সায়াহ্নের 🦋 পর্ব-২২

0
900

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বাবিংশ_পর্ব (সারপ্রাইজ স্পেশাল 🥳🥳)

৬৩.
ঘড়ির কাঁটার সময় তার নিজ পরিক্রমায় চলতে থাকে। সাথে বদলে যেতে শুরু করে পরিস্থিতি, মানুষের জীবন। তেমনই সময়ের পরিক্রমায় চলে গিয়েছে চার মাস। নানান ব্যস্ততায়, সেমিস্টার এক্সাম, ভার্সিটি ক্লাস, বিভিন্ন ফ্যামিলি প্রোগ্রামের মাঝে বেশ ভালোই সময় কাটিয়েছে প্রাচী। সমুদ্রের সাথে ব্যয় করা প্রতিটা মুহূর্ত ই তার দিন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাদের মধ্যকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং আগের চেয়ে আরো কয়েক গুণ বেশি ভালো হয়েছে। আর তার নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে পিহু তো রয়েছেই। এদিকে অন্যান্য সবার মতোই আকাশ আর হৃদিতার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে মধ্যকার সম্পর্কে।
হৃদিতার জন্য জমে থাকা বহুদিনের ফিলিংস কয়েকদিন আগেই বেশ সাহস করে হৃদিতার সামনে তুলে ধরে আকাশ। প্রথম প্রথম রিজেক্ট হওয়ার ভয় থাকলেও তার ভয়কে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে হৃদিতাও খুব স্বাভাবিক ভাবেই তা সাদরে গ্রহণ করে নেয়। নিজ নিজ অনুভূতি প্রকাশ করার মাধ্যমেই দুজনের নতুন পথচলা এবং খুব শীঘ্রই তা বিবাহ নামক বন্ধনে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে।

বিগত চার মাসে পিহুকে নিয়ে দু পরিবারের মাঝে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠলেও প্রতিবারই প্রাচী সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে পিহুকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করেছে সে। প্রাচীর দৃঢ় মনোভাব নিয়ে হোসেন বাড়ির কেউ তেমন আর কথা বাড়ায়নি। কেননা মিসেস জেবা বেগম আর আনোয়ার সাহেব খুব ভালো করেই জানেন যে প্রাচী একবার কোনো কথা ধোঁয়াশা রেখে দিলে তা আর কেউ জানতে পারবে না। মেয়েটার এমন চাপা স্বভাবের জন্য বেশ চিন্তিত হলেও ইশরাক সামলে নিয়েছে।

ভার্সিটির ক্লাস শেষে ক্লান্ত শরীরে বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে প্রাচী। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো বাসায় পৌঁছে কোহিনুর চৌধুরী, পিহু কাউকেই চোখে পড়ে নি তার। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে বেশ খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর বাসার টগর খালার কাছে বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞেস করতেই বলে ওঠেন,
– “জানি না গো মা, মালকিন তো আইজ সক্কাল থেইকাই বাড়িত নাই‌। পিহু মা রেও লগে কইরা লইয়া গেছে। কিছু লাগব নি তোমার?”
ছোট্ট করে না বলেই ফের উপরের দিকে চলে আসে প্রাচী। আজকে এমনিতেই কোনো এক কারণে মনটা বিষন্ন ছিল। একেতো সমুদ্রও এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত তার উপর হুট করেই তাকে না জানিয়ে কোহিনুর চৌধুরী পিহুকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে তাও তার অজানা‌। সব মিলিয়ে পুরো বাড়িতে একা থাকায় মন আপনাআপনিই বিষন্ন হয়ে ওঠে।
বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে ফোন অন করতেই স্ক্রিনের উপর সমুদ্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে ওঠে। কিছু একটা ভেবে সমুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করতেই অপর পাশে রিং হতে থাকলেও কেউ রিসিভ করে না। এখন তো লাঞ্চ টাইম। এখন তো সমুদ্রের ফ্রি থাকার কথা। তাহলে ফোন রিসিভ করছে না কেন? বেশ চিন্তিত হয়ে দ্বিতীয় বার পুনরায় কল করতেই সেকেন্ড কয়েক পর রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে কর্কশ কন্ঠস্বর কর্ণপাত হয় প্রাচীর‌।
– “কি হয়েছে প্রাচী? বারবার ফোন করছো কেন? দেখছ তো আমি ফোন রিসিভ করছি না আমি। তোমার তো বোঝার কথা আমি ব্যস্ত আছি। আমি এখন ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং এ আছি। ফোন রাখছি আমি।”
প্রাচীকে কোনো কথা বলার অবকাশ না দিয়ে খট করে কল কেটে দেয় সমুদ্র। আর এদিকে প্রাচী হতভম্ব হয়ে নিষ্পলক চাহনিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্বাভাবিক ভাবে বললেই তো হতো। এভাবে রুডলি আচরণ না করলেও পারত‌ সমুদ্র। হঠাৎ করেই মন খারাপের পাল্লা আরো দ্বিগুন বৃদ্ধি পায় প্রাচীর। চোখ দুটোও ক্রমশ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। টলমল চোখ দুটো লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিতেই অবাধ্য অশ্রু গুলো চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

৬৪.
নিচ থেকে অনবরত কলিং বেলের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই ঘুমের মাঝে নড়েচড়ে ওঠে প্রাচী। সন্ধ্যার পর পর কখন যে চোখ লেগে এসেছিল টেরই পয় নি সে। চোখ পিটপিট করে ঘড়ির দিকে তাকাতেই হুড়মুড় করে উঠে বসে প্রাচী। বেশ রাত হয়েছে। অন্যদিকে সমুদ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজিয়েই চলেছে। কিন্তু কেউ না আসায় চিন্তার পরিমাণ ভারী হয় তার। ভেতরে প্রাচী ঠিক আছে তো? চিন্তিত তো পুনরায় কলিং বেলে চাপ দিতে যাবে তখনই দরজা খুলে দেয় প্রাচী।
বিধ্বস্ত, উদাসীন মুখশ্রীতে মলিনতার‌ ছাপ স্পষ্ট। চোখ দুটোও বেশ ফোলা। প্রাচীর এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় সমুদ্র। সে তো সন্ধ্যার সময় প্রাচীকে মেসেজ করেছিল। তাহলে প্রাচী এখনো রেডি হয় নি কেন? তবে কি প্রাচী সেই মেসেজ ই দেখে নি? সমুদ্র ভেতরে প্রবেশ করতেই প্রাচী মাথা নতজানু করে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,

– “আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি।”
প্রাচীর এমন গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে সমুদ্র মাথা তুলে তাকায়।
– “মা, পিহু কোথায়?”
– “টগর খালা বলেছে মা পিহুকে নিয়ে সকালেই বেরিয়েছেন। মাকে ফোন করেছিলাম; সে তো বলেছে রাত ১০:০০ টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু এখন তো ১০:৩০ বেজে গিয়েছে। আচ্ছা আমি মাকে ফোন করে দেখছি।”
বলতে বলতে সমুদ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই সমুদ্র পথ রুখে দাঁড়ায় প্রাচীর।
– “এক মিনিট, প্রাচী! তোমার ফোন কোথায়?”
– “ফোন? ফোন তো রুমে। কিন্তু কেন?”
– “বাই এনি চান্স তুমি কি আমার দেয়া মেসেজ পড়ো নি?”
সমুদ্রের কথা প্রাচীর মাথার উপর দিয়ে যায়। কথার ভাবার্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু না বলেই আচমকা প্রাচীর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যায়।
– “কি করছেন আপনি সমুদ্র? আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? আর কিসের মেসেজের কথা বলছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।”
কিন্তু সেদিকে কোনো প্রকার ভ্রূক্ষেপ না করে রুমে এসে কাবার্ডের কাছ থেকে প্রাচীর ‌ফোনটা হাতে তুলে নেয় সমুদ্র। ফোন অন করে মেসেজ অপশনে ক্লিক করে মেসেজটা প্রাচীর সামনে তুলে ধরতেই প্রাচী চোখ দুটো ছোট ছোট করে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। পুরো মেসেজটি পড়তেই মুখ চুপসে যায় তার‌।

– “আ,আস,আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি খেয়াল,,”
পুরো বাক্য শেষ করতে পারে না প্রাচী। তার পূর্বেই সমুদ্র ধমকের সুরে বলে ওঠে,
– “Go and ready right now! ইডিয়ট একটা!”
মুখ ফুলিয়ে কাবার্ড থেকে একটা ডার্ক রেড কালারের গাউন বের করে ওয়াশরুমের‌ দিকে চলে যায় প্রাচী।
ডার্ক রেড গাউন,‌ পার্ল অর্নামেন্টস‌, ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক, চুল গুলো সুন্দর করে বেঁধে রাখা। রেডি হয়ে বের হতেই প্রাচী খেয়াল করে সমুদ্র ও তার সাথে ম্যাচিং করে স্যুট পড়েছে। কিন্তু এত রাতে হঠাৎ রেডি হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পায় না সে। এদিকে সমুদ্র একদৃষ্টে প্রাচীর দিকে তাকিয়ে আছে। ডার্ক রেড কালারে বেশ মানিয়েছে প্রাচীকে‌।
বাইরে আঁধার ঘেরা আকাশে টিমটিমে আলো জ্বলছে। গাড়ির কাছে এসে দাড়াতেই সমুদ্র বলে উঠে,
– “এক মিনিট, এখনো একটা কাজ বাকি আছে।”
সমুদ্রের কথায় ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী। এখন আবার কি বাকি?
– “কিন্তু কি?”
সমুদ্র কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে একটা ব্লাইন্ড ফোল্ডার বের করে প্রাচীকে ব্লাইন্ড ফোল্ডেড করে দেয়।
– “আমার চোখ বন্ধ করছেন কেন সমুদ্র?”
– “হুসস আর একটা কথা না। চুপচাপ গাড়িতে বসো!”
কি আর করার? অগত্যা শাসন মেনে চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ে প্রাচী। এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের অব্যাহতির।

৬৫.
বেলুন, শুভ্র রঙের ফুল, বিভিন্ন ক্যান্ডেল আর মরিচবাতি দিয়ে পুরো ছাদ খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। ছাদের এক পাশে কাপল টেবিল রাখা হয়েছে। সেটাও খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। অতি সন্তর্পণে প্রাচীকে নিয়ে ছাদে উপস্থিত হয় সমুদ্র। এদিকে প্রাচী চোখে থাকা পট্টি খোলার জন্য হাঁসফাঁস করে যাচ্ছে কিন্তু সমুদ্রের কারণে তা আর হয়ে উঠছে না। কিন্তু কথায় আছে না; সবুরে মেওয়া ফলে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সমুদ্র ধীরে ধীরে প্রাচীর চোখ থেকে পট্টি সরাতেই পিটপিট করে তাকায় প্রাচী।
আশপাশের ডেকোরেশন আর কোহিনুর চৌধুরী, পিহুকে একসাথে দেখতে পেয়ে অবাক হয় সে।
পেছনে ঘুরে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই বিনিময়ে সমুদ্র স্মিত হেসে ফিসফিসে আওয়াজে বলে ওঠে,
– “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, মাই ডিয়ার ওয়াইফি‌!”
সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই প্রাচীর টনক নড়ে ওঠে প্রাচীর। জন্মদিন? হ্যাঁ ঠিকই তো। আজ তো তার জন্মদিন। তার ভাবনার সুতো কাটে পিহুর আধো আধো কন্ঠে,
– “হ্যাপি বার্থডে মা!”
সাথে তাল মিলিয়ে কোহিনুর চৌধুরী ও শুভেচ্ছা জানায় প্রাচীকে‌। সমুদ্র চোখের ইশারা দিতেই প্রাচী ভ্রু কুঁচকে পেছনের দিকে তাকায় এবং আরো একধাপ অবাক হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের মাঝে বেশ কয়েকটা ফানুস উড়ছে। ছোট বড় সাইজের ফানুস গুলোতে আকাশের নক্ষত্র গুলোও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আরো কয়েক গুণ বেশি।
সমুদ্র মুচকি হেসে একটা ফানুস প্রাচীর সামনে আনতেই প্রাচীও স্মিত হেসে ফানুস হাতে নিয়ে ছেড়ে দিতেই তা ধীরে ধীরে সুদূর আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে‌।
কেক কাটিং করে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাতেই পিহু কোহিনুর চৌধুরীর কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রাচী আগ বাড়িয়ে পিহুকে নিতে চাইলে কোহিনুর চৌধুরী বাঁধা দিয়ে নিজেই পিহুকে নিয়ে নিচে চলে আসেন।
সমুদ্র ও কিছুক্ষণের জন্য কোহিনুর চৌধুরীকে নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। মিনিট পাঁচেক পর ফের ছাদে উপস্থিত হতেই খেয়াল করে প্রাচী টেবিলে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
– “প্রাচী?”
পরপর কয়েকবার ডাক দেয়ার পর ও যখন কোনো প্রত্যুত্তর পেল না তখন সামনে এগিয়ে যায় সমুদ্র। প্রাচীর কাঁধে হাত রেখে পেছনে ফেরাতেই প্রাচী সমুদ্রের বুকের উপর ঢলে পড়ে।
– “ও মাই ডিয়ার সমুদ্র, জানেমান তুমি এসেছ? লাভ ইউ সুইটহার্ট!”
প্রাচীর প্রলেপ শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে সমুদ্রের। প্রাচী এগুলো তাকে নিজ থেকে বলছে? কিন্তু কি করে সম্ভব?
– “প্রাচী লুক এট মি! কি হয়েছে তোমার? কি সব হাবিজাবি বকছো তুমি?”
প্রাচী মাথা তুলে সরু দৃষ্টে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ফিক করে হেসে দেয়। প্রাচীর এমন উদ্ভট আচরণের উৎপত্তি খুঁজে বের করার জন্য আশপাশে তাকাতেই টেবিলের ওপর ওয়াইনের অর্ধেকের বেশি খালি বোতল চোখে পড়ে সমুদ্রের। ছোট্ট একটা দম ফেলে বলে ওঠে,
– “শিট! হলো তো এবার সারপ্রাইজের মাটি দেয়া!”……………..

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here