সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-২০

0
304

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২০

(৪৪)

ঘুম ভেঙে নিজেকে চার দেয়ালে আবদ্ধ একটা ঘরে আবিষ্কার করলো রুমাইসা। ঘুম ঘুম চোখে একবার চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিলো, ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি বলে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলো না সে কোথায় আছে। একটু পর যখন সে বুঝতে পারলো জায়গাটা তার সম্পূর্ণ অপরিচিত তখনি সে ত্বরিতগতিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো। চার দিকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

“আমি এখানে কি করে এলাম!”
বলে রুমাইসা পুরো কক্ষটা আরেকবার অবলোকন করলো। তার মাথায় কিছু কাজ করছে না, ভেবে পাচ্ছে না সে কি করে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে।

রুমাইসা অবাক হয়ে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলো। তার যতদূর মনে পড়ে সে চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারিঘরে থাকার কথা কিন্তু গতরাতে কাছারিঘরে যা কিছু তার চোখে পড়েছিলো সে সবের কিছুই এই ঘরটায় নেই। অবাক হয়ে পুরো ঘরটা আবারো অবলোকন করতে করতে একটা জায়গায় এসে রুমাইসার চোখ আটকে গেলো। দেয়ালের একস্থান দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড একটা আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি নজরে এলে অন্তঃকরণ হতে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, মনে পড়ে যায় গতরাতে ঘটে যাওয়া প্রতিটা কথা।হলুদের সাজে মাঝরাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলো সে।ছুটে গিয়েছিলো চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারিঘরের দোরগোড়ায়। তারপর কি হলো? মনে করেই রুমাইসার চোখ বেয়ে টপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পড়নে সবুজ পাড় হলুদ শাড়ি, গা ভর্তি কাঁচা ফুলের গহনা, হাতে মেহেদি, কপাল আর গালের দুইপাশে হলুদ লেপ্টে শুকিয়ে আছে, চুল গুলো এলোমেলো হয়ে একপাশে পড়ে আছে, নিজের এমন প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রুমাইসা। জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে ভাবতেই ভেতরটা হু হু করে উঠলো।

বাহিরে সোনালি রোদ ঝলমল করছে, পর্দার আড়াল হতে জানাল ফাঁকে উঁকি দেয়া একটুকরো সোনালি রোদ এসে রুমাইসার পায়ের কাছে লম্বালম্বি হয়ে পড়েছে। রুমাইসা আয়নার পাশ থেকে সরে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। দুই হাতে পর্দা সরিয়ে জানালার কবাট উন্মক্ত করতেই তার চোখের সামনে ভেসে এলো পুষ্প মণ্ডিত একটি উদ্যান। ফুলে ফুলে ভরা একটুকরো স্বর্গ যেনো রুমাইসার চোখে এসে ধরা দিলো। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মাথায় অন্য চিন্তা এসে ভর করলো।

“আমি কোথায় আছি? আর এই জায়গাটাই বা কোথায়। আচ্ছা আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?”
নিজের মনে মনে এসব প্রশ্ন আওড়াতে থাকলো রুমাইসা আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শেহ্ওয়ারের মুখটা তার চোখে ভেসে উঠলো।

“তার মানে উনিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”

“উনি টুনি কেউ আপনাকে এখানে নিয়ে আসে নি মিস রুমাইসা।”

পেছন থেকে স্মরণের কন্ঠস্বর কানে বাজতেই চমকে উঠলো রুমাইসা। সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকালো। স্মরণ তার চেয়ে দুহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। সে আশ্চর্য হয়ে চারপাশে দেখে স্মরণের দিকে তাকালো।

“কি ভাবছেন এখানে কি করে এলেন?”

রুমাইসা সহসা কিছু বলতে পারলো না, নিশ্চুপে মাথানত করলো। স্মরণ কয়েক পা এগিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“রাতের শেষ প্রহরের খানিকক্ষণ আগে আপনাকে সঙ্গে করে নিশ্চিন্দপুর গ্রাম ছেড়েছিলাম, অবশ্য তখন আপনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন। এ ব্যাপারে মি.রমিজ কিছুটা সাহায্য করেছিলেন।”

রুমাইসা এবার চোখ তুলে তাকালো স্মরণের দিকে। তার চোখ দুটো ভিজে উঠেছে ইতিমধ্যে। এই মানুষটা যে শেষ পর্যন্ত তাকে সাহায্য করবে এমনটা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি সে। কৃতজ্ঞতায় রুমাইসার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

“মিস রুমাইসা আপনাকে নিয়ে আমি বেশি দূর পর্যন্ত আসতে পারি নি। আপাতত আপনার এলাকাতেই আছি এখনো।”

“মানে আমরা এখনো নিশ্চিন্দপুর আছি?”

“আপনি বোধহয় আমার প্রথম কথাটা মন দিয়ে শুনেন নি।”

স্মরণের কথায় এক করম লজ্জা পেলো রুমাইসা। সত্যি সে স্মরণের কথা মন দিয়ে শুনে নি। তার মনে এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সকাল সকাল যখন বাড়ির সকলে জানবে সে ঘরে নেই তখন কি হবে? বিয়ের আগের দিন রাতে বউ পালিয়েছে এ কথা এতক্ষণে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নানান মানুষ তাকে নিয়ে নানান কথা বলছে, এই নিয়ে তার বাবাকে ছোট হতে হবে গ্রামবাসীর কাছে। আচ্ছা এত অপমান কি তার বাবা সহ্য করতে পারবে? ভেবেই রুমাইসার অন্তঃকরণ প্রচন্ড যন্ত্রণা হতে লাগলো। বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ভেতরটা গুড়িয়ে যেতে চাইলো।

“কি ভাবছেন?”

“লোকে আমার বাবাকে খারাপ খারাপ কথা বলবে তাই না।”
ভাবলেশহীন ভাবে বলল রুমাইসা।

“এটা আপনার এখন নয় গতকাল রাতেই ভাবা উচিৎ ছিলো।”

“কিন্তু তারা যে আমার বাবাকে ঠকাচ্ছে তার বেলায় তাদের কেউ কিছু বলবে না?”

স্মরণ ভ্রুকুটি করে তাকালো রুমাইসার দিকে। রুমাইসা অন্যমনষ্ক হয়ে ভুল করে কথাটা বলে ফেলেছে বুঝতে পেরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। স্মরণ বুঝতে পেরেছে রুমাইসা ঠিক কি বলতে চেয়েছে, গতকাল রাতেই সে সব রমিজের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলো তাই আর এ ব্যাপারে কোনো কথা বাড়ায় নি সে।

“এই নিন এই ব্যাগটাতে আপনার কিছু জামা কাপড় আছে। ওগুলো ছেড়ে এগুলো পড়ে নিন। আর হ্যাঁ আজ রাতের ট্রেনে আমরা ঢাকায় যাচ্ছি আপাতত আজকের দিনটা এই ঘরের মধ্যেই কাটাতে হবে আপনার।”

রুমাইসা চুপচাপ মেনে নিলো স্মরণের কথা। স্মরণ কিছুটা সময় রুমাইসাকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো। এই কয়দিনে মেয়েটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে গভীর ভাবে, ক্র জানে কত রাত ঠিক করে ঘুমোয় নি।

“মিস রুমাইসা একটু পর রমিজ সাহেব এখানে আসবেন।”

রুমাইসা মুখে কিছু না বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। স্মরণ এবার জানালার কাছ থেকে সরে এসে রুমাইসার সামনে দাঁড়াল। তারপর বলল,

” সামনে আপনার এক্সাম। তাই বই এবং স্কুল থেকে আপনার কাগজ পত্র সব তুলে আনার ব্যাবস্থা করেছি।”

“কিন্তু স্কুল থেকে কাগজপত্র তুলতে গেলে তো সবাই,,,।”

“ওটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না সে সব আমি দেখে নিয়েছি। এবার যান চেইঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি একবার হাসপাতাল ভিজিট করে আসি। আজকে এখানে আমার শেষ দিন তাই কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে আসছি।”
বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো স্মরণ। রুমাইসা ক্ষানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে পড়ে ওয়াশরুমের দিলে চলে গেলো।

(৪৫)

দুপুরের পর রমিজ শুভ্রনগর এসে উপস্থিত হলো। প্রায় আধ ঘন্টা যাবত সে স্মরণের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে তার দেখা পেলো। স্মরণ রমিজকে ইশারা করে চেম্বারে আসতে বললো। রমিজ চেম্বারে ডুকলে স্মরণ তাকে চেয়ারে বসতে বলে নিজেই উঠে আলমারির কাছে গেলো। সেখান থেকে কয়েকটা খাম বের করে ফিরে এসে নিজের স্থান দখল করে বসলো তারপর বলল,

“ওখানে কি অবস্থা? আর যা যা বলেছিস সব করতে পেরেছেন তো রমিজ সাহেব।”

“জ্বী ডাক্তার সাহাব সব কাম কইরা আইছি। স্কুলে গিয়া হেডমাস্টারের লগে সব কথা কইয়া আইছি। উনি কথা দিছেন এই ব্যাপারে তিনি কাউরে কিছু জানতে দিবো না। ”
বলেই রমিজ স্মরণের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিলো। স্মরণ ফাইলটা এক নজর দেখে বলল,

“মিস রুমাইসাকে এখানে এসেই পরীক্ষাটা দিতে হবে, আর কিছু করার নেই। উনার বই গুলো নিয়ে এসেছেন তো।”

“হ, আনছি। বাহিরে রাইখা আইছি।”

“ভালো করেছেন। আর ওই দিকের কি অবস্থা?”

“খবর খুব একটা ভালা না ডাক্তার সাহাব। রুমাইসার মামা খুব ঝামেলা করতাছে যেই কইরাই হোক বিয়া দেওনের কথা কইতে হুনছি।”

“মানে? মিস রুমাইসা তো নেই কি করে বিয়ে হবে?”

“কি কইরা আর হইবো এখন করিম চাচার ছোড মাইয়া রিমা আছে না তার লগে বিয়ার কথা কইতাছে ওই মহিলা।”

“হাউ স্ট্রেঞ্জ, রিমা তো বেশ ছোট ওর সাথে বিয়ে এটা কি করে ভাবছেন তারা। করিম সাহেব কিছু বলছেন না কেনো?”

“উনি আর কি কইবো অসুস্থ মানুষ। তয় উনি রুমাইসারে নিয়া চিন্তায় আছে। বিয়ার যত কিছু আছে সব ওই মহিলাই করতাছে। উনিই কইতাছে রিমারে ওই পোলার লগে বিয়া দিতো।”

“শেহ্ওয়ার কিছু বলছেন না এ ব্যাপারে? উনি একটা বাচ্চা মেয়েকে কি করে বিয়ে করতে পারেন?”

“ওই পোলা এখনো কিছুই জানে না, হে বের হইছে রুমাইসারে খুঁজত।”

স্মরণ সব কিছু জেনে আর তেমন কিছুই বলল না। একটা মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে অন্য মেয়েটা নিজেই বিপদে পড়লো। এই মুহূর্তে আর কি বা করার আছে তার।

চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here