সর্বনাশিনী পর্ব-৩

0
2735

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৩।

আমরিন ভিলা…
রাতের ঘন কালো আকাশ সূর্যের ছোঁয়া পেতেই পালিয়ে গেছে। মিষ্টি রোদ গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে প্রবেশ করছে আমরিন ভিলার সব থেকে বড় কামরার মাস্টার বেডটির মাঝে শুয়ে থাকে এক যুগলের উপর। সাদা চাদরে ডাকা দুজন মানবের দেহে। বোঝায় যাচ্ছে দুজন নর-নারীর আদিম কামনা-বাসনায় রাতটি খুব সুন্দর কাটিয়ে এখন ক্লান্ত শ্রান্ত। দিলশাদ আমরিন। দ্যা বিজনেস কিং। রগচটা, একঘেয়ে, গাম্ভীর্যপূণ মুখের আদল। ঘন কালো কুচকুচে চুলের মাঝে আঙ্গুল চালিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সাদা দেহের নারী মৃদু কম্পন কন্ঠে ডাকলো,

” দিলশাদ?”

সুন্দরী রমনীর বুকের মাঝে শুয়ে থাকা দিলশাদ মৃদু মৃদু পলকে কুচকে পিটপিট করে চোখ খুললো দিলশাদ। ঘন কালো কুচকুচে চোখের মনিতে ডীপ ব্লুর স্পর্শ। সুন্দর চোখ জোড়ায় শক্ত, তীক্ষ্ণ চাহনি মেলে দিলো সুন্দর রমণীর দিকে। শক্ত পক্ত হাতে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিলো তাকে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

” তুমি এখনো এখানে কি করছো? গেট আউট? ”

বলতে বলতে বিছানা থেকে নেমে পড়লো দিলশাদ। নাইট গাউনটি তার অত্যশ্চার্য দেহেটি লুকিয়ে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশরুমের ঠিক সামনে এসেই থেমে গেলো দিলশাদ পিছনে না ফিরেই ডান হাতের দু’টি আঙ্গুল তুলে ঠান্ডা ভার গলায় বলল,

” তোমার কাছে দু’ মিনিট সময় আছে, ইউ যাস্ট গেট আউট মাই হাউজ!”

বলেই ঢুকে গেলো ওয়াশরুমের ভিতরে। বাহিরে রয়ে গেলো সুন্দরী রমণীর ক্রোদনরত মুখ আর ভাঙ্গা হৃদয়। মারিয়া উঠে দাঁড়ালো। দিলশাদের কামরায় হক বসাবার বৃথা চেষ্টাই না করছে সে। কিন্তু দিলশাদ যেন পাথর। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেরনদেহখান একবার দেখে নিলো। এই চেহারার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ তার ফ্যান। চলচ্চিত্র জগৎ এর কত দাম, কত মূল্য। মূল্য নেই শুধু দিলশাদের কাছে। শুধু শারীরিক চাহিদাটুকুর জন্যই কি সে? তা-ও আবার দিলশাদ এতেও যেন অতৃপ্ত কি চাই তার? কি চাই? এসব আকাশ কুসুম ভেবেই মারিয়া চোখের জল টুকু মুছে নিলো। দিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে চোখের কোনের জল টুকু মুছে বিদায় হলো মারিয়া।

ঘন্টাখানেক পানির নিচে দাঁড়িয়ে থেকে-ও দিলশাদের শরীরের গরম যেন কমচ্ছে না। না ঠান্ডা হচ্ছে বুকের ভিতরটা। চোখ দুটি জলছে দিলশাদের। বুকের ভিতরে মাঝে মাঝে খাঁ খাঁ করে চৌচির মাঠ। কেমন যেন খালি খালি। যেন ভিতরটা তছনছ হয়ে গেছে, বাহিরটা শুধুই আবরণ। দিলশাদ এক হাত ওয়াশরুমের দেয়ালে রাখলো। চোখ দুটি বুঝতেই ভেসে উঠলো একটি মুখ। বিড়বিড় করে বলল,

” তুমি কি সত্যি-ই মরে গেছো?”

শেখ বাড়ি….

আঁধারের সাথে আলোর গভীর সম্পর্ক। আঁধারের মাঝে হারিয়ে যায় ছায়ার অস্তিত্ব কিন্তু এক চিলতে আলোর মাঝেই ছায়ার দেখা মিলে। কখনো দুঃখ বা কখনো কষ্ট ছায়া ঠিকি তার বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করে। আঁধার যদি কখনো গভীর ঘন কালো রাতের মতো লম্বা হতে থাকে তখন আরো কোনো মানুষ আপনার পাশে থাকুক আর না থাকুক। আপনার অস্তিত্ব আপনার ছায়া আপনার পাশেই উপস্থিত থাকবে। যেভাবে স্নেহার জীবনে হয়েছে। ছোট থেকেই বন্ধু বলে সাথে পেয়েছে নিজের ছায়া, নিজের অস্তিত্ব। আজ-ও একটি রাত কেঁটে গেছে বাহিরের আলো আধারের খেলা দেখতে দেখতে স্নেহার। পুরোনো স্মৃতি আজো তারা করে বেড়ায় তাকে। স্নেহা চোখ বুঝলো। মিষ্টি রোদের সাথে
তাল মিলিয়ে শীতল বাতস স্পর্শ করে গেলো স্নেহার ঘন কালো চুল। স্নেহার চোখ ভিজে উঠলো পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠলো। আজকের মতো সে-দিনও ছিলো আয়োজন আমেদ ফূর্তি। আজ থেকে ঠিক দু বছর আগের ঘটনা। দিলশাদ আমরিনের বিজনেস সাফ্যলের তৃতীয় বছর পদার্পণে সেদিন-ও বড় সড় পার্টি দিয়েছিলো। সেদিন এনাউন্সমেন্ট হয়েছিলো খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে যাচ্ছে সেহের তালুকদারকে। সেহের তালুকদার, যার ভাগ্যে ছিল দিলশাদ। নাকি অনাথ নামহীন কিংবা নাজায়েজ মেয়ে স্নেহা। দিলশাদ দেশে ফিরেই সেহেরকে আপন করে নেয়। এবং দুজনের ভালোবাসার গুঞ্জন প্রতিটি খবরের কাগজে কাগজে থাকতো তখন। কিন্তু ঠিক তাদের বিয়ের দিন ঘটলো অঘটন। সেহেরকে সব থেকে বড় নামি দামি পার্লারে সাজাতে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে যায় স্নেহা। বধূ সাজে সেহেরকে খুব সুন্দর লাগছিলো। সেখানে না সেজেই সেহেরকে আরো সুন্দর লাগছিলো। সেহের প্রতিবার স্নেহার এই রূপে হিংসা করতো। এমন-ও অনেক দিন গিয়েছিলো স্নেহার এই রূপকে ধংস করতে গরম তেল বা গরম পানির ব্যবহার করতেও পিছপা হয়নি সেহের। কিন্তু ভাগ্য বসতো বেচে ফিরেছে সে। স্নেহা সেহেরের পাশে এসে দাঁড়ালো,

” দিদিভাই, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”

সেহের নাক ছিটকালো। সেহেরের মাথায় তখন চিন্তার ভাব। সে বলল,

” স্নেহা আমার ফুল কম পড়ছে সামনেই একটি ফুলের দোকান আছে, যা ফুল নিয়ে আয়!”

স্নেহা প্রতিউত্তরে মাথা নাড়ালো। স্নেহা ছোট থেকেই ভুতি টাইপের মেয়ে ছিলো। অনাথ আশ্রমের নরকে ফিরে যাওয়ার ভয়ে সে সব সময় ওবিডিয়েন্ট ছিলো। সেহের সব সময় ওকে এই বলে ভয় দেখাতো। আর ছোট স্নেহা ভয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে যেত। স্নেহা বের হতেই সেহের রেডি হয়ে গাড়িতে করে চলে যায়। স্নেহাকে একা ফেলে যায়। স্নেহা বুঝতে পেরে গাড়ির পিছনে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু গাড়িটি কিছু দূরে গিয়েই বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা লেগে যায়। এবং সেহের সেখানেই মারা যায়। আর এই দুঃখ সইতে পারে না দিলশাদ। সে পাথর হয়ে যায়। এই ঘটনার জন্য বরাবরই দায়ী করা হতো স্নেহাকে। তালুকদার বাড়ির মুরুব্বি শিথি শেখ স্নেহাকে সেদিন মেরে আধ মরা করে ফেলেন। সকলেই দোষারোপ করেন স্নেহা ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছে। সম্পত্তির লোভে, দিলশাদকে পাওয়ার লোভে। কিন্তু স্নেহা চিৎকার করে বলে,

” আমি কিছু করিনি!”

কেউ বিশ্বাস করেনি সেদিন। কেউ না। উল্টো সর্বনাশিনীর খ্যাতাব দেয়া হয় তাকে। এবং সেহেরের বাবা রাগে এক মধ্যে বয়সী লোকের সাথে ১৯ বছরের স্নেহার বিয়ে ঠিক করে। স্নেহা সেদিন কেঁদে কুটেও রক্ষে পায়নি। সেহেরের বাবা-মার পায়ের কাছে পড়ে কেঁদেছে সে,

” বাবা-মা রহম করো, আমি বিয়ে করবো না। আমি দূরে কোথাও চলে যাবো। আমার জীবন এভাবে নষ্ট করো না!”

সেদিনের আত্মা চিৎকার না সায়রার কানে গেছে না রায়হানের। স্নেহাকে বিয়ের পিড়িতে বসতেই হয়েছিলো। সাধারণ একটি বেনারসি শাড়ির উপর একটি গোল্ডেন কালারের ওড়না মাথায় টায়ড়া, নাকে নথ, গলায় গাড় আর কানের দুল। হাত ভর্তি কাচের চুরিতে ছোট বালিকাবধূ মনে হচ্ছিলো স্নেহাকে। স্নেহা ভেঙ্গে পড়েছিলো ভিতরে ভিতরে। দিলশাদকে মনে মনে সে অনেক ভালোবাসতো। ভেবে ছিলো আর কাউকে কখনো এই মন প্রান দিবে না। সে তো অপেক্ষা করছিলো দিলশাদের। স্নেহা কথা রেখেছিলো, হ্যাঁ দিলশাদের কথা রেখে ছিলো। অপেক্ষা করেছিলো। স্বপ্ন দেখেছিলো দিলশাদের বউ হবার। কিন্তু দিলশাদ তো তাকে ভুলে গেছে। সে সেহেরকে বেছে নিয়েছিলো। সেহেরকে ভালোবেসে ছিল। বাসবেই না কেন? নামহীন এক মেয়েকে কেউ আপন করতে চায় না। সব্ই ব্যবহার করতে চায়। যেমনটি প্রতিবার তাকে করেছে এই তালুকদার পরিবার। ভেবেই স্নেহা আরো জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো। এদিকে যখন কবুল বলার সময় হলো, স্নেহা মুখে কুলূপ এঁটে নিলো। তা দেখে সায়রা স্নেহা ইচ্ছে মতো চড় থাপ্পড় মেরে বলল,

” আর কত পরের ঘাড়ে বসে খাবি, স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, আর কত সর্বনাস করবি আমার? আর কত??”

স্নেহের কান্নার কারণে শ্বাস আটকে গেছিলো। তবুও সে বলে নি। কিন্তু এতেও রক্ষে নেই যেন। শিথি তালুকদার জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে এসে স্নেহার পায়ে ছুঁয়ে দিতেই স্নেহা চিৎকার করে উঠলো। এর পর আর ছোট স্নেহা সইতে না পেরে হেঁচকি তুলে যেই কবুল বলতে নিলো তখনি একজল লম্বা এক দীর্ঘকায় দেহের ব্যক্তি এসে দাঁড়ালো স্নেহার সামনে। স্নেহার কান্নার জন্য চোখ দুটি ফুলে গেছিলো। টমেটোর মতো গাল দুটি লাল টুকটুকে হয়ে গেছিলো। হাটু ঘেরে যুবকটি বসলো স্নেহার কাছে। স্নেহে খুব কষ্টে উচ্চারণ করলো,

” দি..ল.. শা..দ!”

কিছু একটা পড়ার শব্দে স্নেহার ধ্যান ভাঙ্গলো।সময়ের গতির সাথে স্নেহা এখন সুস্থ । আজ শেখ বাড়িতে চলছে আয়োজন। ছোট মেয়ে ফিরে আসার খুশিতে ধুমধাম করে চলছে সব। স্নেহা সপ্তপর্ণে শ্বাস ছাড়লো, অন্যের অস্তিত্বকে নিজের মাঝে বাঁচিয়ে রাখা অনেক বড় দায়িত্ব। যা পদে পদে আমল করবে স্নেহা। এই পরিবারের মানুষ গুলোর কাছে ঋণি যে স্নেহা। স্নেহার ভাবনার মাঝে দরজায় টোকা পড়লো। স্নেহা তার মৃদু কর্কস কন্ঠে বলল,

” কামিং!”

একজন কাজের লোক কয়েকটি বেগ নিয়ে হাজির হলো,

” মেডাম বড় স্যার এইগুলো পাঠিয়েছেন আজকে পার্টিতে পরার জন্য।”

” ঠিক আছে!”

কাজেরর লোকটি চলে গেলো। স্নেহা কাপড় গুলো বের করে ছুঁয়ে দেখলো। তালুকদার বাড়িতে থাকার সময় স্নেহাকে নব সময় সেহের পুরোনো কাপড় পড়তে দেয়া হতো। সেগুলোই সুন্দর করে ধুয়ে আয়রন করে পড়তো স্নেহা। একটি নতুন জামার জন্য অপেক্ষা করতে হতে দুটি ঈদের। অধির আগ্রহে দিন পার করতো স্নেহা। ক্যালেন্ডার দাগ কেঁটে রাখতো একটি ঈদ গেলে। স্নেহার চোখ আবার জ্বলে উঠলো। বড় বড় চোখ জোড়া টলমল করছে পানিতে। কিন্তু স্নেহা নিজেকে সামলে নিলো। ঘন ঘন ঢুক গিলে তৈরি হয়ে বের হতেই বাহিরে তরুনকে সোফায় বসে সিগারেট টানতে দেখলো। স্নেহা মুচকি হেসে বলল,

” ভাই, আপনি কখন এলেন?”

তারুন তার দাম্ভিক মুখখানায় বিষন্ন হাসলো,

” মাত্রই। আমার বোনটিকে সুন্দর লাগছে।”

স্নেহা প্রতিউত্তর হাসলো।তরুনের কাছে গিয়ে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলো। অভিমানী কন্ঠে বলল,

” ভাই আপনাকে না করেছি এসব খেতে!”

তরুন বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” অনেক দিনের অভ্যস তো। চেষ্টা তো করছি!”

স্নেহা তরুনের হাত ধরে বলল,

” আপনি এমন কেনো ভাই?”

তরুন ফিকে হেসে বলল,

” আমি এমনি।”

” কারণটা তো বোন হিসেবে জানতেই পারি!”

” হুম পার, আমারো একটি গল্প আছে। আমি একজনকে হারিয়ে ফেলেছি, নিজের অবহেলার জন্য। এখন আর তাকে খুঁজে পায় না আর হয়তো পাবো-ও না।”

স্নেহা আশ্বস্ত করে বলল,

” ট্রু লাভ কখনো হারায় না ভাই, দেখবে সে চল আসবে!”

তরুন বলল,

” আই হোপ সো! কিন্তু তোমার ভালোবাসার মানুষ কিন্তু আজ আসবে। দ্যা গেম স্টার্ট নাউ!”

স্নেহা মাথা নাড়লো। সময় এসে গেছে শত্রু পক্ষের মুখোমুখি হওয়ার।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here