সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩)

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩)
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৪.
নিহারীকা এবং এহসান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ছবি তুলে। তারপর নিয়ম রক্ষার্থে কিছুক্ষণ কথা বলে একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়। এহসান গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গ দেয় আর নিহারীকা এদিক ওদিক হাঁটতে থাকে। হাটঁতে হাঁটতেই সে দেখে নির্ঝর একটা ছোট্ট ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। নিহারীকা দূর থেকেই দেখে যে নির্ঝর পানির বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এগোতেই সে শুনতে পায়,

“পানির বোতলে আপনি ইয়ে করে দিয়েছেন কেন ভাইয়া?”

ছোট্ট বাচ্চার মুখে এমন লজ্জাজনক কথা শুনে নির্ঝর চুপসে যায়। বাচ্চাটিকে আদর করে কাছে ডেকে এনে বলল, “খোকা! আমি ইয়ে করেছি মানে? আমি কোনো ইয়ে টিয়ে করিনি তো! এভাবে লোকজনের সামনে শুধু শুধু আমায় লজ্জিত করছ কেন?”

নিহারিহীকা তা শুনে হা হা করে হেসে ওঠে। নিহারীকাকে আকস্মিক আশা করেনি নির্ঝর। নিহারীকার উপস্থিতিতে নির্ঝর আরো লজ্জা পায়। বাচ্চাটির দিকে তাঁকিয়ে বলল,
“এই আমি কোনো ইয়ে টিয়ে করিনি। মিথ্যা বলছ কেন তুমি? তুমি কি জানো না, মিথ্যা বলা মহাপাপ।”

বাচ্চাটি ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
“আমি জানি কিন্তু আপনি জানেন না। আপনি তো মাত্রই আমার মাম বোতলটাতে মুখ লাগিয়ে দিয়েছেন। মুখ লাগিয়ে কেউ খেলে আমি আর সেই বোতলে করে কিছু খেতে পারিনা।”

নির্ঝর এবার হতভম্ব হয়ে গেল। এই সামান্য মুখ লাগিয়ে পানি পান করেছে বলে আজ তাকে এতবড় অপবাদ পেতে হলো! তাও আবার কী না…..
নির্ঝর নিহারীকার দিকে তাঁকায় দ্বিধাগ্রস্থ চেহারা নিয়ে। নিহারীকার হাসি যেন থামছেই না, তরতর করে বেড়েই চলেছে। আশ্চর্য!

কুল না পেয়ে সে দ্রুত পাশে থাকা টেবিল থেকে নতুন ইনটেক একটি পানির বোতল ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। নিহারীকার হাসি তবুও থামে না। সে পেটে হাত চেপেই হাসতে থাকে। ছেলেটিও নিহারীকার দিকে একবার তাঁকিয়ে দৌড়ে তার মায়ের কাছে চলে যায়।

নিদ্রা লেহেঙ্গা উচিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠছে। ভারী লেহেঙ্গাটা নিয়ে এভাবে উঠতেও কষ্ট হচ্ছে। পৃথিলা থাকলে একটু সুবিধা হতো। হয়তো তার হাত ধরেই উপরে উঠতে পারতো। লিফ্টটাও এখন খুলছেনা মানে ভেতরে মানুষ আছে এবং সেটি চলছে। নিদ্রার খুব দ্রুত ওয়াশরুম যেতে হবে। একতলা কোনোরকম উঠেছে ঠিকই কিন্তু বাকিটা উঠতে কষ্ট হচ্ছে। হিলটা বেশিই চিকন তাই একটু পা কাঁপছে যদি পড়ে যায় তো! ভাবনাতে মত্ত নিদ্রার সামনে হঠাৎ করেই শ্যাম বর্ণের বলিষ্ঠ একটি হাত কেউ একজন বাড়িয়ে দিল। নিদ্রা চোখ তুলে দেখে তার স্বপ্ন পুরুষ অভ্র দাঁড়িয়ে। নিদ্রা খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অভ্র এবার মুখ খুলল,

“মিস. নিদ্রা? আপনার এভাবে উপরে উঠতে সমস্যা হচ্ছে বোধ হয়। আমিও রুমেই যাচ্ছি। আপনার কোনো অসুবিধা না থাকলে আমার হাতের সাহায্য নিতে পারেন।”

অভ্রর এই মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ নিদ্রার বুকে লাগে খুব করে। কোনো রকম মাথা নাড়িয়েই অভ্র এক হাত ধরে। তাতেও সুবিধা করতে পারছেনা বিশেষ একটা। বারবার অন্য পাশের লেহেঙ্গার কোণাটা পায়ে বাঁধছে। অভ্র সেটা লক্ষ্য করে বেশ ভালো করেই। এদিক ওদিক তাঁকিয়ে দেখে কেউ আছে কি না। কিন্তু না! সৌভাগ্য বশত সবাই নিচে অনুষ্ঠানেই আছে। এখানে যারা আছে তারা সবাই একটু দূরেই আর তাছাড়া সবারই অপরিচিত মুখ। সেই হিসেবে সে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হবে না।

অভ্র হুট করেই নিদ্রাকে কোলে তুলে নিল। নিদ্রার এবার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই সে শুধু তাঁকিয়ে আছে অভ্রর দিকেই। অভ্রও নিদ্রার মুখের দিকে তাঁকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

“আপাতত এর থেকে বেটার অপশন নেই। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”

নিদ্রা চুপ করেই থাকে। অভ্রও খুব সুন্দর করে উপরে উঠে আসে। নিদ্রাকে একেবারে রুমের সামনেই নামিয়ে দেয়। তারপর কোনো কথা না বলেই নিজের রুমের লক খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। নিদ্রাও আর সেদিকে না তাঁকিয়ে সোজা রুমের লক খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। এই মুহূর্তে তার ওয়াশরুমে যেতে হবে। মূত্র আটকে রাখা নিদ্রার বারণ। সে দুই মিনিট দেরিও করতে পারেনা করলে পেটের অসহনীয় পীড়া সহ্য করতে হয়। আসলে কারোরই মলমূত্র আটকে রাখা ঠিক নয়। আজকাল হয়তো সামান্য ব্যাথা সহ্য করে নিবেন। পরবর্তীতে কিডনি যখন নষ্ট হয়ে যাবে তখন তো আর কিছুই করার থাকবেনা। শুধু কিডনি নয় নানাবিধ অসুখে পড়তে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেই রোগটি দেখা যায় তা হলো মূত্রথলিতে পাথর জমে। তাই সকলের এই বিষয়ে সতর্ক থাকা আবশ্যক। এটি কোনোভাবেও হাসি ঠাট্টা করার বিষয় না অথবা লজ্জা পাওয়ার নয়!

৫.
এহসান আর নিহারীকাকে সবাই একটি রুমে নিয়ে এসে বন্ধ করে রাখে। বিগত দুই ঘন্টা যাবৎ তারা একটা রুমে বন্ধ কিন্তু এই দুই ঘন্টায় তাদের আলাপ অতি ক্ষুদ্র। যা একদমই বেমানান নতুন বর বউয়ের জন্য। দু’জনেই তা বুঝতে পারছে কিন্তু তারা কিছুই করতে পারছেনা। নিহারীকা স্বভাব গত চঞ্চল কিন্তু এই মুহূর্তে সে বাকহারা। এহসানের সাথে কথা বলতে সে সংকোচ বোধ করে তা নয়! এহসান নিজেই কথা বলায় তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনা। নিহারীকা এটা খুব ভালোই ধরতে পেরেছে। তাই সেও যেচে পড়ে কথা বাড়াতে চায়না। আজ সারাদিন সে এই কারণেই এহসানের ফোন ধরেনি আর কথা বলতে চায়নি। কারণ ফোনে কথা বলে কী আর হবে! সেই অন্যান্যদের ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করে সে। তাদের একে অপরকে জানার চেষ্টা করেনা। নিহারীকাকে একশ বার কেমন আছে জিজ্ঞেস করতে পারবে কিন্তু তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা সে একবারও জিজ্ঞেস করে জানতে চায়নি। নিহারীকা কিন্তু ঠিকই জেনে নিয়েছে যে এহসানের প্রিয় রঙ বেগুনী আর কালো। কই? এহসান তো জানতে চায়নি যে নিহারীকার প্রিয় রঙ কী! নিহারীকার প্রিয় রঙটা যে সাদা। তা তো এহসান জানেই না এমনকি এহসান এটাও জানেনা সে এখন কোন সেমিস্টারে! নিহারীকা একটা জিনিস বুঝে গিয়েছে এহসান তার প্রতি সামান্যতম ভালো লাগাও অনুভব করেনা। তাদের বিয়েটা আসলেই বাবাদের ইচ্ছা পূরণ মাত্র। তাদের বাবারা খুব কাছের বন্ধু। সেই হিসেবে নিজ সন্তানদের জীবনে একে অপরকে জড়িয়ে দিতে চাইছে। যাতে তাদের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়। কিন্তু তাদের মতটা তো জানতে চায়নি। এহসান রাজি হয়েছে তার পেছনে কারণ আছে। নিহারীকার রাজি না হয়ে এই মুহূর্তে উপায় নেই। সে এখন দোটানায় পড়ে আছে। এহসান যদি একটু তার প্রতি ভিন্ন অনূভতি প্রকাশ করত তাহলে হয়তো সে সহজেই সব মেনে নিত। সেখানেও তো উল্টোটা হচ্ছে। এহসান হয়তো স্বাভাবিক এরেন্জ ম্যারেজেই খুশি কিন্তু নিহারীকা তো চায় যাকে বিয়ে করবে তাকে সে ভালোবাসবে এবং সেই ব্যক্তিও নিহারীকাকে ভালোবাসবে। নিহারীকা যথেষ্ট চেষ্টা করছে মনকে বোঝানোর! এহসানের দিকে মন আনার, কিন্তু সে পারছেনা। এহসানই তা হতে দিচ্ছে না। কিন্তু কাল বাদে পরশু তাদের বিয়ে। অন্তত এখন এহসানের একটা স্টেপ উঠানোর দরকার।

নিহারীকাকে অবাক করেই এহসান হঠাৎ করেই বলল,

“তুমি খুব সুন্দর নিহারীকা!”

নিহারীকা লজ্জায় পড়ে যায়। এতক্ষণ সে তো চাইছিল এহসান কিছু বলুক। কিন্তু এখন সে নিজেই চাইছে দরজা ভেঙে পালিয়ে যেতে। তার হঠাৎ করেই অদ্ভুত অনূভতি হচ্ছে। এটা মোটেও সুন্দর নয়। অস্বস্তি হচ্ছে, এটা আনন্দে লজ্জিত হওয়া না এটা হলো অস্বস্তিতে লজ্জিত হওয়া। এহসানের মুখে এমন কথা শুনতে তার কান গুলো মনে হয় নারাজ! নিহারীকা চমকায়। সে হঠাৎ করেই অনুধাবন করল যে এহসানের সাথে তার সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো না হওয়া দরকার। এহসানকে কোনোভাবেই সে সেই স্থানে বসাতে পারছেনা। কিন্তু এতক্ষণ সে এটাই চাইছিল। নিহারীকা এটাও বুঝল যে সে নিজেও এহসানকে ঐ ভাবে গ্রহণ করতে চায়না। এতক্ষণ যা ভাবছিল তা হয়তো তার মন মানতে চায়না। এখন নিহারীকার এটা মনে হচ্ছে এহসান প্রথমে যেমন ব্যবহার করত তেমনই করুক। এটা একদমই বেমানান! নিহারীকা এহসানের দিকে তাঁকায় এবং দেখে এহসানের চেহারাতেও অস্বস্তি স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। হয়তো সে কথাটি পরিস্থিতির চাপে পড়েই বলেছে।
নিহারীকা নিজেও তো এতক্ষণ এহসানের থেকে এমন কিছু আশা করছিল কিন্তু এখন যখন এহসান তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইছে নিহারীকা তা গ্রহণ করতে পারছেনা। অদ্ভুত!

#চলবে।

(কিছু কথা না বললেই নয়! উপন্যাসে অনেক চরিত্র থাকে এবং তাদের কার্যকলাপও উল্লেখিত থাকে। তার মানে এটা নয় যে তারা সবাই প্রধান চরিত্র। প্রতিটি চরিত্র দরকারি কাজেই ব্যবহৃত। এমনি এমনি কেউ আসেনি সবার নির্দিষ্ট কাজ আছে। আপনারা ধৈর্যহারা হবেন না দয়া করে। আমি উপন্যাসটি ভেবে রেখেছি একদম শেষ পর্যন্ত। আপনারা ধৈর্য নিয়ে পড়ুন ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হবে। তবে এটা জেনে নিন এখানে প্রধান চরিত্র হলো “নিদ্রা!” “প্রথমা নিদ্রা!” এবং “নিহারীকা নিদ্রা” আর তাদেরকে নিয়ে তো সবার কৌতূহল থাকবেই। উপন্যাসের একটি ঘটনাও আমি পরিবর্তন করব না কারো কথা শুনে কারণ পুরো উপন্যাস আমার মস্তিষ্কে তৈরি হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। সবাই গঠন মূলক মন্তব্য করবেন উপন্যাসের প্রতিটি পর্ব পড়ে।

#বি:দ্র: আমার কাজ হচ্ছে প্রতিটি চরিত্রের উপরে ভালো লাগা তৈরি করানো। আমি সেটাই করছি যাতে সবাইকে ভালোবাসতে পারেন। এবার যেই নিদ্রার হোক না কেন আপনারা যেন খুশিমনে গ্রহণ করতে পারেন। এবার সে, অভ্র, এহসান, নির্ঝর কিংবা মৃত্যুঞ্জয় হোক কোনো সমস্যা থাকবেনা।

আর হ্যাঁ! রি-চেক করার সময় নেই। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here