#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্থ_পর্ব
১০.
-“হোয়াট ননসেন্স! আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড প্রাচী? কি আজেবাজে বকছো এসব? আমি ঐ ছেলেটাকে মেরে হসপিটালে পাঠাব কেন? আর তোমার এই সাইকো লাভারের সাথে আমারই বা কিসের সম্পর্ক!”
তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো কন্ঠস্বরে কপট রাগ দেখিয়ে বলে ওঠে সমুদ্র। যেন প্রাচীর বলা অভিযোগ গুলো তার বোধগম্য হয় নি।
– “আমি যদি আজেবাজে বকে থাকি তাহলে আপনার হাতে এই ক্ষত কিসের? আপনি কি সেদিন হলুদের রাতে আমাকে ওয়ার্নিং দেন নি? বলেন নি আমাকে সেসব কথা? আর এই লেখা চিঠি কি আপনার নয় সমুদ্র ভাইয়া! এতগুলো জিনিস তো আর একসাথে কোয়েন্সিডেন্সলি ভাবে হতে পারে না, তাইনা?”
সন্দিহান চোখে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলে উঠে প্রাচী। আর সেগুলো কর্ণপাত হতেই ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সমুদ্রের। রাগে ক্ষোভে রক্তচক্ষু নিয়ে তড়িৎ গতিতে প্রাচীর বাম হাত চেপে ধরতেই ব্যাথায় হালকা কুঁকড়ে যায় প্রাচী।
– “আমি এতক্ষণ সোজাসুজি ভাবে বলছিলাম সেটা মেইবি তোমার এই ছোট্ট ইউজলেস মস্তিষ্কে পৌঁছায় নি তাইনা! আমি বারবার বলেছি না আমার থেকে দূরে থাকবে, তারপরেও ঘুরেফিরে আমার সামনেই কেন আসতে হবে তোমার?
আর এই চিঠি আমার, রাইট? দেন কাম উইথ মি, ড্যাম ইট!”
বলেই একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে প্রাচীকে রুমের ভেতর নিয়ে যায় সমুদ্র। পরিপাটি রুমটায় এক কর্ণারে বুকশেলফ আর টেবিল রাখা যেখানে প্রয়োজনীয় ফাইল থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপন্যাসের বই, নোটবুক রয়েছে।
– “কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে। আপনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসলেন কেন?”
সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে প্রলাপ বকে প্রাচী। কিন্তু সেদিকে কোনো প্রকার ভ্রূক্ষেপ না করে টেবিলের সামনে আসতেই প্রাচীর হাত ছেঁড়ে দেয় সমুদ্র। প্রাচীকে ছেড়ে দিয়ে টেবিল থেকে একটা মেরুন রঙের নোটবুক প্রাচীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বলে উঠে,
– “এখানে আমার হ্যান্ড রাইটিং দেয়া আছে। আই হোপ এটা দেখার পর নিজেকে এক্সপ্লেইন করতে হবে না কিছু। আর বাকি রইল ব্যান্ডেজের কথা; লুক এট দ্যা মিরর, ইডিয়ট!”
সমুদ্রের ধমকে কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে যায় প্রাচী। সমুদ্রের কথানুযায়ী ঘার ঘুরিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই আরো এক দফা অবাক হয় সে। ভাঙা আয়নার কিছু অংশ বাদে সবটাই পাশে বাস্কেটে পড়ে রয়েছে। তার মানে নিজের অজান্তেই সমুদ্রকে অযথা ভুল বুঝেছে সে। ভাবতেই নিজেকে মনে মনে দু গাল বকা দেয় প্রাচী। পরক্ষণেই কাঁপা কাঁপা হাতে নোটবুক খুলতেই তার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে। নোটবুক আর কাগজে থাকা লিখার মাঝে আকাশ পাতাল সমান তফাৎ। প্রাচীকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে সমুদ্র। এতে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রাচী।
– “হয়েছে? নাকি আরো কোনো প্রুফ দিতে হবে?”
প্রাচী নির্বাক। কি বলবে সে? বলার মতো কিছু আদৌ কিছু রয়েছে?
– “ফারদার আমার উপর অযথা দোষারোপ করার আগে ভালো করে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে। কিছু যাচাই না করেই কারো সাথে এমন মিসবিহেভ করাটা আই থিংক কোনো ম্যানারের মধ্যে পড়ে।
নাও গেট লস্ট ফ্রম মাই রুম, ইডিয়ট কোথাকার!”
সমুদ্রের ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে ভয়ে আতকে উঠে প্রাচী। মাথা নতজানু করে রুম থেকে টু শব্দ ব্যাতীত ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় সে। চোখ দুটোও অশ্রুতে টলমল করছে। এদিকে প্রাচী রুম থেকে বের হতেই সশব্দে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয় সমুদ্র। সারা শরীর রাগে রি রি করছে।
১১.
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। শীতের প্রভাব বেশ খানিকটাই গাঢ় হয়েছে। নির্জন রাত্রি। দূর দূরান্তেও কোথাও কৃত্রিম আলোর ছিটেফোঁটা নেই। ব্যালকনি সংলগ্ন থাকা ঝুলন্ত দোলনায় হাত পা গুটিয়ে বসে রয়েছে প্রাচী। গায়ে একটা অফ হোয়াইট রঙের শাল জড়ানো। মুখশ্রীতে একরাশ হতাশা আর গভীর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটেঔ উঠেছে।
– “সবসময় আমার সাথেই এমন হতে হবে কেন? শুধু শুধু এমন মানুষটাকে দোষারোপ করেছি যে কি না কিছুই করে নি। কিন্তু কি করব; এই অজানা আগন্তুকই বা কে? কে এই ব্যক্তি যে সবার আড়ালে থেকে এসব করছে? না আর পারছি না। এসবের চিন্তায় এবার বোধহয় সত্যি সত্যিই মাথাটা যাবে!”
চিন্তিত কন্ঠে বিড়বিড় করে বলে উঠে প্রাচী। দোলনায় বসে বসেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যায় সে।
পরদিন সকালে,,
সকালের কনকনে শীত অনুভূত হতে ঘুমের মাঝেই নড়েচড়ে উঠে প্রাচী। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই আশেপাশের তীব্র কুয়াশা জর্জরিত আকাশ দেখতে পায় সে। আড়মোড়া দিয়ে দোলনা থেকে নামতে গেলেই পায়ের কাছে বক্স জাতীয় কিছু দেখে থমকে দাঁড়ায় প্রাচী। ভ্রু খানিকটা কুঁচকে বক্স হাতে তুলে নেয় সে। উপরের আবরণ কাঁপা কাঁপা হাতে সরাতেই ভেতরে গুনে গুনে দশটার মতো গোলাপ বেরিয়ে আসে। তার সাথে এডজাস্ট করা একটা কার্ড চোখে পড়তেই সাবধানে ফুলের ভেতর থেকে কার্ড টি বের করে নেয় প্রাচী।
“এই অজানা আমিকে খুঁজে বের করার জন্য এত চিন্তা? নট ব্যাড, সুইটহার্ট। বাট কি বলো তো তোমার এত প্রচেষ্টা সবই ভেস্তে যাবে। যতদিন পর্যন্ত না আমি চাইব ততদিন তুমি আমার নাগাল পর্যন্ত পাবে না।
তাই বলি এই ছোট পুঁচকে মাথায় বেশি প্রেশার দিও না। লাভ হবে না। কেননা আমি তোমার কল্পনাতীত। তবে যেদিন সঠিক সময় আসবে সেদিন আমি নিজ থেকেই তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। কেটে যাবে অপেক্ষার প্রহর গুলো; আর ততদিন না হয় আমি তোমার অজানা আগন্তুক ই হয়ে রইলাম।
ইতি-
তোমার অজানা আগন্তুক!”
কার্ডে থাকা লিখা গুলো পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচী। অতি বিস্ময়ের কারণে চোখে যেটুকু ঘুমের রেশ লেগে ছিল তাও হারিয়ে গিয়েছে। অজানা ব্যক্তিটির সম্পর্কে একান্ত সব চিন্তা ভাবনা কিভাবে জানতে পেরেছে তা ভেবেই মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে প্রাচীর।
– “আপনি যেই হোন না কেন মিস্টার ইনভিজিবল, আমি আপনাকে সবার সামনে এনেই ছাড়ব আর সেটাও খুব শীঘ্রই।”
কার্ডটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে উঠে প্রাচী। মানুষটার প্রতি তার একটু বেশীই কৌতুহল জমে গিয়েছে। তার ভাবনার সুতো কাটে দরজায় খটখট আওয়াজ পেয়ে।
– “প্রাচী, এই প্রাচী! তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এসো। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
– “আসছি মামনি!”
জেবা বেগমের গলার স্বর পেয়ে তড়িঘড়ি করে ব্যালকনি থেকে রুমে এসে কার্ড আর ফুলগুলো আলমারির নিচের তাকে সন্তর্পণে লুকিয়ে নেয় প্রাচী। অতঃপর ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের দিকে।
১২.
নাস্তার টেবিলে সবাই যার যার চেয়ারে বসে টুকটাক কথা বলে যাচ্ছে। ইশরাকের ঠিক বাম পাশেই ফিহাকে বসানো হয়েছে। ফিহা লাজুক মুখে সবার করা প্রশ্নের উত্তর টুকটাক দিচ্ছে মাথা নিচু করে। আর ঠিক অপর পাশেই চেয়ারে বসে রয়েছে সমুদ্র। সবার সাথে কথা বললেও মুখে রয়েছে বেশ গাম্ভীর্যতা।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলেই ডাইনিং টেবিলে থাকা সমুদ্রের উপর চোখ পড়ে প্রাচীর। আড়চোখে একবার তাকিয়ে ধীর পায়ে এগোতেই দুটো চেয়ার খালি দেখতে পায় সে।
– “কি ব্যাপার মেহরিশ, ওভাবে সং সেজে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শিগগিরই বসে পড়। তোর জন্যে তো সবাই বসে আছে না খেয়ে।”
দাদির কথায় খানিকটা লজ্জা পায় প্রাচী। তার জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ভেবেই লজ্জা লাগছে তার।
– “বসছি দাদিমা।”
বলেই একটা চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখনই হুড়মুড় করে প্রাচিকে পাশ কাটিয়ে সেই চেয়ারে বসে পড়ে আকাশ।
– “তোকে কি বলে থ্যাংকস দেই দোস্ত। তুই এত কষ্ট করে আমার জন্যে চেয়ার টেনে দিলি, না বসে কি পারি বল? নে নে তুই ও পাশের চেয়ারে বসে পড়।”
দাঁত কেলিয়ে বলে উঠে আকাশ। এদিকে আকাশের এহেন কান্ডে প্রাচী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চোখ দুটো গরম করে আকাশের দিকে তাকিয়ে পাশের চেয়ারে চোখ যেতেই আতকে উঠে। কেননা খালি চেয়ারটার পাশেই সমুদ্র বসে রয়েছে।
– “আচ্ছা সমস্যা নেই তো, তুই সমুদ্রের পাশের চেয়ারটাতে বসে পড় প্রাচী। প্রচুর খিদে পেয়েছে এমনিতেই।”
ইশরাকের কথায় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চেয়ার টেনে বসে পড়ে প্রাচী। কিন্তু সমুদ্র যেন প্রাচীকে দেখেও না দেখার ভান করছে যেটা বোধগম্য হতেই খানিকটা মিইয়ে যায় প্রাচী। কোনো রকমে নাস্তা কমপ্লিট হতেই দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে উপরের দিকে পা বাড়ায় সে।
মাঝ থেকে কেটে গিয়েছে আরো তিন দিন। রোজ রাতে অথবা ভরদুপুরে অজানা ব্যক্তিটির হুটহাট চিঠি কিংবা র্যাপিং করা গিফট বক্স পাঠানোর মতো ঘটনায় রীতিমতো একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠেছে প্রাচী। শ খানেক চেষ্টা করেও অজানা ব্যক্তিটি সম্পর্কে কোনো ক্লু খুঁজে না পাওয়ায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে প্রাচীর মুখশ্রীতে।
– “ব্যাস, অনেক হয়েছে এসব লুকোচুরি! আপনি প্রতিবার আমার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যান অথচ আপনার নাগাল পাই না। কিন্তু এবার আর না। আজকে আমি আপনার আসল পরিচয় জেনেই ছাড়ব মিস্টার ইনভিজিবল।”
আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই একা একা প্রলাপ বকে প্রাচী।……..
#চলবে 🍂