#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২০)
লেখক- ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩১.
নির্ঝর অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে তার পাশে বসা লোকটি অর্থাৎ মৃত্যুঞ্জয় খুব মনযোগ দিয়ে ম্যাপের একটা জায়গা ঘেটেই চলেছে। জায়গাটা নির্ঝর ভালোই চেনে। সে প্রথমে ভেবেছিল কিছু জিজ্ঞেস করবেনা কারণ নিহারীকার বয়ফ্রেন্ড সে। কিন্তু নিজের মধ্যকার গল্প করা আর কৌতূহল প্রবণতাটা দমিয়ে রাখতে পারেনি। ফট করেই জিজ্ঞেস করে ফেলে,
-“আপনি কি রূপনগরের খাঁন বাড়ি যাচ্ছেন নাকি?”
-“হ্যাঁ তবে আপনি বুঝলেন কীভাবে?” মৃত্যুঞ্জয় ভীষণ চমকে গেছে পাশে বসা যুবকের কথা শুনে। সে বুঝল কী করে! দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে তালগোল হারিয়ে ফেলছে সে। নির্ঝর তার কথা শুনে একটি আমতা আমতা করে বলল,
-“আসলে আমি দেখছিলাম আপনি বারবার এই এক জায়গায় আঙুল ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তাই।”
-“রূপনগর তো ম্যাপেই বড় করে লেখা আছে কিন্তু এই যে বাড়িটির কথা বলছেন তা চিনলেন কীভাবে? তার নাম টাম তো উল্লেখ্য নেই। এটা এত সূক্ষ্ম ভাবে কীভাবে বুঝতে পারলেন?”
এবার নির্ঝরের মুখে হাসি ফুঁটে ওঠে। নিজের বিচক্ষণতা ঝারার ভঙ্গিমায় বলল,
-“আরে মশাই! আমি চিনব না তো কে চিনবে? আমার বাসার ড্রয়িং রুমেই তো রূপনগরের কেবল রূপনগরেরই একটা বড় ম্যাপ সুন্দর করে কাঁচবন্দি করে ঝুলিয়ে রাখা আছে। আমার মায়ের গ্রাম তার গ্রামকে সে খুব ভালোবাসে। সেখানকার সম্ভ্রান্ত খাঁন বংশের মেয়ে তিনি। এই যে জায়গাটা ধরে রেখেছেন সেখানে আমাদের ম্যাপে খাঁন বাড়ির নাম লিখে সেই সীমানা টা ভালো করে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। পুরো ম্যাপটা আপনার ম্যাপের মতোই পার্থক্য একটা এখানে খান বাড়ির নাম নেই। তবে আমি ছোট থেকে দেখে আসছি তাই এই জিনিস তো আমি ভুলব না। একদমই না!”
মৃত্যুঞ্জয় হঠাৎ করেই এই অপরিচিত লোকটির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে নিতে চাইলো। কারণ বোঝাই যাচ্ছে এই লোকটা তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারবে। ভালো মানুষই মনে হচ্ছে তাকে। কিছুক্ষণ আগেও একে গম্ভীর মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে ঐটা তার আসল রূপ নয় বরং এটাই সে। এতক্ষণ নিজেকে খোলসে আবৃত করে রাখছিল কিন্তু তার চঞ্চলতার জন্য তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। এতক্ষণে এই বত্রিশ ঘন্টা পর মৃত্যুঞ্জয় খুব স্বস্তি পেল। যাক! পরবর্তী ধাপটা একটু শীথিল হতে যাচ্ছে বোধ হয়! নির্ঝরকে হেসে বলল,
-“চমৎকার ব্যাপার তো! ভালোই হলো আপনাকে পাশে পেয়ে। আমি আসলে জায়গাটা চিনিনা। তবে ঘোরার খুব ইচ্ছে ছিল। কীভাবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। এখন আপনার থেকে একটু জেনে নিলে সুবিধাই হয়।”
নির্ঝর এবারও খুশি হলো। নিহারীকার বয়ফ্রেন্ডের যে তাকে খুব দরকার পড়েছে এই ভেবে সে আনন্দে ভাসছে। দারুন অনুভূতি! সে কিছুটা আফসোসের সুরে বলল,
-“আহ! আরো আগে বলতেন তাহলে আরো আগেই সুবিধাটা করে দিতে পারতাম।”
মৃত্যুঞ্জয় কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,
-“কেন? আরেকটু আগে বলতেই হতো কেন? এখন কী তবে আপনে সাহায্য করতে পারবেন না?”
-“আমি এমনিতেও বিশেষ সহায়তা করতে পারতাম না। তবে আপনার লস হচ্ছে এটাতেই যে আপনার প্লেনে উঠা উচিত হয়নি। রূপনগর কক্সবাজার থেকে চারঘন্টার জার্নি করে বাসেই যেতে পারতেন। এখন আবার ঢাকা গিয়ে সেখান থেকে বারো ঘন্টার মতো জার্নি করাটা খুব কষ্টের হবে। আকাশপথের ব্যবস্হা নেই সেদিকে। বাস হচ্ছে একমাত্র মাধ্যম। তবে পার্সোনাল গাড়ি বা রিজার্ভ গাড়িতেও যাওয়া যায়। বাসটাই বেশি চলে।”
মৃত্যুঞ্জয় আসলে জানত না। সে টেনশনে এত খেয়াল করেনি। তবে খেয়াল করেও লাভ হতো না। তার তো ঢাকা যেতেই হতো তাও রূপনগর যাওয়ার আগেই। সে সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
-“কথাটা তো ঠিক মি. তবে আমার আসলে আগে ঢাকাতেই ফিরতে হবে। কিছুই করার নেই।”
-“ওহ্! তা ঐখানে কেন যাচ্ছেন?”
-“আমার একটু ঘোরাঘুরির শখ। সারা বাংলাদেশ ঘোরার ইচ্ছা বলতে পারেন। তাই ঐ রূপনগরটাও আর বাদ দিলাম না।”
-“আচ্ছা। তা আপনার নামটা?”
-“মৃত্যুঞ্জয় সরকার।”
-“ডেঞ্জারাস নাম তো!”
-“তাই নাকি?”
-“তাই তো মনে হচ্ছে।”
-“বেশ তবে! আপনার নাম?”
-“ইফতেখার রহমান নির্ঝর।”
-“আপনার নাম ইফতেখার?”
-“হ্যাঁ। সবাই নির্ঝর বলে আপনিও বলতে পারেন।”
-” না সেটা না আসলে। আমি যতটুকু শুনেছি খাঁন বাড়ির মালিকের নামও ইফতেখার খাঁন।”
-“হ্যাঁ! আমার নানাজান। আমার মা তার বাবাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি সম্মান করে। তাই তার নামের সাথে মিলিয়েই আমার নাম রেখেছেন।”
-“উনি বেঁচে আছেন?”
-“নানা? হ্যাঁ আছে তো! তবে এখন একটু অসুস্থ্য। আমি ছুটি নিয়ে কিছুদিন পর যাব তাকে দেখে আসতে।”
-“কবে যাবেন?”
-“তা সঠিক জানিনা। এই মাসের শেষে বা সামনের মাসে। এই সপ্তাহ ছুটিতে ছিলাম। তাই সামনে ছুটি পাবো কিনা সন্দেহ আছে। আর না পেলে কোনো এক বৃহষ্পতিবার রাতের বেলা রওনা হব। তাহলেই সকালের আলো ছড়িয়ে গেল পৌঁছাতে পারব। আবার দিনে থেকে রাতে ফিরে আসব। আমি মাঝেমাঝেই এমন করি।”
-“ট্রাভেল করতে তো তাহলে আপনার কষ্ট হয়না।”
-“লং হলে কষ্ট সবারই হয়। কিন্তু আমি অভ্যাসের মত করে ফেলেছি। তাই আর ভেজাল লাগেনা। আনফরচুনেটলি! আই আম এ গুড ট্রাভেলার।”
-“মি টু!”
-“আপনি কোথায় থাকেন?”
-“ঢাকাতেই আছি বর্তমানে। একটা বিশেষ কাজ আছে। তা শেষ করে সিঙ্গাফুর ফিরে যাব। ঐখানেই থাকি। আসলে থাকিও না। দুইবছরের ট্রেনিং চলছে আমি একমাস ছুটি নিয়েছি কোনো রকম।”
-“ও আচ্ছা। আপনার সাথে উনি কে?”
-“ও আমার খুবই কাছের মানুষ। তাকে ছাড়া আমি অচল বলতেই পারেন।”
নির্ঝর আনমনেই এর একটা অর্থ বের করে নিল। তারপরে আর কথা বলল না। মৃত্যুঞ্জয় আর কিছু বলল না। এখন তার মাথায় নতুন প্ল্যান ঘুরছে। নির্ঝরের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে হয়তো আর কথা আগাতে চাইছেনা। থাক! পরে আবার কখনও জেনে নিবে তার প্রশ্নের উত্তর। এখন বেশি ঘাটালে ক্ষতি তারই। তাছাড়া নির্ঝরকে খুঁজে নিতে বা তার এড্রেস জানাটাও মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে বড় ব্যাপার না। সে সব হাতের মুঠোতে নিয়েই ঘোরে বলা যায়।
৩২.
নিদ্রা আর এহসান একসাথে পাশাপাশি বসে আছে। অতিথিরা আসছে, শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, উপহার দিচ্ছে আর খেয়ে গল্প গুজব করে যার আর জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। এহসান সেই কখন থেকে অভ্র আর নির্ঝরের জন্য অপেক্ষা করছে তাদের দেখাই মিলছেনা। কল করলেই বলছে এইতো আর একটু। আর কত একটু? চল্লিশ মিনিট হয়ে আসছে এই একটু একটু কথা শুনতে শুনতে। এহসান বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিল। নিদ্রা তার বিরক্তি বুঝতে পারছে। তবে তার মধ্যেও একটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতি দৌঁড়ে যাচ্ছে। অভ্রর সম্মুখীন না হওয়ার জন্য দোয়া করছে তার মন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। অপেক্ষার পালা শেষ করে নির্ঝর আর অভ্র এসে পড়ে। নিদ্রাকে শুভেচ্ছা জানায় তারপর উপহার দেয়। ভাবটাই এমন যে কিছুই হয়নি সব স্বাভাবিক। কিন্তু তিনটে হৃদয়ের মধ্যেই ভর করে আছে একঝাক অস্বস্তি। নির্ঝরের এখন নিদ্রার দিকে তাঁকাতেও লজ্জা লাগে। কত জল্পনা কল্পনা করল সে নিদ্রাকে নিয়ে। এখন কী হলো? নিদ্রা তার বন্ধুর বউ। কি বিশ্রী ব্যাপার। নির্ঝর টুকটাক কথা বলে সিটকে গেল সেখান থেকে। এহসানও এতক্ষণে রিল্যাক্স হয়ে অভ্রকে নিদ্রার সাথে কথা বলতে বলে নির্ঝরের সাথে হাঁটা দিল। তাদের আন্ডারে থাকা বস এসেছেন এখানে। তার সাথে কথা না বলাটা ঠিক হবেনা। এদিকে অভ্র আর নিদ্রা দুজনেই লজ্জায় আর অস্বস্তিতে কুপোকাত। অভ্র তাও কোনোরকম জড়তা কাটিয়ে বলল,
-“কী খবর আপনার মিসেস. নিদ্রা!”
নিদ্রার এই গম্ভীর স্বরটা যে খুব পছন্দের। তার গলায় কান্না দলাপেঁকে যাচ্ছে। কথারা আটকে আসছে। তার বলতে ইচ্ছা করল, -“আপনি মিস. নিদ্রা বলতেন সেটাই ঠিক ছিল। এই মিসেস কথাটা আমি হজম করতে পারিনা। আমার খুব কষ্ট হয়। আপনার জন্য খুব কষ্ট হয়। আমার মন পোঁড়ে।”
মনের কথা তো মনেই ছিল। মুখ ফুঁটে বেরিয়ে এলো ছোট্ট দুইটি শব্দ।
-“ভালো, আপনি?”
-“আমিও।”
অভ্র নিদ্রাকে আর অস্বস্তিতে না ফেলে সেখান থেকে চলে আসে আসার আগে শুধু বলল,
-“নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। অতীত ভুলে বর্তমান নিয়ে ভাবাটাই বেটার। ভবিষ্যৎটাও না। বর্তমান হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার যা আমরা সকলে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাই। ভবিষ্যৎ তো আনএক্সপেক্টেড। পাব কী পাব না তার নিশ্চয়তাও নেই। তাই বর্তমানকে ভালোবাসুন।”
নিদ্রা জবাবে মুঁচকি হেসেছে কেবল। অথচ চোখে নোনাজলে টইটুম্বর। গড়িয়ে পড়বে পড়বে এমন। তার তো অতীতটাই ভালো লাগত। অতীতকেই তো ভালোবাসতো। অভ্র চলে যাওয়ার পর টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে বসে পড়ে আবার। সুখে থাকার অভিনয় চালাতে হবে যে। দূর থেকে এহসান সব দেখেছে। নিদ্রার হাবভাব তাকে অনেককিছুই ভাবিয়ে দিয়েছে। তার মন মানতেই চাইছেনা সেই সত্যটা! এহসান আজ যে সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভয় পাচ্ছে সেটা তো কিছুইনা। একদিন এই নিদ্রাই তার সবটা উজাড় করে কেবল এহসানকে ভালোবাসবে। তা কী সে আজ এ অসময়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে পেরেছে? কোথায়! পারল না তো। থাক! না পারুক সময়ের সাথে সাথে তো সব বদলেই যাবে।
#চলবে।
(কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন। আর রূপনগর আমার কাল্পনিক গ্রাম। বাস্তবের সাথে মেলাবেন না।)