সবটা অন্যরকম♥ পর্ব_৫

সবটা অন্যরকম♥
পর্ব_৫
Writer-Afnan Lara
.
সন্ধ্যা সাতটা বাজে,,কলিং বেল বাজতেই আহনাফদের বাসায় যে মহিলা কাজে হেল্প করেন উনি এসে দরজা খুলে দিলেন
আরিফ এসেছে,,বাসায় ঢুকে নিজের রুমে যাওয়ার আগে ওর চোখ গেলো গেস্ট রুমের দিকে
সেখানে দিবা বসে বসে একটা পর্দা বানাচ্ছে বারান্দায় ঝুলাবে বলে
আরিফ একটু এগিয়ে এসে বললো”আপনি?”
.
দিবা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়লো সাথে সাথে
.
আপনাকে তো ভাইয়ার সাথে সায়দাবাদ দেখেছিলাম,,এবার মনে পড়েছে, মা?? ও মা??
.
আহনাফের মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন”কিরে এমন ডাকিস কেন?”
.
উনি কে?
.
উনি না,তুমি কিংবা তুই বলতে পারিস,তোর ছোট,,তোর খালাতো বোন হয়
.
আমার খালাতো বোন?ইতি তো না,তাহলে কে?
.
দিবা,,তোকে ওসব পরে বুঝিয়ে বলবো,আগে বল বিয়ে কেমন খেলি
.
ভালো,অনেক টায়ার্ড হয়ে গেছি, আরিশার বাবা আমাকে দিয়ে ছেলের কাজ করিয়েছেন সব ,,
.
তা তো করাবেই,,ছোট মেয়ের হবু জামাই বলে কথা
.
কথাটা বলে মা মুচকি হাসলেন,আরিফ লজ্জা পেয়ে চলে গেলো
.
দিবা পর্দাটা নিয়ে আবারও বিছানায় বসলো,পর্দার কাপড় হলো তার একটা পুরোনো ওড়না,,পর্দা বানিয়ে বারান্দায় এসে টাঙালো সে সুন্দরমতন,,তারপর মিনিকে কোলে নিয়ে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকলো,,,আর আকাশের তারাগুলোর দিলে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো
তারাগুলো কি সুন্দর একসাথে আছে,এদের ও তো ফ্যামিলি আছে
আর আমার থেকেও নেই,,জীবনটা কত কঠিন,একজনের এক সমস্যা
কেউ সুখে নেই,সবার মনে চাপা কষ্ট আছে,তাও মানুষ প্রতিটা দিন যাপন করে,যেমনটা আমি করছি,মায়ের থেকে এত দূরে এসে আজ একটা দিন শেষ করতে আমার কত কি না করতে হলো তাও দিনটা শেষ হচ্ছে না আমার
খালামণি কাজ ও করতে দিচ্ছেন না,কাজে থাকলে দিন কেটে যেতো

নাফি লিস্ট নিয়ে ম্যানেজমেন্ট রুমে গেলো বসের হাতে দেওয়ার জন্য,,বস হলেন শেখর চৌধুরী,,উনি মুখটা গম্ভীর করে নাফির হাত থেকে কাগজটা নিলেন,উনি নাফিকে দেখলে সবসময় মুচকি হাসেন তবে আজ হাসলেন না
নাফি তাইই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে
.
কি হয়েছে?একটা মেয়ে এসে বললো তুমি নাকি তার সাথে মিসবিহেভ করেছো
.
আমি?কিসের মিসবিহেভ?
.
ওর হাতে সিল মারো নাই,ও চেয়েছিলো তুমি ওর হাতে সিল মারো
নাফি ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!!!বার এর মধ্যে এরকমটাই হয়,,তোমাকে বুঝতে হবে,,মেয়েদের এরকম হেট করলে তো চলবে না
কিছু কিছু মেয়েরা বারের ম্যানেজারকে দেখে পাগল হয় আর বারে বার বার আসে সেই কারণে,,সবগুলো মেয়ের বাবা হাই প্রোফাইলের, তাহলে জেনেশুনে নিজের পায়ে কুড়াল কেন মারছো?
.
টাকা পয়সা আছে তো কি স্যার?মেয়েগুলোর চরিত্র আছে??
নাফি সেই মেয়েটার হাত ধরে মুখের দিকে তাকাবে যার চরিত্রে কোনো দাগ নেই
.
তোমাকে বোঝানো অসম্ভব,তবে নেক্সট টাইম এমন এ্যাটিটিউড দেখাবে না,,জাস্ট হাত ধরে সিল মারাই তো শর্ত ছিলো,,এটাতে তো আর কিছু হবে না,তুমি তো অনেক মেয়ের হাতেই সিল মেরেছো,তাই নয় কি?
.
মেরেছি,বাট ঐ মেয়েটা গায়ে পড়া স্বভাবের,আমার ভাল্লাগে নাই বলে নিহাদকে দিয়ে করিয়েছি
.
আর এমন করবা না,,তোমার কথাবার্তা পারসোনালিটি তে ইম্প্রেস হওয়া মেয়ে আজ নতুন না,,এর আগেও অনেকে ইম্প্রেস হয়েছে,যার কারণে আমি তোমায় ম্যানেজার পদ দিয়েছি
আশা করি এই পদ হারানোর কেনো কাজ করবে না,এখন যাও
.
নাফি মুখে মাস্ক পরতে পরতে বেরিয়ে আসলো,,মেজাজটা বিগড়ে আছে,এই বারের অসভ্য মেয়েদের সাথে নাকি আমায় হাসি হাসি কথা বলতে হবে
মন চায় গলা টিপে মেরে দিই,কিন্তু নাহ!!চাকরি বাঁচাতে আমাকে এটা করতে হবে
.
পার্টি শুরু হয়ে গেছে,,শতে শতে মেয়ে এসেছে আজ,,নাফি এক পাশে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পার্টিটা দেখছে
সেই মেয়েটা দূর থেকে নাফিকে খেয়াল করছে,শেষে উঠে আসলো এদিকে,নাফির সামনে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকালো সে,,নাফি হাত ভাঁজ করে আরেকদিকে তাকালো,,মেয়েটা নাফির হাত ধরে ভাঁজ খুলে কাছে টেনে ফিসফিস করে বললো”লেটস্ ডান্স”
.
নিহাদ দূর থেকে হাত দিয়ে জোস বলছে,,
নাফি মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে নিজের সিটে এসে বসলো চুপচাপ,,মেয়েটা নাফির কাছে এসে রেগে রেগে বললো”খুব বড় ভুল করছো”
.
নাফি ওর কথার তোয়াক্কা না করে কাগজপত্র গুছাচ্ছে
মেয়েটা এবার নাফির সামনের টেবিলটার উপর বাম পা উঠিয়ে নিজের ডান হাত বাড়িয়ে হাতে পায়েল দেখিয়ে বললো”আমার এই পায়েলটা খুলে গেছে,লাগিয়ে দাও”
.
নাফি চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে,নিহাদ কাছে এসে বললো”ভাই কর,,মেয়েটা ঐ বিজন্যাস ম্যানের মেয়ে,,আর বস ও তাকিয়ে আছে এদিকে”
.
নাফি বসের দিকে তাকালো একবার,,তারপর বড় করে শ্বাস নিয়ে পানি খাওয়ার জন্য কাঁচের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ ,,গ্লাসটাকে খুব শক্ত করে ধরেছে সে
মেয়েটা পা আরেকটু এগিয়ে দাঁড়ালো,,তার চোখে মুখে জিতে যাওয়ার হাসি
এক মিনিটেই হাতের চাপে গ্লাসটা ভেঙ্গে চুরমার করে ফেললো নাফি,রক্তে ওর হাতে লাল হয়ে গেছে
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কাঁচের টুকরো গুলো ডাস্টবিনে ফেলে নাফি বললো”সরি মিস!!হাত কাটা গেছে আমার,পায়েল লাগানের সাধ্য নেই,আপনি বরং নিহাদের হাতেই লাগান”
.
আমাকে ছুঁলে মরে যেতা??
.
আমার প্রেয়সীর জন্য রাখা প্রেমের সাথে পানি মিশে যেতো,,ছুঁলে তাকেই ছুঁবো,নাহয় রক্ত ঝরাবো,,ইজ ইট ক্লিয়ার??
.
আমার তোমাকে চাই!!!হয় তুমি আমার হবে নয় তো এ জায়গা থেকে তুমি আউট হবে!!!
.
মেয়েটা পা নামিয়ে চলে গেলো হনহনিয়ে
.
ভাই! পায়েলটা লাগালে এখন তোকে এই থ্রেট শুনতে হতো না,কেন করলি এমন?এবার দেখিস এই মেয়েটা কি করে
.
নাফি মুখ থেকে মাস্ক খুলে বার থেকে বেরিয়ে গেলো
বারের সামনে একটা গার্ডেন আছে,,সেটাতে থাকা গুটিকয়েক চেয়ার সরিয়ে দূরের কোণার চেয়ারটায় বসলো সে,,চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললো
.
ওর আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে,, অনেক কষ্ট!!কেন মেয়েরা এমন করে,,তারা কি বোঝে না কিছু কিছু ছেলে একজনকেই ভালোবাসতে শেখে,আর আমি তাকে ভালোবাসি যাকে কিনা আমি চিনি না,তবে আমি জানি, আমি বিশ্বাস করি সে আমার জীবনে আসবে,,
.
নিহাদ দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো”নাফি তোকে ঐ বিজন্যাস ম্যান কি যেন নাম,,ও হ্যাঁ মিঃবাবুল ডাকছে,তার মেয়ে গিয়ে কিসব বলেছে তোকে নিয়ে”
.
টেবিলের উপরে থাকা টিসু দিয়ে হাতের রক্ত মুছে নাফি আবারও মাস্ক আর চশমা পরে ছুটলো সেদিকো
নিশ্চয় চাকরিটা গেলো
বাবুল এর সামনে এসে দাঁড়ালো নাফি,,বাবুল ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে মাস্ক আর চশমা সরাতে বললেন,,
নাফি মাস্ক আর চশমা সরালো,উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন”আমি চাই তুমি আমার মেয়ের সাথে ডান্স করো,টাইম স্পেন্ড করো,এখন”
.
সরি স্যার,,আমাদের বারের সকল কর্মচারীর কাজ হলো কাসটমারদের সকল কাজ করে দেওয়া তবে এটা নিয়ম নাই যে তাদের মেয়ের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে হবে
.
মিঃ বাবুল বারের বস শেখরের দিকে তাকালেন,,উনি ইশারা করলেন নাফির দিকে চেয়ে
নাফি চোখ বন্ধ করে রেখেছে,অনেক কষ্টে এখানে চাকরি পেয়েছে সে,,অন্য কোথাও এত ভালো বেতনের চাকরি সে পেতো না,,সে এই চাকরিটা হারালে সংসার কে চালাবে??
চোখ খোলার আগেই ঘাড়ে মেয়েটার হাতের স্পর্শ পেলো নাফি
মেয়েটা এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছে
ঠিক তখন অন্য একটা গান চালু করে দিয়েছে ডি.জে
Tu hi meri shab hai subah hai
Tu hi din hai mera
Tu hi mera rab hai jahaan hai
Tu hi meri duniya
Tu waqt mere liye main hoon tera lamha
Kaise rahega bhala hoke tu mujhse judaa
.
মেয়েটা ঘুরে ঘুরে নাফির ঘাড়ে হাত দিয়ে গানের সাথে মুখ মেলাচ্ছে,,,নাফি হাত মুঠো করে দুফোটা চোখের পানি ফেলে চুপচাপ মেয়েটার হাত ধরে ওকে ঘুরিয়ে এনে কোমড় জড়িয়ে ধরলো তার
মিঃ বাবুল হো হো করে হেসে হাত তালি দিয়ে দূরের চেয়ারে গিয়ে বসলেন,সবাই যার যার মতন পার্টিতে ইঞ্জয় করছেন আবারও
নাফি বুকে পাথর রেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মেয়েটার হাত ধরে নাচছে,,নাহিদের কষ্ট হচ্ছে নাফির চোখে পানি দেখে
গানটা শেষই হচ্ছে না,,শেষ হতে না হতেই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো
ঠিক তখনই নাফি ধরে ফেলেছে ওকে,,ওর বাবা ছুটে এসে বললেন ও নাকি আজ বেশি বিয়ার খেয়ে ফেলেছে,,উনার পরিবারের লোকেরা এসে মেয়েটাকে নিয়ে গেলো
নাফি বার থেকে বেরিয়ে গেলো সেসময়ে,আর থাকলো না ওখানে,তার মনটা ভেঙ্গে গেছে,,রাত বারোটা দুই বাজে এখন,,মাস্ক আর চশমা পকেটে ঢুকিয়ে বাইকে বসলো সে,,স্পিড বাড়িয়ে বাসায় ফিরছে সে

দিবা মিনিকে কাছে টেনে শুয়ে আছে,,এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আসলে ঘুম আসার কথা না,দিবার ও হয়েছে তাই,এপাশ ওপাশ করছে শুধু
বাকিরা ঘুমাচ্ছে,বাসার কাজে হেল্প করা মহিলাটি চলে গেছেন,,উনার নাম হলো হালিমা,,সকালে আসেন আর রাতে চলে যান
দিবা উঠে বসলো ঘুম আসছে না দেখে,,পানির তৃষ্ণা পেয়েছে বলে সে নেমে গেলো ডাইনিংয়ের দিকে
পানি ঢেলে এক গ্লাস খেয়ে চলে আসতে নিতেই দরজা খোলার আওয়াজ পেলো সে
বাসার দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো তাহলে খুলছে কি করে,চোর টোর নাকি?
টেবিলের উপর থেকে ফল কাটার ছুরি নিয়ে দিবা লুকিয়ে পড়লো ফ্রিজের পাশে,সে দেখলো লোকটা বাসায় ঢুকে সোজা আহনাফের রুমের দিকে যাচ্ছে,লোকটা আহনাফ নাকি অন্য কেউ সেটা সিউর হতে দিবা ও পিছু পিছু গেলো,,
রুমে ঢুকেই লাইট জ্বালালো আহনাফ
দিবা মুখ দেখে সিউর হলো এটা চোর না,এটা আহনাফ
নিশ্চিত হয়ে সে মুখের সামনের চুলগুলো কানের পিছনে গুজে চলে যেতে নিতেই শুনতে পেলো আহনাফ ব্যাথায় ছুটফট করছে
দিবা থেমে গিয়ে পিছনে তাকালো আবার
আহনাফ বিছানায় বসে হাত ঝাঁকড়াচ্ছে শুধু,, চোখদুটো খিঁচিয়ে
দিবা ওর হাতের দিকে খেয়াল করলো, রক্ত শুকিয়ে লাল হয়ে আছে ওর হাতটা,,দিবা তো ভয় পেয়ে গেলো,ভাবলো এমনটা কি করে হলো,ওর কি যাওয়া উচিত?
এসব ভাবতে ভাবতে একটু এগিয়ে আসতে যাওয়ার আগেই টের পেলো আহনাফ কাঁদছে
দিবা আর এগোনোর সাহস পেলো না,চলে আসলো নিজের রুমে
আচ্ছা ছেলেরা কেন কাঁদে??আমরা মেয়েরা এমনি এমনি কাঁদি কারণ আমরা কান্না থামাতে পারি না তাই
তাহলে ছেলেরা কেন কাঁদে?উনার হাতে ব্যাথা বলে কাঁদছিলো?
আমি কি মলম লাগিয়ে দেবো?
.
আহনাফের সাথে করা ঝগড়া ভুলে দিবা আবারও রুম থেকে বের হলো আহনাফের হাতে মলম লাগাবে বলে,,দরজায় হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিলো খোলার জন্য কিন্তু আহনাফ ভেতর থেকে দরজাটা দিয়ে ফেলেছে
দিবা তাই আর ডাকলোনা ওকে ,,রুমে ফেরত চলে আসলো সে
ঘুম আসছে না দেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো দিবা
গ্রিল থেকে ওড়নাটা সরিয়ে ঢাকার শহরটাকে দেখায় মনযোগ দিলো সে,,অন্ধকার নাহ,,যার যার বাসায় আলো জ্বলছে,,ঢাকার মানুষ এত জলদি ঘুমায় না
দিবা সামনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আহনাফের বারান্দার দিকে তাকাতেই ওকে দেখতে পেলো,আহনাফ গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দূরের পানে চেয়ে আছে নিঃশব্দে
দিবা একটু এগিয়ে বললো”আপনার হাতে কি হয়েছে?”
.
আহনাফ চমকে পাশে তাকিয়ে দিবাকে দেখে আর এক মূহুর্ত ও দাঁড়ালো না,রুমে ফেরত চলে গেলো
আর দিবা বোকার মতন দাঁড়িয়ে ভাবছে সে কি এমন বললো যে আহনাফ জবাব না দিয়েই চলে গেলো
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here