সায়াহ্নের প্রণয় 🦋 পর্ব-১৩

0
770

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রয়োদশ_পর্ব (বিয়ে স্পেশাল‌🥳🥳)

৩৬.
কাঁচা হলুদ আর চন্দনের মিশ্রণের‌ প্রলেপ গাল ছুঁয়ে দিতেই আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয় প্রাচী। অতি সযত্নে ইশরাক পাশের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে প্রাচীর গালে ছুঁইয়ে দেয়। হৃদিতা আর আকাশ ও উপস্থিত রয়েছে। বিনিময়ে প্রাচী আলতো হাসে।
প্রাচীর থেকে ঠিক সামনেই কিছুটা দূরে পিলার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। দৃষ্টি তার প্রাচীর মুখশ্রীতে স্থির।
– “কি ব্যাপার সমুদ্র, ওভাবে দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এখানে আয়, প্রা‌চীকে হলুদ লাগা।”
ইশরাকের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে সমুদ্র। একপলক প্রাচীর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায় সে। প্রাচীর দিকে সামান্য ঝুকতে‌ই মাথা তুলে তাকায় প্রাচী।
– “কংগ্রেচুলেশন মিস প্রাচী। উ‌ইশিং ইউ এ হ্যাপি ম্যারি‌ড ‌লাইফ।”
ফিসফি‌সে কন্ঠে বলেই প্রাচীর বাম গালে হলুদের প্রলেপ লাগিয়ে দেয় সমুদ্র।
অন্যদিকে সমুদ্রের বলা প্রতিটি কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে প্রাচী। দৃষ্টি তার সমুদ্রতে আবদ্ধ। চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটিও যেন তার কথাবার্তার মতোই রহস্যময়।
হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় রাত ন’টা বেজে এসেছে।
ওয়াশরুম‌ থেকে বের হয়ে রুমে নিজের বাবাকে উপস্থিত থাকতে বেশ অবাক হয় প্রাচী। কেননা প্রাচীর রুমে আনোয়ার সাহেবের আনাগোনা থাকে না বললেই চলে।

– “বাবা, তুমি? তুমি এখনো ঘুমাও নি?”
বিচলিত কন্ঠে আনোয়ার সাহেবের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় প্রাচী।
– “হ্যাঁ, আমি। কিছু কথা বলতে মন চাইল, তাই চলে আসলাম। তুই ফ্রি আছিস তো?”
– “হ্যাঁ, বাবা অবশ্যই।”
আনোয়ার সাহেব মুচকি হেসে ইশারা দিতেই প্রাচীও বাধ্য মেয়ের মত গিয়ে চুপটি করে বাবার সামনে বসে পড়ে।
– “জানিস একটা বাবার কাছে তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি? তার সন্তানের ভালো থাকা। তার সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ব পালনে সফল হওয়া। আর প্রতিটা বাবা মাই তার সন্তানকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সবসময় চেষ্টা করে তার সন্তান যেন একটা হ্যাপি লাইফ লিড করতে পারে।
আর যার একটা তোর মত ফুটফুটে মেয়ে আছে তার দায়িত্ব কি জানিস? তার মেয়েটা যেন সবসময় খুশি থাকে, তার মেয়েটার প্রতি সবচেয়ে বড় দায়িত্ব; এক জোড়া বিশ্বস্ত হাতের মুঠোয় তার মেয়ের ভরণপোষণ তুলে দেয়া। আর আমিও জীবনের সবচেয়ে সেই পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছি।
তোর বিয়ের মত এত বড় সিদ্ধান্ত আমি ভেবে চিন্তেই নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি রাইয়্যান একজন ভালো ছেলে আর তোকেও খুব ভালো রাখবে। আমি চাই তুই ভালো থাক, প্রাচী।
বি প্রিপেয়ার ফর ইউর নেক্সট, প্রিপেয়ার ইউর‌ মাইন্ড।”
বলতে বলতেই প্রাচীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আনোয়ার সাহেব। প্রাচীও এতক্ষণ যাবৎ একদৃষ্টে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে আনোয়ার সাহেবের বলা প্রতিটি কথা শুনে যাচ্ছিল।
আসলেই তো। তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত এই বিয়ে যাকে ঘিরে সামনে বাকি অনেক লড়াই।
– “এখন ঘুমিয়ে পড়। আমি না হয় আসি।”
বলে বসে থেকে উঠে দাঁড়ান। শীতল চোখ জোড়ায় অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। সাথে করে চশমাটাও। চোখে থাকা চশমাটা পাঞ্জাবির হাতায় মুছে পা বাড়ালেন নিজের রুমের দিকে। এতো বছরের মায়া কি এক মুহূর্তেই কাটানো যায়? তবুও কাটিয়ে নিতে হয়।

৩৭.
বিয়ে। দুই অক্ষরের এই শব্দটি প্রতিটি মানুষের জীবনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মানুষ সামাজিক জীব। আর একে অপরের সাথে থাকতে হলে অবশ্যই তাকে বিবাহ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়।
নববধূ সাজে প্রাচীকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পুরো কালো লেহেঙ্গা, কালো আর সাদা স্টোনের অর্নামেন্টস্, খোঁপা করা চুলে গাজরা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। নববধূ সাজে প্রাচীকে কোনো পুতুলের চেয়ে কম লাগছে না।
বিকেলের সময়। আর একটু পরেই হয়তো বরযাত্রী এসে উপস্থিত হবে। মিসেস জেবা বেগম কিছুক্ষণ আগেই মেয়ের সাথে দেখা করে গিয়েছে। এমন দম বন্ধ করা অবস্থায় এর আগে কখনো পড়তে হয়েছে বলে মনে হয় নি তার।
– “তুই কি সত্যিই রাইয়্যান স্যারের সাথে বিয়েটা করছিস প্রাচী?”
হৃদিতার প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী। নির্বাক তার দৃষ্টি। কি বলবে সে প্রত্যুত্তরে; এটাই কি যে এর প্রকৃত উত্তর সে নিজেও জানে না।
– “কি ব্যাপার প্রাচী? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি; তুই কি আসলেই বিয়েটা করতে যাচ্ছিস? কিন্তু তুই তো রাইয়্যান স্যারকে ভালোবাসিস না।”
হৃদিতার কথায় তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই প্রাচীর।
– “দেখা যাক কার ভালোবাসা প্রকৃত ও গ্রহণযোগ্য! তার টা যে নিজেকে লুকিয়েও তার সবটা দিয়ে আমাকে ভালোবাসে নাকি তার টা যার ভালোবাসার আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই।”
প্রাচীর কথা শুনে কিছু বুঝে ওঠে না হৃদিতা। কি চলছে মস্তিষ্কে কে জানে? ভেতর থেকে শুধু এক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

বরযাত্রীর জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ছোট বড় সবার মাঝেই টান টান উত্তেজনা বিরাজমান। কয়েকজন গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সবার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সুসজ্জিত বরযাত্রীর‌ গাড়ি আসতেই সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
কিন্তু পরক্ষণেই গাড়ির ড্রাইভার গিয়ে পেছনের দরজা খুলতে ভেতর থেকে বরের পরিবর্তে বরের বাবা অর্থাৎ ফজলুল সাহেব এবং সাথে করে একজন লোক বেরিয়ে আসে।
ফজলুল সাহেবকে দেখামাত্র সাদরে স্বাগতম জানানোর জন্য এগিয়ে যান আনোয়ার সাহেব। কিন্তু ফজলুল সাহেবের বিষন্ন মুখ পরিলক্ষিত হতেই বেশ চিন্তায় পড়ে যান তিনি।

– “কি ব্যাপার ভাইসাহেব; আপনি একা কেন? রাইয়্যান‌ কোথায়?”
আনোয়ার সাহেবের প্রশ্নে মাথা নিচু করে ফেলেন ফজলুল সাহেব। এতে চিন্তার পরিমাণ দ্বিগুণ পরিমাণ বেড়ে যায় আনোয়ার সাহেবের।
– “সবকিছু ঠিক আছে তো ভাইসাহেব? কোনো সমস্যা হয় নি তো?”
– “আসলে কিভাবে যে শুরু করব তা ঠিক বুঝতে পারছি না। আর আমিও কখনো কল্পনাও করিনি আমার নিজের ছেলে এমনটা করবে। আমি খুবই লজ্জিত ভাইসাহেব।
না চাইতেও বিয়েটা এখানেই ভেঙে দিতে হচ্ছে আমাকে। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিবেন ভাইসাহেব।”
বলেই আনোয়ার সাহেবের দিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দেন ফজলুল সাহেব। অতঃপর দ্রুত গিয়ে গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলা শুরু করে তার নিজ গতিতে।
এদিকে ঘাম বেয়ে পড়ছে আনোয়ার সাহেবের। বোধ হয় প্রেশার টা এখনি দুম করে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। চারপাশে উপস্থিত সবাই কানাঘুষাও শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।

৩৮.
ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করেন আনোয়ার সাহেব। হাতে থাকা চিরকুট টা কাঁপা কাঁপা হাতে খুলতেই ভেতরে স্পষ্ট লিখা,
“সরি প্রাচী, আমি এই বিয়েটা করতে পারব না। একচুয়ালি‌ আমি চাইনা তোমার লাইফটা নষ্ট হয়ে যাক। আর না আমি তোমাকে ভালবাসি। এর চেয়ে বেশি আমার পক্ষে এক্সপ্লেইন করা পসিবল‌ না। আ’ম সরি।”

লিখা টুকু পড়তেই সোফার উপর ধপ করে বসে পড়লেন আনোয়ার সাহেব। এত বড় একটা কথা শুনে মাথা ঝিমঝিম করছে তার। আনোয়ার সাহেবের এরূপ অবস্থা দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে ইশরাক আর সমুদ্র। লোকেমুখে বলা কথা বাতাসের আগে ছড়ায়‌। ঠিক তাই হয়েছে। বিয়ের কনে অর্থাৎ প্রাচীর কাছেও বর না আসার খবর পৌঁছে গিয়েছে। বিয়ের দিন এমন দুর্বিষহ ঘটনার সম্মুখীন তাকে এবং তার পরিবারকে হতে হবে তা কল্পনাও করতে পারে নি প্রাচী।
নিচে মেহমানদের মাঝে কেউ কেউ তো সরাসরি প্রাচীকে‌ অপয়া বলেই সম্বোধন করছে।
থমথমে পরিস্থিতিতে আনোয়ার সাহেব ব্যাথিত গলায় বলে ওঠেন,
– “এসব কি হয়ে গেল? আমার মে,মেয়েটার‌ সাথে এসব কি হয়ে গেল? বিয়ের আসরে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে রাইয়্যান‌। আমি তো কত আশা নিয়ে বসেছিলাম রাইয়্যানের‌ হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিব। এখন কি হবে আমার মেয়ের?”
পাশ থেকে জেবা বেগম এগিয়ে আসেন। চোখ মুখ শুকিয়ে এসেছে তার।

– “মেয়ের চরিত্রেই সব দোষ। না হলে বিয়ের দিন এভাবে কেউ বিয়ে ভেঙে দেয় নাকি। আর এই অপয়া বিয়ে ভাঙা মেয়েকে কেই বা বিয়ে করবে?”
পাশ থেকে মধ্যবয়স্ক মহিলার এরূপ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলা কথা কর্ণপাত হতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সমুদ্র। রাগে ক্ষোভে চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে সবাই প্রাচীর চরিত্র পর্যন্ত কথা তুলতে দ্বিধাবোধ করছে না।
– “বিয়ে হবে। প্রাচীর বিয়ে হবে; আর সেটাও আজকে এখনই হবে।
আমি বিয়ে করব প্রাচীকে। রাইয়্যানের‌ করা ভুলের জন্য আমি প্রাচীর সম্মানহানি হতে দেব না।”
গম্ভীর কন্ঠে উপস্থিত সবার মাঝেই বলে উঠে সমুদ্র। আর সমুদ্রের এহেন কথায় আনোয়ার সাহেব সহ ইশরাক, জেবা বেগম সবাই অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে।
– “কি বলছিস তুই সমুদ্র? তুই ভেবেচিন্তে বলেছিস এসব? জানিস এটা বড় একটা সিদ্ধান্ত? আর সবচেয়ে বড় কথা এখানে প্রাচীর ফিউচার ডিপেন্ড করছে।”
– “হ্যাঁ, আমি ভেবেচিন্তেই বলছি। আমি প্রাচীকে বিয়ে করব আর এখন থেকে প্রাচীর সব দায়িত্ব আমার।
আঙ্কেল আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন আমাকে।”
সমুদ্রের কথায় আনোয়ার সাহেব কৃতজ্ঞতা স্বরূপ উঠে গিয়ে সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

৩৯.
”বলুন বাবা কবুল!”
কাজী সাহেবের কথায় মাথা তুলে তাকায় সমুদ্র। পাশে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে পরপর তিনবার বলে উঠে,
– “কবুল!”
সাথে সাথেই চারপাশে মুখরিত ধ্বনিতে সবাই ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলে উঠে।
সমুদ্রের ঠিক সামনেই পর্দার অপর পাশে মাথা নতজানু হয়ে বসে আছে প্রাচী। পাশেই ফিহা, হৃদিতা, জেবা বেগম সহ বড়রা বসে আছেন। সমুদ্রের কাছে রেজিস্ট্রি আর কাবিননামায় সই করিয়ে নিতেই কাজী সাহেব এগিয়ে যান প্রাচীর নিকট।
– “পিতা: আনোয়ার হোসেন, মাতা: জেবা বেগম এর কন্যা মেহরিশ আয়াত প্রাচী, সাদাত চৌধুরীর পুত্র সমুদ্রের সাথে …. টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া যদি এই বিবাহে রাজী থাকেন,
বলুন মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
কাজী সাহেবের কথায় মাথা তুলে তাকাতেই ফিহা সহ জেবা বেগম সম্মতি দেন। চোখ অশ্রুসিক্ত।
– “কবুল!”
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে প্রাচী।
ভাবতেই অবাক লাগছে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার জীবনে কি থেকে কি হয়ে গেল। এখন থেকে সে সমুদ্রের স্ত্রী। তার অর্ধাঙ্গিনী‌। সমুদ্রের জীবনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছে সে। তবে কি নতুন জীবনের পথচলা শুরু হয়ে গিয়েছে প্রাচীর?……….

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here