সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৮) (প্রথম খন্ডের সমাপ্তি) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৮) (প্রথম খন্ডের সমাপ্তি)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৬৭.
একদিন জমিদার শাহনেওয়াজ মহলে ফিরল না। সিন্ধুর কাছেই ছিল। বেগম সুগন্ধ্যাও নিজের মতো ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত। সন্ধ্যা হলেই দরজায় খিল দেয়। অন্দরমহল একপ্রকার ফাঁকা হয়েই থাকে। মাশহুদা বেগমের বিশ্বস্ত কর্মী জবেদা সব দিক নিশ্চিত করে মাশহুদা বেগমের যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন ইংরেজ কুঠিতে। রাত্রির মধ্যভাগে সেখানে উপস্থিত হলেন মাশহুদা বেগম। তৎকালীন নিয়োগ প্রাপ্ত ইংরেজ কমান্ডার লুইস সাদরে গ্রহণ করলেন সবাইকে। তারা যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। মাশহুদা বেগমের ভোজনের আয়োজন করলে তিনি এক বাক্যে না করলেন। বললেন,
-‘জরুরী তলব কী দরকারে! সেটা বলুন!’
লুইস হেসে বলল,
-‘ইউর এক্সিলেন্সী! দ র কা র পড়েইছে দেখ এই তো ডেক এইছি।’
-‘কী ব্যপারে!’
-‘আপনার সান আই মিন শা হা নেজ..
-‘শাহনেওয়াজ।’
-‘ইয়াহ। তিনি আমাদের কাজেইই বাঁধা দিচ্ছেন। আমরা গোটা অঙ্কের অ্যামাউন্ট অফার করেইছি বাট হি ডিড নট এক্সেপ্ট ইট। তিনি আমাদের ব্যবসার লস করছে। এই মুহূর্ত গোটা দেশের প্রধানেরা তার উপর রে গে আছে। খুব দ্রুত তারা একটা পরামর্শ নিবে। আপনার সান এর কারণে আপনার পুরো জমিদার বাড়ি ক্ষ’ত’ম হয়ে যাবে। আপনার হাসব্যান্ড এর এত কষ্টের ল্যান্ড আপনি কীভাবে হারিয়ে যেতে দিচ্ছেন! ইট ইজ সো আনফেয়ার।’
-‘আপনি কী বলতে চাইছেন! আমার ছেলের কারণে কী হবে!’
এবার এক বাঙালী লোক কথা বললেন। তিনি এতক্ষণ বসেই ছিল। তাদের কথা শুনছিল। দেখে মনে হচ্ছে সব এক দলের। মাশহুদা বেগমের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
-‘বেগম সাহেবা! জমিদার ভুল পথে হাঁটছে। আত্ম অহংকার এর বশে আপনার ভিটে মাটি নষ্ট করছে। এই যে দেখুন! তার উপর এখন রাজা, নবাব, ইংরেজ, ফরাসি সবাই চটে গেছে। যে কোনো দিন যে কোনো কিছু হতে পারে। দেখা গেল তারা যুদ্ধে নামবে তখন এই এত বড় সৈন্যের কাছে হেরে আপনার পুত্রকেই খেসারত দিতে হবে। সবাই তার থেকে তার জমিদারি ছিনিয়ে নিবে। নিস্ব করে দিবে তার পুরো বংশ। তাই এখনও সময় আছে, তাকে বোঝান আপনি। আর যদি সে না বুঝতে চায় একটাই পথ আছে। সব হারাতেই হবে।’
-‘কী বলছেন! এর জন্য আমার বংশ পরম্পরার জমিদারি কেন ছিনিয়ে নিবেন!’
-‘এটাই করতে হবে। আর কোনো কিছু করার নেই। অবশ্য আরেকটা পথও খোলা আছে।’
-‘কী!’
এবার লুইস টেবিলে দুই হাত রেখে শ’য়’তা’নি হাসি দিয়ে বলল,
-‘কি’ল ইউর সান।’

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো মাশহুদা বেগম। কথাটা শুনেই অন্তরআত্মা কেঁপে উঠল তার। সে বলল,
-‘মশকরা করছেন নাকি! এটা কেমন কথা!’
বাঙালি লোকটাও উঠে এলো বসা থেকে। বলল,
-‘দেখুন! আজ নয়তো কাল ব্রিটিশদের গু’লি খেয়েই তাকে ম’র’তে হবে। যার ফলে আপনা আপনি সকল কিছু ব্রিটিশ সরকারের কাছে চলে যাবে। তাই আগে আগেই আসল কাজটা সেরে নিলে সবই ঠিক থাকে। আপনার নাতি তো আছে! ভবিষ্যৎ জমিদার! তার বড় হওয়া পর্যন্ত না হয় আপনি সামলালেন সব। সমস্যা কোথায়?’
-‘আপনাদের মাথা খারাপ! আমি নিজে হাতে পুত্র হ’ত্যা করব? আমি! এটা কখনোই সম্ভব না। কখনোই না।’

মাশহুদা বেগম বের হয়ে আসতে নিলেই লোকটি এবার জোর গলায় বলল,
-‘শুনেছি আপনার পুত্র সাঁপুড়ে কন্যা বিবাহ করেছে। এখন যদি পাঁচ কান হয় তাহলে সম্মান থাকবে কিছু আপনাদের! এমনিতেও লোকজন দূর ছাই করবে। ভেবে দেখুন আরেকবার বে গ ম সাহেবা! আর আপনার পুত্রও কেমন! মায়ের আজ্ঞা পালন করে না। একবারও নিজের পিতৃকূলের কথা ভাবল না। নিজের স্ত্রী সন্তানের কথা ভাবল না। কলিযুগের এই এক দশা। এক্কেবারে অধঃপতন।’

পরমুহূর্তেই কীসের বশবর্তী হয়ে কে জানে! মাশহুদা বেগম এই কু’চ’ক্রী’দের দলে ভিড়লেন। আত্ম অহংকার এবং ক্ষোভের জন্য এটা ভুলে গেলেন শাহনেওয়াজ তার কী! নিজের অহমিকা টিকিয়ে রাখতেই সে এই নিকৃষ্ট খেলায় নামে।

৬৮.
সিন্ধুর এখন নয় মাস চলছে। পেটের ভারে নুয়ে থাকে। তবে তার ভেতরের আনন্দ যেন সবসময় উপচে পড়ে। আর অল্প কিছুদিন! তার পরেই তো নতুন মানুষের আগমন ঘটবে। কী দারুন ব্যাপার।

তবে একটা ভ’য় আতঙ্ক ও সর্বদা তাকে ঘিরে রাখে। জমিদার তার নিজস্ব দল বল আর মিত্রদের সহায়তায় ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে ছোট খাটো এক যু’দ্ধে’র ঘোষণা করেছে। এই নিয়ে আজ তিন চারদিন তাদের মধ্যে সংঘ’র্ষও চলছে। তবে এখনও কারো নি’হ’তের খবর আসেনি। তবে বোঝা যাচ্ছে জমিদার জিতবে। কেননা প্রত্যয় শাহ্ তো যু’দ্ধ ময়দানে ছিল এখন শেখ মৃত্যুঞ্জয় ও যোগ দিয়েছেন। শাহনেওয়াজ তো আছেই! তবুও কেন যেন এসব সিন্ধুর ভালো লাগছেনা। তার মনে উল্টা পাল্টা চিন্তা আসে।

তার এই অবস্থা দেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল,
-‘আপনাকে এমন চিন্তিত মানায় না। শুনেছি আপনার আগে খুব তেজ ছিল। এখন সেসব কোথায় ভরলেন? সাহসী হচ্ছেন না কেন? মন শক্ত রাখুন। অবশ্য এটাই সমস্যা। প্রেম ভালোবাসায় মানুষের বোধ-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা লোপ পায়। তবে মনে রাখবেন- The meaning of life is to find your gift. The purpose of life is to give it away. এটা উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর উক্তি। উপলদ্ধি করতে পারলে বুঝবেন এটা আসলে কতটা সত্য। এইটার মর্মার্থ চরম সত্য।’
-‘আপনি এমন করে কেন বলছেন? আপনার থেকে কী নিয়ে নিয়েছে? একটু বলবেন?’
-‘অবশ্যই বলব। আমার থেকে আমার ভালোবাসার সুগন্ধী নিয়ে গেছে এই জীবন। তার সুঘ্রাণটাও আমি এখন আর পাই না।’
-‘আপনার মতো একজনকে কে পায়ে ঠেলতে পারে! আপনার সে কী ছেড়ে গেছে নাকি কোনো ভাবে হারিয়ে ফেলেছন!’
-‘আফসোস এইখানেই। সে কখনোই আমার ছিল না।’

এর বিপরীতে সিন্ধুর আর কিছু বলার ছিল না। জীবন! বড়ই বিচিত্র। কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়।

———–
জমিদার শাহনেওয়াজ তার মা-য়ের কক্ষের আরাম কেদারায় বসে আছেন। মাশহুদা বেগম জরুরী তলব করেছেন তাকে। কী ব্যাপারে সেটা বসে বসে ভাবছেন তিনি। অবশেষে মাশহুদা বেগম এলেন। বসা থেকে দাঁড়িয়ে মাকে সালাম করলেন শাহনেওয়াজ। সালাম নিয়ে তিনি শক্ত গলায় বললেন,
-‘এসব কী শুরু করেছ? ইংরেজ এর বিরুদ্ধে কেন লাগছ?’
-‘আপনাকে আগেও বলেছি আম্মাজান। এটার দরকার আছে।’
-‘আমি দেখছি না আহামরি দরকার। ক’বিঘা জমি ছেড়ে দিলে কি ক্ষতি হতো!’
-‘গরীব চাষারা এসব আ’ফি’ম চাষ করে পাবে কী আর খাবে কী? তাছাড়া জমির উর্বরতা নষ্ট করছে। আমি কীভাবে আমার আপনজনদের এমন বিপদে ফেলি আম্মাজান! আপনি তো এমন শিক্ষা দেননি আমায়।’
-‘কখনো কখনো শিক্ষা সংস্কৃতি ভুলতে হয় নিজ স্বার্থের জন্য। তোমার জীবনের নিশ্চয়তা দেখছি না এ ক্ষেত্রে।’
-‘যে জীবনে অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে হয় সেই জীবন না হয় আমি স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করলাম। সমস্যা কোথায়?’
-‘তুমি বলছ ম’র’তেও আপত্তি নেই।’
-‘না, নেই।’
-‘বেশ। তুমি ঐ মেয়ে কে কবে ছাড়বে?’
-‘কার কথা বলছেন!’
-‘ঐ বেদের মেয়ে। সাঁপ কেচ্ছা ধরে যে।’
-‘আম্মাজান, সে আমার স্ত্রী।’
-‘রাখো তোমার এসব কথা। আমি মানি না এই বিয়ে।’
-‘আমার আর তাঁর সন্তান এই পৃথিবীতে আসতে চলেছে।’
-‘না। আমি সেই সন্তানকে মানি না। আমার বংশের কেউ নয় সে।’
-‘সে আপনার আর আমার রক্ত আম্মাজান। আপনি তা অস্বীকার করতে পারেন না।’
-‘পারি। আলবৎ পারি। তুমি ঐ মেয়েকে তালাক দাও।’
-‘সম্ভব না।’
-‘ভেবে বলছ তো?’
-‘হ্যাঁ। বিনিময়ে সব ছাড়ব তবে তাকে নয়।’
-‘আমাকেও ছাড়তে পারবে!’
-‘জানিনা। তবে আমি চাই না এমন পরিস্থিতি তৈরি হোক যখন আমার কাউকে বেছে নিতে হবে।’
-‘যদি হয়!’
-‘আমি সিন্ধুকে ভালোবাসি আম্মাজান। তাঁকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
-‘তবে বলছ আমাকে ছাড়বে! আর বেগম আর তোমার পুত্র? তাদের?’
-‘আমি কাউকেই ছাড়তে চাইছিনা। আপনি বোঝার চেষ্টা করুন।’
-‘কিছুই বোঝার নেই। যা বোঝার বুঝে গেছি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহনেওয়াজ। তখনিই জবেদা আসে হাতে দুধের পেয়ালা। মাশহুদা বললেন,
-‘গরম গরম দুধ খাও। শরীরে তো দেখছি পুষ্টি নেই। খাওয়া দাওয়া নাকি করছ না! এখন এটা খাও আমার সামনে। আমি একটু দেখি।’

শাহনেওয়াজ খুশি হলো। মা তার উপর বুঝি রেগে থাকবে? কখনোই না। মা তো মা। সে তার সন্তানের সাথে মান অভিমান করে কতক্ষণ থাকবে? যদিও দুধ খেতে ইচ্ছে করছিল না তার তবুও মায়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে দুধ পান করল। মিনিট গড়ানোর ও সময় লাগল না। শাহনেওয়াজ এর ভেতর থেকে আত্মচিৎকার ভেসে এলো। গলা ধরে রাখল। তার যে বুক গলা সব জ্বলে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তেই বেগম সুগন্ধ্যা কক্ষে প্রবেশ করে। দরকারি কাজে এসেছিল মাশহুদা বেগমের কাছে। কিন্তু এসে স্বামীকে এভাবে ছটফট করতে দেখে সে আৎকে ওঠে। দিক দিশা ভুলে গিয়ে শাহনেওয়াজ এর কাছে কোনোরকমে ছুটে গেল। আকড়ে ধরতেই শাহনেওয়াজ এর গোঙানির শব্দ শুনতে পেল। মাশহুদা বেগমের দিকে তাকালে দেখতে পায় তিনি বসে আছেন। নড়ছে না একটুও। তার ছেলে এভাবে কাতরাচ্ছে সে কী দেখছে না!
-‘আম্মাজান! উনি এমন করছেন কেন! আম্মাজান!’
সুগন্ধ্যা হাউমাউ করে কেঁদে দিল। জবেদা কে বলল,
-‘বৈদ্য ডাকুন কবিরাজ ডাকুন। উনি এমন করছেন কেন? ইয়া আল্লাহ্!’

শাহনেওয়াজ এর কথা আসছেনা মুখে তবুও সুগন্ধ্যার হাত ধরে বলল,
-‘আমার সন্তানদের দেখে রেখো বেগম। আমার সিন্ধুকে দেখে রেখো। আমার আম্মাজানকে দেখে রেখো। নিজের খেয়াল রেখো।’
তারপর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বহু কষ্টে বলল,
-‘আম্মা আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম আম্মা। আপনার উপর রাগ নেই।’
-‘এসব কী বলছেন আপনি! আপনার মাথা খারাপ হলো নাকি! এমন কেন করছেন!’
আর জবাব দিতে পারল না শাহনেওয়াজ। তার মুখ ভর্তি ফেনা গড়িয়ে পড়ল। মৃ’ত্যু’র দিকে সে তলিয়ে গেল। সুগন্ধ্যা শূন্য হয়ে গেল। তার বুঝতে বাকি রইল না তার স্বামী কেন এমন করছিল! সে মাশহুদা বেগমের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকায়। তার চোখে পানি টলমল করছে। তবুও সে শক্ত। সুগন্ধ্যা সবই বুঝে গেল। এই নিষ্ঠুরতা সইতে পারল না। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হাহাকার করে ওঠে।
-‘আল্লাহ্!’
সে কী আর্তনাদ তার! সারা জমিদার বাড়ি কেঁপে উঠে তার এই গগনবিদারী কান্নায়। সে যখন কান্নায় ব্যস্ত তখন মাশহুদা বেগম উঠে এলেন ধীর পায়ে। শাহনেওয়াজ এর পায়ের কাছে বসে তার সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিল। ডান হাতটা নিয়ে উল্টোপিঠে চুমু খেয়ে বলল-
-‘আমার আব্বা! তুমি কেন আমারে মাফ করলা!’
তিনি এখন বুঝতে পারছেন রাগের বশে তিনি কী করে ফেলেছেন! দিন দুনিয়া ভুলে গেলেন। একবারও ভাবলেন না কাকে তিনি খু’ন করতে যাচ্ছে। এই গুনাহ এর শাস্তি কী!

জবেদা আশেপাশে ছড়িয়ে দিল ইংরেজদের সাথে পরাজয় হওয়ার ভ’য়ে জমিদার আত্মহ’ত্যা করেছেন। প্রত্যয় শাহ্ সেই মুহূর্তে জমিদার বাড়িতেই প্রবেশ করছিল। সব শুনে দৌঁড়ে আসে। শাহনেওয়াজ এর লা’শ দেখে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। কে বলেছে পুরুষ মানুষ কাঁদতে পারেনা? তারা কী দেখেছে, কঠোর হৃদয়ের প্রত্যয় শাহ্ এর সেই কান্না! বন্ধু বিয়োগে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে তা প্রত্যয় শাহ্কে দেখেই সবাই জানল। শেখ মৃত্যুঞ্জয় এলেন পরদিন। কবর দেওয়ার আগে তাকে যখন মাটি ছুঁতে দেওয়া হলো সে এক মুঠ মাটি নিজের পকেটে পুরে নেয়। আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। কারণ সুগন্ধ্যার আর্তনাদে চারপাশ কেমন বি’ষি’য়ে উঠছে। সে সইতে পারছে না এসব। তার মন বলছে এটা আত্ম’হ’ত্যা নয়। আসল সত্যি জানার অপেক্ষা শুধু।

সিন্ধু খবর পেয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেল। এই কাঁদে, এই শাহনেওয়াজ এর স্মৃতি মনে করে হাসে, এই নিজের ভাগ্যকে দোষারপ করে। সে হাউমাউ করে কাঁদে। একটি বার! কেন একটি বার সে শাহনেওয়াজকে আটকালো না! কেন! আজ যদি সে তাকে নিজের কাছে আটকে রাখত তবে কী এমন কিছু হতো?

ভোর রাতে তার প্রসব বেদনা উঠল। তার কোল আলো করে এলো এক কন্যা সন্তান। কিন্তু সেই সন্তানটির জীবনে আলো নেই। কারণ তার যে বাবা নেই!

জমিদারকে কবরে চির নিদ্রায় শায়িত করার পর বেগম সুগন্ধ্যার কাছে মৃত্যুঞ্জয় আসে। তাকে দেখেই সুগন্ধ্যা বলতে থাকে,
-‘উনি আত্ম’হ’ত্যা করেনি। সব মিথ্যে। আম্মাজান! আম্মাজান খু’ন করেছে। দুধে বি’ষ মিশিয়ে।’
মৃত্যুঞ্জয় নিজেই চমকে গেল। সে ভাবতেও পারেনি যে এই কাজ মাশহুদা বেগম করেছেন!
-‘আমার স্বামী আমাকে তার সন্তানদের দেখে রাখতে বলেছেন। সিন্ধুকে দেখে রাখতে বলেছেন। আমি তার কথা পালন করব। আমাকে বলুন! সিন্ধু কোথায় আছে! আমি তার কাছে যাবো।’
-‘আপনি বের হতে পারবেন না এখন।’
-‘বেশ। আমি আজ না হলেও দুইদিন পর ঠিকই বের হবো। আমার স্বামীর শেষ কথা আমি মেনে চলবই।’
আবারও বিলাপ শুরু হলো। তখনিই সিন্ধুর সন্তানের খবর এলো মৃত্যুঞ্জয় এর কানে। সে ছুটে গেল সেই মহলের দিকে।

তার এখন যে অনেক কাজ বাকি আছে! আগে সিন্ধু এবং তার সন্তানকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে হবে।

৬৯.
সেই রাতে আরেকটি মৃ’ত্যু ঘটে। সন্তান প্রসবের সময় অতিরিক্ত র’ক্ত ক্ষ”রণের জন্য সিন্ধুকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। দুনিয়ার উপর ভীষণ অভিমান করে সে চলে গেল। দুধের শিশুটা একা পড়ে রইল। মৃত্যুঞ্জয় গিয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিল। তবে সে মুন্নার থেকে একটি চিঠি পেল। চিঠির সাথে একটা বাক্স। মুন্নার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব কান্না কাটি করেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের মুন্নার জন্য মায়া হলো। ছেলেটি শাহনেওয়াজকে যেমন ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা করত তেমনি শাহনেওয়াজ তাকে স্নেহ করত, আগলে রাখত। আজ এই ছেলেটা কে দেখবে? সিন্ধুও চলে গেল না ফেরার দেশে। এই ছেলেটি ভীষণ একা!

চিঠির ভাজ খুলতেই সুন্দর হাতের লেখা ভেসে উঠল-

মৃত্যুঞ্জয় মশাই,
আপনাকে আমি বরাবরই ভীষণ রকম শ্রদ্ধা করি। কেন না আপনার মতো খাঁটি হীরে খুব কম হয়। আপনার ব্যবহার আপনার কথা বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনার চেয়ে বিশ্বস্ত আমার আর কেউ রইল না। আমি জানি, আমার স্বামী আত্ম’হ’ত্যা করেনি। এই বিশ্বাস আমার আছে। আমি জানিনা কেন যেন আমার মন কু ডাকছে। এমন মনে হচ্ছে বাঁচব না। অবশ্য এই চিঠি আপনি তখনিই পাবেন যখন আমার মৃ’ত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমি মৃ’ত। মুন্নাকে দেখে রাখবেন। আমার ছোট ভাইয়ের মতো সে। আর আপনার বন্ধুর কী হয় তা তো জানেনই। আমার সন্তান যদি বেঁচে থাকে তবে তাকে দেখে রাখবেন। দয়া করে তার বড় মা অর্থাৎ বেগম সুগন্ধ্যার কাছে বড় আপার কাছে তাকে দিবেন। আমি জানি সে আমার সন্তানকে ফেলে দিবেনা। জমিদার কন্যার পরিচয় না-ই বা পেল। একটা ঘর যেন পায়। আমার বাবা গ্রামে থাকে। তার একটু খোঁজ খবর নিবেন। কিছু পয়সা কড়ি রেখেছি আমার পটলিতে। আমার বাবাকে দিবেন। আর এই যে বাক্স! এটা আপনার বন্ধুর দেওয়া শেষ এবং মহামূল্যবান উপহার। এটা হলো সিন্ধুর নীল। আমার আর তার ভালোবাসার প্রতীক। আপনি এই বস্তুকে একটি সুরক্ষিত জায়গায় রেখে দিবেন। আমার স্বামীর এই ভালোবাসার প্রতীকে যাতে অবমাননা না হয়। লুটে’রাদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। তবে আপনার পরবর্তীতে এই সিন্ধুর নীলের জন্য এমন কাউকে বেছে নিবেন সে যেন আমার এই ভালোবাসার প্রতীককে রক্ষা করে। সম্পূর্ণ আপনার উপর এই সিদ্ধান্ত। আমি জানি! আপনি কখনো ভুল করবেন না। অন্তত পক্ষে জ্ঞানত।
সব শেষে বলব এই ছোট বোনটার জন্য দোয়া করবেন। আর আমার স্বামীর হ’ত্যার বিচার করবেন। পা’পীদের চরম শা’স্তি দিবেন। আর একটু চেষ্টা করবেন ভালো থাকার। আমি কিন্তু বুঝে গেছি একটা জিনিস। কী জানেন? আপনার সেই না পাওয়া ভালোবাসা হলো বেগম সুগন্ধ্যা আইনীন। আপা ও ভালো নেই। তার ভালোবাসা হারিয়ে সেও ভালো নেই। তাকে একটু ভালো রাখবার চেষ্টা করবেন। আম্মাজানকেও দেখে রাখবেন।

আপনার বাধ্যগত শরবত বানানো বোন
সিন্ধু।

শেষের এই টুকু পড়ে ফিক করে হেসে দিল মৃত্যুঞ্জয়। ছোট্ট বাচ্চাটাকে মুন্নার থেকে নিয়ে সে বলল প্রত্যয় শাহ্ কে খবর দিতে। সিন্ধুর দাফন এর কাজ শুরু করতে হবে তো।

তারপর শাহনেওয়াজ আর সিন্ধুর ভালো বাসার প্রতীক সিন্ধুর নীল আর তাদের কন্যাকে নিয়ে সে অজানায় পাড়ি দিল। সুগন্ধ্যাকে খবর পাঠায় সে মুন্নার মাধ্যমেই। তাকে বলা হয় সে যেন অতি দ্রুত বাচ্চাটিকে নিয়ে যায় এসে। সুগন্ধ্যা বাহিরে এসে দেখে ঝড় শুরু হয়েছে। এই তান্ডবে মৃত্যুঞ্জয়ের বলিষ্ঠ অভয়ব দেখা যাচ্ছে। সে কাছে যেতেই বাচ্চাটিকে তার হাতে ধরিয়ে দিল সাথেই দিল দুইটি ডায়েরী এবং একটি চিঠি। সেই চিঠিতে লেখা ছিল সিন্ধুর নীলের খবর। মৃত্যুঞ্জয় দূর দূরান্তে ছুটল কেবল এই সিন্ধুর নীল রক্ষা করার জন্য। অবশেষে এমন এক জায়গা পেল। সেই জায়গার কথা সে বৃত্তান্ত লিখে দিল সুগন্ধ্যার কাছে। কেননা সিন্ধু যেমন তাকে বিশ্বাস করে সে ও বিশ্বাস করে সুগন্ধ্যাকে। প্রত্যয় শাহ্ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। এই মুহূর্তে এই গুরু দায়িত্ব তাকে দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া তারা যোদ্ধা। যে কোনো দিন যে কোনো জায়গায় শহীদ হতে পারে। তখন এই অমূল্য রতন কে দেখে রাখবে! এর মধ্যে দামি পাথরের থেকেও দামি হলো ভালোবাসা। এই ভালোবাসার প্রতীক সে নিজের জীবন ভর আগলে রাখবে। তার বন্ধুর শেষ স্মৃতি! তার ছোট বোনের শেষ স্মৃতি!

☆☆☆☆☆☆
পরের পৃষ্ঠা গুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এখনও অনেক কিছু জানা বাকি আছে। নিদ্রা হাসফাস করতে থাকে। এ সে কী পড়েছে! এর শেষ না জানলে যে তার কোনো কিছুতে মন বসবে না। সে আরেকটু খুঁটিয়ে বইটি দেখতে থাকে। তখনিই তার চোখ যায় হার্ডকভার এর গায়ে লেখা “মৃত্যুঞ্জয় সরকার” নামটিতে। সে চমকে উঠল। এ কোন মৃত্যুঞ্জয়! আর সরকার! শাহনেওয়াজ সরকার, শেখ মৃত্যুঞ্জয়। সব কেমন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে নিদ্রার। এই লোক কে? আর এই সব আসলেই কী ঘটেছে! সব তো সত্যিই লাগছে। তবে সেই সিন্ধুর নীল কোথায়? কোথায় রাখা হয়েছিল!
বইটা ব্যাগে পুনরায় রেখে দিয়ে নিদ্রা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভোর হয়ে আসছে বলা চলে। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। কপাট গুলো খুলে দিতেই তরতর করে বাতাস ঢুকে তার খোলা চুল এলোমেলো করে দেয়। তখনিই একটা গাড়ি আসে গেইটের সামনে। সে সেদিকে আর তাকায়না। তার যে এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না কেমন বুক ধরফর করছে।
ওদিকে গাড়ি থেকে একে একে নির্ঝর, অভ্র, এহসান, নিহারীকা এবং মৃত্যুঞ্জয় নেমে পড়ে। সবাই এই লং জার্নিতে ভীষণ ক্লান্ত। বাস স্ট্যান্ডে আসতেই নির্ঝর তার ছোট মামাকে কল করে। তিনি গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সবাই ভেতরে ঢুকলেও এহসান কেন যেন দাঁড়িয়ে পড়ল। তিন তলা বাড়িটির দোতালার ডান দিকের কোণায় যে রুমটি আছে তার বড় জানালা টা উন্মুক্ত। জানালার সাথে এক রমণী দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে ফিরে। এহসানের মনে হলো এ যেন তার বহুদিনের চেনা কেউ! বারবার তার মনে কড়া নাড়ছে একটি নাম ‘প্রথমা নিদ্রা’।

নির্ঝর এহসানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী সে বুঝতে পারলো না!

(প্রথম খন্ডের এই খানেই সমাপ্তি টানলাম। দ্বিতীয় খন্ড কবে শুরু হবে জানিনা। তবে আপনাদের এত অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখীত। আমি আজ রি-চেইক দিতে পারলাম না। বেশ বড় আর হাতেও সময় নেই। আগামীকাল আবার সব ঠিকঠাক করব। আপনারা ভুল গুলো ধরিয়ে দিবেন। আর এই সিন্ধুর নীলের জার্নি কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন।)

5 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here