সায়াহ্নের প্রণয় 🦋 পর্ব-১৪

0
884

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্দশ_পর্ব

৪০.
চৌধুরী ভিলার‌ সামনে এসে গাড়ি থামতেই খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রাচী‌। আকাশে নিকষ কালো অন্ধকার। সমুদ্র নিঃশব্দে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেও‌ প্রাচী চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকে। ভেতরে ভেতরে ভীষণ নার্ভাস ফিল হচ্ছে। একটু আগেই প্রিয় অট্টালিকার মায়া কাটিয়ে চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে সে।
কিছুদূর যাওয়ার পরও প্রাচীর মাঝে কোনো হেলদোল দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে নেয় সমুদ্র।
– “এক্সকিউজ মি, মিসেস প্রাচী চৌধুরী। সারারাত কি এভাবেই গাড়িতে কাটাতে চাও? কাটাতে পারো, আই হ্যাভ নো প্রবলেম।
আমার তো আবার বিছানা ছাড়া ঘুম আসে না।”
সমুদ্রের বলা কথা কর্ণপাত হতেই নড়েচড়ে বসে প্রাচী। আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠে,
– “হ্যাঁ আমার তো খুব শখ এই এত শীতের মধ্যে গাড়িতে সারারাত কাটানোর। এদিকে আমার ভয়ে, নার্ভাসনেসে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে; কোথায় একটু সান্ত্বনা দিবে, সাহস দিবে তা না কিছু না বলেই হুড়হুড় করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার পিঞ্চ ও করছে। ব্যাটা বদ কোথাকার।”
– “হয়েছে? শেষ হয়েছে আমাকে নিয়ে গবেষণা করা? আর এখানে নার্ভাস হওয়ার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। এখন থেকে তুমি আমার স্ত্রী।
তো এখন কি বের হবে নাকি তোমাকে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে বের করতে হবে?”
বিস্ময়ে হতভম্ব প্রাচী। তার বিড়বিড় করে বলা কথা কিভাবে সমুদ্র জানতে পারল এই ভেবেই তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।

মিস্টার সাদাত চৌধুরী ও কোহিনুর চৌধুরীর সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচী। দুজনের মুখশ্রীই‌ বেশ থমথমে। প্রাচীর তো ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে এই ভেবে যদি কোহিনুর চৌধুরী কিংবা সাদাত চৌধুরীর কেউ তাকে অথবা সমুদ্রকে ভুল বুঝে। কিন্তু তার কল্পনাতীতকে‌ সম্পূর্ণ মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে মিসেস কোহিনুর চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে প্রাচীকে আগলে নিলেন।
– “এভাবে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের পর করে দিচ্ছ না তো? এটা কিন্তু ভুলে করেও ভাববে না। আমাকে আর সমুদ্রের বাবাকে নিজের মা বাবার মতোই দেখবে। আর সমুদ্র আমাকে সবটা বলেছে। আজ থেকে তুমিও আমাদের সন্তানের মতোই। মনে থাকে যেন; কেমন?”
কোহিনুর চৌধুরীর কথায় নির্বাক চোখে তাকিয়ে দেখে প্রাচী। তার ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষটা। কত সহজেই তাকে আপন মনে করে নিল। এতক্ষণ অযথা ভাবনার জন্য নিজেকেই দু গাল বকা দেয় প্রাচী।
কোহিনুর চৌধুরীর সাথে সাথে সাদাত চৌধুরীর ও বিনয়ী আচরণ মুগ্ধ করে তোলে প্রাচীকে‌। সবটাই যেন নিজ তৈরি করা কল্পনার জগতের মতো মনে হচ্ছে।
সুবিশাল বাড়ির দোতলায় থাকা দক্ষিণের বড় রুমটা বেশ‌ পরিপাটি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রুমে বসবাসকারী মানুষটাও বেশ শৌখিন। এই প্রথম সমুদ্রের রুমে প্রবেশ করল প্রাচী। এর আগেও কয়েকবার এ বাড়িতে আসার কথা থাকলেও কোনো না কোনো কারণবশত তা আর হয়ে ওঠে নি। একপাশে বেড, আসবাবপত্র অপর পাশে মাঝারি আকারের একটা বুকশেলফ যেখানে বিভিন্ন সাইন্স ফিকশন, হরর, থ্রিলার সিরিজ রাখা হয়েছে। মানুষটা তাহলে বইপ্রেমীও বটে। দেয়ালের সাথে টানানো ফ্রেম গুলোতে ছোট বেলা থেকে শুরু করে নানা ছবি টাঙানো। সেগুলোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে প্রাচী। একটু আগেই মিসেস কোহিনুর চৌধুরী তাকে রুমে দিয়ে গিয়েছে।

৪১.
প্রাচীর ভাবনার সুতো কাটে কারো গলা খাঁকারি দেয়ার মাধ্যমে।
– “আই নো আ’ম সো হ্যান্ডসাম। বাট এভাবে একদৃষ্টে আমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা, ইউ নো ইটস্ নট ফেয়ার।
নজর পড়ে যেতে পারে। বাই দা ওয়ে তুমি এখনো ফ্রেশ হও নি?”
সমুদ্রের কথায় ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় প্রাচী।‌ লোকটার কথাবার্তা, আচরণ তার মতোই যথেষ্ট পরিমাণ রহস্যজনক। এমন ভাবে কথা বলছে, আচরণ করছে যেন সবকিছুই তার কাছে স্বাভাবিক।
– “আমাকে নিয়ে গবেষণা করা শেষ হলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। এমনিতেই তোমার এই বিয়ে নিয়ে প্রচুর ধকল গিয়েছে। আ’ম সো টায়ার্ড।”

প্রাচী আর কথা বাড়ায় না। সন্দিহান চোখে একপলক তাকিয়ে লাগেজ থেকে একটা নরমাল ড্রেস বের করে নেয় সে। আসলেই ফ্রেশ হওয়া দরকার। এই ভারী লেহেঙ্গায় এত শীতের মধ্যেও অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে। প্রাচী চলে যেতেই সমুদ্র স্মিত হেসে পকেট থেকে ফোন বের করে নেয়।
ফ্রেশ হয়ে আসতেই প্রাচী খেয়াল করে সমুদ্র রুমে নেই। একটু আগেই তো ছিল। ঘড়িতে তাকাতেই খেয়াল করে রাত প্রায় ১০:৩০ টা বেজেছে ইতোমধ্যে। একটু পর সমুদ্র ও রুমে প্রবেশ করে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের দিকে।
সারাদিনের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে নিজের নিস্তেজ শরীরটাকে নিয়ে বিছানায় যেতেই সমুদ্র পাশ থেকে একটা বালিশ আর কাবার্ড থেকে কম্বল বের করে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াবে এমন‌ সময় প্রাচী বলে উঠে,
– “আপনি এই বালিশ, কম্বল নিয়ে এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”
থমকে দাঁড়ায় সমুদ্র। পেছনে ঘুরে ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
– “গেস্টরুমে।”
– “এত বড় রুম থাকতে গেস্ট রুম কেন? এই রুমে যেই বিছানা রয়েছে সেখানে অনায়াসেই তিন জন দিব্যি ঘুমোতে পারবে। এক মিনিট, আপনি কোনোভাবে এটা রিয়েলাইজ করাতে চাইছেন না তো যে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে, দয়া দেখিয়ে?
লিসেন, আমি আপনাকে বলি নি আমায় বিয়ে করতে। আপনি নিজ ইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করেছেন। সো এখন থেকে আমার সাথে এ রুমেই থাকতে হবে আপনাকে।”
একনাগাড়ে বলে উঠে প্রাচী। আর সেসব কর্ণপাত হতেই রাগে শরীর রি রি করছে সমুদ্রের। এ মেয়েকে যতটা সরল, বোকা ভেবেছিল ততটাও নয়। একটা কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আরেকটা মিনিং বের করে নিতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।
হাতে থাকা বালিশ আর কম্বল পাশের সোফায় রেখে গিয়ে রুমের দরজা সশব্দে লাগিয়ে দেয় সমুদ্র। এতে কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে প্রাচী।

– “এই রে একটু বেশি বলে ফেললাম না তো? দেখে তো মনে হচ্ছে রেগে বোম হয়ে গিয়েছে। এখন কিছু বলবে না তো?”
ভয়ে জড়সড় হয়ে বিড়বিড় করে প্রাচী।
দরজা লাগিয়ে পেছনে ঘুরে ধীরে ধীরে পা বাড়ায় প্রাচী যেটা দেখেও না দেখার ভান করে প্রাচী।
– “কি যেন বলছিলে? বিয়ে যেহেতু হয়েছে তার মানে আমাকে এই রুমেই ঘুমাতে হবে রাইট? তার মানে স্বামী হওয়ার বাদবাকী সব অধিকার ও আমার আছে, এম আই রাইট মিসেস প্রাচী?”
প্রাচীর দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠে সমুদ্র। আগ্রাসী কন্ঠে যথেষ্ট ঘোর লাগানো। এদিকে সমুদ্রের কথার ভাবমূর্তি বুঝতে পেরেই কাশি উঠে গিয়েছে প্রাচীর‌।
– “এটুকুতেই কাশি উঠে গেল? এখনো তো কিছুই বললাম না। সবে তো শুরু মিসেস প্রাচী। এটুকুই যদি সহ্য করতে না পারো,,”
প্রাচীর দিকে নজর যেতেই খেয়াল করে খাটের বাম পাশে ভয় পেয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে সে।
– “লিসেন আমাকে কিছু বলার আগে ভেবেচিন্তে বলবে। ইউ নো আ’ম সো কন্ট্রোল লেস!”
বলেই প্রাচীকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে বিছানায় অপর পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে সমুদ্র। আর অন্যদিকে প্রাচী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
– “কই ভেবেছিলাম ব্যাটাকে‌ একটু লজ্জায় ফেলে জব্দ করব। তা আর করা হলো কই? ব্যাটার তো মুখে কিছুই আটকায় না। লাজ লজ্জা তো দূরেই থাক। উল্টো আমাকেই লজ্জায় ফেলে দিব্যি নাক টেনে ঘুমোচ্ছে।”
বিড়বিড় করে পাশ থেকে লাইটের সুইচ অফ করে শুয়ে পড়ে প্রাচী। আর শরীর ক্লান্ত থাকায় কিছু মুহূর্ত পরেই গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায় সে।

৪২.
সকালের একফালি‌ মিষ্টি রোদ মুখশ্রী ছুঁয়ে যেতেই ঘুমের মধ্যেই চোখ মুখ কুঁচকে নেয় প্রাচী। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই বাইরের আকাশ দৃশ্যমান হয়। আড়মোড়া দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতেই খেয়াল করে রুমের কোথাও সমুদ্র নেই। ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই আতকে উঠে প্রাচী।
ঘড়িতে সকাল ৯:০০ টা বাজে। সে কি এতটা দেরি হয়েছে খেয়াল ই ছিল না। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নেয় প্রাচী‌।
নাস্তার টেবিলে,,
– “মা আমি বাইরে যাচ্ছি। আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে।”
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে এমন সময় কোহিনুর চৌধুরী বলে উঠে,
– “ইম্পর্ট্যান্ট কাজ মানে? কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ‌ নেই। প্রাচী এ বাড়িতে এসেছে একদিন ও হয়নি আর তুমি এখনি কাজে যাবে মানে? গিভ হার এ প্রোপার টাইম। একটা নিউ প্লেসে এডজাস্ট হতে কিছু সময় লাগে।”
– “আমি জানি মা, বাট আই হ্যাভ নো অপশন। আমাকে যেতেই হবে। তবে আমি তাড়াতাড়িই চলে আসব।”
বলেই কোহিনুর চৌধুরীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ে সমুদ্র। সমুদ্রের এহেন আচরণে প্রাচীর মন ও সামান্য বিষন্ন হয় তবে কিছু করার নেই। সবকিছুই পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল।

অন্ধকার রুমের মধ্যে চোখ পিটপিট করে তাকায় রাইয়্যান‌। চারপাশে আলোর ছিটেফোঁটা পর্যন্ত ও নেই। হাত পা শক্ত কিছুর সাথে বেঁধে রাখা অনুভূত হতেই স্থির হয় সে।
– “হু দ্যা হেল ইজ দিস! আমাকে এখানে বেঁধে রেখে লাভ নেই। আমি আমার প্ল্যান সাকসেসফুল করেই ছাড়ব। আমি জানি তুই এখানেই আছিস; অন্ধকারে লুকিয়ে না থেকে আমার সামনে আয়।”

– “বাহ্ তোর সেন্স অফ হিউমর অনেক ভালো বলতে হবে। আমার উপস্থিতি ও আজকাল চিনতে পারিস। ভেরি গুড, আই লাইক ইট মিস্টার রাইয়্যান‌ আহমেদ।”
একটা ছায়ামূর্তি এসে রাইয়্যানের‌ এসে দাড়াতেই মাথা তুলে তাকায় রাইয়্যান‌।
– “বলেছিলাম না মেহু পাখি শুধু আমার, আমি ছাড়া অন্য কেউ তার নাগাল পর্যন্ত পাবে না। মেহরিশকে ভালোবাসার, ওকে স্পর্শ করার অধিকার আমি ব্যাতীত অন্য কাউকেই দেইনি।”
– “এই ভালোবাসা বেশি দিন টিকবে না। আমি নিজ হাতে শেষ করে দিব তোর ভালোবাসাকে, তোর মেহু পাখিকে।
যখন তোর আসল পরিচয় প্রাচীর সামনে আসবে তখন কি হবে জানিস? বুমম! তোদের মধ্যকার বিশ্বাসের মধ্যে ফাটল পড়বে। আর সেটার জন্য একমাত্র তুই দায়ী। আমার বানানো প্ল্যানে তুই নিজেই এসে ধরা দিয়েছিস।”
বলেই হু হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রাইয়্যান‌। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটির মুখশ্রীতে নেই কোনো নিশ্চিহ্নতার‌ ছাপ। নেই কোন ভয়। শুধুই রয়েছে এক টুকরো ঝুলন্ত রহস্যময় হাসি।…………

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here