রসিকতার ছলে বান্ধবীকে বলেছিলাম ‘তোর সতীন হবো। দুই সতীন একসাথে থাকব। মাঝে মাঝে বরকে নিয়ে খুব ঝগড়াও করব।’
কে জানত, কথাটা এভাবে সত্যি হয়ে যাবে। মন থেকে বলি নি। তবুও কেন হলো? না হলেও তো পারত!
আজকে সন্ধ্যায় দিগন্ত ভাইয়াকে আমার স্বামী হিসেবে গ্রহন করলাম। কবুল বলে বৈধভাবে।
‘দিগন্ত’ যাকে আমার কলিজার বান্ধবী প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। আমরা দুই বান্ধবী, সাফা ও শিফা। সাফা আমার বান্ধবীরুপী বোন আর আমি শিফা। সাদামাটাভাবে বিয়ের কার্য সম্পূর্ণ করে চললাম এক নতুন পথের উদ্দেশ্যে।
নিজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জান-যৌবন সব লিখে দিলাম দিগন্তের নামে। এই মানুষটা এখন আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সঙ্গী। আসার সময় দেখলাম আমার পাগলটা অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। হয়তো হৃদয়টা খুব জ্বলছে। কষ্টও হচ্ছে বোধহয়! উফ, একটু ভুল বলে ফেললাম যে। সে আর আমার নয়। আমি এখন দিগন্তের নববধূ।
ওকে ছিন্ন করে’ই আসলাম। সে এখন মরিচিকা মাত্র! তবে আমার বুকটা কেন জানি জ্বলছে।দম আটকে আসছে। চোখ দু’টোও বড্ড জ্বলছে।ওহ, বেশি সুখে হয়তো! অদ্ভুত, সুখেও তাহলে এমন হয়। পাশের মানুষটা নির্বাক হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কথা নেই! জোরপূর্বক বিয়ে করাতে বুঝি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। এছাড়া উপায়’ও ছিল না।
আমিও যে দায়বদ্ধ। সেই দায়মুক্ত হতে দায়িত্বটা বুঝে নিলাম। তাছাড়া পাশে বসা শ্যামবর্ণের পুরুষটাকে বান্ধবীর জন্য সেই পছন্দ করেছিল।
আর গর্ব করে বলেছিল,
-‘শোন, একেই আমি দুলাভাই বানাব। উনাকে ভালোবাসতে শুরু করে দে। তোদের বিয়ে অবধি এগোনোর দায়িত্ব আমার।’
শিফার কথা আর দিগন্তের ব্যবহারে সাফা সত্যি প্রণয়ে আক্রান্ত হয়েছিল। ক্ষণে ক্ষণে অনুভূতিটা গাঢ় হচ্ছিল। সে মেনেও নিয়েছিল, দিগন্ত’ই ওর জন্য সেরা। কারণ সাফার ভাষ্যমতে, শিফার মানুষ চিনতে ভুল হয় না। তাই পৃথিবী উল্টে গেলেও দিগন্তকেই সে ভালোবাসবে, আর বেসেও ছিল। কিন্তু আকস্মিক ঝড়ে সব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। গাড়ির হর্ণের শব্দে শিফার ভাবনায় ছেদ ঘটল। দিগন্ত ওর দিকে একবার তাকিয়ে নামতে ইশারা করল। দিগন্তের বাবা-মা, ভাই-ভাবি’রা ওদের আগেই চলে এসেছেন। সাদামাটা একটা সালোয়ারকামিজে শিফা শশুড়বাড়িতে প্রবেশ করল। শাশুড়ি আর বড় জা মিলে ওকে সোফায় বসিয়ে কিছু রীতিনীতি পালন করলেন। শিফার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। এখানে সাফার থাকার কথা। অথচ পরিস্থিতি ওকে এনে দাঁড় করিয়েছে। আর ওদের বিয়ের খবরটা যেন বাতাসের বেগে ছড়িয়ে গেছে। প্রতিবেশী’রা বউ দেখতে এসেছে। দিগন্তের আম্মু খুব ধূর্ত মহিলা। ঘরের খবর যেন বাইরে প্রকাশ না পায়। এজন্য
বড় পূত্রবধূকে ইশারায় সব সামলাতে বললেন। আর শিফাকে শাড়ি গয়না পরিয়ে এনে সোফায় বসিয়ে দিলেন। সবাই বউ দেখছে! খুব কাছের আত্মীয়রাও এসেছেন। সাথে যুক্ত আছে, নানান কৌতুহল আর প্রশ্নের পাহাড়। ততক্ষণে দিগন্ত’ও উঠে চলে গেছে। আর শিফা মাথা নিচু করে বসে আছে। সে নিজের জীবনের হিসাব কষতে ব্যস্ত। গণিতে বরাবরই পটু হয়েও আজ চরমভাবে ব্যর্থ হলো। পরিশেষে, অশ্রু ঝরিয়ে নিজের হার মেনে নিলো।
তখন রাত বারোটা। শিফাকে একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। বেশ পরিপাটি রুমটা! দেওয়ালের ছবিতেই স্পষ্ট, দিগন্তের রুম। সবাই হাসি-ঠাট্টার সমাপ্ত করে চলে গেল। যদিও অনেক পরামর্শ’ও
দিয়েছে। কথার ছলে খোঁচা মেরে মজাও লুটেছে।
বন্ধরুমে একা হতেই, শিফা ডুকরে কেঁদে উঠল।
বেহায়া চোখ দু’টো আজ বড্ড অবাধ্য। কিছুতেই বারণ শুনছে না। আর ওর পাগলাটা কী করছে? কাঁদছে? নাকি একগুচ্ছ অভিযোগের খাতা খুলে বসেছে? আচ্ছা,স্বপ্নীল খুব কষ্ট পাচ্ছে? মানুষটা ওকে কখনো ক্ষমা করবে? হয়তো না! স্বপ্নীল একদম ঠিক বলেছ, সে ছলনাময়ী, নিষ্ঠুর, মিথ্যুক, হৃদয়হীনা, স্বার্থপর। নয়তো তিল তিল করে গড়া ভালোবাসাকে এভাবে ভাঙতে পারত না। এসব ভেবে সে অঝরে অশ্রু ঝরাচ্ছে। না, কাঁদলে হবে না। এখন ওর অনেক দায়িত্ব। খুব শক্ত হতে হবে, খুব। নয়তো হাল ধরতে পারবে না। শিফা চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। তখন দিগন্ত রুমে প্রবেশ করে একটা প্যাকেট এগিয়ে বলল,
-‘ফ্রেশ হয়ে নাও।’
-‘হুম।’
দিগন্ত একবার শিফার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। শিফা ওয়াশরুমে গিয়ে একদফা কেঁদে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসল। পরণে হলুদ সালোয়ারকামিজ।
অল্প সময়ে রুমটা কেউ সুন্দর করে সাজিয়েছে। সাধারণভাবে হলেও বেশ লাগছে।আজ পূর্ণিমা। শুক্লপক্ষের তিথিতে চাঁদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। কি সুন্দর চাঁদ! অসংখ্য নক্ষত্রও আছে। শিফা বেলকণিতে গিয়ে তারকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘খুশি হয়েছিস? শান্তি পেয়েছিস, হুম? দেখলি ওয়াদা রাখতে গিয়ে হৃদয়ভঙ্গেরও কারণ হলাম। তোর প্রিয়কে বিয়েও করলাম। এবার ফিরে আয়, ঝগড়া করবি না? আয় না রে সাফা, প্লিজ ফিরে আয়!’
কথাটা বলে শিফা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগল। শব্দ নেই, শুধু ঝরে যাচ্ছে অশ্রুবিন্দু।
ওর কষ্ট আদৌও কেউ বুঝবে? হয়তো না! হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,
-‘এসবে আমাকে না জড়ালেও তো পারতে। শুধু আমাকে..!’
-‘আমি কী আপনার যোগ্য নই? নাকি আমাকে পছন্দ না?’
-‘আমি তা বলি নি।’
-‘ বউ হিসেবে আমার দিক থেকে ত্রুটি থাকবে না। প্রাণ থাকতে, আপনার প্রতি কখনো হেলাও করব না। আপনি যেমন সঙ্গী চান। আমি ঠিক তেমন হয়ে উঠব। এমনকি এই মুহূর্তে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেও, আমি প্রস্তুত!’
দিগন্ত হাসল। তখন শিফার ফোনটা উচ্চশব্দে
বেজে উঠল। স্বপ্নীল কল করেছে। কেটে দেওয়ার পরেও, কল দিচ্ছে। দিগন্ত নিঃশব্দে বসে শিফার দিকে তাকিয়ে আছে। শিফা কল রিসিভ করতেই স্বপ্নীল চিৎকার করে বলল,
-‘কুত্তার বাচ্চা, আমার বুকে লাভা ঢেলে বাসর করছিস, তোর বাসরের গুষ্ঠি কিলাই।ছলনাময়ী,
স্বার্থপরের বাচ্চা! স্মরণে রাখিস, মাফ করব না তোকে, কখনো না। তুই আমার কাছে মৃত! ঘৃণা করি তোকে, খুব খুব ঘৃণা করি।’
শিফা ওর কন্ঠস্বরটা যথেষ্ট কঠোর করে জবাব দিলো।
-‘দিগন্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আছি। ফারদার কল দিয়ে বিরক্ত করবে না। নয়তো গিয়ে চড়িয়ে ভূত নামিয়ে আসব।’
স্বপ্ন হতভম্ব হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল।না এটা ওর শিফা হতেই পারে না। শিফা তো এমন নয়। স্বপ্নীলের বাকশক্তি যেন হারিয়ে গেছে। সে আর কিছু বলতে পারল না। শিফা কল কেটে সিমটা ভেঙে বাইরে ফেলে দিলো। আর পিছুটান রাখবে না। এটা বড্ড যন্ত্রনাদায়ক। সে গলার ওড়নাটা ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় বসে বলল,
-‘ঘুমাব নাকি আপনি…!’
-‘ঘুমাও।’
-‘আচ্ছা।’
শিফা চুপটি করে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। যেন ঘুমে চোখ বুজে আসছে। এখন না ঘুমালে জীবনটা বৃথা যাবে। দিগন্ত লাইটটা বন্ধ করে পাশে শুয়ে পড়ল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো। সাফা আর শিফার মধ্যে সে অজান্তে ফেঁসে গেছে। সাফারা ওদের বাসায় নিচ তলায় ভাড়া থাকত। আর সেই সুবাদে সাফাকে চিনতো। তবে কখনো কথা বলা হয় নি। সাফা
সামনাসামনি পড়লে ভদ্রভাবে মুচকি হেসে চলে আসত। তবে খেয়াল করত, সাফা ওকে দেখে অকারণে লজ্জা পেতো। অফিসে যাওয়ার সময় রোজ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকত। সন্ধ্যার সময় ফিরলে আগে ওর সঙ্গে দেখা হতো। যেন মেয়েটা ওর’ই অপেক্ষায় থাকত। তার বেশ কিছুদিন পর, শিফাকে চিনলো। প্রায় যাত্রাযাত্রা ছিল শিফার। তাই দেখা হয়ে গেলেও পাশ কাটিয়ে চলে যেতো। তারপর অফিসের কাজে চারমাস সিলেটে থেকে, কিছুদিন হলো সে ফিরেছে। তারপর এসে শুনল, সাফা হসপিটালে ভর্তি।
ওকে নাকি দেখতে চেয়েছিল মেয়েটা। এর কারণ দিগন্তের অজানা। দিগন্ত যাওয়ার আগেই সাফা মারা গিয়েছিল। সাফা মারা যাওয়ার ঠিক বাইশ দিন পর, শিফা নিজে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রথমে সে নাকচ করেছিল। মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে শিফার বাবা’ই প্রস্তাব নিয়ে আসেন।
পরে দুই পরিবার মিলে ঘরোয়া ভাবে বিয়ের ডেট
করেছিলেন। দুইমাস পরে’ই বিয়ের কথা ছিল।তাছাড়া দিগন্তের পছন্দের কেউ ছিল না। তাই আর দ্বিমত করে নি।
কিন্তু আজ শিফা ধারালো ছুরি কবজির উপর রেখে জেদ করছিল, আজই বিয়ে করবে। তাই জেদ রক্ষার্থে আজ’ই বিয়েটা সম্পূর্ণ করা হলো।
তবে শিফার কার্যকলাপ দিগন্তের কাছে সুবিধার লাগছে না। কেমন যেন! শিফা ওকে ভালোবাসে নাকি জেদ? কিসের জেদ? তখন বলল, ‘তোর প্রিয়কে বিয়ে করেছি। সাফা এবার ফিরে আয়।’ একথার মানে কী? সাফার প্রিয় সে কেন হবে?
শিফা কী বোঝাতে চাচ্ছে? উফ, মস্তিস্কটা কাজ করছে না। সবকিছু একটা কিন্তুতে গিয়ে আঁটকে যাচ্ছে। এর উত্তর কেবল শিফা’ই দিতে পারবে।
দিগন্ত আর ভাবতে পারছে না। সে সমস্ত চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে চোখজোড়া বুজে নিলো।দেখা যাক, সামনে আর কী কী অপেক্ষায় করছে! ঝড়ঝাপ্টা সামলাতে সেও এবার প্রস্তুত!
-‘সাঁঝক বাতি
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[০১]