সায়াহ্নের প্রণয় 🦋 পর্ব-৭

0
850

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তম_পর্ব

১৯.
প্রাচীর চিৎকার শুনে রীতিমতো জেবা বেগম, ফিহা, ইশরাক আর আনোয়ার হোসেন সবাই এসে উপস্থিত হয়েছেন প্রাচীর রুমে।
প্রাচীর বেগতিক দশা দেখতে পেয়ে জেবা বেগম আর ফিহা দুজনেই দ্রুত এগিয়ে যায়।

– “প্রাচী, এই প্রাচী কি হয়েছে? আকাশের কি হয়েছে?”
বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন মিসেস জেবা বেগম। তবুও প্রাচীর মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। তার চোখে মুখে এক প্রকার আশংকা। কাঁপা কাঁপা হাতে ল্যাপটপে থাকা ফাইলের দিকে ইশারা করতেই ল্যাপটপটি দ্রুত তুলে নেয় ইশরাক। অতঃপর ফাইলটি ওপেন করতেই ভয়ংকর দৃশ্য ভেসে উঠে ল্যাপটপ স্ক্রিনে।
– “আ,আক্,আকাশ! আ,আকাশকে ও মেরে ফেলেছে মা।”
আধ ভাঙা কন্ঠস্বরে কোনো মতে বলে উঠে প্রাচী।
– “কে মেরেছে? আর কেনই বা আকাশকে কেউ মারবে? তুই কি বলছিস এসব প্রাচী মা?”
খানিকটা এগিয়ে এসে বলে উঠেন আনোয়ার হোসেন।
– “আমি জানি না বাবা। ঐ যে ভিডিও ক্লিপে কেউ আকাশকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছে। বাজেভাবে মারার পর আবার গুলি,,”
পুরোটা বলার পূর্বেই ডুকরে কেঁদে ওঠে প্রাচী। ফিহা সান্ত্বনা দেয়ার জন্য প্রাচীকে আগলে নেয়। পুরো রুমেই থমথমে অবস্থা বিরাজমান। হওয়ারই কথা; এমন একটা ঘটনা মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই নীরবতার মাঝে ইশরাক হুট করেই বলে উঠে,

– “এমনটা তো নাও হতেও পারে। আর এমন হলে তো আকাশের পরিবারের কাছে খবর পৌঁছানোর কথা। আর সেটা হলে অবশ্যই তারা তোকে প্রথমে ফোন করে জিজ্ঞেস করত। আফটার অল আকাশ তোর বেস্ট ফ্রেন্ড।
আচ্ছা তুই এক কাজ কর, আকাশের ফোনে একবার কল করে দেখ!”
ইশরাকের‌ কথায় কান্না থামিয়ে নড়েচড়ে বসে প্রাচী। হ্যাঁ তাই তো। ইশরাকের বলা প্রতিটা কথাই ঠিক। গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে পেয়েও যায়।
কললিস্ট ঘেঁটে আকাশের নম্বর বের করে তাতে কল দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে প্রাচী। তার মন বলছে আকাশের কিছু হবে না। ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু অপর পাশ থেকে কেউ রিসিভ না করায় কল আপনাআপনি কেটে যায়। এতে করে জমে থাকা বাদবাকি আশাটুকুও মুহুর্তে গুড়িয়ে যায়।
– “ভাইয়ু কল রিসিভ হচ্ছে না। আকাশের কিছু হবে না তো?”
– “কিছু হবে না প্রাচী। তুই আবারো কল ব্যাক কর!”
ভাইয়ের কথানুযায়ী পুনরায় কল ব্যাক করে প্রাচী। আশ্চর্যজনক ভাবে কয়েক সেকেন্ড পর কল রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে আকাশের চেনা পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

– “হ্যাঁ বল প্রাচী। সরি দোস্ত, ইহানের বাসায় একটু ইমার্জেন্সি ছিল তাই তোকে না জানিয়েই ক্লাস বাঙ্ক দিয়েছি।”
অবাক হয় প্রাচী। যদি আকাশ ইহানের বাসায়ই থেকে থাকে তাহলে এসব ভিডিও ক্লিপ কিসের।
– “হোয়াট! তুই ঠিক আছিস? তুই এখন কোথায়?”
– “কেন? আমার আবার কি হবে এন্ড অফকোর্স আমি এখন বাসায়। আর তোর গলায় কি হয়েছে?”
আকাশের বলা প্রতিটি কথায় প্রাচী যেন নতুন করে অবাক হচ্ছে। অপর পাশ দিয়ে হ্যালো হ্যালো আওয়াজ আসলেও তার কোনোরকম প্রত্যুত্তর না দিয়ে নিরবে কল কেটে দেয় প্রাচী।

– “আকাশের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমি এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই মা।”
প্রাচীর বলা কথার মিসেস জেবা বেগম একপলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে আনোয়ার সাহেবকে ইশারা দিতেই রুমে উপস্থিত সবাই একে একে বের হয়ে যায়। প্রাচীর দিনকে দিন এমন পরিবর্তন বেশ ভাবিয়ে তুলছে হোসেন বাড়ির সকলকে।

২০.
কেটে গিয়েছে পাঁচ দিন। ভার্সিটির ক্লাস, পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতে নিতে মাঝ থেকে যে আরো পাঁচটি দিন কেটে গিয়েছে তা টেরই পায়নি প্রাচী। সেদিনের পর থেকে আগের থেকে অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে সে। ইতোমধ্যে আনোয়ার হোসেন আর জেবা বেগম এ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে তা কোনো বাহানা দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে সে। সেদিনের পাঠানো মিথ্যে ভিডিও ক্লিপটি সম্পর্কে ইশরাকের সাথে আলোচনায় এটাও জানতে পারে কেউ ইচ্ছে করেই এমনটা করছে তবে নির্দিষ্ট সোর্সের অভাবে সেই অজানা মানুষটির খোঁজ পাওয়া যায়নি।

দীর্ঘ একটা সময় ভার্সিটিতে কাটানোর পর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে পড়ে প্রাচী। আজ হৃদিতা আর আকাশ দুজনের কেউই আসেনি। যার ফলস্বরূপ ইশরাককে ফোন করে অনেক আগেই পিক আপ করতে বলেছে প্রাচী। বাইরে দাঁড়িয়ে ইশরাকের জন্য অপেক্ষা করছিল এমন সময় ওড়নায় টান পড়তেই আতকে উঠে প্রাচী‌। তড়িঘড়ি করে পেছনে ঘুরে তাকাতেই সাত-আট বছর বয়সী ছোট একটা বাচ্চাকে দেখতে পায় সে।
– “কি হয়েছে ভাইয়া? কিছু বলবে?”
– “হ্যাঁ, আপা। একটা ভাইজান তোমার জন্য এটা পাঠাইছে।”
বলেই একটা ফুলের তোড়া এগিয়ে দেয় ছেলেটি।
প্রাচীও কিছু না বলে তোড়াটা হাতে নিয়ে নেয়।
– “কিন্তু এই তোড়াটা যে পাঠিয়েছে তুমি কি তাকে দেখেছ?”
– “না গো আপা, ভাইজান তো মুখে মাস্ক লাগাইয়া ছিল। তার মাস্কের লাইগা তার চেহারা দেখবার পারি নাই। আচ্ছা আপা, আমি আসি তাইলে।”
প্রাচীকে আর কিছু বলার ফুরসৎ না দিয়েই ছেলেটি দৌড়ে চলে যায়। প্রাচীও সামান্য পরিমাণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
হাতে থাকা ফুলের তোড়া টা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে একপর্যায়ে ছোট কাগজ চোখে পড়ে।

“কেমন আছো মেহু পাখি?
খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন তাইনা, নিজের চোখের সামনে নিজেরই বেস্ট ফ্রেন্ড কে শেষ হয়ে যেতে দেখে? কিন্তু কি করব বলো? আমার প্রতিটা কথার অমান্য করো তুমি। তুমি নামক নেশার আশপাশে আমি ব্যাতীত অন্য কারোর উপস্থিতি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না। আর তাই কেউ যদি তোমার কাছে আসার চেষ্টাও করে তার পরিণতি সেই ভিডিও ক্লিপটার মতোই হবে আর সেটা যে কেউই হোক না কেন!”

লেখাগুলো পড়ে রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে কাগজটা মুচড়িয়ে পাশে ছুঁড়ে ফেলে প্রাচী।

– “কি পেয়েছে টা কি? যখন যা চাইবে তাই হবে? সবকিছু তার রুলস মোতাবেক চলবে? নেভার! ব্যাস, অনেক সহ্য করেছি এই তামাশা। ইউ, মিস্টার ইনভিজিবল, লিসেন এই ডিজগাস্টিং ওয়ার্নিং আর ইউজলেস কথাবার্তা শুনে আমি ভয় পাই না। সাহস থাকলে এইসব চিরকুট না দিয়ে, আড়ালে না থেকে আমার সামনে আসুন। আমিও দেখতে চাই কে আপনি!”
রাগের বশে বিড়বিড় করে প্রাচী। কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিরক্ত হয়ে সামনে ফিরতেই রাইয়্যানের মুখোমুখি হয় সে।

– “মিস মেহরিশ আয়াত প্রাচী, রাইট? আপনি এখানে?”
– “ইয়েস স্যার, একচুয়ালি একজনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাট স্যার আপনি এখানে?”
রাইয়্যান মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রাচীর ফোন বেজে ওঠে। আননোন নাম্বার দেখে ওতটা পাত্তা না দিয়ে পুনরায় কথাবার্তায় মনোযোগী হতে যাবে তখনি কারো হেঁচকা টানে ভয় পেয়ে যায় প্রাচী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কারো পুরুষালী দেহের উপর বুকের উপর আছড়ে পড়ে সে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাইয়্যানও‌। ভয় পেলেও পরমুহূর্তেই মাথা তুলে তাকাতেই চোখ তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।

– “সমুদ্র ভাইয়া, আপনি!”
সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অবাক স্বরে বলে ওঠে প্রাচী; সমুদ্রের এহেন উপস্থিতি তার কাম্য নয়।
– “কেউ তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়েট করবে না। তুমি ছাড়াও আমার কাছে আরো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ রয়েছে। সো আর এক মিনিট ও দেরি করে চলো আমার সাথে।”
সমুদ্রের বলা প্রতিটা কথাই প্রাচীর মাথার উপর দিয়ে গেল। গোল গোল চোখে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করেই প্রাচীর বাম হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করতেই টনক নড়ে প্রাচীর।

– “আরে করছেন টা কি? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? দেখুন সমুদ্র ভাইয়া এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। একটু পর ভাইয়া আমাকে পিক আপ করতে আসবে আর আপনি এখন আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় প্রাচী। কিন্তু সেদিকে কোনো ভাবান্তর না করে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির সামনে এসে দাড়াতেই হাত ছেড়ে দেয় সমুদ্র।
– “যাও গাড়িতে গিয়ে বসো।”
শান্ত গলায় বলা সমুদ্রের কথাটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
– “না আমি যাব না, আগে বলুন কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?”
– “জাস্ট শাট আপ! আর একটা কথা বললে ভালো হবে না প্রাচী। তোমাকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে না। ইশরাক একটা কাজে আটকে গিয়েছে তাই আমাকে পাঠিয়েছে তোমাকে পিক আপ করতে।
এখন তুমি গাড়িতে বসবে নাকি আমি বসাব?”
মুহুর্তেই মুখশ্রী চুপসে যায় প্রাচীর।

– “তো সোজাসুজি ভাবে বললেই তো পারত! এভাবে ষাঁড়ের মত চিল্লানোর‌ দরকার কি? ব্যাটা বদ কোথাকার।”
মনে মনে বিড়বিড় করতে করতেই গাড়ির ফ্রন্ট সিটে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে প্রাচী। সমুদ্র ও একবার আড়চোখে তাকিয়ে গিয়ে বসে পড়ে ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি চলা শুরু করে তার নিজস্ব গতিতে।…….

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here