#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#বিংশ_পর্ব ( রহস্য উন্মোচন ৩)
৫৭.
পশ্চিমা আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে। লাল আবির মাখা রক্তিম আকাশে সূর্য প্রায়ই অস্তমান। সন্ধ্যে নামা আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে প্রাচী। দৃষ্টি তার স্থির। পাশেই রেলিং ঘেঁষে বুকে দু হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। মাথা নতজানু হলেও মুখশ্রী তার গম্ভীরতায় ঘেরা।
আজ সকালেই চৌধুরী বাড়িতে ফিরেছে প্রাচী, সমুদ্র আর পিহু। পিহু আর প্রাচীকে নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠলেও তা কোনোমতে এড়িয়ে গিয়েছে প্রাচী আর সমুদ্র।
– “কেন লুকালেনে এসব আমার কাছ থেকে, সমুদ্র? এত এত রহস্যের মায়াজালে কেন আটকে রেখেছিলেন আমাকে?
ভাইয়ুর বিয়ের হলুদ থেকে শুরু করে এখন অবধি যা যা ঘটেছে আপনি সব জানতেন; জানতেন বলছি কেন? এসবের পেছনে তো আপনিই ছিলেন! সেসব লিখা চিরকুট পড়ে একটা সময়ের জন্য মনে হয়েছিল এসব আপনার কাজ; এমনকি এই সন্দেহ থেকে আপনার সামনে আমি বহুবার প্রশ্ন ও ছুঁড়ে দিয়েছি। তবুও কেন এড়িয়ে গিয়েছিলেন আমায়?”
বলেই দুম করে নিঃশ্বাস ফেলে প্রাচী। একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে গিয়ে নিঃশ্বাস বার বার আটকে আসছিল। আড়চোখে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই খেয়াল করে সমুদ্র আগের মতোই অবিকল দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু পরিমাণ নড়বড় ঘটেনি তার মাঝে। তার মানে কি সমুদ্র তার কথাকে পাত্তা দিচ্ছে না নাকি বিগত সময়ের মত এবারও এড়িয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
– “আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি সমুদ্র। আপনি একজন সিক্রেট গ্যাংস্টার! এত বড় একটা রহস্য এতদিনের মাঝে একবারও মনে হয়নি আমাকে বলা উচিত! তার উপর নিকিতা, পিহু! কেন গোলক ধাঁধায় ফেলে রেখেছেন আমাকে? কে এই নিকিতা? পিহু আর প্রাচীর সাথে আপনার আর রাইয়্যানের কিসের সম্পর্ক?”
সমুদ্রের দিকে ঘুরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই সমুদ্র আড়চোখে প্রাচীর দিকে তাকায়। প্রাচীও বেশ উৎসুক হয়ে আছে সমুদ্রের উত্তরের জন্যে। সমুদ্র তার কথার প্রত্যুত্তরে কি বলবে তা শোনার জন্য।
– “ফিনিস? প্রশ্ন শেষ হয়েছে নাকি আরও কিছু বাকি রয়েছে?”
সমুদ্রের কথায় হালকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে প্রাচী। এ কেমন উত্তর? ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সমুদ্র তার গাম্ভীর্য কন্ঠে বলে ওঠে,
– “পিহু আমার মেয়ে না প্রাচী। পিহু রাইয়্যানের মেয়ে। আর নিকিতা হলো সেই মেয়ে যাকে ভালোবেসে প্রচন্ড ভাবে আঘাত দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে মাঝপথে ছেড়ে গিয়েছিল রাইয়্যান
রাইয়্যান যখন নিকিতাকে ছেড়ে গিয়েছিল তখন নিকিতা ছিল অন্তঃসত্ত্বা যার মাঝে একটু একটু করে একটা প্রাণ বেড়ে উঠছিল। এটা ছিল রাইয়্যানের সম্পূর্ণ অজানা। আজ থেকে কয়েক বছর আগে যখন আমি ইউকে যাচ্ছিলাম তখনই আমার নিকিতার সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটা প্রচন্ড ভাবে ভেঙে গিয়েছিল। আর তার আগে থেকেই আমি গ্যাংস্টার ছিলাম। রাইয়্যান ও ছিল সেই গ্যাংস্টারের মধ্যে একজন। দলের হিডেন ইনফরমেশন সহ বেশকিছু ইম্পর্ট্যান্ট ব্লু প্রিন্ট বিরোধী দলের কাছে প্রতারণা করে পৌঁছে দেয়ায় সেদিন দলের চার পাঁচজন মেম্বার বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়। সেই সাথে যেখানে আমি নিকিতাকে সেফলি রেখেছিলাম সেখানেও আক্রমণ চালানো হয়।
নিকিতার তখন সাড়ে আট মাস চলছিল। আক্রমণের এক পর্যায়ে একটা গুলি এসে নিকিতার শরীর ছুঁয়ে যায়। আমি পারিনি সেদিন তাকে বাঁচাতে। তবে নিকিতার কাছে আমি ওয়াদা করেছিলাম যে পিহুর কথা যেন কোনো মতেই রাইয়্যান না জানে। আর এটাও কথা দিয়েছিলাম রাইয়্যানের কোনো ক্ষতি করব না। শুধুমাত্র সেদিনের দেয়া কথার জন্যেই রাইয়্যান প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সেদিন রাতে ওটির সামনে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন নার্স এসে আমার কোলে সদ্য জন্মানো একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে তুলে দেয় আর পাশেই রেখে দেয় নিকিতার নিথর দেহ। নিজের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আমায়। সেদিন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পিহুকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে। তাইতো সেদিন রাতের ফ্লাইটেই পিহুকে নিয়ে চলে আসি বিডিতে। বনানীতে ফার্ম হাউজেই অর্পিতার কাছে বড় হতে থাকে পিহু। পিহু জানে যে তার মা এই পৃথিবীতে নেই। তবে তার বাবা হিসেবে আমাকেই চিনে আর আমিও পিহুকে নিজের মেয়ের মতোই দেখি।
আর রইলো রাইয়্যানের কথা? ওকে আমি সেদিনই ওর শাস্তি স্বরূপ ওর কাছে থাকা গ্যাংস্টার পাওয়ার কেড়ে নিয়েছিলাম। তীক্ষ্ণ কথার পরিপ্রেক্ষিতে অপমান করে বের করে দিয়েছিলাম গ্যাং থেকে। তাইতো এতো বছর পরেও মুখোমুখি হতে হলো দুজনকে। তবে কে জানত এটাই রাইয়্যানের সাথে আমার শেষ দেখা ছিল!”
সমুদ্রের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে প্রাচী। সমুদ্রকে ঘিরে থাকা এতগুলো রহস্য তাহলে তার এতদিন অজানা ছিল। অতি আশ্চর্যতার কারণে চোখের পলক ফেলতে ও ভুলে বসেছে বোধ হয় প্রাচী।
৫৮.
– “এত বড় রহস্য আমার থেকে না লুকালেও পারতেন সমুদ্র! আপনি শুধু আমার কাছ থেকে না বরং আপনার ফ্যামিলি, আমার ফ্যামিলি, ভাইয়ু সবার কাছ থেকেই এত এত রহস্য লুকিয়েছেন!”
অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রাচী। প্রাচীর এমন বিস্ময়তা দেখে মৃদু হাসে সমুদ্র।
– “উহু ভুল বলেছ। বেশি কেউ না, আমার এত এত রহস্য তোমার ভাই অর্থাৎ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ইশরাক আর মা জানত। আর তোমার কাছে লুকানোর ও যথেষ্ট কারণ ছিল। নিজের প্রেয়সীর কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাই না!”
– “তার মানে! ভাইয়ু আর মা ও জানত কিন্তু কেউ আমাকে কিছু বলে নি!
নিজেকে তো খুব সাইকো লাভার বলে দাবি করেন, আমাকে নিজের প্রেয়সী বলে দাবি করেছিলেন। এই আপনার ভালোবাসা?
ধ্যাত কারো সাথেই কথা বলব না আমি। আর আপনি! বিশেষ করে আপনার সাথে তো আর কথাই বলব না। কেউ আমাকে ভালোবাসে না”
ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে বাচ্চাদের মতো অভিযোগ করে কথাগুলো বলে উল্টো দিকে পা বাড়াতেই তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয় সমুদ্র। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমুদ্রের বুকের উপর গিয়ে পড়ে প্রাচী। সমুদ্র ও অতি সযত্নে নিজের হাত দুটো প্রসারিত করে আগলে নেয় নিজের প্রেয়সীকে। নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালালেও শেষ মেষ সমুদ্রের শক্তিশালী বাহুর কাছে হার মেনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে প্রাচী।
বিশাল পুরুষালী দেহের হার্টবিট স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে প্রাচী।
– “দেখো আমার হার্টবিট ও বলে দিচ্ছে যে এই সমুদ্র তার প্রেয়সীকে কতখানি ভালোবাসে।”
সমুদ্রের কথা শুনে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী। সমুদ্র ও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে খানিকটা ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে উঠে,
– “এভাবে তাকিও না প্রেয়সিনী। এই দৃষ্টিই আমাকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। পরে বিমোহিত হয়ে কিছু করে বসলে আমার কোনো দায়ভার থাকবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।”
সমুদ্রের এহেন কথায় চোখ বড় বড় করে নিজেকে দ্রুত ছাড়িয়ে নেয় প্রাচী।
মাগরিবের আজানের সুমধুর সুর ভেসে আসছে দূরে থাকা মসজিদ গুলো থেকে। সন্ধ্যেও নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।
– “মুখে কি কিছু আটকায় না নাকি? ব্যাটা লুচু কোথাকার!”
আপনমনে বিড়বিড় করে প্রাচী।
– “আমাকে লুচু উপাধি দেয়া নটস্ ফেয়ার প্রাচী। কিছু না করেই লুচু উপাধি দেয়াটা একদমই ঠিক না মিসেস প্রাচী।”
– “কিছু করতেও হবে না। সন্ধ্যে নেমেছে। নিচে চলুন। মা, পিহু সবাই চিন্তা করছে।”
বলেই আর কথা বলার সুযোগ দেয় না প্রাচী। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিচের দিকে চলে যায়। সমুদ্র প্রাচীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসে। আজকের সন্ধ্যাটা একটু বেশিই স্পেশাল তার কাছে। জীবনের থাকা সব কালো অধ্যায় গুলো এই বুঝি কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।
৫৯.
রাতের ডিনার শেষে,,
রুমের মধ্যে আয়নার সামনে বসে চুলে বিনুনি করতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। পিহুকে খাইয়ে দেয়ার পর পরই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মিনিট পাঁচেক পর ই রুমে প্রবেশ করে সমুদ্র। প্রাচীকে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে সামনে এগিয়ে যায় সে।
হঠাৎ কারো তুড়ি বাজানোর শব্দ শুনতে পেয়ে নড়েচড়ে বসে প্রাচী। মাথা তুলে তাকাতেই সমুদ্রকে চোখে পড়ে তার।
– “কি ব্যাপার? কি ভাবছিলে অন্যমনস্ক হয়ে?”
– “তেমন কিছু না। মাথায় দু একটা প্রশ্ন জট পাকিয়ে বসে আছে। সেগুলোই ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম আর কি।”
প্রাচীর কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে সমুদ্রের।
– “মানেহ!”
– “আমি ভাবছিলাম যে আপনি তো বলেছিলেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন, কিন্তু সেটা ঠিক কখন থেকে? এই বছর, ছ মাস আগে থেকে নাকি সেই চার বছর আগে থেকেই?”
প্রাচীর ছুড়ে দেয়া প্রশ্ন শুনে থমকে যায় সমুদ্র। এ কেমন প্রশ্ন? এর উত্তর কি আদৌ রয়েছে তার কাছে?………….
#চলবে 🍂