সায়াহ্নের প্রণয় 🦋 পর্ব-১২

0
891

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বাদশ_পর্ব

৩৩.
হোসেন বাড়ি পুনরায় বিয়ে নামক শব্দে মুখরিত। চারপাশে ব্যস্ততা একপ্রকার চেপে বসেছে যেন। আনোয়ার সাহেবের মুখে প্রাণোচ্ছ্বল হাসি। বড় ছেলের পর একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
বাড়ির সবার মুখ হাসি হাসি থাকলেও হাসি নেই শুধু ইশরাকের মুখশ্রীতে; বরং হাসির পরিবর্তে একরাশ আশংকার ছাপ স্পষ্ট। তার মতে সবটা এত তাড়াহুড়ো না করে হলেও পারত। অন্যদিকে বিয়ে বাড়ির সব ঝামেলা, আমেজ থেকে দূরে সরে নিজের রুমে বসে বসে কম্পিউটার স্ক্রিনে হরর, থ্রিলার মুভি “Halloween Kills” দেখে চলেছে প্রাচী; যেন এই বিয়ে নিয়ে তার মাঝে কোনো ভাবান্তর ই নেই।
– “প্রাচী, এই প্রাচী আর কত রুমের মধ্যে বসে থাকবি? দরজা খোল!”
দরজার ওপাশ থেকে জেবা বেগমের দৃঢ় কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই একপলক দরজার দিকে তাকিয়ে মুভি পজ করে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী।
– “কি হয়েছে মা?”
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় প্রাচী।
– “আর কত এভাবে রুমের মধ্যে পড়ে থাকবি? এখন ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে। একটু পর সবাই বের হবে।”
মায়ের কথায় আপনাআপনি ভ্রু কুঁচকে আসে প্রাচীর।
– “বের হবে মানে? কোথাও যাব নাকি সবাই?”
– “হ্যাঁ, বিয়ের কনে তো এমনি এমনিই বিয়েতে উপস্থিত হবে না। বিয়ের ড্রেসের জন্য একটু আগেই রাইয়্যান ফোন করেছিল। সবাই মিলে শপিং এ যেতে হবে। রাইয়্যান ও আসবে সেখানে। এখন দ্রুত রেডি হয়ে নাও।”
রাইয়্যানের কথা শুনতেই চোখ মুখ কুঁচকে নেয় প্রাচী যেন রাইয়্যানের উপস্থিতি তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। তবুও জোরপূর্বক হেসে বলে উঠে,
– “ঠিক আছে, আমি আসছি রেডি হয়ে।”
মেয়ের কথা শুনে জেবা বেগম ও স্মিত হেসে সেখান থেকে দ্রুত পায়ে চলে আসেন।
চুলগুলো একপাশে বেনি করা, মুখে তেমন একটা মেকআপের আবরণ নেই। পরিপাটি হয়ে নিচে আসতেই খেয়াল করে সবাই খোশগল্প করায় ব্যস্ত। কর্ণারের‌ দিকে চোখ যেতেই খানিকটা বিস্মিত হয় প্রাচী। সমুদ্র এখানে কি করছে? তাহলে কি তার বিয়ের খবরটা সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে? গম্ভীর হয়ে ভাবতে ভাবতেই নিচে নেমে আসে প্রাচী।

– “ঐ তো প্রাচীও‌ এসে পড়েছে। এবার না হয় চলা যাক, বাইরে ড্রাইভার ওয়েট করছে; আর ওদিকে রাইয়্যানের ফ্যামিলিও এসে পড়বে।”
আনোয়ার সাহেবের কথায় সবাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
পেছনের গাড়িতে ফিহা, প্রাচী আর সমুদ্র বসেছে। ফ্রন্ট সিটে থাকা লুকিং গ্লাসে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সমুদ্র। তার বিপরীত পাশে বসে থাকা প্রাচীর দিকে তার দৃষ্টি স্থির।
জানালার গ্লাস ভেদ করে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রাচীর।
– “বিয়ে? বিয়ে করার খুব শখ তাই না প্রাচী? নে এবার বোঝ। ঐ ব্যাটা বদ লোকের জন্য কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে। বিশেষ করে ঐ ব্যাটা রাইয়্যানের‌ এসব ন্যাকামি। তার উপর এই কনকনে শীতের ঠান্ডা হাওয়া। একবার আপনার আসল পরিচয়টা পেয়ে নেই মিস্টার ইনভিজিবল; এর থেকে দ্বিগুণ নাকানিচোবানি না খাইয়েছি তাহলে আমিও প্রাচী না।
এখন শুধু আমার বানানো প্ল্যান সাকসেসফুল হলেই হয়।”
ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বিড়বিড় করতেই প্রাচীর চোখ পড়ে লুকিং গ্লাসের দিকে। সে কি? সমুদ্র তার দিকে সরু দৃষ্টিতে একইভাবে তাকিয়ে রয়েছে। লজ্জায় দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে। সমুদ্র কি ভাবছে ভেবেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে প্রাচীর‌।

৩৪.
শপিং মলের বিয়ের কনে ও বরের ড্রেস, অর্নামেন্টস‌ এরিয়ায় চলে যেতেই রাইয়্যান সহ তার পুরো পরিবারকে দেখতে পায় প্রাচী। আনোয়ার সাহেব এগিয়ে গিয়ে ফজলুল সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময় করেন।
সবাই মিলে ভেতরের দিকে গেলেও সমুদ্র একটা ফোনকলের জন্য বাইরেই ওয়েট করে। এদিকে প্রাচী যতই রাইয়্যানের‌ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে ততই রাইয়্যান তার সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করে।
– “ইউ লুক সো গর্জিয়াস মিস প্রাচী।”
খানিকটা ফিসফিস করে প্রাচীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে রাইয়্যান।
– “গর্জিয়াস? কেন মিস্টার রাইয়্যান? আমি কি আপনার সামনে বউ সেজে বসে আছি নাকি?”
তড়িৎ গতিতে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে প্রাচী। এতে সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাইয়্যান‌। গলা খাঁকারি দিয়ে আর কিছু না বলেই হাঁটা শুরু করে সামনের দিকে।

– “চোখ না চুলা! ফাপরবাজির ও একটা লিমিট থাকে। কাম ডাউন প্রাচী। সবার সামনে হাইপার হলে চলবে না। আর কয়েকটা দিন ই তো। সহ্য করে নে। ব্যাটা আস্ত একটা ফাপরবাজ‌।”
রাইয়্যানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজের সাথেই আনমনে প্রলাপ বকে প্রাচী।

ভারী কাজের মধ্যে বেশ কয়েকটা লাল রঙের লেহেঙ্গা সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রাচীর। কিন্তু কোনোটাই তার পছন্দ হয়নি। প্রাচীর এহেন কান্ডে দোকানদাররাও বেশ বিরক্ত যা তাদের মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
– “আচ্ছা সমুদ্র কোথায়? ওকে তো দেখতে পারছি না। এক কাজ করি, সমুদ্রকে ডেকে নিয়ে আসি। আফটার অল সমুদ্রের পছন্দ সবসময়ই বেস্ট হয়।”
ইশরাকের প্রস্তাবে উপস্থিত সবাই সায় দিলেও রাইয়্যানের তা কেন জানি খুব একটা পছন্দ হয় নি। তবে বড়দের কথার
অমান্য করতে না পারায় সবটা চুপচাপ মুখ বুজে সহ্য করে নেয় সে।
ইশরাক সমুদ্রকে নিয়ে একপ্রকার জোর করেই প্রাচীর পাশে বসিয়ে দেয়। আড়চোখে প্রাচীর দিকে একপলক তাকিয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দেয় সমুদ্র।

পছন্দ অনুযায়ী ইশারা দিতেই দোকানদার কালো রঙের একটা বিয়ের ড্রেস নিয়ে আসে। অসাধারণ কারুকাজ আর সাথে কালো স্টোনের সংমিশ্রণে লেহেঙ্গাটির সৌন্দর্য যেন আরো ফুটে উঠেছে। প্রাচীও অবিশ্বাস্য চোখে একবার লেহেঙ্গার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সমুদ্রের দিকে। আসলেই ছেলেটার পছন্দ আছে বলতে হবে। গত একঘন্টা যাবৎ যা সে পছন্দ করতে পারে নি তা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সমাধান করে দেয়াতে সবাই সমুদ্রের প্রশংসায় ব্যস্ত।
বিয়ের কেনাকাটা শেষ করতে করতে বিকেল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা। চারপাশে ব্যস্ত ঢাকা নগরীর কোলাহল ও আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। রেস্টুরেন্টের এক কর্ণারে বসে এতক্ষণ এগুলোই দেখছিল প্রাচী। হঠাৎ কেউ তার মুখোমুখি হয়ে বসতেই নড়েচড়ে বসে সে। মাথা তুলে তাকাতেই রাইয়্যানের চেহারা চোখে পড়ে তার‌। সাথে সাথেই মুখশ্রী থেকে হাসির রেখা উবে যায় প্রাচীর।
– “হেই মিস, সরি উডবি‌ মিসেস প্রাচী এভাবে এখানে একা একা বসে আছো কেন?
আমার তো বিলিভ ই হচ্ছে না আর মাত্র দু’দিন পরেই আমি তোমাকে নিজের করে পাব সারাজীবনের জন্য। আ’ম রিয়্যালি হ্যাপি ফর দ্যাট। আই লাভ ইউ সো‌ মাচ, প্রাচী।”
টেবিলের উপর রাখা প্রাচীর হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে উঠে রাইয়্যান‌।

– “শখ কত বিয়ের? আর এমন ভাবে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট‌ করছে যেন ভালোবাসা উতলে উতলে পড়ছে আমার জন্য। আর কত নাটক করতে হবে কে জানে? জাস্ট বিরক্ত লাগছে এসব। যত্তসব ন্যাকামি!”
মাথা নতজানু করে বিড়বিড় করে প্রাচী।
– “কিছু বললে?”
চোখ দুটো ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে ওঠে রাইয়্যান‌।
– “নো, মিস্টার রাইয়্যান‌। আমি বলছিলাম যে আমিও প্রচুর খুশি আপনার যতো এমন একজন লাইফ পার্টনার পেতে চলেছি।”
বলেই জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে প্রাচী।

৩৫.
ঘড়িতে রাত ১১:০০ টা ছুঁই ছুঁই। সারাদিনের ধকলে শরীরে ক্লান্তি জুড়ে বসেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়ানোতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। এমনিতেই আগামীকাল হলুদের অনুষ্ঠান রয়েছে। তার উপর ক্লান্ত শরীরে ঘুমে চোখ আপনাআপনিই বুজে আসছে বারবার।
ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে লাইট অফ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে প্রাচী। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন; কিন্তু ফোনের ভাইব্রেশনের মতো তীক্ষ্ণ বিরক্তিকর শব্দ কানে এসে পৌঁছাতেই ঘুম ঘুম চোখেই হাতড়ে টেবিলের উপর থেকে ফোন তুলে নেয় প্রাচী। আননোন নাম্বার থেকে টানা ১৩ বার মিসড কল এসেছে অথচ সে এতটাই গভীর ঘুমে ছিল টেরই পায়নি। রিসিভ করে কানের কাছে নিতেই ফোনের অপরপাশে থাকা ব্যক্তিটির ঘোর লাগানো আগ্রাসী কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “মেহু পাখি?”
নিমিষেই চোখে লেগে থাকা ঘুমের রেশ কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে যায়। এ তো চেনা কন্ঠ। তবে কি মিস্টার ইনভিজিবল আর কেউ নয় বরং ……
ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে প্রাচীর।

পরনে কাঁচা হলুদ আর ডার্ক পিংক কালারের লেহেঙ্গা, কাঁচা ফুলের অর্নামেন্টস্, চুলগুলো কার্ল করে বেনি করা, মুখে মেকআপের আবরণ, সবমিলিয়ে পুতুলের চেয়ে কম লাগছে না প্রাচীকে। বিয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে গায়ে হলুদ। আর আজকে সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই হোসেন বাড়ি মেহমানে পরিপূর্ণ। প্রাচীর মুখেও স্নিগ্ধ হাসি।
সন্ধ্যে নেমেছে। বাড়ির ছাদে সুন্দর করে রঙ বেরঙের কাঁচা ফুল, মরিচবাতি দিয়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে। চারপাশের করা ডেকোরেশন ও‌ যথেষ্ট পরিমাণে নজরকাড়া। আনোয়ার সাহেব ও জেবা বেগমের মাঝে মেহমান নিয়ে রয়েছে বেশ ব্যস্ততা।
রুমের মধ্যে আয়নার সামনে বসে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। তখনই রুমে প্রবেশ করে ফিহা। মুচকি হেসে এগিয়ে যেতেই আদুরে গলায় প্রাচীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
– “আজ আমার ননদিনীর‌ থেকে চোখ ফেরানোই মুশকিল। না জানি বিয়ের দিন রাইয়্যানের কি অবস্থা হবে। বেচারা তোমাকে দেখে দেখেই দিন পার করে দিবে।”
ফিহার‌ কথার প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসে প্রাচী। আসলেই জীবন অদ্ভুত সুন্দর। কখন কোথা থেকে কোন মোড়ে চলে যায় তা বোঝা অত্যন্ত কঠিন।………..

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here