সর্বনাশিনী পর্ব-৭

0
2364

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৭।
ইট পাথরের শহরের কোলাহল বড় বড় দালানের উপরে পৌঁছে খুব কম। গাড়ি হর্ণ, যানবাহনের তীব্র শব্দ থেকে বাঁচতেই দিলশাদ আমরিন তার এ্যামপ্যায়ারটির সর্ব শেষ তালায় নিজের কেবিনটি করেছে। নিরব আর নিরবতার জন্য। গত একটি বছর দিলশাদের জীবনে বড্ড অগোছালো, ঝামেলাপূর্ণ ছিলো। কাজের মাঝেই বেঁচে থাকার এক মাত্র আশা খুঁজে পেয়েছে যেন। কাজের মাঝে মনের কোনের দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা। নিজেকে কেমন যেন রোবট বানিয়ে ফেলেছে সে। দিলশাদ কাজের মাঝেই স্বচ্ছ কাচের দেয়াল ছেদ করে বাহিরের কেবিনে আকৃতা শেখকে বসে থাকতে দেখে বুকে মাঝে ধক করে উঠলো। ” স্নেহা!”
নাহ্.. নিহাত শুধু মনের কল্পনা। শুধুই হ্যালোসিনেশন।

দিলশাদ গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে। চোখ জোড়া আজ খুব জ্বলছে। বুকের ভিতরটা পুরছে। হয়তো হাতের কাছে বন্দুক থাকলে হৃদয় নামক যন্ত্রটাকে ঝাঝরা করে ফেলতো এখনি। নিজের ভালোবাসা কিভাবে সে চিন্তে পারলো না? কিভাবে? কিভাবে হারিয়ে যেতে দিলো সে? চোখ বুঝলো দিলশাদ। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে। টমেটোর মতো লাল গাল আর বড় বড় চোখ। ঠোঁটের মাঝে হাসির খিলখিল।

দিলশাদ আমরিন। ছোট থেকে এই যুবক নিজের ভাবান্তর সম্পর্কে কাউকে বুঝতে দেয়নি। না তার সম্পর্কে কেউ কোনো ধরণা করে মিল পেয়েছে। ছোট থেকেই দিলশাদ রগচটা, একরোখা মনোভাবের ছিলো। যা তার পছন্দ হতো? যে কোনো মূল্যেই চাই। সেটি খেলনা হোক আর কোনো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। দিলশাদ ছোটতেই ঠান্ডা গম্ভীর শীতল প্রকৃতির ছিলো। অতটুকু বয়সেই ম্যাচুরিটি ভাব চলে এসেছিলো তার মধ্যে। এভাবে ছেলেকে অন্য সব বাচ্চাদের থেকে আলাদা দেখে বিন্দু আর শিশির খুব কষ্ট পেতো, ভয় পেতো। কেন তার ছেলেটি এমন। যেন এক্সট্রা অরডিনারি কিছু ছেলেটির মাঝে। দিলশাদ যখন ১১ বছরের তখনি ২ টা ক্লাস স্কিপ করে এবং উপরের ক্লাসে ভর্তি হয়ে যায়। ওইটুকুন বয়সেই কম্পিউটার হ্যাকিং করা শিখে ফেলে। ইন ফেক্ট যে কারো ফোন ইজিলি ট্রাকিং করতে পারতো। এমন আরো অসম্ভব কিছু এইটুকুন বয়সেই আয়ত্ত করে ফেলে দিলশাদ।দিলশাদের জীবন এমনি চলছি একদিন তার বাবা-মা একটি ছোট পরির সাথে দেখা করালো। ছোট পরি, গোল গাল মুখ, টমেটোর মতো লাল গাল, বড় চোখ আর তার পলক। দিলশাদকে আকর্ষণ করলো। তারপর থেকেই সেই ছোট মেয়েটি তার জীবন হয়ে উঠলো। নিজের জীবনে আর কোনো মেয়ের জায়গায় ছিলো না। দিলশাদ আমরিন এই শীতল বরফ মানুষটি তার ভালোবাসার জন্য সব করতে পারে। আর ওর পরিবার আর ভালোবাসার মাঝে যারা আসে? ধংস করতে কোনো দ্বিধাই কাজ করে না। দিলশাদ সেই বাচ্চা কাল থেকে মনের কোনো পোশা মানুষটির জন্য অপেক্ষা করতে করতে বড় হচ্ছিলো। একদিন দিলশাদ তার ভার্সিটি থেকে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঠিক তখনি টুং করে নোটিফিকেশন বেজে ওঠে। দিলশাদ ফোন নিয়ে আনমনেই চেক করতে লাগলো ফোন। এই একটা নোটিফিকেশন দেখেই দিলশাদের চোখ ছানাবড়া। খুশির এক ফোঁটা ছোয়া ছিলো চোখে মুখ।

” সেহের তালুকদার। এটা কি সত্যি তুমি? আমার ছোট পরি?”

দিলশাদ সেহেরে প্রোফাইল খুলে প্রোফাইল পিকচারটা জুম করে দেখলো। খুশিতে তার বুক ভরে গেলো। হ্যাঁ এটাই তো তার ছোট পরি। গলার মাঝে এখনো সেই লকেটটা সেহের সুন্দর গলার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। দিলশাদ জলদি জলদি এক্সেপ্ট করলো ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট। কিন্তু ততখনে সেহের অফলাইনে চলে গেছে। দিলশাদ দীঘশ্বাস ছাড়লো। ফেইসবুক থেকে বেরিয়ে বিন্দুকে কল করলো। দিলশাদের বুকের ভিতরটা এখন খুশির ঢোল বাজছে। মনে হচ্ছিলো এই দৌঁড়ে দেশে ফিরে প্রিয় মানুষটিকে কাছে টেনে নিতে। ফোনের ওপাশে রিসিভ করতেই দিলশাদ তার উৎসুক গলায় বলল,

” আম্মু? তোমার কি মনে আছে আমরা দেশে থাকতে তালুকদার আঙ্কেলের বাসায় গেছিলাম?”

” হ্যাঁ মনে আছে তো, তুই তাদের মেয়ে তোর তাবিজটি দিয়ে এসেছিলি যে!”

” হ্যাঁ আচ্ছা ওর নাম কি? ”

বিন্দু কৌতূহল কন্ঠ বলল,

” ব্যাপার কি বলতো? হঠাৎ তালুকদার বাড়ির মেয়ের উপর এত ইন্টারেস্ট জাগাচ্ছে কেন?”

দিলশাদ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। এবং চুপ করে যায়। গম্ভীর কন্ঠে কিছুক্ষণ পর বলে উঠে,

” আম্মু তুমি বলবে? না কি ফোন রাখবো?”

বিন্দু হন্তদন্ত হয়ে বলল,

” রাগিস কেন বাপ, বলছি তো, তালুকদার বাড়ির মেয়ের নাম সেহের!”

দিলশাদের ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ছেয়ে রইলো। বিড় বিড় করে বলল,

” সেহের!”

সেদিনের পর থেকেই সেহের ছিলো দিলশাদের সব কিছু। দিলশাদের জান প্রাণ সব। সব সময় তার ভালবাসার জন্য ছিলো লোয়েল। সেহের সামনে সব মেয়েরাই ছিলো অদৃশ্য।

কিন্তু দিলশাদ আমরিন ভুল করেছিলো। চিন্তে ভুল করেছিলো তার প্রাণ পাখিটিকে তার ছোট পরিটিকে।
দিলশাদ হা করে শ্বাস ছাড়লো। আকৃতা শেখের দিকে আবার তকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কেনো এত টানে এই মেয়েটি তাকে? কেনো?

————–

শীতকালের মাঝে হঠাৎ টিপ টিপ বৃষ্টি। পরিবেশটি আরো রোমাঞ্চকর করে তোলে। চারিদিকে ঘন কালো অন্ধকার ধেয়ে আসে পৃথিবীর বুকে। বৃষ্টির প্রতিটি শীতল ফোঁটায় শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এমন-ই সময় বিরক্তি নিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সেহের। হুট করেই গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। ঘন কালো আধার তার উপর কাজ বাড়াতে বৃষ্টি। উফ! কি বিরক্তি! সেহের এদিক সেদিক দেখলো। নাহ্ এই সন্ধ্যা কোনো গাড়ি তো দূর মানুষের ছায়া টুকু নেই। সেহেরের এমন এক নির্জন জায়গায় হুট করে ভয় লাগতে শুরু করেছে। দূরে কোথাও নেকড়ে কুকুরা ডাকাডাকি করছে। হুট করে বুঝি কোনো পাখি উড়ে গেলো?? হাড়কাঁপানো ভয়ে সেহের কোনো রকম ফোনটি হাতে নিলো। দিলশাদ লিখা নাম্বারটিতে ডায়েল করতেই ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ মেয়েলী কন্ঠ ভেসে এলো।

” ম্যাম স্যার মিটিং -এ!”

সেহেরের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না। কোনো রকম আটকে আসা গলায় বলল,

” আ.. মা..র গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। তোমার স্যারকে বলো আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। হ্যালো হ্যালো!”

কেটে গেলো কলটি। সেহের অজানা ভয়ে এদিক সেদিক চাইলো। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। হুট করে একটি কালো ছায়া হেলতে দুলতে এদিকে আসতে দেখা গেলো। রাস্তা ধারের লাইটের আলো গুলো আরো.. আরো.. ভয়ানক করে তুলছে ছায়াটিকে। সেহের ভয়ে গুটিয়ে গেলো। ঠিক তার পিছন থেকেই একটি হাত শক্ত করে চেপে ধরলো সেহেরকে। এবং এক টানে নিয়ে গেলো রাস্তার ধারের ঝোপাটার আড়ালে। এবং ফেলে দিলো মাটিতে। বৃষ্টির ফোঁটায় ঝোপের ধারে কাঁদা মাটি লেগে গেলো সেহের শরীরে থাকা ওয়েস্টার্ন ড্রেসটিতে। সেহের আতঙ্কে কেঁপে উঠলো। একজন বীভৎস দেখতে লোক সেহেরের সুন্দর পা টেনে ধরলো। মুখ দিয়ে আপত্তিকর শব্দ বের করে হেঁচকি তুলে হাসতে লাগলো। বীভৎস লোকটির হাত চলতে লাগলো সেহেরের নরম মাংসপেশিতে। সেহের কাতরাতে লাগলো গলা কাঁটা মুরগীর মতো,

” প্লীজ আমাকে ছেড়ে দাও। লিভ মি। প্লীজ!”

লোকটি সেহের এমন কাতরানোতে চোখ মুখ কুচকে ঠাটিয়ে এক চড় বসালো সেহেরর সুন্দর গালে। সেহেরের মনে হলো কোনো ভয়ংকর হায়না তাকে গিলে খাচ্ছে। সেহের এতটা আতঙ্কে যে চিৎকার করতে ভুলে গেছে। এদিকে লোকটি তার কাপড় ছিড়ে ফেলেছে অর্ধেক। সেহের কেঁদে কুটে গাঙ ভাসাচ্ছে।কিন্তু কোনো লাভ হলো না। লোকটি এবার তার প্যান্টের চেন খুলতেই ধুম করে গিয় দু হাত দূরে ছিটকে পড়লো। সেহের সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিচু গলায় ক্রোদন রত কন্ঠে বলল,

” দিলশাদ। দিলশাদ তুমি এসেছো। তুমি না এলে…”

কথাটুকু বলেই ফুপিয়ে উঠলো সেহের। দিলশাদ কিছু বলল না। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকলো বীভৎস লোকটার দিকে।যাকে ঘিরে রেখেছে দিলশাদের বডিগার্ডরা। লোকটিকে মনে হচ্ছে বদ্ধ পাগল। না যেন কতদিন গোসল করে নি, দাঁত মাজে নি। এই মুখ নিয়ে সেহের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বন করছে এই নিকৃষ্ট লোকটি? ছিঃ ভেবেই বমিটিং করতে ইচ্ছে করছে সেহেরের। দিলশাদ সেহেরকে নিজের কোটটা দিয়ে ঢেকে দিলো। বীভৎস দেখতে লোকটিকে আরো কয়েকটা মার মেরে পুলিশকে ফোন করলো দিলশাদের বডিগার্ডরা।আর দিলশাদ সেহেরকে সেখান থেকে নিয়ে চলে গেলো।

এসব কিছু দূর থেকে দেখে স্নেহার বুকের ভিতর ঝড় উঠতে লাগলো। ধংস করে দিতে লাগলো শরীরের অঙ্গ পতঙ্গ। এসব কিছুই ছিলে স্নেহার প্ল্যান। ঠিক যেমনটি সেহের তার সাথে করেছিলো। একটি রেস্টুরেন্টের বারে কিছু মাতালদের মুখে ছেড়ে দিয়েছিলো। সেখান থেকে কোনো রকম নিজের সম্মান টুকু বাঁচিয়ে ফিরেছিলো স্নেহা। কই ছিলো সেদিন দিলশাদ? যতবার বিপদে পড়েছে স্নেহা কেউতো আসেনি তাকে বাঁচাতে। কেউ না। আর সেহের? ও বিপদে পড়তেই দিলশাদ সবসময় হাজির হয়। সবসময়। স্নেহের বুক ফাঁটা চিৎকার গিলে ফেললো। চোখের জল টুকু মুছে চোখে পড়েনিলো কালো রঙের চশমা। ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময়ী হাসি ফুঁটিয়ে স্নেহা বলল,

” সেহের? দিলশাদ কি সব সময় থাকবে তোমার সাথে? নাহ্! থাকবে না। আমার সাথে তুমি যা যা করেছো সব এবার তোমার সাথে-ও হবে। একেই বলে কারমা…..! যেমন বীজ বপন করবে তাইতো পাবে! এটাতো কেবল শুরু সেহের!”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here