সায়াহ্নের 🦋 পর্ব-২১

0
769

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#একবিংশ_পর্ব

৬০.
– “এ,এটা আবার কেমন প্রশ্ন প্রাচী? হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি; কিন্তু কখন থেকে এটা আবার কেমন কথা?”
আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে সমুদ্র। যেন কিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। সমুদ্রের কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। সমুদ্রের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে সরু দৃষ্টিতে তাকায় সে।
– “এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন সমুদ্র? আমি তো শুধু একটা সিম্পল‌ প্রশ্ন ই করেছি। আপনি তো দেখি বেশ সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন।”
কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায় প্রাচী। সমুদ্র তাও নিশ্চুপ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সে।

– “এটা বললেই তো হয় যে আপনি আমাকে এখন থেকে না বরং সেই পাঁচ বছর আগে থেকেই ভালোবাসেন। শুধু মাত্র সেই ভালোবাসা, অনুভূতি গুলোকে প্রকাশ করতে চান নি বলে এড়িয়ে গিয়েছেন আমাকে। চলে গিয়েছিলেন আমাকে ছেড়ে সেই সুদূর ইউকে তে। অ্যাম আই রাইট, মিস্টার জুনায়েদ আরহাম‌ সমুদ্র?”
পিলে চমকে ওঠে সমুদ্র। অবাক হয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রাচীর দিকে। অন্যদিকে প্রাচীর দৃষ্টি স্থির। দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই তার মাঝে।
– “কি হলো? এভাবে চমকে উঠলেন কেন? ভাবছেন আমি জানলাম কি করে, এটাই তো? আফটার অল, একজন গ্যাংস্টারের প্রেয়সিনী ছিলাম তার মাথার বুদ্ধি ও তো একটু ইউনিক হতে হবে তাই না? তাহলে শুনুন, আপনার এতদিনের এই অজানা আগন্তুক সেজে থাকার কথা আমি জানতাম। সেদিন রাতে যখন আপনি ব্যালকনি টপকে লুকিয়ে লুকিয়ে রুমে এসেছিলেন হলুদ লাগিয়ে দেয়ার জন্য সেদিন রাতেও আমি সজাগ ছিলাম। এমনকি এতদিনের লিখা চিঠিগুলোও যে আপনার ই; কেননা আপনি একইসাথে অনেক রকম লিখা লিখতে পারেন। সবটা জেনে শুনেও চুপচাপ ছিলাম এই আশায় কখন এসে আমাকে সবটা বলবেন। কিন্তু আফসোস; লাস্টে আমারই সত্যিটা বের করতে হলো। কি করব বলুন? এত টুইস্ট আমার আবার একসঙ্গে হজম হয় না।
রাত হয়েছে অনেক। আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমারো প্রচুর ঘুম পাচ্ছে এমনিতেই। গুড নাইট ডিয়ার হাজবেন্ড!”
প্রাচীর এমন পরিবর্তিত রূপ ঠিক বোধগম্য হয় না সমুদ্রের। অতি পরিমাণ অবাক হওয়ার কারণে ঠিক কি রিয়্যাক্ট করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক। প্রাচী তো দেখছি তার চেয়েও একধাপ বেশি ইন্টেলিজেন্ট!
– “এ মেয়ে তো দেখছি আমার চেয়েও বেশি এডভান্স‌। বাহ্ সমুদ্র বাহ্। শেষ মেষ তোর বউ ডিটেকটিভ অফিসারদের ও হার মানাবে এসব ব্যাপারে। আসলেই তারিফ করতে হয়‌। এতদিন ভেবেছিলাম শুধু আমার মাঝেই রহস্য; এখন তো দেখছি আমার চেয়ে আরো বেশি রহস্য এই মেয়ের ভেতরে। ইন্টারেস্টিং!”
মনে মনে বিড়বিড় করে সমুদ্র। ঘড়িতে রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। আসলেই শরীর আজ বেশ ক্লান্ত। তাই আর কথা না বাড়িয়ে গিয়ে বিছানায় একপাশে শুয়ে পড়ে। প্রাচীও এগিয়ে গিয়ে পিহুর পাশে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। মিনিট দশেকের মাঝেই দুজনেই তলিয়ে যায় অতল ঘুমের ঘোরে।

৬১.
– “আচ্ছা তুমি কি আমাল‌ নতুন মা?”
পিহুকে‌ রেডি করতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। হঠাৎ পিহুর‌ প্রশ্নে থমকে যায় সে। দেখতে অবিকল নিকিতার মতো হয়েছে পিহু‌। বিদেশিনী বিদেশিনী ভাব রয়েছে। সরু নাক, গাঢ় ব্রাউন‌ রঙের চোখ জোড়া। পিহুর আহ্লাদী সুরে বলা কথা শুনে মুচকি হাসে প্রাচী।
– “নতুন মা হবো কেন? নতুন পুরনো বলে মা হয় না। আমি তো তোমারই মা। আমাকে মা বলেই ডাকবে,‌ কেমন?”
– “সত্যি বলছো? ইয়েএএ কি মজা! তার মানে এখন থেকে আমাল ও মা হবে। সবার মতো আমাল মা ও আমাল সাথে স্কুলে যাবে।”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে পিহু। পিহুর‌ এমন উৎফুল্ল তা দেখে মুচকি হেসে পিহুকে জড়িয়ে ধরে প্রাচী।
মাঝ থেকেই আরো এক সপ্তাহ ‌কেটে গিয়েছে চোখের নিমিষেই। আজ হোসেন বাড়িতে যেতে হবে। নতুন মেহমানের আগমনের খবর শুনে প্রত্যেকেই বেশ খুশি। সেই কথা শুনেই আজ কোহিনুর চৌধুরী আর সাদাত চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে সে বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল প্রাচী। পিহুকেও সাথে নিয়ে যাবে সে। অবশ্য এই কয়েক দিনে কোহিনুর চৌধুরী পিহুকে নিয়ে বিন্দুমাত্র টু শব্দ ও করেন নি; হয়তো পিহুর‌ ব্যাপারে সবটা জানেন। কোহিনুর চৌধুরীকে যতই দেখে ততই অবাক হয় প্রাচী।

ফোনের মেসেজের রিংটোনের টুং শব্দে ভাবনার সুতো কাটে প্রাচীর। ফোনের স্ক্রিনে সমুদ্র নাম থেকে মেসেজ এসেছে। মেসেজ পড়ে ফোনের দিকে একপলক তাকিয়ে পিহুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।
গাঢ় সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ি, হালকা অর্নামেন্টস্, চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। পিহুকে কোলে গাড়ির কাছে এগোতেই সমুদ্রকে চোখে পড়ে প্রাচীর।
এদিকে সমুদ্র এতক্ষণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিল। অপেক্ষা করছিল প্রাচী আর পিহুর‌ জন্য। শাড়ি পরিহিতা নারীর অবয়ব চোখে পড়তেই কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় সে। সমুদ্রকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিতেই নড়েচড়ে দাঁড়ায় সমুদ্র।

– “উহুম,উহুম! এখানেই কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারাদিন পার করার প্ল্যান আছে নাকি ডিয়ার হাজবেন্ড? দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলুন।”
সরু দৃষ্টে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রাচী।
– “তুমি চাইলে তা করতে পারি। ডু ইয়ু ওয়ান্ট টু স্টে হেয়ার মাই ডিয়ার ওয়াইফি‌? বাই দা ওয়ে ইয়ু লুক সো হট!”
সমুদ্রের কথা শুনে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রাচীর। এদিকে পিহু খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে।
– “ধ্যাত আপনার সাথে কথায় পেরে ওঠা অসম্ভব! কথাই বলব না আমি।”
বলেই সমুদ্রকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে প্রাচী। প্রাচীর এহেন রিয়্যাকশনে‌ হেসে সমুদ্রও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়তেই গাড়ি চলা শুরু করে তার নিজ গতিতে।

হোসেন বাড়িতে মেহমান গিয়ে পরিপূর্ণ। হলরুমে মেহমান গিজগিজ করছে। ফিহাকে ঘিরে সবাই নানা আয়োজনে, সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রাচীর দাদীও উপস্থিত রয়েছে। হলরুমে সবার সাথে দেখা করে পিহুকে নিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায় প্রাচী। নিচে থাকলে মানুষের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যেটা এখন চায় না সে।
রুমে আসতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। ধীরে ধীরে মেহমান কমলে নিচে যেয়ে কথা বলা যাবে। পিহুকে বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে কাবার্ড থেকে কয়েকটা টেডিবিয়ার বের করে দিতেই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পিহু। প্রাচীও চলে যায় ফ্রেশ হতে। এদিকে নিচে সমুদ্র বড়দের সবার সাথেই আলাপ আলোচনায় সময় পার করে দিচ্ছে।

৬৩.
সন্ধ্যার পরে,,
বাড়ির সব সদস্য খোশগল্প করতে ব্যস্ত। বাড়ির বড়রা তো ফিহার‌ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রাচী কিচেন থেকে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে হলরুমে উপস্থিত হতেই প্রাচীর চাচী মিসেস হেলেনা হাসতে হাসতে কটাক্ষের সুরে বলে উঠেন,
– “কি ব্যাপার গো মেহরিশ; এ বাড়ির বউ তো সুখবর দিয়ে দিল! তা এ বাড়ির মেয়ে আমাদের কবে সুখবর দিবে? আমাদের ও তো বয়স হয়েছে। আর কদিন ই বা বাঁচব বলো?”

চাচীর কথা শুনে প্রথমে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রাচী। কিন্তু পরমুহূর্তেই বিষয়টি বোধগম্য হতেই লজ্জায় মাথা আপনাআপনি নতজানু হয়ে আসে তার। এর চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনায় সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে তার মনে হয়না। ভাগ্যিস এখানে সমুদ্র নেই। তাহলে তো লজ্জায় চোখ তুলেই তাকাতে পারত না সে। দ্রুত নাস্তার ট্রে টেবিলের উপর রেখে সবাইকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনই সমুদ্রের গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ায় সে।

– “আরে চাচি সাহেবা‌, একদম ঠিক বলেছেন আপনি। বয়স তো দেখি আপনার আসলেই অনেক হয়েছে। তা রাইসা যেন কোথায়? শুনেছিলাম তো লাস্ট মান্থ লন্ডনে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। বয়স তো রাইসার ও হয়েছে। এতদিনে তো বিয়ে করে আপনাকে নাতি-নাতনি দেয়ার কথা। ঠিক বলেছি না, চাচি সাহেবা?”
সমুদ্রের কথা শুনে মুহূর্তেই মিসেস হেলেনার‌ মুখ চুপসে যায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সমুদ্রের কথা শুনে বেশ বিরক্ত বোধ করছেন। মুখ বাঁকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সমুদ্র পুনরায় বলে উঠে,
– “আপনারা সবাই জানেন প্রাচীর আর আমার বিয়েটা হুট করেই হয়েছে। সবটাই পরিস্থিতির স্বীকার ছিল। তাছাড়া প্রাচীর এখনো ইয়ারলি এক্সাম বাকি। আমি চাই প্রাচী ওর স্টাডি কন্টিনিউ করুক। আর তেমন কিছু হলে সবার আগের মিষ্টিমুখ আপনাকেই করানো হবে চাচি সাহেবা‌।”
এদিকে সমুদ্রের উদ্ভট সব কথাবার্তা শুনে এককোণে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে প্রাচী। সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র ও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে পেছনে ঘুরে প্রাচীর হাত ধরে সবার সামনে থেকেই উপরের দিকে হাঁটা শুরু করে। মিসেস হেলেনা সহ উপস্থিত সবার মুখেই যেন তালা পড়ে গিয়েছে।

– “আরে করছেন টা কি! ছাড়ুন আমাকে। আমি তো চলেই আসছিলাম উপরে। কিন্তু ওখানে সবার সামনে কথাগুলো বলা কি জরুরী ছিল? চাচি সহ সবাই কি মনে করবে এখন? আমিই বা সবার সামনে মুখ দেখাব কি করে? আসলেই আপনার মুখে কোনো কথা আটকায় না!”
মুখ ফুলিয়ে বিরক্তির সুরে সমুদ্রকে বলে ওঠে প্রাচী। সমুদ্র ও হাত ছেড়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সেকেন্ড কয়েক সরু দৃষ্টে তাকিয়ে হুট করেই খানিকটা ঝুকে পড়ে প্রাচীর দিকে। ফিসফিস করে ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে ওঠে,

– “কেন ভুল কিছু বলেছি নাকি আমি? ওয়ান মিনিট, ওয়ান মিনিট! বাই এনি চান্স তুমি কি কোনোভাবে এটা বলতে চাইছো না যে নিচে হলরুমে চাচির কথার সাথে তুমিও সহমত? বাহ্, বাহ্ আমার ডিটেকটিভ ওয়াইফি দিন দিন একটু বেশিই রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে।”

সমুদ্রের ফিসফিস করে বলা কথা কর্ণপাত হতেই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রাচীর। সমুদ্রের ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে দ্রুত ছিটকে দু কদম পেছনে সরে এসে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় সমুদ্রের বুকে।
– “ব্যাটা লুচু কোথাকার! তিলকে তাল বানিয়ে ফেলেছে। যান আপনাকে আজ থেকে বয়কট করলাম আমি! ধারে কাছে দেখলেও অবস্থা খারাপ করে দেব।”
হঠাৎ প্রাচীর এমন উটকো কথা শুনে মিনিট কয়েক থম মেরে যায় সমুদ্র। অতঃপর বুঝতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আর সেটা খেয়াল করে প্রাচীও মুখ বাঁকিয়ে চলে যায় রুমে।…….

#চলবে 🍂
( আসসালামু আলাইকুম 🌼। সবাই কেমন আছেন?
গল্পের সব রহস্য দিয়ে দেয়া হয়েছে। আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন। আর গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। কেমন হয়েছে জানাবেন।

ভালোবাসা অবিরাম 🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here