প্রশ্ন কেনো?”

এবার রমিজ কিছুটা লজ্জা পেলো। মাঝে মাঝে সে আগ বাড়িয়ে একটু বেশি কথা বলে সেটার প্রমাণ সে আজ নিজেই পেলো। স্মরণ কিছু সময় পানিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইলো। আকাশে আজ ভরা পূর্ণিমারচাঁদ। তবুও এতটুকু আলো নেই চারপাশে। আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা, মাঝে মাঝে তারা চাঁদকে আড়াল করে নিচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেবের পদ্ম পুকুরের শান্ত জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব পড়েছে আর সে দিকে তাকিয়ে স্মরণ রমিজকে বলল,

“মাঝে মাঝে আকাশের চাঁদও যে ধরনীর বুকে এসে ধরা দেয়, তা জানেন তো রমিজ সাহেব?”

রমিজ বোকা হাসি হেসে তাকিয়ে রইলো স্মরণের দিকে। স্মরণ ঘাঢ় ফিরিয়ে একবার রমিজকে দেখলো, রমিজের হাতের জ্বলন্ত সিগেরেটের দোয়ার দিকে তাকিয়ে স্মরণ স্মিত হাসলো তারপর বলল,

“আরেকটা সিগেরেট হবে?”

স্মরণের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রমিজ। দ্রুত নিজের হাতের সিগেরেট মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে নিলো, তারপর জিভে কামড় দিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,

“এই ভুল আর হইবো না ডাক্তার সাহাব। আপনের সামনে আর খামু না কসম কইরা কইতাছি।”

স্মরণ এবার রমিজকে অবাক করে দিয়ে বলল,

“আমায় একটা সিগেরেট দাও দেখি।”

“আপনে সিগেরেট খাইবেন?”

“কেনো ডাক্তার হয়েছি বলে আমার সিগেরেট খাওয়া বারণ?”

“কিন্তু আপনে তো,,,।”

“মাঝে মাঝে দুঃখ হাল্কা করতে শুনেছি লোকে সিগেরেট খায়। তাতে আদৌ কোনো উপকার আছে বলে বলতে পারেন?”

“তা আমি কইবার পারি না, তবে সিগেরেট হইলো নেশার মতোন একবার ধরলে আর ছাড়ন যায় না।”
বলে লুঙ্গীর কোছড় থেকে বের করে একটা সিগেরেট স্মরণের দিকে এগিয়ে দিলো।

সিগেরেট মুখে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে টান দিতে দিতে আকাশের দিকে মুখ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আবারো বলল,

“মাঝে মাঝে আকাশের চাঁদও যে ধরনীর বুকে এসে ধরা দেয়, তা জানেন তো রমিজ সাহেব?”
একি প্রশ্ন স্মরণকে আবারল করতে দেখে রমিজ এবার মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

“আপনি আবার কবি হইলেন নাকি ডাক্তার সাহাব?”

সিগেরেটে দ্বিতীয় টান দিয়ে স্মরণ জবাব দিলো,

“উহু। তবে কথাটা নেহাত মিথ্যে কিছু নয়। এই যে দেখো আকাশে চাঁদ পুকুরের জলে কেমন লুটোপুটি খাচ্ছে। তার থেকে আমাদের দূরত্ব কিন্তু খুব একটা বেশি নয়, তবুও তাকে ধরার সাধ্য আমাদের নেই। শুধু দূর থেকে তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। মানুষের জীবনও কিছুটা আকাশের চাঁদের ন্যায়। উপরে তাকালে সে অনেক খানি দূরে আর যখন জলভাগে তাকাবে তখন দেখবে সে অতি নিকটে তবুও তাকে ধরার সাধ্য কেউর নেই। ঠিক এমনি কারো কারো জীবনে চাঁদের ন্যায় একজন বিশেষ মানুষ থাকে, যাকে আমরা মন থেকে চাই ভালোবাসি কিন্তু সে কখনো আমাদের অতি নিকটে অবস্থান করে কখনো বা অতিদূর, চাইলেও তাকে ধরা যায় না, শুধু দূর থেকে তাকে অনুভব করা যায়।”

স্মরণের এমন কঠিন কথার অর্থ রমিজ ধরতে পারলো না। তবে সে বুঝতে পেরেছে স্মরণ কিছু একটা নিয়ে কষ্ঠ পাচ্ছে।

বেশ খানিকটা সময় দুজন নিশ্চুপে কাটিয়ে দিলো।
রাতের গভীরতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। স্মরণ তখনো একিভাবে বসে রইলো। রমিজ হাই তুলে ইতিউতি তাকিয়ে বলল,

“ডাক্তার সাহাব মেলা রাইত হইছে ঘরে যাইবেন না?”

“উহু আরেকটু বসবো। আপনি গেলে যেতে পারেন।”

রমিজ আর কিছু বলল না, আরো কিছুটা সময় একিভাবে কাটিয়ে দিলো। তারপর কি যেনো মনে করে বলল,

” আইজ করিম চাচার মাইয়া রুমাইসার গায়ে হলুদ। ইশশ মাইয়াটা কতই না চেষ্টা করলো বিয়াখান না করবার কিন্তু কিছুই হইলো না। খুব খারাপই লাগে মাইয়াডার কথা ভাইবা। মা মরা মাইয়াটা সারা জীবন সৎ মায়ের লাথি ঝাঁটা খাইয়া বড় হইছে। আর এখন মেট্রিক পরীক্ষার আগেই বিয়া দিয়া দিতাছে। হুনছি মামাতো ভাইর লগেই নাকি বিয়া হইতাছে।

রুমাইসার কথা মনে হতে স্মরণের ভেতটা কেমন হুহু করে উঠলো। মনে পড়ে গেলো মেডিকেল ক্যাম্প হতে ছেড়ে যাবার দিন সন্ধ্যে বেলার কথা। ভর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিধ্বস্ত রুমাইসা শেষ আশা নিয়ে তিন কোশ রাস্তা পাড়ি দিয়ে তার কাছে ছুটে এসেছিলো, কিন্তু সেদিন তাকে সে ফিরিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু কেনো দিয়েছিলো? এই কথার উত্তর শুধু তার অবচেতন মনই জানে।

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here