সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৯)

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৯)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩০.
এহসান নিদ্রাকে সারা রুম খুঁজেও পেল না। বারান্দায় আর ওয়াশরুমেও নেই। এদিকে ভেতর থেকেও দরজা লক করা। অর্থাৎ সে এখানে কোথাও আছে। তবে কোথায়? রিডিং রুমে নয়তো! এহসানের ভ্রু কুঁচকে যায়। নিদ্রা সেখানে যাবে কেন? ব্যপারটা অদ্ভুত না! অবশ্য অদ্ভুত হওয়ার কিছু নেই। তবে একেবারেও যে নেই তা কিন্তা না। কারণ সে তো এহসানের কোনো কিছুতেই আগ্রহ প্রকাশ করেনা। কাবার্ড টা এখনও ব্যবহার করেনি। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় নেয় আবার ধুঁয়ে শুকানোর পর ব্যাগেই গুছিয়ে রেখে দেয়। আর বড় কথা সারাদিন মন মরা হয়ে বসে থাকে সে। সব কিছুতেই উদাসীন। হঠাৎ করেই এহসান ঘাবড়ে গেল। দ্রুত পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। একদম কিনারায় গিয়ে যখন নিচের দিকে তাঁকাবে তখন পেছন থেকে নিদ্রার খলার আওয়াজ আসে,
-“ওখানে কী করছেন?”

এহসান নিদ্রাকে পেছন ফিরে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। কি সব বাজে চিন্তা করে ফেলেছিল সে! নিদ্রা আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে তো না। নিদ্রা এহসানের জবাবের অপেক্ষা করল না। সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুম আসবে কিনা সে জানেনা। তবে এখন তার আর কিছু ভালো লাগছেনা। এহসান এখন যদি জিজ্ঞেস করে কোথায় ছিল তখন কী জবাব দিবে? মনে মনে অনেক খুঁজেও কিছু কথা পেল না বলার মতো। তাই চুপ করেই থাকে। সে ভাবে এহসান এখনই হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু না! তার ভাবনা ভুল করে এহসানও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। দুজনেই চুপ চাপ থাকে ক্ষাণিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এহসান ঘুমিয়ে পড়ে। নিদ্রা তখন উঠে বইটা নিজের ড্রেসের ভেতর থেকে বইটা নিয়ে লুকিয়ে ফেলে ট্রলির ভেতর। এহসান টের পায়নি মোটেও। নিদ্রাও এখন ঘুমিয়ে পড়া শ্রেয় মনে করছে। আগামীকালই তাদের রিসিপশনের অনুষ্ঠান রয়েছে। অনেক ধকল যাবে আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছে। আর রাতে যদি না ঘুমায় তো কাল কিছুই ঠিক ভাবে করতে পারবেনা।

—————————-
অভ্র আর নির্ঝর তৈরি হয়ে হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাদের ভাড়া করা গাড়িটি এখান থেকে এসে তাদের সোজা এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবে। সেখান থেকে যার যার বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এহসানদের বাড়িতে যেতে হবে। নির্ঝরের ম্যুডটা আজকে একটু ভালো আছে। সব ভুলে নিজ কর্মে ব্যস্ত থাকাটাই এখন তার বড় উদ্দেশ্য। আর একটি দেওয়াল পার করলেই সব কিছু থেকে দূরে সরে যাবে সে। আর সেই দেওয়াল টা হলো এহসানের রিসিপশন। না গিয়ে উপায় নেই তাই যেতেই হচ্ছে। নিজের মনকে ধাতস্ত করে নিয়েছে। কোনোভাবেই সে নিদ্রাকে নিয়ে মনে কিছু আনবে। কারণ সেটা অনেক বড় পাপ। দরকার কী? শুধু শুধু পাপ জমিয়ে এমনিতেও কম তো করেনি।

বিমানে উঠার পর অভ্র আর নির্ঝরের মাথায় হাত! তাদের সিট প্ল্যানটা একেবারে কেটে গেছে। তাড়হুড়োয় খেয়াল করেনি যে তারা পাশাপাশি সিট নিয়েছে কিনা! এখন ভূগতেই হবে আর কী করার! একসাথে বসার কথা ছিল তা তো হলোই না বরং দুইজনকে আগে পিছে করে দুই সিট পেছনে বসতে হলো। অভ্র বসেছে দুই সিট আগে জানালার পাশে আর তার পাশে একটি সিট খালি। আর নির্ঝর বসেছে দুই সিট পরে তবে জানালার পাশে জায়গা নেই। একজন লোক সেখানে বসে আছে আর তার হাতে ম্যাপ। খুব মনযোগ দিয়ে সে ম্যাপটা খুটিয়ে দেখছে। নির্ঝরের লোকটাকে কোথাও দেখেছে বলে মনে হলো। তবে ঠিক কোথায় দেখেছে বা কবে দেখেছে খেয়াল করতেই পারছেনা। তাই সে আর ওতো ঘাটায়নি ব্যাপারটা। সিট বেল্ট লাগাতেই খেয়াল করে একটি মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মেয়েটির মুখ দেখে নির্ঝর অবাক হয় তবে কিছু বলল না। সে সোজা তার পাশেই বসা লোকটাকে বলল,
-“মি. মৃত্যু! আ’ম সরি ফর বেয়িং লেইট! টেইক ইট! ইউর ম্যাগাজিন।”

নির্ঝর ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেল। প্রথমত নিহারীকা দেখে, দ্বিতীয়ত পাশে বসা লোকটিকে মৃত্যু বলাতে, আর তৃতীয়ত লোকটিকে এখন সে চিনে ফেলেছে। এই লোকটিকেই তো সেদিন নিহারীকার সাথে রেস্টরন্টে দেখেছিল। অর্থাৎ এই লোক নিহারীকার বয়ফ্রেন্ড। বিরক্তি, বিতৃষ্ণাতে নাক,মুখ কুঁচকে নেয় সে। ইচ্ছে করছে টুপ করে উঠে গিয়ে ধপ করে অভ্রর পাশে বসে যেতে। মন মেজাজ বিগড়ে বিশ্রী একটা অবস্থা হচ্ছে। নিহারীকা নির্ঝরকে দেখে তবে পাত্তা দিল না। মৃত্যুঞ্জয়ের ম্যাগাজিনটা দিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সিট অর্থাৎ অভ্রর পাশের সিটেই বসে পড়ে। অভ্র ফোনেই ব্যস্ত ছিল এতক্ষণ। নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই পাশ ফিরে তাঁকায়। চমকে যায় নিহারীকাকে দেখে। নিজের এই চমকটাও তাৎক্ষণিক গিলে নেয়। মৃদু হেসে বলল,
-“মিস. নিহারীকা এমদাদ! কেমন আছেন?”

নিহারীকা অভ্রকে খেয়াল করেনি বসেই নিজের সিটবেল্ট বাধতে ব্যস্ত ছিল। সে হঠাৎ করেই অভ্রর ডাকে অবাক হয়। অভ্রকে দেখে সে খুশিই হয়েছে বোধ হয়। হেসে ফেলে বলল,
-“আমি আছি কোনোরকম। আপনি?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্! তা ঢাকা যাচ্ছেন?”
-“ঢাকার ফ্লাইট যেহেতু তাই ঢাকাতেই যাচ্ছি।”
-“আমি আসলে তা বলিনি।”
-“আপনি কী বলতে চান তা আমি বুঝেছি। ঢাকা যাচ্ছি কারণ আমার অফিস থেকে নেওয়া ছুটির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে।”
-“আমি জানতাম আপনি স্টুডেন্ট। পড়ালেখা করেন এখনও।”
অভ্রের গলায় বিস্ময় ছিল। নিহারীকা হাসে।

-“ভুল শোনেননি। আসলে পার্ট টাইম করি জাস্ট। একটু দক্ষতার প্রয়োজন তারই সাথে কিছুটা ব্যস্ততায় সময় কাটিয়ে নেওয়া যায়।”
-“দক্ষতার ব্যাপারটা মানতেই পারছি। তবে ব্যস্ত সময় কাটাতে চান কেন? সবাই চায় ব্যস্ততা থেকে ছুটি পেতে আর আপনি চান ব্যস্ততা?”
-“কী আর করব বলুন? একা একা সময় কাটানো সবসময় সুখকর হয়না। একাকীত্ব কাউকে বাঁচতে দেয়না। অতীত মনে পড়ে, বারবার কেউ মনে করিয়ে দেয় যে আমার কেউ নেই। আমার পাশে কেউই নেই।”
-“আপনার বাবা-মা?”
-“তারা আমেরিকা সেটেলড্।”
-“আপনি এইখানে কেন?”
-“তারা সাথে নেয়নি তাই।”
-“আমার বোধ হয় আপনার পার্সোনাল লাইফে এন্টারফেয়ার করার দরকার নেই। তবুও কৌতূহল থেকে জানতে চাইছি। আপনি কী একাই থাকেন সবসময়?”
-“না। দুইবছর হলো ঢাকা এসেছি। মাস্টার্স শেষ হচ্ছে হচ্ছে করেও হচ্ছেনা। সেশন জট বেঁধে গেছে। এখন ফাইনাল এক্সামটা হয়ে গেলেই বাঁচি।”
-“পার্টটাইম জব দিয়েই কী নিজের যাবতীয় খরচ বহন করেন?”
-“আরে না! আমার যথেষ্ট আছে। জব না করেও এইগুলো খেয়ে জীবন কাটাতে পারব। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার কেবল টাকাটাই আছে। নেই কোনো আপনজন, বন্ধু। দুঃখ তো শেয়ার করতেই পারিনা আনন্দটাও পারিনা। সবাই চায় আমার বন্ধু হতে তবে আমিই হইনা। কারণ একটাই! তারা আমার সাথে নামমাত্র বন্ধুত্ব করতে চায় মূলত আমার বাবার অঢেল সম্পত্তিই তাদের নজর আর মন দুইটাই কেড়ে নেয়। তাই সেইসবে কিছুটা ভাগ বসাতেই আমার কাছে আসে। আমার জীবনে একসময় বন্ধুর অভাব ছিল না। অনেক বন্ধু ছিল। একসাথে ঘুরতাম, পড়তাম, খেতাম তবে ধীরে ধীরে সব হারিয়ে গেছে। সব! আমার বাবা-মা যখন ছয় বছর বয়সের আমিকে ফেলে আমেরিকায় পাড়ি দিল তখন সবাই আমাকে আর ভালোবাসেনি। আমার খোঁজও নেয়নি। আসা যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। অনেকে বলত মানে এখনো বলে যে, তার মা-বাবা তারে ছেড়ে গেছে সে আর কত ভালোই হবে? বাবা, মা ভালোই মেয়েটাই খারাপ। আচ্ছা আপনিই বলুন? ছয় বছর বয়সী মেয়ের খারাপ কি ছিল? নিজের বাবাকে নিজ চোখের সামনে কাউকে ….
নিহারীকা দমে গেল। বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা। কাউকেই বলেনি সে। আর আজ কীভাবে বলবে? তবে বলে দিতে ইচ্ছে করছে। সে বলবে। তার তো দোষ নেই। তবে কেন সে দোষ বয়ে বেড়াবে? অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“কি করেছেন উনি?”
-“খু*ন। আমাদের বাড়ির মালি ছিল। বাবা তাকে গুলি করে দিয়েছিল। আমি তখন সবে মাত্র বাহির থেকে খেলা করে এসেছিলাম। ঐরকম দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান যখন ফিরে তখন দেখি সবাই আমাকে কীভাবে যেন দেখছে। ভয়, আতঙ্ক আর সাথে ঘৃণা। কিছুই ভুলিনি আমি। কিছুই না। আজও সেইসব দৃশ্য জ্যন্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসে। কি হয়েছিল জানেন? আমি নাকি খেলার ছলে ছোট কাকার পিস্তল দিয়ে মালি কাকাকে শ্যুট করেছি। আর রক্ত দেখেই ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছি। তবে এটা ছড়ানো গুজব ছিল। গুজবটা বাবাই কারো মাধ্যমে ছড়িয়েছিল। আর নিজে গা ঢাকা দিয়েছিল। আমি ছিলাম দোষী। তবে ভাগ্য প্রসণ্ণ ছিল। পুলিশ আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পেল না। এরইমধ্যে বাবা মালি কাকার নামে একটা কথা ছড়ায়। সে নাকি ড্রা*গ সাপ্লাইয়ের সাথে জড়িত। হয়তো সেই দলের কেউই খুন করেছে। তারপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটে গেল। বাবাকে আমার আর সহ্যই হতো না। পাগল বলে আমাকে পাগলাগারদে পাঠাতেও বাবা দুইবার ভাবেনি। ছয়মাস ঐখানে ছিলাম। ধীরে ধীরে সব ভুলে থাকতে শিখে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে জানতে পারি আমাকে পাগলা গারদে পাঠানোর পরেই বাবা আর মা আমেরিকা চলে গেছে। আমার মা প্রেগন্যান্ট ছিলেন। ছোট্ট বাবুকে দেখার জন্য যে আমি ছটফট করতাম সেই আমাকে ফেলেই তারা দূরের দেশে চলে গেল। আমার ছোট বোন তন্দ্রা আমেরিকার সিটিজেন। তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। সে আমাকে বোনই মানেনা। ইভেন আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ আসেনি। বাবাও আনেনি তাকে। বাবার প্রিয় সে। তবে সবকিছু না পেলেও প্রতিমাসে মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট পেতাম। ব্যাস! তাতেই চলে যেত। এখনও চলছে আর চলবে। আমি জানি আমার বাবা টাকা দিয়েই আমাকে নিজের বশে রাখতে চায়। তাই সব বন্ধ হলেও টাকা আসাটা বন্ধ হবেনা। ইচ্ছেমত টাকা উড়াই আমি। এইতো এখন ঢাকা গিয়ে কোনোমতে পরীক্ষা দিয়েই মালদ্বীপ ঘুরে আসব। জগৎ সংসারের প্রতি এখন আর টান লাগেনা।”
কথাগুলো বলে হাফ ছেড়ে বাঁচল নিহারীকা। কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। হঠাৎ, অসময়ে, অর্ধপরিচিত মানুষকে জীবনের সবচেয়ে তিক্ত সত্যটা জানাতে পেরে কেমন ভালো লাগা কাজ করছে তার। খুব ভালো অনুভব হচ্ছে। বিমানটাও যে কখন আকাশে উড়া শুরু করে দিয়েছে খেয়ালও করেনি। কী অদ্ভুত!
অভ্র চুপ করে আছে। তার মায়া হচ্ছে এই নারীর প্রতি। সে কিছুটা শুনেছিল এহসানের কাছে যে নিহারীকা খুব একা। বাবা মা সাথে থাকেনা। তবে তার পেছনে যে এতবড় সত্য লুকিয়ে আছে তা সে কী কেউই ভাবতে পারেনি আর পারবেও কিনা সন্দেহ আছে। নিহারীকাকে কিছু বলার জন্য পেল না। শুধু তার ডানহাতটা নিহারীকার বামহাতের উপরিপিঠে রেখে পাশে থাকার আশ্বাস দিল। সেটাই ছিল আনন্দদায়ক। সুন্দর আর স্নিগ্ধ!

নিহারীকা পেছন ফিরে নির্ঝরের দিকে তাঁকায়। তখনিই চোখে চোখ পড়ে যায়। নির্ঝর কী তবে নিহারীকাকেই দেখছিল? হয়তো আবার হয়তো না।

#চলবে।
(রি-চেইক দিতে সময় পাইনি। পরে দেখে নিব এর মধ্যে আপনারা ভুল পেয়ে থাকলে ধরিয়ে দিবেন প্লিজ। দেরিতে হলেও এটাই স্বস্তি যে রাইটিং ব্লক কাটিয়ে ফেলেছি। আলহামদুলিল্লাহ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here